
গত ১৩ জুন ইরানে হামলা চালায় ইসরায়েল। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ হামলা চালানো হয় ইরানের অভ্যন্তর থেকেই। যার প্রতিবাদে ইরানও পাল্টা হামলা চালায়। এতে শুরু হয়েছে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ। ইরানে ইসরায়েলের হামলা কয়েক বছরের পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন। যার শুরুটা হয় ইরানের নিরাপত্তাবাহিনীতে ইসরায়েলিদের অনুপ্রবেশ দিয়ে। এ ছাড়া স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে ইরানের অভ্যন্তরে অস্ত্র চোরাচালান ও অস্ত্র উৎপাদন ছিল এ পরিকল্পনার অংশ।
এসব তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশের মাধ্যমে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইরানের ভেতর থেকেই ঘুণ ধরায় ইসরায়েল, তারপর এক সময় সেটি ভেঙে ফেলার জন্য সক্রিয় হয়।
প্রায় ১ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত ইসরায়েল ইরানের ওপর স্থলপথে হামলা চালায়।
বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাবমেরিন বিধ্বংসী ব্যবস্থা, ক্ষেপণাস্ত্রের ভাণ্ডার ছিল তাদের হামলার নিশানা। এ ছাড়া ইরানের কমান্ড সেন্টার, নির্বাচিত ব্যক্তিবিশেষকে লক্ষ্য করে একযোগে হামলা চালানো হয়েছিল। একমাত্র সে দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমেই এ ধরনের সুপরিকল্পিত এবং নিখুঁত হামলা চালানো সম্ভব।
তবে এই পুরো ঘটনায় ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ভূমিকা কতটা ছিল তা এখনো স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হচ্ছে মোসাদ নয়, ইরানে চালানো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অন্য গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত।
ইরানের অভ্যন্তরে অস্ত্র চোরাচালান, সমাবেশ ও অস্ত্র উৎপাদন
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েল শুধু ইরানের সংবেদনশীল তথ্য সংগ্রহ করা নয়, ইরানের মাটিতে আক্রমণাত্মক অস্ত্র তৈরি ও মোতায়েনের জন্য একটা সংগঠিত ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলেছিল।
অভিযোগ রয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্থানীয় এজেন্টের নেটওয়ার্ক ও নিজেদের পরিবহনব্যবস্থা তৈরি করে তাদের গোপন কর্মকাণ্ড দীর্ঘ দিন ধরে চলেছে।
আর এই প্রস্তুতির ভিত্তিতেই সাম্প্রতিক হামলার ভিত্তি স্থাপন হয়েছে। সামরিকবিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘দ্য ওয়ার জোন’ এবং অন্য সূত্রের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ইসরায়েল অল্প অল্প করে সংবেদনশীল ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র সরঞ্জাম ইরানে চোরাচালান করেছে। আর এ জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, ইরাকের মধ্য দিয়ে যাওয়া ট্রাক, বাণিজ্যিক কনটেইনার এবং যাত্রী স্যুটকেস। এসবের মধ্যে বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে রেখে সেগুলো ইরানে আনা হয়েছে।
এই ডিভাইসগুলোর মধ্যে বৈদ্যুতিক ফিউজ, উন্নত ইলেক্ট্রো-অপটিক্যাল ক্যামেরা, লিথিয়াম ব্যাটারি, হালকা ওজনের ইঞ্জিন, জিপিএস-ভিত্তিক গাইডেন্স সিস্টেম এবং সুরক্ষিত যোগাযোগ ডিভাইস অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। এই সব যন্ত্রাংশ পরে ইরানের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা মোসাদের গোপন ঘাঁটিতে নিয়ে গিয়ে একত্রিত করে তাকে আক্রমণাত্মক অস্ত্রের আকার দেওয়া হয়েছে।
ইরানের বার্তা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, মোসাদের সদস্যরা গত কয়েক বছর ধরে ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে গোপন ডেরা তৈরি করেছিল। তেহরানের কাছে এমনই এক তিনতলা ভবনের সন্ধান পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ওই ভবন ছিল আত্মঘাতী ড্রোন তৈরি ও সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা ঘাঁটি। ওই ভবনের একটি ঘরের টেবিল এবং তাকের ওপরে অন্তত একটি ড্রোন, ড্রোন প্রপেলার, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ এবং সেটিকে কন্ট্রোল করার সরঞ্জাম রাখা ছিল। সেখানে একটি থ্রিডি প্রিন্টারও পাওয়া গেছে। এ ধরনের থ্রিডি প্রিন্টার ইউক্রেনে ড্রোনের যন্ত্রাংশ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে।
ইরানের পুলিশের এক মুখপাত্র জানান, তেহরানের একটা এলাকায় দুটো পৃথক অভিযানে মোসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুজন ‘এজেন্টকে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে ২০০ কেজির বেশি বিস্ফোরক, ২৩টা ড্রোনের যন্ত্রাংশ, লঞ্চার, কন্ট্রোল সিস্টেম এবং একটা নিশান গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া ইস্ফাহানে যেখানে ইরানের সবচেয়ে স্পর্শকাতর পরমাণু স্থাপনা রয়েছে, সেখানে এক কর্মশালায় অভিযান চালিয়ে বিপুল সংখ্যক ড্রোন এবং মাইক্রো-ড্রোন তৈরির সরঞ্জাম এবং যন্ত্রাংশ জব্দ করা হয়। এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে চারজনকে ইতোমধ্যে আটক করা হয়েছে।
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নষ্ট করা
ইসরায়েল ইরানের ওপর বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ শুরুর আগে তাদের (ইরানের) আকাশ প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ককে নিষ্ক্রিয় করতে সমন্বিত হামলা চালায়। এ হামলায় ছোট আত্মঘাতী ড্রোন, ইরানের মাটিতে মোতায়েন করা গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। এগুলোর সম্মিলিত ব্যবহারের লক্ষ্য ছিল ইরানের রাডার সিস্টেমকে ব্যর্থ করে দেওয়া এবং ডিফেন্স মিসাইল লঞ্চ প্ল্যাটফর্মকে ধ্বংস করা। হামলা চালানোর জন্য ইসরায়েল যেন একটা নিরাপদ করিডর পেয়ে যায়।
ধারণা করা হচ্ছে, হামলার শুরুতে ছোট এবং হালকা কোয়াডকপ্টারের মতো ড্রোন এবং মাইক্রো-ড্রোনের মাধ্যমে একযোগে সক্রিয় করা হয়েছিল। এসব ড্রোন গত কয়েক মাসে ইরানের বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ইরানে হামলার প্রথম দিনই একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জানায়, মোসাদ কমান্ডোরা ইরানি ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছে এবং ইরানি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চারপাশে নির্ভুল-নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে। সমন্বিত এসব আক্রমণ কেবল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যই নয়, বরং ইরানের প্রাথমিক উৎক্ষেপণ ক্ষমতা ধ্বংস করার জন্যও তৈরি করা হয়েছিল। অর্থাৎ ইসরায়েল প্রথমে যুদ্ধবিমান দিয়ে নয়, বরং ইরানের মাটিতে লুকানো ডিভাইস দিয়ে আক্রমণ করেছিল।
স্মার্ট অস্ত্রের ব্যবহার
ইসরায়েল ইরানের মাটিতে হালকা ওজনের, নির্ভুল ও রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে কাজ করে এমন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এই ধরনের আধুনিক ও বিশেষ প্রযুক্তিতে তৈরি অস্ত্র কোনো অপারেটরের উপস্থিতি ছাড়াই ইরানের ভেতর থেকে নিক্ষেপ করা যায়।
ইরানের ইংরেজি নিউজ চ্যানেল প্রেস টিভি জানায়, ইরানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এমন ধরনের স্পাইক মিসাইল লঞ্চার উদ্ধার করেছে, যেগুলো ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে লক্ষ্যবস্তু হিসাবে নিশানা করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিল। এই সিস্টেমগুলো ইন্টারনেট-অটোমেশন এবং রিমোট কন্ট্রোল দ্বারা সজ্জিত ছিল। আর মোসাদের এজেন্টরা এই সিস্টেমগুলো পরিচালনা করছিল। এই লঞ্চারগুলো ইলেক্ট্রো-অপটিক্যাল গাইডেন্স সিস্টেম, অত্যাধুনিক ক্যামেরা এবং স্যাটেলাইট যোগাযোগ অ্যান্টেনা দিয়ে সজ্জিত। তাই দূর থেকেই কমান্ড (নির্দেশ) নিতে পারে এই ডিভাইস।
স্মার্ট অস্ত্র ব্যবহার করায় ইরান নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মকর্তা এমনকি জনসাধারণকেও মোবাইল ফোন, স্মার্ট ওয়াচ বা ল্যাপটপের মতো নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ডিভাইস ব্যবহার না করার বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়। সবাইকে এসব ডিভাইস ব্যবহার কমিয়ে ফেলার কথা বলা হয়।
টার্গেটেড কিলিং এবং কমান্ড সিস্টেমের ক্ষতি
ইসরায়েল ইরানের সামরিক বাহিনী ও রেভল্যুশনারি গার্ডকে দুর্বল করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিত্বদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নিশানা করে। মোসাদ ও তার মিত্ররা গোপন তথ্য ও স্মার্ট অস্ত্রের সাহায্যে ইরানের কমান্ড সিস্টেম ভাঙার চেষ্টা করে। শুরুর দিকে কয়েকটা হামলায় সামরিক ঘাঁটি বা ক্ষেপণাস্ত্র প্ল্যাটফর্মকে নিশানা করা হয়নি বরং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাড়িতে বা অফিসে হামলা চালানো হয়েছিল। ইরানের মাটি থেকেই স্পাইক মিসাইল লঞ্চার দিয়ে এসব হামলা চালানো হয়েছিল। এই জাতীয় ক্ষেপণাস্ত্র ভবনের ভেতরে থাকা মানুষকেও সরাসরি নিশানা করতে পারে।