
ইরানে চলতি সপ্তাহে পালিত হচ্ছে ইসলামী বিপ্লবের ৪৬তম বার্ষিকী। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই বিপ্লব ইরানের স্বনির্ভরতার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। বিশেষ করে সামরিক খাতে দেশটি অনেক দূর এগিয়েছে। বিপ্লবের পর ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতে শক্তি অর্জন করে।
১৯৭৯ সালে পশ্চিমা-সমর্থিত রেজা শাহ পাহলভির একনায়কতন্ত্রের পতনের পর ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে ইরান ক্রমেই এক শক্তিশালী বৈশ্বিক সামরিক শক্তিতে রূপ নিচ্ছে। দশকের পর দশক কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও বিদেশি চাপের মধ্যেও ইরান ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে বিশ্বের অগ্রণী রাষ্ট্রগুলোর কাতারে পৌঁছেছে। ইরানের উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন অস্ত্রাগার শুধু প্রতিরক্ষার জন্য নয়, এটি শত্রুদের ওপর পাল্টা আঘাত হানার জন্যও প্রস্তুত। তেল আবিবের মতো আগ্রাসী শাসকদের বিরুদ্ধে এই শক্তি প্রয়োগে দ্বিধা করছে না ইসলামিক প্রজাতন্ত্র। কারণ ইহুদিবাদী শক্তি বারবার উসকানি দিয়ে যাচ্ছে।
‘ট্রু প্রমিজ ১’ ও ‘ট্রু প্রমিজ ২-এর সময় ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষমতার নিখুঁত প্রদর্শন ঘটায়। শত শত নির্ভুল নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র অধিকৃত অঞ্চলে ছোড়া হয়। সেগুলো ইহুদিবাদী বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করে গভীর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এতে ইরানের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও প্রতিরোধ শক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কীভাবে এটি শুরু হয়েছিল
ইসলামিক বিপ্লবের আগে ইরান ছিল পুরোপুরি পশ্চিমা অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। মার্কিন-সমর্থিত পাহলভি শাসনামলে দেশটি একচেটিয়াভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে সামরিক সরঞ্জাম আমদানি করত। আঞ্চলিক গুরুত্ব ও বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ইরানের সামরিক বাহিনীর ভিত্তি ছিল বিদেশি ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার ও অস্ত্রব্যবস্থার ওপর। এই নির্ভরতা প্রযুক্তিগতভাবে ইরানকে অত্যন্ত দুর্বল করে তোলে। ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান প্রতিরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও একই অবস্থা ছিল। অথচ এই খাতগুলোতেই আজ ইরান বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অনেক দিক থেকে পশ্চিমাদের থেকেও এগিয়ে।
১৯৭৯ সালের আগে ইরানে কোনো দেশীয় ইউএভি বা ড্রোন কর্মসূচি ছিল না। তারা পুরোপুরি আমদানি করা সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল (এসএএম) ও এয়ার-টু-এয়ার মিসাইলের (এএএম) ওপর নির্ভর করত। প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও সীমিত ছিল। শুধুমাত্র স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার কিছু ব্যবস্থা ছিল। তাদের ভাণ্ডারে ছিল মার্কিন বিচক্রাফ্ট এমকিউএম-১০৭ স্ট্রীকার টার্গেট ড্রোন, আরআইএম-৬৬ স্ট্যান্ডার্ড এসএএম, এআইএম-৫৪ ফিনিক্স এএএম এবং ব্রিটিশ র্যাপিয়ার ও মার্কিন এমআইএম-২৩ হক বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। সবই ছিল পশ্চিমা আমদানি, যেগুলো বিদেশি সহায়তা ছাড়া পরিচালনাও সম্ভব ছিল না।
উদ্ভাবনের পথ
১৯৮০-এর দশকে ইসলামী বিপ্লবের পরপরই ইরানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়। এতে আমদানি-নির্ভর পুরোনোব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ইরানের সামরিক বাহিনীর প্রকৃত অবস্থা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির সহায়তায় ইরাক ইরানের বিরুদ্ধে এক নৃশংস যুদ্ধ শুরু করে। তেহরান তখন একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়- সামরিক স্বনির্ভরতা অর্জন না করলে পরাজয় অনিবার্য। যুদ্ধ যত তীব্র হয়, তত অকেজো হয়ে পড়ে ইরানের পশ্চিমা-নির্মিত অস্ত্র। কারণ নিষেধাজ্ঞার কারণে খুচরা যন্ত্রাংশ পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা পূর্ব ইউরোপীয় ব্লক থেকেও বিকল্প মেলে না। কারণ মস্কো তখন ইরাকের পক্ষে ছিল।
এই পরিস্থিতিতে অভিযোজন ও উদ্ভাবন ছাড়া ইরানের সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। তাই দেশটি উচ্চাভিলাষী এক যাত্রা শুরু করে সামরিক স্বনির্ভরতার পথে। শুরু করে নিজস্ব অস্ত্র তৈরির কাজ। কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের গবেষণায়, আবার কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের সীমিত সহায়তায়। ওই সময় ইরানের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল এমন অস্ত্র, যেটা দিয়ে দূরের শত্রুকে টার্গেট করা যায়। পাশাপাশি দরকার ছিল এমন নজরদারিব্যবস্থার, যাতে দামি যুদ্ধবিমান ছাড়াই গোয়েন্দা তৎপরতা চালানো সম্ভব হয়। এই হতাশাজনক পরিস্থিতি থেকেই জন্ম নেয় ইরানের আধুনিক সামরিক কমপ্লেক্স। এটি এমন এক শক্তিতে পরিণত হয়, যেটা ৪৬ বছর পরেও অঞ্চলজুড়ে অন্যতম উন্নত সামরিক শক্তি হিসেবে বিবেচিত।
১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইরান প্রথম পদক্ষেপ নেয় সামরিক স্বনির্ভরতার পথে। তেহরানে ‘কুদস অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি কোম্পানি’ ও ইস্ফাহানে ‘এইচইএসএ’ (ইরান বিমান উৎপাদন শিল্প কোম্পানি) গড়ে তোলে। এই দুটি প্রতিষ্ঠান পরে ইরানের ড্রোন শিল্পের মেরুদণ্ডে পরিণত হয়। তারা ‘মোহাজের’ রিকনেসান্স ড্রোন, ‘তালাশ’ প্রশিক্ষণ ড্রোন ও ‘আবাবিল’ আক্রমণ ড্রোনের মতো প্রাথমিক ইউএভি তৈরি করে। এই ড্রোনগুলো ছিল প্রাথমিক ও সীমিত ক্ষমতার। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ছিল গেম-চেঞ্জার। ‘মোহাজের’ একাই শত শত মিশনে অংশ নেয়। তোলে ৫০ হাজারের বেশি গোয়েন্দা ছবি। এমনকি এটি ছিল ইরানের প্রথম যুদ্ধ ড্রোন, যাতে আরপিজি রকেট লাগিয়ে আকাশ হামলা চালানো হয়েছিল।
ড্রোন প্রযুক্তির অগ্রগতির পাশাপাশি ইরান বন্ধুবান্ধব রাষ্ট্র থেকে পুরোনো ক্ষেপণাস্ত্র মডেল সংগ্রহ করে। পরে সেগুলো বিপরীত-প্রকৌশলের মাধ্যমে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি শুরু করে। যুদ্ধের শেষদিকে এসে ইরান ‘ওঘাব’ ও ‘নাজিয়াত’ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি ও মোতায়েন করে। এগুলো ছিল কঠিন জ্বালানি চালিত স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক অস্ত্র। ‘ওঘাব’র পাল্লা ছিল ৪৫ কিলোমিটার, ‘নাজিয়াত’-এর ১০০ কিলোমিটার। যুদ্ধ ছিল ধ্বংসাত্মক। কিন্তু ইরান পিছু হটেনি।
প্রতিকূলতার মধ্যেও অগ্রগতি
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্য নতুন হুমকি তৈরি হয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্র দেশগুলো ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। নিজেদের রক্ষায় ইরান একটি ভিন্ন কৌশল নেয়। ব্যয়বহুল যুদ্ধজাহাজ বা জেটের বদলে তারা বেছে নেয় স্বল্প খরচের, ব্যাপকভাবে উৎপাদনযোগ্য অস্ত্র। এতে গড়ে ওঠে একটি অসম যুদ্ধের কৌশল।
ইরান দৃষ্টি দেয় ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, জাহাজ-বিধ্বংসী অস্ত্র এবং বহুস্তর প্রতিরক্ষাব্যবস্থার দিকে। ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি তখন প্রাথমিক স্তরে থাকলেও, ১৯৯০-এর দশকে ইরান চীন, উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়া থেকে উন্নত প্রযুক্তি সংগ্রহ করে। পরে সেগুলোর ভিত্তিতে দেশীয় অস্ত্র উদ্ভাবন শুরু হয়। এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ইরান শতাব্দীর শেষ দিকে ‘শাহাব’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘জেলজা’ ভারী রকেট সিরিজ তৈরি করে। এসব অস্ত্র কয়েক শ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম ছিল।
১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে ইরান তৈরি করে মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘শাহাব-৩’। এর পাল্লা ছিল ২ হাজার কিলোমিটার। এতে আশপাশের প্রায় সব বিদেশি সামরিক ঘাঁটি এই ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় চলে আসে। একই সময়ে দেখা যায় নতুন ড্রোনের উদ্ভব। উন্নত ফ্লাইট নিয়ন্ত্রণ ও চলাচলের ক্ষমতা ছিল এসব ড্রোনে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘মোহাজের-২’ ও ‘আবাবিল-২’।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থার পরিবর্তন
নতুন শতাব্দীর শুরুতে ইরান নতুন অস্ত্রব্যবস্থায় বড় অগ্রগতি অর্জন করে। এর কেন্দ্রে ছিল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এই প্রকল্প পরিচালনা করেন হাসান তেহরানি মোকাদ্দাম। তাকে ‘ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির জনক’ বলা হয়। ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর বা আইআরজিসির এই প্রকৌশলী ও সংগঠক ইরানের রকেট উন্নয়নে নেতৃত্ব দেন। তার ভূমিকা অনেকটা জার্মান ও মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রকৌশলী ভন ব্রাউন বা সোভিয়েত রকেট কর্মসূচির সের্গেই করোলেভের মতো।
২০১১ সালে ‘আমির আল-মুমিনিন’ ঘাঁটিতে এক বিস্ফোরণে মোকাদ্দাম তার ১৬ জন সহযোদ্ধাসহ শহিদ হন। তবে তার রেখে যাওয়া দক্ষ প্রকৌশলীদের হাত ধরে কর্মসূচি এগিয়ে যায়। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন থেমে থাকেনি। তখন পর্যন্ত ইরানের প্রধান ব্যালিস্টিক অস্ত্র ছিল শাহাব-৩। এটি বেশ বড় ও ভারী। পরিবহনে অসুবিধাজনক। এতে তরল জ্বালানি ব্যবহৃত হতো। যেটা ভরতে সময় লাগত। এ ছাড়া, লক্ষ্যভেদে সুনির্দিষ্ট ছিল না। বড় ঘাঁটিতে আঘাত হানার জন্য তৈরি হলেও যুদ্ধক্ষেত্রে এটি অনুপযুক্ত ছিল।
শাহাব-৩ ছিল ব্যয়বহুল। উৎপাদন হতো মাত্র কয়েক শ। শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাকা অবস্থায় এই সীমিত অস্ত্র কার্যকর হতো না। এ কারণে ২০০০ দশকের মাঝামাঝি ইরান নতুন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে। এর মধ্যে ছিল গদর-১১০, ফজর-৩, আশুরা ও সাজিল। এই মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো (এমআরবিএম) কঠিন জ্বালানিতে চলে।
ফলে প্রস্তুতির সময় কমে আসে। নির্ভুলতাও বাড়ে। তবে এসব নতুন ক্ষেপণাস্ত্রও আকারে বড় ও ব্যয়বহুল ছিল। পরে ২০১০-এর দশকে ইরান আরও ছোট ও দ্রুত ছোড়া যায় এমন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে। এর ভিত্তি ছিল ফাতেহ-১১০। এটি ছিল স্বল্প পাল্লার কঠিন জ্বালানির ক্ষেপণাস্ত্র। এর প্রাথমিক পাল্লা ছিল ২০০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার।
ফাতেহ-১১০-এর ভিত্তিতে তৈরি হয় আরও উন্নত সংস্করণ। ফাতেহ-৩১৩-এর পাল্লা ৫০০ কিলোমিটার। জোলফাঘরের পাল্লা ৭০০ কিলোমিটার। দেজফুল যেতে পারে ১ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত। সর্বশেষ সংস্করণ খাইবার শেকানের পাল্লা ১ হাজার ৪৫০ কিলোমিটার। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর পাল্লা প্রায় পুরোনো এমআরবিএমের সমান হলেও এগুলো আরও নির্ভুল। এগুলো মোবাইল প্ল্যাটফর্ম থেকে ছোড়া যায়। সহজে পরিবহনযোগ্য। দ্রুত উৎক্ষেপণযোগ্য। যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলগত সুবিধা দেয়। শত্রুর বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এগুলো শনাক্ত ও ধ্বংস করতে কঠিন হয়। এ ছাড়া এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ব্যাপক হারে উৎপাদন করা যায়। ইরান ইতোমধ্যে ভূগর্ভস্থ ঘাঁটিতে এসব ক্ষেপণাস্ত্রের বিশাল মজুতের ভিডিও প্রকাশ করেছে। তা থেকেই স্পষ্ট, ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতে গড়ে তুলেছে শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার।
বিশ্বের শীর্ষ সামরিক শক্তির তালিকায় ইরান
২০১০ সালের মধ্যেই ইরান বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির অধিকারী দেশে পরিণত হয়। বিদেশি সামরিক বিশ্লেষকরা একে বিশ্বের সাতটি সবচেয়ে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির একটি বলে স্বীকৃতি দেন। ব্যালিস্টিক অস্ত্রাগারের আকারের দিক থেকে ইরান ছিল শীর্ষ চার দেশের তালিকায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক চাপ থামেনি। তবে ইরান তার অস্ত্র তৈরি থামায়নি। ওয়াশিংটন চেষ্টা করেছে তেহরানকে উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত রাখতে। তারা রাশিয়াকে ‘এস-৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সরবরাহ না করার জন্য চাপ দেয়।
জার্মানিকে বলা হয় হালকা ড্রোনের মোটর রপ্তানি বন্ধ করতে। চীনকে নিষেধ করা হয় ক্ষেপণাস্ত্রের যন্ত্রাংশ না দিতে। তবে এসব প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ইরান নিজেই প্রতিটি যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি তৈরি শুরু করে। নিষেধাজ্ঞা ঠেকাতে তারা স্বনির্ভরতার পথে হাঁটে। প্রতিরোধ গড়ে তোলে। স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায়। প্রয়োজনীয় উপাদান ঘরে তৈরি করে ইরান আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। এই ধারা অব্যাহত রেখে তারা নিজেদের সামরিক স্বনির্ভরতা জোরদার করে।
দূরপাল্লার জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতেও ইরান অনেকদূর এগিয়ে গেছে। কাদের, গাদির ও ইয়া আলী ক্ষেপণাস্ত্র এই তালিকায় রয়েছে। এ ছাড়া মেশকাত, সৌমার, আবু মাহদি, পাভেহ, হোভেজেহ এবং কাদর-৪৭৪ নামের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যেগুলোর পাল্লা ৩ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত। এই ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির দিক দিয়ে ইরান এখন বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে। শাহেদ ও আরাশ ধরনের ড্রোনও ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই শক্তি আরও জোরদার হয়েছে। ইরান হাইপারসনিক ‘ফাত্তাহ’ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে। তৈরি হয়েছে টার্বোজেটচালিত লোটারিং মিউনিশন ও সুপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র।
ড্রোন শক্তিতেও ইরান এখন অত্যন্ত সক্ষম। ফোট্রোস, কামান-২২, মোহাজের-১০, শাহেদ-১২৯ এবং শাহেদ-১৪৯ গাজার মতো ড্রোন তৈরি হয়েছে, যেগুলোর পাল্লা ক্ষেপণাস্ত্রের সমান। এসব ড্রোন বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র বহনে সক্ষম। সেগুলো দূরপাল্লার মিশনেও ব্যবহৃত হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা ও বাধা অতিক্রম করেও ইরান তার সামরিক শক্তিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও আধুনিক অস্ত্র তৈরিতে দেশটি এখন বিশ্বের অন্যতম অগ্রণী শক্তি।
বিমান প্রতিরক্ষা ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধে দক্ষতা অর্জন
শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে ইরান নিজস্ব রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থার একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। এই ব্যবস্থাগুলো বহুবার ইরানের আকাশসীমায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি ড্রোন ও বিমান অনুপ্রবেশ ব্যর্থ করে দিয়েছে।
শুরুতে ইরান ‘মেরসাদ’ নামের পুরোনো প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা চালু করে। তবে ২০১০ সালের মধ্যে দেশটি নতুন প্রজন্মের অত্যাধুনিকব্যবস্থা তৈরি করে। এর মধ্যে রয়েছে ‘রাদ-২’, ‘তাবাস’, ‘৩ খোরদাদ’, ‘জোশান’ ও ‘কামিন-২’। এ সবই সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত। দূরপাল্লার প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় ইরান ‘বাভার-৩৭৩’ এবং ‘আরমান’ নামের দুটি শক্তিশালী সিস্টেম তৈরি করেছে। এদের পাল্লা ৩০০ কিলোমিটারেরও বেশি। লক্ষ্য শনাক্ত ও ট্র্যাকিং সক্ষমতাও উন্নত। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ব্যবস্থাগুলো এখন বিশ্বের সেরা কিছু প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম। এই সব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ইরানের বিস্তৃত রাডার নেটওয়ার্কের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সমন্বিত। ফলে শুধু আকাশসীমা নয়, আশপাশের অঞ্চলও নজরদারির আওতায় থাকে।
১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে ইরান নানা বাধা মোকাবিলা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির চাপ, অবৈধ নিষেধাজ্ঞা, অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক অবরোধ ইরানকে থামাতে পারেনি। বরং এসব প্রতিকূলতার মধ্যেই দেশটি গড়ে তুলেছে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, রাডার এবং বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বিশাল অস্ত্রাগার।
বিশাল ভূগর্ভস্থ ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি, হাইপারসনিক প্রযুক্তি ও ক্রমেই শক্তিশালী ড্রোন বহরের মাধ্যমে ইরান আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। দেশটি এখন যেকোনো হুমকির বিরুদ্ধে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে প্রস্তুত।
লেখক: প্রেসটিভির সংবাদদতা। লেখাটি প্রেসটিভি থেকে অনুবাদ: এম আর লিটন