
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘর্ষ যতই দিন গড়াচ্ছে উভয়পক্ষের হতাহতের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। ইরানে কমপক্ষে ৪৩০ জনের বেশি নিহত এবং সাড়ে তিন হাজার আহত হয়েছেন। তাছড়া ইসরায়েলে কমপক্ষে ২৪ জন নিহত এবং অনেক আহত হয়েছেন। ইরানের মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলছেন, ইরানের বিভিন্ন পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালানো প্রয়োজন ছিল।
ইসরায়েলি জনসাধারণের কাছে বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলি সরকার কেন একতরফা, বিনা প্ররোচনায় আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নিল তার প্রকৃত কারণ কেউই ব্যাখ্যা করেননি।
ইসরায়েল সরকার দাবি করে, এই হামলা একটি ‘প্রতিরোধমূলক’ অভিযান, যার উদ্দেশ্য ইরানের পক্ষ থেকে পারমাণবিক বোমা তৈরির তাৎক্ষণিক, অনিবার্য হুমকি মোকাবেলা করা।
এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই বলে মনে হচ্ছে। ইসরায়েলের হামলা নিঃসন্দেহে দীর্ঘ সময় ধরে সতর্কতার সঙ্গে পরিকল্পনা করা হয়।
একটি প্রতিরোধমূলক আক্রমণের ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার উপাদান থাকতে হয়, যা আবার একটি জরুরি পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে এমন কোনো জরুরি পরিস্থিতির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
এ ছাড়াও, ইসরায়েল বলেছে যে, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) কর্তৃক ১২ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদন, যা ২০০০ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত পরমাণু অস্ত্র বিস্তার নিষেধাজ্ঞা চুক্তির (এনপিটি) প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের জন্য ইরানকে অভিযুক্ত করে, সেটিই জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কিন্তু আইএইএ মনে হচ্ছে এই দাবি প্রত্যাখ্যান করছে। কারণ, প্রতিবেদনে এমন কিছুই ছিল না যা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আগে জানা ছিল না।
ইসরায়েল সরকার ‘প্রতিরোধমূলক’ হামলার ধারণার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত হয়েও দাবি করেছে যে, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ‘অগ্রভাগে আঘাত’ করে ধ্বংস করতে চায়। তবে গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সাধারণভাবে এই ব্যাপারে একমত রয়েছে যে, ইসরায়েলের পক্ষে এককভাবে এমন হামলা চালিয়ে ইরানের পুরো পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা সম্ভব নয়।
এই অভিযানের ধরণ দেখে মনে হচ্ছে, ইসরায়েল কখনোই ইরানের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড ধ্বংস করার ইচ্ছা পোষণ করেনি। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি থেকে শুরু করে গ্যাসক্ষেত্র এবং তেলের ডিপো পর্যন্ত বিভিন্ন সামরিক ও সরকারি লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলা চালিয়েছে। তারা ইরানের জ্যেষ্ঠ সামরিক নেতাদের ওপরও একাধিক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। নিহতদের মধ্যে একজন ছিলেন প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা আলী শামখানি, যদিও ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এবং সরকার এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। গত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় শামখানি একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব বলে মনে করা হচ্ছে।
এই হত্যাকাণ্ড, যেমনটি অন্যদের ক্ষেত্রেও হয়েছে, ইসরায়েলের একটি পছন্দের কৌশল বা অভ্যাসকে প্রতিফলিত করে। ইসরায়েল প্রায়ই নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের ‘বিলুপ্ত’ করার চেষ্টা করে এই আশায় যে, তাদের মৃত্যু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থার ভেঙে পড়ার কারণ হবে। শামখানির মৃত্যু ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার আলোচনা ভঙ্গের একটি প্রচেষ্টা হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। যেকোনো ভাবেই হোক, এই ধরনের হত্যাকাণ্ড ইসরায়েলের একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়, যার উদ্দেশ্য হলো ইরানের সরকারের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড ও প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে নিজের শক্তি প্রদর্শন। এটি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কোনো ‘অগ্রভাগে আঘাত’ বা ‘নেতৃত্বচ্ছেদ’ নয়।
তৃতীয় যে ব্যাখ্যাটি দেওয়া হচ্ছে তা হলো - ইসরায়েলের লক্ষ্য তেহরানে ‘শাসন পরিবর্তন’ প্রক্রিয়া শুরু করা। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ‘ইরানের গর্বিত জনগণকে’ ‘একটি দুষ্ট ও দমনমূলক শাসন থেকে মুক্তির জন্য’ দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
ইরানিদের ওপর একতরফাভাবে এবং ধারাবাহিকভাবে বোমাবর্ষণ করে তাদের দিয়ে ইসরায়েলের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে। এই ধারণাটি এমন এক কল্পনার মতো, যেমনটি ধরে নেয় যে, যদি ইসরায়েল গাজায় ফিলিস্তিনিদেরকে পর্যাপ্ত মাত্রায় অনাহারে রেখে নিধন করে, তাহলে তারা হামাসের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়িয়ে একে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবে।
যদি তাই হতো, তবুও এই ধারণা যে ইরানিরা কেবল ইসরায়েলের একটি হামলার অপেক্ষায় আছেন যেন তারা শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে - এটি ইরানের রাজনীতিকে চালিত করা শক্তিগুলোর প্রতি গভীর অজ্ঞতার পরিচয় দেয়। যদিও অনেক ইরানি নিঃসন্দেহে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতা করে, তবুও সব মতাদর্শের ইরানিরাই ধারাবাহিকভাবে ‘দেশপ্রেমিক’। তারা ইরানের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার পক্ষে অটল, এবং বিদেশি শক্তির অ্যাজেন্ডা চাপিয়ে দেওয়ার যেকোনো চেষ্টার বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নেয়।
প্রকৃতপক্ষে যেমনটি দেখা গেছে, অনেক ইসরায়েলি, যারা নিজেদেরকে নেতানিয়াহুর কঠোর সমালোচক হিসেবে বিবেচনা করেন, ইসরায়েলের হামলা শুরু হওয়ার পরই সতর্ক হয়ে উঠেছে। তারা এখন প্রকাশ্যে সরকারের প্রতি সমর্থন দিচ্ছেন। সবচেয়ে স্পষ্টভাবে সমর্থন দিচ্ছেন সংসদের ‘বিরোধী দলের’ সদস্যরাও।
তেমনি ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বহু বিরোধীও এখন জাতীয় পতাকার পেছনে একত্রিত হয়ে ইরানের লঙ্ঘিত সার্বভৌমত্বের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। ইসরায়েলের আক্রমণ কেবল একটি গণবিপ্লবের ‘ভিত্তি তৈরি করছে’ বলে দাবি করা এক ধরনের নির্লজ্জ রাজনৈতিক চাতুরি।
শুধু এসব কারণেই ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করেনি। তাহলে আক্রমণের কারণ কী?
গাজায় চলমান গণহত্যার প্রেক্ষাপটে, নেতানিয়াহু ভালভাবেই জানেন যে তার সরকারের কৌশলগত বিকল্পগুলো দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আঞ্চলিক মিত্ররা প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সমালোচনা করতে শুরু করেছে। কেউ কেউ একতরফাভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, যেমন- ফিলিস্তিনিকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) পক্ষ থেকে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। আর আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) দখলদারত্বের আইনি বৈধতা নিয়ে রায় অপেক্ষমাণ। ইসরায়েল এবং এর সামরিক বাহিনী বারবার হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তা অস্বীকার করেছে, এবং পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে তারা মিথ্যা বলেছে।
নেতানিয়াহু যে ইরানে হামলার পরিকল্পনা বহু বছর ধরে করছিলেন, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি কেবল উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। সেই সময়টি এল ১৩ জুন (শুক্রবার)। এটি এক ধরনের মরিয়া প্রচেষ্টা, যাতে বিশ্বকে আবার ইসরায়েলের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করা যায়। এটি ঠিক তখনই শুরু করা হয়েছে যখন বিশ্বের নানা জায়গায় ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের দায়মুক্তি শেষ করার প্রস্তুতি চলছে।
ইরানকে এখনো গ্লোবাল নর্থের অনেক বড় শক্তি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। একতরফাভাবে প্রাণঘাতী হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ইসরায়েলের পরিচিত ভাষ্য - ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিশ্রুতি থেকে শুরু করে হলোকাস্ট পর্যন্ত - নেতানিয়াহু এসব পুনরুজ্জীবিত করে বিশ্বব্যবস্থায় আগের মতোই ইসরায়েলকে স্বাধীনভাবে সবকিছু করার অধিকার ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন।
এই ‘নিরাপত্তা’ হলো ইসরায়েলের বর্তমান সংজ্ঞা - যা এর অস্তিত্বের মূলনীতির অন্যতম। এটি হলো একটি আপাত অরাজনৈতিক ভিত্তি, যা ইসরায়েলিত্বের জন্মস্থল, যেখানে পূর্ণভাবে ইহুদি আধিপত্যের ধারণা নিবেদিত। কারণ ‘নিরাপত্তা’ মানেই - ইসরায়েল চাইলে যাকে খুশি, যখন খুশি, যেখানে খুশি হত্যা করতে পারবে, এবং এর কোনো মূল্য দিতে হবে না।
এই ‘নিরাপত্তা’ই ইসরায়েলের কার্যক্রম চালিয়েছে গাজা থেকে ইয়েমেন, লেবানন, সিরিয়া এবং এখন ইরান পর্যন্ত। এ ধরনের ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ অবশ্যই সম্প্রসারিত হতে থাকে। এটি কখনো থেমে থাকতে পারে না। ইরানে হামলা চালিয়ে নেতানিয়াহু যেন সর্বস্ব ঝুঁকিতে ফেলেছেন। চেষ্টা করছেন ইসরায়েলের এবং নিজের জন্য পরম দায়মুক্তির দাবি প্রতিষ্ঠা করতে। তা হেগে হোক বা দেশের অভ্যন্তরীণ আদালতে।
এটাই কি হবে নেতানিয়াহুর মুক্তির পথ? ইসরায়েলি জনগণ কি তাকে দেশে ব্যর্থতা ও গাজায় ভয়াবহ অপরাধের জন্য ক্ষমা করে দেবে? বর্তমান ইসরায়েলি গণমাধ্যম ও জনমনে উদ্দীপনার যে ঢেউ দেখা যাচ্ছে, তাতে এমন সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না।
প্রতিটি খোলা দোকানে, হার্ডওয়ার থেকে খাদ্যদ্রব্য পর্যন্ত দীর্ঘ লাইন প্রমাণ করে - ইসরায়েলিরা এখন নিছক টিকে থাকার মনোভাব নিয়ে চলছে। একটি নিঃশব্দ, বশ্যতাপূর্ণ নাগরিক সমাজ নেতানিয়াহুর জন্য সুবিধাজনক হতে পারে কিন্তু এটি একটি শক্তিশালী ও প্রতিরক্ষাযোগ্য ইসরায়েলি সমাজ গঠনের জন্য অশনিসংকেত। সূত্র: আল-জাজিরা
লেখক: ওরি গোল্ডবার্গ
নিরপেক্ষ বিশ্লেষক
অমিয়/