
ইরান-ইসরায়েল চলমান সংঘাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের একাধিক পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার মধ্য দিয়ে পাল্টে যাচ্ছে এ যুদ্ধের গতিপথ। পাল্টাপাল্টি হামলা অব্যাহত থাকলেও ইরানের আকাশসীমায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের দাবি করছে ইসরায়েল। অর্থাৎ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় ইরানের দুর্বলতার বিষয়টি এখন বিশেষজ্ঞদের চর্চায়।
বিশ্লেষকদের আলোচনায় রয়েছে, ইরান কীভাবে তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে পারত। কোন দুর্বলতার কারণে ইসরায়েল সহজেই ইরানের আকাশসীমা দখলে নিতে পারছে। ইসরায়েল অতীতেও ইরানকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। তবে সর্বশেষ চলমান এই অভিযান পূর্ববর্তী হামলাগুলোর চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত। ইরান কেবল উল্লেখযোগ্য প্রাণহানির শিকার হয়নি, বরং তাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক মেরিন ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্রায়ান বারলেটিকের বরাতে মিলিটারি ওয়াচ ম্যাগাজিন ইরানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কিছু বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়, বিভিন্ন বিশ্লেষণে উঠে এসেছে ইরান দেশের অভ্যন্তরে পশ্চিমা ও ইসরায়েল-সমর্থিত মিলিশিয়াদের কার্যক্রম মোকাবিলায় তুষ্ট ছিল। পাশাপাশি ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে পর্যাপ্ত সমন্বয়ের অভাব নিয়েও সমালোচনা আছে। এতে বলা হয়, ইরানের প্রতিরক্ষার অন্যতম বড় দুর্বলতা হলো আধুনিক যুদ্ধবিমানের অভাব। দেশটির ১৬টি যুদ্ধবিমান স্কোয়াড্রন বহু আগেই প্রযুক্তিগতভাবে অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে। ফলে জাতীয় আকাশসীমা রক্ষার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে মাটিভিত্তিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোননির্ভর পাল্টা হামলার ওপর নির্ভরশীল। ফলে যুদ্ধবিমান থেকে কোনো কার্যকর সহায়তা মেলেনি। এই প্রেক্ষাপটে ইরানের সমর্থকরা কেবল ইরান সরকারের প্রতি নয়, রাশিয়া ও চীনের প্রতিও সমালোচনামূলক মনোভাব দেখিয়েছেন। কারণ তারা আধুনিক যুদ্ধবিমান সরবরাহে যথেষ্ট ভূমিকা নেয়নি। যদিও ইরান ইতোমধ্যেই এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমানের অর্ডার দিয়েছে। তার পরও তা সরবরাহ না হওয়ায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছে।
এই সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রায়ান বারলেটিক বলেন, রাশিয়া বা চীনের পক্ষে ইরানকে কার্যকর যুদ্ধবিমানের বহর সরবরাহ করা বাস্তবসম্মত ছিল না। তিনি যুক্তি দেন- ধরুন, রাশিয়া এসইউ-৩৫ নিজেরা উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বিনামূল্যে ইরানকে দিলেও কয়েক বছর পর্যন্ত ইরান সেগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারত না। এমনকি এসইউ-৩৫ পেলেও সেগুলোর পক্ষে এফ-৩৫-কে প্রতিহত করাটা অবাস্তব। কেবল সাম্য অর্জন করতেও ইরানকে ১০০-৩০০টি যুদ্ধবিমান, প্রশিক্ষিত পাইলট, গ্রাউন্ড ক্রু, জ্বালানি, রক্ষণাবেক্ষণ অবকাঠামো- সবকিছু প্রয়োজন হতো। ১০ বছর আগে শুরু করলেও তারা এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারত না বলে দাবি বারলেটিকের। এই বক্তব্যের পেছনে বারলেটিক আরও বলেন, চীন যদি ইরানে নতুন যুদ্ধবিমান রেখে যায়, তা ব্যবহারেও একই মাত্রার প্রস্তুতি দরকার হবে। কারণ কয়েকটি বিমান যথেষ্ট নয়, শতাধিক লাগবে।
তার বক্তব্য অনুযায়ী, রাশিয়া ও চীন ইতোমধ্যেই তাদের সাধ্যের সবকিছু দিয়ে ইরানকে সাহায্য করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা ব্লকের সমালোচক হিসেবে পরিচিত বারলেটিকের এই মূল্যায়নকে অনেকেই রাশিয়া ও কিছুটা চীনের দায় এড়ানোর চেষ্টা বলে মনে করছেন।
বারলেটিকের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তার কিছু দাবি যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো- তিনি বলেছেন, ইরানকে একটি কার্যকর যুদ্ধবিমানের বহর গড়তে ১০ বছরেরও বেশি সময় লাগবে। বাস্তবে, ইরান এরই মধ্যে বৃহৎসংখ্যক যুদ্ধবিমান পরিচালনা করে। যার মধ্যে আছে রুশ মিগ-২৯, এসইউ-২৪ এম, এসইউ-২২ ও চীনা জে-৭। এমনকি তারা ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে মার্কিন এফ-১৪ পরিচালনা করে আসছে, যেটি বিশ্বের অন্যতম জটিল ও রক্ষণাবেক্ষণনির্ভর বিমান। তাই মিগ-২৯ বা এফ-১৪ থেকে এসইউ-৩০এসএম বা মিগ-৩৫-এর মতো আধুনিক বিমানে রূপান্তর করতে ১০ বছর লাগবে- এই দাবি বাস্তবতা-বিবর্জিত।
মিলিটারি ওয়াচ ম্যাগাজিন তাদের বিশ্লেষণে আরও বলে, ভারতের মতো দেশ, যেখানে ২০০০-এর দশকে মাত্র দুই বছরের মধ্যে মিগ-২৯ থেকে এসইউ-৩০এমকেআইয়ের মতো ভারী, আধুনিক যুদ্ধবিমানে রূপান্তর করা সম্ভব হয়েছে, সেখানে ইরানের মতো অভিজ্ঞ দেশও দ্রুত এই পরিবর্তন করতে সক্ষম। বারলেটিকের প্রশ্নবিদ্ধ আরেকটি দাবি হলো- ইরানকে কার্যকর প্রতিরক্ষা গড়তে ১০০-৩০০টি যুদ্ধবিমান এবং মার্কিন-ইসরায়েলি পর্যায়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাইলট দরকার। বাস্তবে, তুলনামূলকভাবে কমসংখ্যক (৫০টির মতো) উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ‘৪+ জেনারেশন’ যুদ্ধবিমানও ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারত। কারণ যুদ্ধ ইরানের সীমান্তবর্তী এলাকায় হচ্ছে। যেখানে ইসরায়েলি বিমানগুলোর জন্য ট্যাংকার-নির্ভরতা রয়েছে এবং দীর্ঘ দূরত্বে জ্বালানি ট্যাংক বহন করতে হচ্ছে। এদিকে আধুনিক ইরানি যুদ্ধবিমানগুলোর পক্ষে দেশীয় আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা সম্ভব। এ ছাড়া ইসরায়েলের প্রায় ২০০টি এফ-১৫ ও এফ-১৬ বিমান ১৯৯০-এর দশকের প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। যেগুলো আধুনিক চীনা জে-১০সি, জে-১৬ বা রুশ এসইউ-৩৫-এর তুলনায় অনেক পিছিয়ে। আধুনিক বিমানের দূরপাল্লার রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা ইসরায়েলের ট্যাংকার বিমানের জন্যও হুমকি হতে পারত। এমনকি যদি ইসরায়েল হামলা চালাত, তবুও এই আধুনিক যুদ্ধবিমানগুলো ইসরায়েলকে বাধ্য করত তাদের এফ-৩৫ স্কোয়াড্রনকে আকাশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যস্ত রাখতে। যার ফলে মাটিভিত্তিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বা স্থাপনা লক্ষ্যবস্তুতে হামলার সক্ষমতা কমে যেত।
যদিও বারলেটিক যথার্থভাবে বলেছেন যে একটি কার্যকর যুদ্ধবিমানবহর রাতারাতি গড়ে তোলা যায় না, তবু ইরানের সামনে সময় ছিল। জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ২০২০ সালে প্রত্যাহার হওয়ার পর প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে ইরান চাইলে যুদ্ধবিমান কিনতে পারত। মাত্র ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগেই পাকিস্তানের মতো দেশ জে-১০সি যুদ্ধবিমান কিনেছে। ইরান যদি সেই পথে হাঁটত, তাহলে আজ হয়তো এ বিপর্যয় এড়ানো যেত। সূত্র: মিলিটারি ওয়াচ ম্যাগাজিন