
দুঃসাহস, নির্মমতা ও ভাগ্যের এক মিশ্রণে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরায়েল ও এর আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের মধ্যকার শক্তির ভারসাম্য ওলট-পালট করে দিয়েছেন। তবে তার সবচেয়ে বড় সাফল্য হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর পূর্ণ শক্তি দিয়ে তেহরানে হামলার প্রয়োজনীয়তায় রাজি করানো।
টাইমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনায় যুক্ত দুই ইসরায়েলি কর্মকর্তার মতে, ট্রাম্পকে নিজেদের পক্ষে আনার নেতানিয়াহুর সাফল্য কৌশলগত কয়েকটি সিদ্ধান্তের ফল। এর শুরু হয় ৪ ফেব্রুয়ারি। যখন দ্বিতীয় দফায় ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর নেতানিয়াহু প্রথমবারের মতো হোয়াইট হাউসে যান। কেবিনেট রুমে দীর্ঘ টেবিল ঘিরে বসে নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে মনে করিয়ে দেন, ইরান তার (নেতানিয়াহুর) বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্র করেছিল।
এরপর তিনি একটি বিশদ স্লাইড উপস্থাপন করেন, যেখানে দেখানো হয় উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়াম মজুত ও সেন্ট্রিফিউজ প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে ইরান কীভাবে ধীরে ধীরে পারমাণবিক সীমা অতিক্রমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
নেতানিয়াহু বলেন, দেখুন ডোনাল্ড, এটা থামাতে হবে। কারণ ওরা খুব দ্রুত এগোচ্ছে। এরপর তিনি নাটকীয় বিরতি নিয়ে ট্রাম্পের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আপনার আমলে পারমাণবিক ইরান হতে দেওয়া যাবে না।’
এতে ট্রাম্প কিছুটা প্রভাবিত হন। কিন্তু তখনো তিনি সরাসরি ইসরায়েলি হামলায় সম্মতি দেননি। ট্রাম্প বলেন, তিনি প্রথমে কূটনীতির চেষ্টা করতে চান। তিনি তো নির্বাচিত হয়েছিলেন যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, নতুন যুদ্ধ শুরুর জন্য নয়। এ জন্য তিনি তার পুরোনো বন্ধু, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী স্টিভ উইটকফকে তেহরানের সঙ্গে সমঝোতার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। এ পর্যায়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে কিছু সময় দেন সমঝোতার সম্ভাবনা যাচাই করতে। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের টিম ৬০ দিনের একটি কাঠামো ঠিক করে আলোচনা এগিয়ে নিতে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেন, এই সময়সীমা পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে যাওয়াই কৌশলগত ছিল, কারণ ইরান যখন সময়সীমা অতিক্রম করে, তখন ট্রাম্প ইসরায়েলের সামরিক পরিকল্পনার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন। ‘এটা ট্রাম্পকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমাদের কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ নেই,’ ওই কর্মকর্তা টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন। এটাই ইসরায়েলিদের দাবি। তবে ট্রাম্প এখনো তার অবস্থান পরিবর্তনের পেছনের ব্যাখ্যা পুরোপুরি দেননি। যেখানে তেহরান আক্রমণে সরাসরি অংশগ্রহণকারী হয়ে ওঠেন।
হোয়াইট হাউস বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে, ট্রাম্প স্বীকার করেন যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলাকালে তিনি নেতানিয়াহুকে সামরিক পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে নেতানিয়াহু পুরোমাত্রার হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। তার কিছু সহায়তাও ছিল। ৩১ মে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা জানায়, ইরান তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম গোপন করছে, যা ২০১৯ সালের একটি চুক্তির লঙ্ঘন। এরপর ইসরায়েলিরা ট্রাম্পকে এমন গোয়েন্দা তথ্য দেয়, যা তাদের মতে প্রমাণ করে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উপকরণ সংগ্রহ করছে এবং আলোচনার মাধ্যমে সময় নষ্ট করছে। একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ওরা স্টিভের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ ব্যবহার করে এমন অবস্থানে যেতে চাচ্ছিল, যেখানে তারা বলতে পারবে, ‘আমরা প্রস্তুত, মাত্র এক দিন বাকি।’
ইউএস গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশ্বাস করে- জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড মার্চে কংগ্রেসকে বলেন, তেহরান এখনো পারমাণবিক বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়নি। কিন্তু ট্রাম্পের ৬০ দিনের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ট্রাম্পের হতাশাকে কাজে লাগান। তারা বলেন, ইরান কয়েক মাসের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র পেতে পারে। তারা আমেরিকানদের জানান, ইসরায়েল ভোরবেলায় ইরানি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাবে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইরান পাল্টা হামলা করে, কেন্দ্রীয় ইসরায়েলে তিনজন বেসামরিক মানুষ নিহত হন। তবে দ্রুতই ইসরায়েল ইরানের আকাশসীমার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আইডিএফের মুখপাত্র মাস্কা মিশেলসন বলেন, ‘মাত্র দুই দিনেই আমরা ওদের এক-তৃতীয়াংশ অস্ত্রভান্ডার ধ্বংস করেছি।’
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা আশা করেন, তেহরান আবার আলোচনায় ফিরে আসবে ও স্থায়ীভাবে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতে রাজি হবে। তবে ট্রাম্পের কিছু মিত্র, যেমন স্টিফেন ব্যানন ও টাকার কার্লসন আশঙ্কা করছেন, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে টেনে নিয়েছে।
এদিকে ইসরায়েলের চূড়ান্ত লক্ষ্য এখনো স্পষ্ট নয়। নেতানিয়াহু বলেছেন, তার লক্ষ্য সরকার পরিবর্তন নয়, তবে সেটাও হতে পারে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারাও জানেন না শেষ পর্যন্ত কী হবে। তবে তারা আরও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ইসরায়েলের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি চমক দেখিয়েছি। সম্ভবত আরও কিছু চমক আমাদের হাতের মুঠোয় আছে।’
বস্তুত, এটা পরিষ্কার যে ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে ট্রাম্পকে রাজি করাতে সফল হয়েছেন নেতানিয়াহু।