যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, তার দেশ ইউক্রেনের জন্য প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও অন্যান্য অস্ত্র পাঠাবে ন্যাটোর (NATO) মাধ্যমে। তিনি বলেন, এই অস্ত্রগুলো ন্যাটোর কাছে হস্তান্তর করা হবে এবং তারাই সেগুলো ইউক্রেনে বিতরণ করবে। ন্যাটো এই অস্ত্রের ব্যয়ভার বহন করবে বলেও জানান তিনি।
এই ঘোষণা আসে এমন এক সময়ে, যখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ট্রাম্পের সঙ্গে একটি ‘সফল আলোচনা’ হয়েছে বলে জানিয়েছেন। সম্প্রতি ইউক্রেনের শহরগুলোতে রাশিয়ার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বেড়ে যাওয়ায় জেলেনস্কি ১০টি প্যাট্রিয়ট সিস্টেমের আবেদন করেছিলেন।
বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে প্যাট্রিয়ট সিস্টেম অন্যতম। এটি শত্রুপক্ষের আগত ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত ও ধ্বংস করতে সক্ষম।
জার্মানি ও নরওয়ের আর্থিক সহযোগিতা
স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) রোমে দেওয়া বক্তব্যে জেলেনস্কি জানান, জার্মানি দু’টি এবং নরওয়ে একটি প্যাট্রিয়ট সিস্টেমের জন্য অর্থ প্রদানে সম্মত হয়েছে। ইউরোপের আরও কিছু দেশ সহায়তা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
গত সপ্তাহে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপের পর ট্রাম্প বলেন, যুদ্ধ শেষ করার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় তিনি ‘অখুশ’। তিনি অভিযোগ করেন, পুতিনের ‘ভদ্র আচরণ’ আসলে অর্থহীন প্রমাণিত হয়েছে।
এনবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, আগামী সোমবার (১৪ জুলাই) রাশিয়া বিষয়ে তিনি একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা’ দেবেন, যদিও বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছু জানাননি। তিনি আরও বলেন, ইউক্রেনে পাঠানো অস্ত্রের সম্পূর্ণ ব্যয় ন্যাটো বহন করবে, যা সদস্য দেশগুলোর যৌথ তহবিল থেকে আসে।
ন্যাটোর মজুত অস্ত্র ব্যবহারের তাগিদ
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও শুক্রবার জানান, তিনি জার্মানি ও স্পেনসহ বেশ কয়েকটি দেশকে তাদের মজুত প্যাট্রিয়ট সিস্টেম দ্রুত ইউক্রেনের জন্য সরবরাহ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
রুবিও বলেন, ‘আমরা আমাদের ন্যাটো মিত্রদের উৎসাহ দিচ্ছি, যেহেতু এসব অস্ত্র তাদের কাছে ইতোমধ্যেই রয়েছে। পরে আর্থিক চুক্তির মাধ্যমে তারা প্রতিস্থাপন কিনে নিতে পারবে।’
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র কিছু গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র চালান সাময়িকভাবে স্থগিত করায় ইউক্রেন উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউক্রেন। এসব অস্ত্রের মধ্যে ছিল প্যাট্রিয়ট ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম গোলাবারুদ।
এই অবস্থায় রুশ বাহিনী ইউক্রেনের ওপর ব্যাপক ড্রোন হামলা চালালে ট্রাম্প জানান, তিনি নতুন করে অস্ত্র পাঠাবেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের পাঠাতেই হবে। ইউক্রেন এখন খুবই জঘন্যভাবে আক্রান্ত হচ্ছে।’
জেলেনস্কি এই অস্ত্র চালান পুনরায় চালু করার আহ্বান জানিয়ে প্যাট্রিয়ট সিস্টেমকে ‘ইউক্রেনীয় জনগণের প্রকৃত রক্ষক’ বলে বর্ণনা করেন।
রেকর্ড হামলা ও বেসামরিক হতাহত
গত মঙ্গলবার (৮ জুলাই) রাতে ইউক্রেন রেকর্ড ৭২৮টি ড্রোন হামলার শিকার হয়। জেলেনস্কি সতর্ক করে বলেন, রাশিয়া এই সংখ্যা ১ হাজারে উন্নীত করতে চায়।
জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন মাস ছিল ইউক্রেনে গত তিন বছরের মধ্যে বেসামরিক হতাহতের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ মাস -যেখানে ২৩২ জন নিহত ও ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি আহত হয়।
ইসরায়েলের প্যাট্রিয়ট সিস্টেম ইউক্রেনে যাচ্ছে
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে মেরামতের পর ইসরায়েলে মোতায়েন থাকা এক ব্যাটারি প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্রের চালান ইউক্রেনে পাঠানো হবে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছিল। ইউক্রেনের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গত মাসে জানান, ব্যাটারিটি যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছে, তবে এখনো ইউক্রেন তা পায়নি।
প্যাট্রিয়ট সিস্টেম ও এর ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের বেসামরিক ও সামরিক অবকাঠামোকে রুশ হামলা থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সোভিয়েত যুগের এস-৩০০ এবং পশ্চিমা নির্মিত NASAMS ব্যবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে ইউক্রেন এক ধরনের ‘স্তরবিন্যাসভিত্তিক প্রতিরক্ষা’ (layered air defence system) গড়ে তুলেছে। এর উন্নত রাডার ও নিখুঁত আঘাত হানার সক্ষমতা ইউক্রেনের জন্য একটি অবিচ্ছেদ্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম।
তবে এই সিস্টেম অত্যন্ত ব্যয়বহুল, একটি প্যাট্রিয়ট ব্যাটারির দাম ক্ষেপণাস্ত্রসহ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। এ কারণেই অনেক পশ্চিমা দেশ এখনো এই অস্ত্র সরবরাহে অনাগ্রহী।
২০২৩ সালের এপ্রিলে ইউক্রেন প্রথম দু’টি পশ্চিমা প্যাট্রিয়ট সিস্টেম পায়। এখন ইউক্রেনের কতটি সিস্টেম সক্রিয় রয়েছে, সে তথ্য গোপন রাখা হচ্ছে।
প্রতিটি নতুন ব্যাটারি যুক্ত হওয়ায় ইউক্রেন আরও বেশি শহর ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো—যেমন বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সামরিক ঘাঁটি—রক্ষা করতে পারছে।
তবে ইউক্রেন একটি বিশাল দেশ। সব অঞ্চলকে একযোগে রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই মিত্র দেশগুলো এখন অস্ত্র সরবরাহে গতি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমানোর চাপ
গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফেরার পর থেকেই ট্রাম্প ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমানোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
জার্মান গবেষণা সংস্থা কিয়েল ইনস্টিটিউট-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের শুরু থেকে ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ৬৯ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।
ট্রাম্প ন্যাটো মিত্রদের সামরিক খাতে তাদের জিডিপির ২% ব্যয় করার চাপও দিয়ে যাচ্ছেন। গত বছর সব ইউরোপীয় সদস্য দেশ এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
রাশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বন্ধে দুই পক্ষকে আলোচনায় আসার আহ্বান জানিয়ে আসছে।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা
মালয়েশিয়ায় এক সম্মেলনের ফাঁকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে আলোচনার কথা জানান মার্কো রুবিও। তিনি বলেন, ‘শান্তি আলোচনায় অগ্রগতির অভাব এবং রাশিয়ার নমনীয়তার ঘাটতিতে আমরা হতাশ।’
তিনি জানান, তারা যুদ্ধ শেষ করতে কিছু নতুন ধারণা তুলে ধরেছে, যা তিনি ট্রাম্পের কাছে তুলে ধরবেন। সূত্র: বিবিসি
মাহফুজ/