
মধ্যপ্রাচ্য মানেই যেন যুদ্ধের ঘনঘটা। কয়েক দশক ধরে কয়েকটি দেশের পারস্পরিক অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব-সংঘাত যেকোনো দিন যুদ্ধে রূপ নেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এটি এই অঞ্চলের স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীল এই পরিস্থিতিকে আরও ঘনীভূত করে তুলছে ইসরায়েল ও ইরানের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব। একদিকে কূটনৈতিক আলোচনার স্থবিরতা, অন্যদিকে সেনা মহড়া ও প্রক্সি যুদ্ধ - সব মিলিয়ে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে।
এর মধ্যেই সম্প্রতি ইরানি সংবাদমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে, ‘ইরানের গোয়েন্দারা একটি গোপন অভিযান চালিয়ে ইসরায়েলের বিপুল, গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শকাতর গোপন নথি হাতে পেয়েছে। এসবের মধ্যে কয়েক হাজার নথি ইসরায়েলের পারমাণবিক অবকাঠামো সংক্রান্ত। যারমধ্যে অসংখ্য ছবি ও ভিডিও রয়েছে।
ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ এবং হিজবুল্লাহ সংশ্লিষ্ট লেবানিজ সংবাদমাধ্যম আল-মায়েদানে এই খবর বেশ ফলাও করে প্রচার করা হয়। শুধু তাই নয়, শনিবার (৭ জুন) দ্য জেরোসালেম পোস্ট-সহ একাধিক ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ইরানের এই দাবির সত্যতা নিশ্চিত করে!
এ ছাড়াও, ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণে অনড় অবস্থান, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির উন্নয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শীতল ও ধীরগতির কূটনৈতিক সম্পর্ক, চীনের ওপর অতিমাত্রায় অস্ত্র ও সামরিক ক্ষেত্রে সহায়তা নেওয়ার প্রবণতা - সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন বেশ উত্তপ্ত।
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ বিশ্ব নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এই সংঘর্ষ বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহে ব্যাঘাত, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর জড়িয়ে পড়া এবং আঞ্চলিক অস্থিরতা গভীরতর করে তুলতে পারে।
এমন প্রেক্ষাপটে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউজউইক একটি প্রতিবেদনে ইরান-ইসরায়েলের সম্ভাব্য যুদ্ধ নিয়ে ৫টি ইঙ্গিত দিয়েছে। পাঠকের জন্য সেগুলো হুবহু তুলে ধরা হলো—
ইরানের অস্বাভাবিক মাত্রায় ক্ষেপণাস্ত্র-জ্বালানি সংগ্রহ
ইরান সম্প্রতি চীন থেকে হাজার হাজার টন অ্যামোনিয়াম পারক্লোরেট আমদানি করছে। এগুলো মূলত কঠিন জ্বালানিভিত্তিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির মূল উপাদান। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতে, এই উপাদান দিয়ে প্রায় ৮০০ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি সম্ভব।
এছাড়া, এর কিছু অংশ হামাস এবং ইয়েমেনের হুতি মিলিশিয়াসহ অন্যান্য মিত্র গোষ্ঠীর কাছেও পাঠানো হতে পারে। এটি ইরানের কৌশলগত প্রস্তুতির একটি অংশ।
প্রস্তুত ইসরায়েল
ইসরায়েল খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছে, ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আঘাত হানার জন্য তারা প্রস্তুত। দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) সম্প্রতি ইরানি লক্ষ্যবস্তুতে বহু দিবসীয় আক্রমণের মহড়া দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ থেকে বিরত রাখা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চাইলেও, তারা যুদ্ধের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়নি।
বাড়ছে এলাকাভিত্তিক প্রক্সি যুদ্ধ
বুধবার (৪ জুন) সিরিয়া ইসরায়েলে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লে ইসরায়েলও পাল্টা বিমান হামলা চালায়। তারা এর জন্য দায়ী করেছে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারাকে। তবে দামেস্কের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
একইসময়ে ইয়েমেনের হুতিরা তেল-আবিবের জাফায় একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইরান ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলোর এই সমন্বিত তৎপরতা যুদ্ধক্ষেত্রকে আরও প্রস্তুত করে তুলছে।
নেতানিয়াহুর ওপর মারাত্মক রাজনৈতিক চাপ
সম্প্রতি দেশে নিজের জোট ও বিরোধীদের চাপে মারাত্মক বেকায়দায় পড়েছেন নেতানিয়াহু। জোট ছাড়ার হুমকি দিয়েছে তার সরকারের শরিক কট্টর রক্ষণশীল দল ইউনাইটেড তোরাহ জুডাইজম (ইউটিজে)। এছাড়া তৈরি হয়েছে পার্লামেন্ট ভাঙার আশঙ্কা। এর বাইরে তিনি গাজায় যুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরেই যথেষ্ট বেকায়দায় রয়েছেন।
তাই, অভ্যন্তরীণ এই রাজনৈতিক সংকট থেকে দৃষ্টি সরাতে ইরানের হুমকিকে কেন্দ্র করে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিচ্ছেন নেতানিয়াহু। তার মতে, ইরান এখন দুর্বলতম অবস্থায় রয়েছে এবং এটি হামলার জন্য উপযুক্ত সময়।
কোণঠাসা ইসরায়েল
গাজায় যুদ্ধের কারণে ইসরায়েল এখন আন্তর্জাতিকভাবে বেশ কোণঠাসা। দেশটি থেকে রাষ্ট্রদূত ফিরিয়ে নিয়েছে জর্ডান, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তুরস্ক এবং সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আলোচনা ভেঙে পড়েছে। বিপরীতে ইরান রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন এনেছে।
সামনে যা হতে পারে
নানাবিধ কারণে পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে এই পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। ইসরায়েল কারও তোয়াক্কা না করে (এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেরও) একতরফা ইরানে আক্রমণ করতে পারে। কেননা, তারা মনে করে; ইরান ইতোমধ্যেই ‘লাল দাগ’ অতিক্রম করে ফেলেছে।
অন্যদিকে, ইরান তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের অধিকার জোর দিয়ে আগাম সতর্কবার্তা দিচ্ছে যে, হামলা হলে তারাও পাল্টা জবাব দিতে প্রস্তুত। তাই, এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সুলতানা দিনা/অমিয়/