আধুনিক যুগের প্রথম দিকের মেসোআমেরিকান (মেসোআমেরিকা হলো একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল ও সাংস্কৃতিক এলাকা, যা উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ অংশে শুরু হয় এবং মধ্য আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত) প্রাচীন মায়া সভ্যতা নিয়ে রহস্যের যেন শেষ নেই। এই সভ্যতা তার প্রাচীন মন্দির এবং পরিশীলিত গ্লিফ (মায়া লিপি), শিল্প, স্থাপত্য, গণিত, ক্যালেন্ডার এবং জ্যোতির্বিদ্যা ব্যবস্থার জন্যও বিখ্যাত।
মায়া সভ্যতা আজকের দক্ষিণ-পূর্ব মেক্সিকো, সমগ্র গুয়াতেমালা এবং বেলিজ এবং হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের পশ্চিম অংশ নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে রয়েছে- ইউকাতান উপদ্বীপের উত্তরের নিম্নভূমি এবং সিয়েরা মাদ্রের গুয়াতেমালার উচ্চভূমি, মেক্সিকান রাজ্য চিয়াপাস, দক্ষিণ গুয়াতেমালা, এল সালভাদর এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলীয় সমভূমির দক্ষিণের নিম্নভূমি।
তাদের বংশধর, যারা সম্মিলিতভাবে মায়া নামে পরিচিত, তাদের সংখ্যা বর্তমানে ৬০ লাখেরও বেশি। তারা ২৮টির বেশি মায়ান ভাষায় কথা বলেন এবং তাদের পূর্বপুরুষদের মতো প্রায় একই অঞ্চলে বাস করেন।
এবার গুয়াতেমালার মায়াদের ভূগর্ভস্থ একটি গুহার সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে পাওয়া গেছে শত শত মানুষের হাড়। যা সভ্যতাটির মানব বলিদানের অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর ধর্মীয় রীতির ইঙ্গিত দেয়।
এটি কুয়েভা দে সাংগ্রে বা ‘রক্তগুহা’ নামে পরিচিত। এটি গুয়াতেমালার পেটেনের দোস পিলাসের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের নিচে অবস্থিত। এটি এই অঞ্চলের এক ডজনেরও বেশি গুহার মধ্যে একটি, যা খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ থেকে ২৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মায়ারা ব্যবহার করতেন।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে রক্তের গুহা থেকে মানুষের হাড়ের একটি বিশাল সংগ্রহের সন্ধান পাওয়া যায়, যার মধ্যে অনেকগুলোতে মৃত্যুর সময় আঘাতের প্রমাণ মিলেছে।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, এখানকার দেহাবশেষ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে বলিদানের সময় সংঘটিত ধর্মীয় রীতি অনুসারে এসব মানবদেহ কেটে অঙ্গ ছিন্ন করা হতো।
উদাহরণস্বরূপ, কপালের বাম দিক থেকে আসা একটি খুলির টুকরো থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, কেউ এটিকে কুঠার-সদৃশ হাতিয়ার দিয়ে আঘাত করে এটিকে দ্বিখণ্ডিত করেন। একইভাবে কয়েকটি শিশুটির নিতম্বের হাড়েও একই রকম চিহ্ন পাওয়া গেছে।
এছাড়া, গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, হাড়গুলো গুহার মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এবং খুব অদ্ভুত্ভাবে সম্ভবত ধর্মীয় কোনো উপায়ে সেগুলো সাজানো ছিল। এছাড়া মূল জরিপের সময় খননকারীরা গুহার একটি অংশে চারটি স্তুপ করা খুলির টুপি আবিষ্কার করেন। আর হাড়ের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় আচার-অনুষ্ঠানের কিছু নিদর্শন। যেমন- অবসিডিয়ান ব্লেড এবং লাল কুড়াল, একটি প্রাকৃতিক মরিচা রঙের রঙ্গক। এসবই প্রমাণ দেয় যে, রক্তগুহার ভিতরে কোনো ধরণের অনুষ্ঠান হয়েছিল।
গবেষক এবং ফরেনসিক নৃ-বিজ্ঞানী এলেন ফ্রিয়ানকো লাইভ সায়েন্সকে জানান, গুহায় পাওয়া মানুষের দেহাবশেষের পরিমাণ, তাদের আঘাতের ধরণ এবং ধর্মীয় জিনিসপত্রের উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে, এটি সম্ভবত একটি বলিদানের স্থান ছিল।
তিনি এবং তার সহকর্মী জৈব প্রত্নতাত্ত্বিক মিশেল ব্লুজ, গত এপ্রিল মাসে আমেরিকান প্রত্নতত্ত্ব সমিতির বার্ষিক সভায় তাদের বিশ্লেষণের ফলাফল উপস্থাপন করেন।
মজার ব্যাপার হলো, রক্তগুহায় কেবল একটি ছোট খোলা জায়গা দিয়ে প্রবেশ করা যায়, যা একটি নিচু পথের দিকে নেমে একটি পুকুরের দিকে নিয়ে যায়। এর গঠনের কারণে গুহাটি বছরের বেশিরভাগ সময় প্লাবিত থাকে। শুধু মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে শুষ্ক মৌসুমে এটিতে প্রবেশ করা যায়।
মায়ারা বিশ্বাস করেন, গুহার ভেতরে থাকা বলিদানের দেহাবশেষ বৃষ্টির দেবতা চাকের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছিল। মায়ারা সাধারণত খরার মতো সংকটের সময় দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য মানব বলিদান করতেন।
গুয়াতেমালার মায়া সংস্কৃতির একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যা মেসোআমেরিকান অঞ্চলে চার হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত।
কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে, এই গবেষণাপত্রে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, মায়াদের বংশধররা আজও নাকি একইরকম আচার পালন করেন! তারা ৩ মে, অথবা পবিত্র ক্রুশের দিন, শুষ্ক মৌসুমের শেষে বৃষ্টি এবং ভালো ফসলের জন্য প্রার্থনা করার জন্য এই গুহাগুলোতে যান।
এদিকে, মৃত ব্যক্তিদের সম্পর্কে আরও জানতে গবেষকরা এই হাড়ের প্রাচীন ডিএনএ অধ্যয়ন করার পরিকল্পনা করছেন। তারা অস্থিগুলোর স্থিতিশীল আইসোটোপ বিশ্লেষণও করবেন, ফলে মৃত ব্যক্তিদের খাদ্যাভ্যাস এবং অভিবাসনের ধরণ এবং জীবিত থাকার সময় পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে। সূত্র: লাইভ সায়েন্স এবং ডেইলি মেইল
সুলতানা দিনা/অমিয়/