
ইউরোপের তরুণদের বড় অংশ গণতন্ত্রে আস্থা হারাচ্ছে। ফ্রান্স, স্পেন ও পোল্যান্ডে অর্ধেকেরও কম তরুণ গণতন্ত্রকে সেরা শাসনব্যবস্থা মনে করেন। অনেকেই কর্তৃত্ববাদ সমর্থন করছেন। তরুণদের দৃষ্টিতে ইউরোপ দুর্বল হচ্ছে। তারা পরিবর্তন চান, কিন্তু কেমন হবে, তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় এমনটাই উঠে এসেছে।
জার্মানির বার্লিন ফ্রি ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী থর্স্টেন ফাস বলছেন, ‘গণতন্ত্র এখন চাপের মুখে, ভেতর থেকেও, বাইরে থেকেও।’ তিনি বলেন, ‘যেসব তরুণ নিজেদের রাজনৈতিকভাবে ডানপন্থি এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক মনে করেন, তাদের মধ্যে মাত্র একজন গণতন্ত্রকে সমর্থন করেন।’
গবেষণায় দেখা গেছে, ইউরোপের জেনারেশন জেড তরুণদের মাত্র ৫৭ শতাংশ গণতন্ত্রকে অন্য যেকোনো শাসনব্যবস্থার চেয়ে ভালো মনে করেন। জার্মানিতে এই হার সবচেয়ে বেশি, ৭১ শতাংশ। কিন্তু ফ্রান্স ও স্পেনে মাত্র ৫১ থেকে ৫২ শতাংশ। পোল্যান্ডে মাত্র ৪৮ শতাংশ তরুণ গণতন্ত্রকে সমর্থন করেন।
তরুণদের একাংশ নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে ভালো মনে করেন। ইউরোপজুড়ে প্রতি পাঁচজনে একজন, ২১ শতাংশ এমন মত দিয়েছেন। ইতালিতে এই হার সবচেয়ে বেশি, ২৪ শতাংশ। জার্মানিতে সবচেয়ে কম, ১৫ শতাংশ। ফ্রান্স, স্পেন ও পোল্যান্ডে এই সংখ্যা ২৩ শতাংশ।
জরিপে প্রায় ১০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, দেশ গণতান্ত্রিক কি না, তা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১৪ শতাংশ জানেন না বা উত্তর দেননি। গবেষণাটি এপ্রিল ও মে মাসে ইউগভ ইনস্টিটিউট পরিচালনা করে। এতে ইউরোপের সাত দেশের (ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, গ্রিস ও পোল্যান্ড) ১৬ থেকে ২৬ বছর বয়সী ৬ হাজার ৭০০ তরুণ অংশ নেন। গবেষণাটি করেছে টুই ফাউন্ডেশন। যারা ইউরোপের তরুণদের জন্য নানা প্রকল্পে অর্থায়ন করে থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ইউরোপের তরুণদের ৪৮ শতাংশ মনে করেন, তাদের দেশের গণতন্ত্র বিপন্ন। এমনকি জার্মানির মতো দেশে এই হার ৬১ শতাংশ। যেখানে দেশটির অর্থনীতি মন্দা এবং কট্টর ডানপন্থিদের সমর্থন বেড়েছে।
জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের অনেকেই মনে করেন, ইউরোপ আর আগের মতো শক্তিশালী নয়। ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন, চীনের উত্থান ও ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ আক্রমণ ইউরোপের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে, এমন ধারণা ক্রমে বাড়ছে। শুধু ৪২ শতাংশ উত্তরদাতা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বিশ্বের তিনটি প্রধান শক্তির মধ্যে গণ্য করেছেন।
তবে ব্রিটিশদের মধ্যে এই বিশ্বাস বেশি। ব্রেক্সিটের পরেও ৫০ শতাংশ ব্রিটিশ তরুণ মনে করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনো শীর্ষ তিন শক্তির একটি। ব্রিটিশ তরুণদের ৭৩ শতাংশ ইইউতে ফিরে যেতে চান। অন্যদিকে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক তরুণ ৪৭ শতাংশ, ব্রিটেন ও ইইউর মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক চান। জরিপে ৮৩ শতাংশ তরুণ যুক্তরাষ্ট্রকে শীর্ষ শক্তির একটি হিসেবে দেখেছেন। এরপর চীন (৭৫ শতাংশ) ও রাশিয়া (৫৭ শতাংশ)।
গবেষণায় দেখা গেছে, ইউরোপীয় তরুণদের রাজনৈতিক অবস্থানেও মেরূকরণ বাড়ছে। ২০১৯ সালের তুলনায় এখন অনেকেই নিজেদের রাজনৈতিক মতবাদ স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করছেন। ১৯ শতাংশ তরুণ নিজেদের ‘মধ্যপন্থি’ বলে দাবি করেছেন। যেটা ২০২১ সালে ছিল ১৪ শতাংশ। এখন ৩৩ শতাংশ মধ্যপন্থি, ৩২ শতাংশ বামপন্থি। ১৬ শতাংশ তরুণ কোনো পক্ষে অবস্থান না নেওয়ার কথা বলছেন।
রাজনীতিতে এই বিভাজনের মধ্যে একটি লিঙ্গভিত্তিক ব্যবধানও দেখা যাচ্ছে। জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির তরুণী ভোটাররা আগের চেয়ে বেশি প্রগতিশীল হলেও পোল্যান্ড ও গ্রিসের তরুণ পুরুষরা হয়ে উঠছেন আরও রক্ষণশীল।
২০২১ সালের তুলনায় অভিবাসনের ওপর কড়াকড়ির প্রতি সমর্থন বেড়েছে। তখন যেখানে ২৬ শতাংশ তরুণ কঠোর নীতির পক্ষে ছিলেন, এখন তা বেড়ে ৩৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে তরুণদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র অনুভূতি। অধিকাংশ তরুণ এখনো ইইউকে সমর্থন করেন। প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন এর পক্ষে। তবে ৩৯ শতাংশ তরুণ মনে করেন, ইইউ ‘বিশেষভাবে গণতান্ত্রিক নয়’। মাত্র ৬ শতাংশ তরুণের মতে, তাদের জাতীয় সরকার ভালোভাবে চলছে। তারা মনে করেন, বড় কোনো পরিবর্তনের দরকার নেই।
তবে ইইউকে নিয়ে বিরক্তিও আছে। ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, ইইউ তুচ্ছ ও খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। তাদের প্রত্যাশা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেন জীবনযাত্রার উচ্চব্যয়, বহিরাগত হুমকি ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এগিয়ে আসে। তরুণদের বড় একটি অংশ চান, ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত হোক, যেন কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ে।
টুই ফাউন্ডেশনের প্রধান এলকে হ্লাওয়াতশেক বলেন, ‘যে ইউরোপীয় প্রকল্প গত কয়েক দশকে আমাদের শান্তি, চলাফেরার স্বাধীনতা আর অর্থনৈতিক অগ্রগতি দিয়েছে। আজ সেটিকেই অনেক তরুণ অসহনীয় মনে করছেন।’
সবচেয়ে বেশি হতাশা দেখা গেছে গ্রিসে। দেশটির তরুণরা রাজনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার চান। ইইউ নিয়ে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সন্দেহ আছে। থর্স্টেন ফাস বলেন, ‘গ্রিসের তরুণদের মধ্যে এই মনোভাব ইউরোজোনের ঋণ সংকটের দীর্ঘস্থায়ী আঘাতের ফল।’
জলবায়ু নিয়ে তরুণদের আগ্রহ থাকলেও অর্থনৈতিক বাস্তবতা তাদের অগ্রাধিকার পাল্টে দিচ্ছে। এখন মাত্র এক-তৃতীয়াংশ তরুণ মনে করেন, জলবায়ু সুরক্ষা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালে এই হার ছিল ৪৪ শতাংশ।
এসব পরিসংখ্যানই দেখাচ্ছে, ইউরোপের তরুণদের মধ্যে গণতন্ত্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও দ্বিধা বাড়ছে। পরিবর্তনের প্রয়োজন তারা বুঝছেন। কিন্তু ওই পরিবর্তন কেমন হবে, তা নিয়ে এখনো অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান