ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের সংঘর্ষের পর এবার চীন থেকে অত্যাধুনিক এইচকিউ-৯বি আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা পেয়েছে ইরান।
মধ্যপ্রাচ্যের গোয়েন্দা সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ইরান তেলের বিনিময়ে এসব সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছে। এইচকিউ-৯বি যুক্ত হওয়ার ফলে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা বলয় আরও শক্তিশালী হচ্ছে। বিশেষ করে স্টেলথ ও দ্রুতগামী ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলায় এইচকিউ-৯বি ব্যবস্থা বেশ কার্যকর হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন এই পদক্ষেপ চীন-ইরান সামরিক সহযোগিতার বিস্তার এবং মধ্যপ্রাচ্যে বেইজিংয়ের কৌশলগত প্রভাব বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে, যদিও দুই দেশ এখন পর্যন্ত সরাসরি সামরিক কোনো জোট গঠন করেনি।
মধ্যপ্রাচ্যের গোয়েন্দা সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে, গত ২৪ জুন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরই ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য এই ক্ষেপণাস্ত্রের চালান তেহরানে পৌঁছায়। এর আগে ইরান রাশিয়ার এস-৩০০ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আমদানি করে।
এইচকিউ-৯বি হলো আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা, যা চীনের একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। এটি রাশিয়ার এস-৩০০ প্রযুক্তির সঙ্গে চীনের নিজস্ব রাডার ও ইলেকট্রনিক্স সিস্টেম একত্রিত করে তৈরি একটি ব্যবস্থা। এইচকিউ-৯বি ২৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে এবং এটি ২৭ কিলোমিটার উচ্চতায়ও কাজ করতে সক্ষম। এই ক্ষেপণাস্ত্রে কমান্ড পোস্ট, এইচটি-২৩৩ এস-ব্যান্ড রাডার, লক্ষ্য শনাক্তকরণ রাডার এবং ছয় থেকে আটটি লঞ্চার থাকে।
এই নতুন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মূলত ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি, রাডার এবং কমান্ড অবকাঠামো পুনর্প্রতিষ্ঠায় ব্যবহৃত হবে। যুদ্ধ চলার সময় ইসরায়েল ক্ষণিকের জন্য ইরানের আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। ওই হামলায় বেশ কয়েকজন ইরানি জেনারেল ও বিজ্ঞানী নিহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় উভয় দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। যুদ্ধবিরতির আগে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনাতেও হামলা চালায়। আর ইরান যুদ্ধবিরতির আগে পর্যন্ত ইসরায়েলে বহু ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এতে ইসরায়েলের ৩১ হাজারের বেশি ভবন ধ্বংস হয়।
ইরানে বর্তমানে একটি বহুস্তরীয় আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে আছে রাশিয়ার এস-৩০০, নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি বাভার-৩৭৩, আরমান, খোরদাদ, সেয়াদ, এবং মাঝারি ও স্বল্পপাল্লার অন্যান্য ব্যবস্থা। তবে এসব ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেলথ প্রযুক্তির এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রতিহত করার ক্ষমতা সীমিত। ইসরায়েল সম্প্রতি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে। এখন এইচকিউ-৯বি যোগ হওয়ায় ইরানের এই প্রতিরক্ষা বলয়ে নতুন মাত্রা যোগ হলো। এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ও স্টেলথ ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলা করা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর পাশাপাশি চীন থেকে ইরান বিপুল পরিমাণে ক্ষেপণাস্ত্র জ্বালানির উপাদান, যেমন সোডিয়াম পারক্লোরেট ও অ্যামোনিয়াম পারক্লোরেটও আমদানি করেছে। এসব দিয়ে শত শত ছোট পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা সম্ভব। কিছু উপাদান ইয়েমেনের হুথি ও ইরাকের শিয়া গোষ্ঠীগুলোর কাছেও পাঠানো হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চীন ও ইরানের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বাড়লেও চীন সরাসরি অস্ত্র বিক্রি করতে অস্বীকার করে এবং বলে তারা রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা মেনে চলে। এসব সত্ত্বেও চীনা কোম্পানি ও হংকংভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ইরানের সঙ্গে চুক্তিতে যুক্ত বলে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এর জবাবে ইতোমধ্যে কিছু চীনা ও ইরানি ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
একজন আরব গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ইরান দীর্ঘদিন ধরেই তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার চেষ্টা করছিল। আরেক কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার আরব মিত্ররা আগে থেকেই জানত যে ইরান এমন উদ্যোগ নিচ্ছে। হোয়াইট হাউসকেও বিষয়টি জানানো হয়েছিল।
তবে ইরান ঠিক কতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র পেয়েছে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ইরান তেলের বিনিময়ে এই ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে। বর্তমানে ইরানের সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা চীন। যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অনুযায়ী, ইরানের প্রায় ৯০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল এবং কনডেনসেট রপ্তানি হয় চীনে।
এর আগেও ইরান চীনের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র পেয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় চীনের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া থেকে সিল্কওয়ার্ম ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র পেয়েছিল ইরান। সেই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইরান কুয়েত এবং যুক্তরাষ্ট্রের ট্যাংকারে হামলা চালিয়েছিল।
চীন ও ইরান গত মার্চে যৌথ নৌ-মহড়া করেছে। গুঞ্জন রয়েছে, ইরান চীনের কাছ থেকে জে-১০সি যুদ্ধবিমানও কিনবে। যদি এ ব্যাপারে চুক্তি চূড়ান্ত হয় তবে তা ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষায় আরও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে।
চীনের তৈরি এইচকিউ-৯বি ও এইচকিউ-১৬বি ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা ইতোমধ্যে পাকিস্তান ও মিসরের কাছে বিক্রি হয়েছে। এবার ইরান এই তালিকায় যুক্ত হলো। সূত্র: ডিফেন্স নিউজ