ভারত-মায়ানমার সীমান্তবর্তী তামু জেলায় একটি অস্থায়ী কাঠের চিতার সামনে পড়ে আছে ১০টি পচেগলে যাওয়া মৃতদেহ। মৃতরা মায়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি ঐক্য সরকারের সহযোগী সশস্ত্র গোষ্ঠী পিকেপি সদস্য, যাদের মধ্যে তিনজন আবার কিশোর বয়সী। বেশিরভাগের গায়ে রক্তমাখা যুদ্ধবেশ। কাঠ, পুরনো টায়ার ও দাহ্য পদার্থ দিয়ে দ্রুত প্রস্তুত করা হচ্ছে গণদাহ।
ভারতীয় সেনাবাহিনী দাবি করেছে, মায়ানমারের সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে এখনও চলমান একটি অভিযানে এই ১০ জন জঙ্গি নিহত হয়েছেন। তারা বলছে, ১৪ মে পরিচালিত এক অভিযানে এদের প্রাণহানি ঘটে।
তাদের দাবি , যুদ্ধসামগ্রীসহ বিদ্রোহী কার্যকলাপে যুক্ত সন্দেহভাজনদের গুলি করে হত্যা করেছে তারা। বুধবার (২৮ মে) এক-এর এক পোস্টে তারা এই অঞ্চলে সংঘটিত বন্দুকযুদ্ধের কথা উল্লেখ করে বলছে, ‘দশজন ক্যাডারকে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে।’
কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে মায়ানমারের নির্বাসিত ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)। তাদের দাবি, এসব বিদ্রোহীকে ভারতীয় সেনারা গ্রেফতার করে, নির্যাতন চালিয়ে পরে গুলি করে হত্যা করেছে।
মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকেই ভারতীয় সীমান্তে আত্মগোপনে ছিল সশস্ত্র বিদ্রোহীরা এতদিন ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে ‘অলিখিত সহাবস্থানে’ ছিল। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডে সেই ভারসাম্য ভেঙে পড়েছে। আতঙ্ক ছড়িয়েছে হাজার হাজার মায়ানমার শরণার্থীদের মধ্যে, যারা ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
তামু অঞ্চলে বিদ্রোহীদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজনকারী থিদা (ছদ্মনাম) বলেন, আমরা সবাই আতঙ্কে আছি। চার বছরে এমনটা কখনও হয়নি। এবার যেহেতু ঘটেছে, সামনে আরও হতে পারে—এই আশঙ্কাই আমাদের গ্রাস করছে।
ভারতের সেনাবাহিনী প্রথমে জানায়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তল্লাশি চালানো হয়, তখন বিদ্রোহীরা গুলি ছোড়ে এবং জবাবে ১০ জন নিহত হয়। পরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান, ‘একটি টহলদল হামলার শিকার হলে প্রতিক্রিয়ায় বিদ্রোহীদের হত্যা করা হয়।‘
কিন্তু দু’দিন পর নতুন আরেকটি বিবৃতিতে বলা হয়, ‘নিহতরা ভারতীয় সীমান্তে বেস্টনী নির্মাণের কাজে নিযুক্তদের ওপর হামলার উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়েছিল।‘
নয়াদিল্লির একজন সাবেক সরকারি উপদেষ্টা এ বিষয়ে বলেন, ‘এটি কি আগাম গোয়েন্দা অভিযানে করা হামলা, নাকি তাৎক্ষণিক আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ?—দুটি ব্যাখ্যা একসঙ্গে সত্য হতে পারে না।‘
তামুর স্থানীয় প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যখন মরদেহ নিতে গিয়েছিলাম, তখন আসাম রাইফেলস আমাদের কিছু কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। বলা হয়, না করলে মরদেহগুলো ফিরিয়ে দেওয়া হবে না।‘
এছাড়া এই কাগজগুলোতে সীমান্ত বেড়া নির্মাণে সম্মতি এবং সংঘর্ষের তথ্য লেখা ছিল বলে দাবি করেন তিনি।
মায়ানমারের নির্বাসিত সরকার বারবার ভারতকে অনুরোধ করেছে সীমান্ত বেড়া নির্মাণ বন্ধ করতে এবং আলোচনায় বসতে। কিন্তু দিল্লি গত বছর থেকেই তা জোরদার করেছে। এই বেস্টনী ঐতিহ্যগতভাবে উন্মুক্তভাবে চলাচল করা জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিভেদ তৈরি করছে।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত বছর বলেছিলেন, ‘সীমান্ত বেস্টনী ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার জন্য জরুরি।’
কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই পদক্ষেপে উত্তর-পূর্ব ভারতের ভঙ্গুর জনপদগুলোতে নতুন অস্থিরতা ছড়াতে পারে।
এদিকে মায়ানমারের নির্বাসিত সরকার ও স্থানীয়রা স্পষ্ট করে জানান, তারা ভারতকে কোনোভাবে প্রতিরোধ করতে পারবে না। এ নিয়ে তারা বলেন, আমরা তো নিজেদের দেশেই বিদ্রোহী, ভারতীয় সেনার মতো শক্তিশালী বাহিনীকে কীভাবে ঠেকাবো?
এরপর লাশগুলোর দুরাবস্থার কথা উল্লেখ করে থিদা বলেন, ‘লাশগুলোর কি অবস্থার ছিল জানেন? পোকারা শরীরের ভেতর ঢুকে পড়েছিল। অন্তত আমাদের মৃতদের প্রতি তাদের সম্মান দেখানো উচিত ছিল।’
নভেম্বরে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে নির্বাচিত বেসামরিক সরকার উৎখাতের পর মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে এই এলাকার ১,৬৫০ কিলোমিটার (১,০২৫ মাইল) সীমান্তে স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গিয়েছে।
ভারতের দিকে, ২০২৩ সালের মে মাস থেকে মণিপুরে জাতিগত সংঘাতের ফলে প্রায় ২৬০ জন নিহত হয়েছে, ৬০,০০০ এরও বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
৩২ লক্ষ জনসংখ্যার এই রাজ্যটি দুটি জাতিগত ছিটমহলে বিভক্ত, একটি উপত্যকা যা মেইটাইদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং একটি কুকি-অধ্যুষিত পাহাড়।
সূত্র: আল-জাজিরা এবং রয়টার্স
সুলতানা দিনা/