
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) চার বিচারকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ওয়াশিংটন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ান জারি এবং আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তোলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) একহাত দেখে নিল ট্রাম্প প্রশাসন।
এদিকে হেগ-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এটিকে ‘অবৈধ’ এবং ‘রাজনীতিকরণ’ আখ্যায়িত করে এই উদ্যোগের তাৎক্ষণিক নিন্দা জানিয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে- মার্কিনমুলুকে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা এবং যুক্তরাষ্ট্রে রক্ষিত সম্পদ জব্দ করা।
বৃহস্পতিবার (৫ জুন) মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, এই চার ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং আমাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে আইসিসির অবৈধ এবং ভিত্তিহীন কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িত।
শুক্রবার ( ৬ জুন) এক প্রতিবেদনে এই খবর জানায় বার্তাসংস্থা ল'ওরিয়েন্ট টুডে ।
আইসিসির বিরুদ্ধে নজিরবিহীন প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, আইসিসি রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে আদালতের পক্ষ থেকে খেয়াল খুশিমতো তদন্ত পরিচালনা, অভিযোগ গঠন, এমনকী রায় পর্যন্ত দেওয়া হয়।
নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া ওই চার বিচারক হচ্ছেন উগান্ডার সোলোমি বালুঙ্গি বোসসা, পেরুর লুয দেল কারমেন ইবানেয কারানযা, বেনিনের রেইনে আদেলাইদে সোফিই আলাপিনি গানসোউ এবং স্লোভেনিয়ার বেতি হোলের।
রুবিও অভিযোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও আমাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন ও অবৈধ পদক্ষেপ নিয়েছে আইসিসি। আর ওই চার বিচারক প্রত্যক্ষভাবে আদালতের কর্মকাণ্ডে জড়িত।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তীব্র নিন্দা জানিয়ে আইসিসি বলেছে, বিশ্বজুড়ে অবর্ণনীয় নিপীড়ন সহ্য করা লাখ লাখ মানুষের ন্যায়বিচার ও আশার প্রতীক হচ্ছে আইসিসি। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিচারিক ব্যবস্থার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করল।
আইসিসি বিচারক বোসসা ও ইবানেয কারানযা ২০১৮ সাল থেকে আদালতের সঙ্গে যুক্ত আছেন। ২০২০ সালে তারা এমন একটি আপিল রায়ে অংশ নেন, যা মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে যুদ্ধাপরাধ তদন্ত শুরুর অনুমতি দেয়।
যদিও ২০২১ সাল থেকে আদালত মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে তদন্তকে অগ্রাধিকার না দিয়ে আফগান সরকারি বাহিনী ও তালেবানের অপরাধ তদন্তে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
বাকি দুই বিচারক গানসোউ ও হোলের ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েলের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গাজা সংঘর্ষে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা অনুমোদনে ভূমিকা রাখেন। পাশাপাশি হামাস নেতা ইব্রাহিম আল-মাসরির বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
আইসিসির সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে তিক্ততা এই নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে আরও বৃদ্ধি পেল। আগের মেয়াদেও আন্তর্জাতিক আদালতের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছিলেন ট্রাম্প। ২০২০ সালে আফগানিস্তান ইস্যুতে আইসিসির কিছু পদক্ষেপ পছন্দ না হওয়ায় তৎকালীন কৌঁসুলি ফাতৌ বেনসৌদা এবং তার অন্যতম প্রধান সহযোগীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন তিনি।
এর আগে ফেব্রুয়ারিতে, যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির প্রসিকিউটর করিম খানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, যিনি ইসরায়েলি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এই প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন।
এদিকে আইসিসি দ্রুত এক বিবৃতিতে প্রতিক্রিয়া হিসেবে জানায়, এই পদক্ষেপগুলো বিশ্বব্যাপী ১২৫টি সদস্য রাষ্ট্রের অধীনে পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক বিচারিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করার স্পষ্ট প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।
সংস্থাটি আরও জানায়, আইসিসি তার কর্মীদের সম্পূর্ণ সমর্থন করে এবং অবিচলভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যাবে।
এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মানবাধিকার রক্ষাকারী সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের লিজ ইভেনসন জানান, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য আইসিসিকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনে সংঘটিত গুরুতর অপরাধের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করতে বাধা দেওয়া। মার্কিন সহযোগিতায় গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতা বন্ধ করার জন্য ব্যবহার করা উচিত। সবচেয়ে গুরুতর অপরাধের জন্য বিচার চাইছেন এমন ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়।
তিনি এএফপিতে পাঠানো এক বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল কেউই আইসিসির সদস্য নয়। গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার ও বিচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি স্থায়ী এখতিয়ার। তারা তাদের নাগরিকদের বিচার করার জন্য এর ক্ষমতা স্বীকার করে না।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আইসিসির তৎকালীন প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদাকেও আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। ২০২১ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই যা জো বাইডেন তুলে নেন।
এদিকে, শুক্রবার ভোরে এই উদ্যোগের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
নিজের এক্স-হ্যান্ডেলে এক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘রাজনীতিক আইসিসি বিচারকদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিওকে ধন্যবাদ। আপনি সঠিকভাবে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং সমস্ত গণতন্ত্রের বিপরীতে নৃশংস সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার অধিকার রক্ষা করেছেন।’
সুলতানা দিনা/অমিয়/