চীন তিব্বতের মেদোগ কাউন্টিতে তিব্বত, ভারত ও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের (তিব্বতে ইয়ারলুং সাংপো নামে পরিচিত) উপর বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। এই প্রকল্পটি শেষ হলে এই বাঁধ ভারত তথা অরুণাচল রাজ্যের জন্য বোমার মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছেন রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী পেমা খাণ্ডু।
বুধবার (৯ জুলাই) ভারতীয় বার্তাসংস্থা প্রেস ট্রাস্ট ইন্ডিয়া (পিটিআিই)-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ সতর্কবার্তা দেন অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘ওই বাঁধ ভারতের জন্য বোমার মতোই ভয়ঙ্কর এবং ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের চেয়েও বেশি কিছু। চীনের এই প্রকল্প শেষ হলে তা আমাদের জীবন-জীবিকার অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে।’
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘হিমালয়ের কৈলাস পর্বতের মানস সরোবর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি। এই কৈলাস পর্বতের অবস্থান বর্তমান চীনের স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ তিব্বতে। মানস সরোবার থেকে উদ্ভূত হওয়ার পর তিব্বতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারতের অরুণাচল রাজ্য, আসাম এবং তারও পরে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে ব্রহ্মপুত্র। তিব্বতে এবং চীনে এই নদের নাম ইয়ারলুঙ্ক সাংপো, অরুণাচলে নাম সিয়াং, আসামে প্রবেশের পর নদের নাম হয়েছে ব্রহ্মপুত্র।‘
সাক্ষাৎকারে অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘সমস্যা হলো, চীন আন্তর্জাতিক পানিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। এ কারণেই চীনকে বিশ্বাস করা যায় না। কেউই জানে না যে তারা কী করতে পারে।’
চীন এই প্রকল্পটি হাতে নেয়ার পরই ভারত ও বাংলাদেশে, ভাটির দেশগুলোতে, জলপ্রবাহ, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং পরিবেশগত ভারসাম্যের উপর এটির সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে গবেষক-পরিবেশবিদ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ এবং এখানকার সাধারণ মানুষ।
এরপর এসব উদ্বেগের জবাবে, চীন তাদের পরিকল্পনার পক্ষে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়ে জানায়,নিঁখুদ বৈজ্ঞানিক মূল্যায়নের পরই বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পটি পরিবেশগত, ভূতাত্ত্বিক অবস্থা ও ভাটির দেশগুলোর পানি সম্পদের সাথে সম্পর্কিত অধিকার এবং স্বার্থের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।
তবে, এরপরও ভারত ও বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা এই প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত অঞ্চলটি ভূমিধসের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং এটি একটি ভূতাত্ত্বিক ফল্ট লাইনের উপর অবস্থিত যা ইয়ারলুং জাংবো নদীকে অতিক্রম করে।
এই ধরণের জটিল ভূখণ্ডে এই ধরণের বাঁধের পরিকল্পনা ভারত ও বাংলাদেশের ভাটির অঞ্চলের জন্য উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি তৈরি করে, বিশেষ করে যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে বা জলপ্রবাহে পরিবর্তন আসে। সম্প্রতি তিব্বতে ভূমিকম্পে কমপক্ষে ১২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির কথা তুলে ধরেছে।
প্রকল্পের বিস্তারিত বিবরণ:
এই বাঁধটি পূর্ব তিব্বতের একটি প্রত্যন্ত নদী গিরিখাতে অবস্থিত হবে, যা ভারত সীমান্তের খুব কাছে অবস্থিত। এই অংশ ধরে নদীটি ২০০০ মিটার (৬,৫৬০ ফুট) গভীরে নেমে গেছে, যা জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান স্থান। এই প্রকল্পের ব্যয় ১৩৭ বিলিয়ন ডলার এবং উৎপাদন ক্ষমতার দিক থেকে এটি থ্রি গর্জেস বাঁধকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চীনের অবস্থান:
চীন এই প্রকল্পের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, বলছে এটি একটি নিরাপদ প্রকল্প যা পরিবেশগত সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয় এবং কার্বন নিরপেক্ষতার লক্ষ্য পূরণে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তারা আরও দাবি করেছে, এই প্রকল্পটি ভাটির দেশগুলোর উপর কোনও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।
নিম্নগামী উদ্বেগ:
ভারত ও বাংলাদেশ পানি প্রবাহে এই বাঁধের কারণে সৃষ্ট সম্ভাব্য ব্যাঘাতের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ এটি কৃষি, বাস্তুতন্ত্র এবং সামগ্রিক পানি নিরাপত্তার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া, বাঁধটি নদীর স্বাভাবিক পলি কণার প্রবাহকে আটকে রাখতে পারে, নদীর প্রবাহকে প্রভাবিত করতে পারে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনকে মারত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
রয়েছে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব:
এই প্রকল্পটি ভারত ও চীনের মধ্যে ইতিমধ্যেই নাজুক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জটিলতার আরেকটি স্তর যুক্ত করেছে, যেখানে সম্ভাব্য কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে পানি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র একটি আন্তঃসীমান্ত নদী তাই এর পানি বন্টন নিয়ন্ত্রণকারী একটি চুক্তির অভাব ন্যায়সঙ্গত পানি বণ্টন এবং দুর্যোগ প্রস্তুতি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলবে।
সুলতানা দিনা/