
ইসরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক যুদ্ধের পরও তেহরান তার পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে অটল বলে মনে হচ্ছে। শাহ শাসন আমলে মার্কিন সহায়তায় শুরু হওয়া পারমাণবিক কর্মসূচি এক সময় দেশটির শক্তি প্রদর্শনের প্রতীক ছিল। কিন্তু এখন এটি ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর স্থিতিস্থাপকতারও প্রতীক।
সম্প্রতি মার্কিন ও ইসরায়েলি বিমান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে তেহরান আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (IAEA) সাথে তার সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছে।
ইরান বলছে, ‘যতক্ষণ না ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ইরান IAEA-কে সহযোগিতা করা স্থগিত রাখবে।’ গত সপ্তাহে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সংদের স্পিকার মোহাম্মদ বাঘের গালিবাফ জানান, মাসুদ পেজেশকিয়ান বুধবার (২ জুলাই) এই পদক্ষেপে স্বাক্ষর করেছেন।
তবে, ১২ দিনের সংঘাতের সময় ইরানে অবস্থানরত আইএইএ পরিদর্শকদের উপর এই সিদ্ধান্তের কেমন প্রভাব পড়বে তা এখনও জানা যায়নি। ভিয়েনা-ভিত্তিক জাতিসংঘের এই সংস্থাটি ইসরায়েল এবং মার্কিন হামলার শিকার ইরানের তিনটি শীর্ষ পারমাণবিক স্থাপনা- ফোর্দো, ইসফাহান এবং নাতানজে - এর অবস্থা সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ করতে চাচ্ছে। এছাড়া, ইরানের স্থাপনাগুলোতে আঘাত করার পর, এটিও এখন আর স্পষ্ট নয় যে, বিশ্বব্যাপী অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ভিত্তি, বিস্তাররোধক চুক্তিতে (এনপিটি) থাকতে ইরান ইচ্ছুক কিনা।
ইরানে ইসরায়েলি হামলার আগেই, আইএইএ সতর্ক করে , ইরানই একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন দেশ যারা প্রায় অস্ত্র-গ্রেড স্তরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে এবং তাদের কাছে বেশ কয়েকটি পারমাণবিক বোমা তৈরির পর্যাপ্ত উপাদান রয়েছে। তবে, একই সময়ে, আইএইএ জোর দিয়ে এ-ও বলেছে যে, তাদের কাছে ‘পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য পদ্ধতিগত প্রচেষ্টার কোনও প্রমাণ’ নেই।
তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির দীর্ঘ এবং জটিল ইতিহাস ১৯৫০ এর দশকে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির সময় থেকে শুরু হয়। মার্কিন-সমর্থিত রেজা পাহলভি মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ারের ‘শান্তির জন্য পরমাণু’ নামে পরিচিত একটি উদ্যোগে যোগদানের মাধ্যমে বেসামরিক পারমাণবিক প্রযুক্তিতে প্রবেশ করে।
মূলত ইরান তার নিজস্ব পারমাণবিক কর্মসূচির ভিত্তি তৈরি করার জন্য এই প্রস্তাবের সুযোগ নিয়েছিল। এরপর, ১৯৫৮ সালে তেহরান আইএইএ-তে (IAEA) যোগ দেয়।
ইরান শুরুতে পারমাণবিক কর্মসূচিকে একটি মর্যাদাপূর্ণ প্রকল্প হিসেবেই দেখতো। তেল ও গ্যাসের ব্যবহারও কমানোর পাশাপাশি দেশটি তার বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে এবং বিদেশী সরবরাহকারীদের সহযোগিতায় স্বাধীনভাবে নিজস্ব পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন করতে চেয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে, ১৯৭০ সালে, ইরান পরমাণু বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যা IAEA-এর তত্ত্বাবধানে বেসামরিকভাবে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব ইরানকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলে দেয়। এসময় আমেরিকা তেহরানের গবেষণা চুল্লিতে পারমাণবিক জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ১৯৮০ সালে, ইরাক ইরানের তেলক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য আক্রমণ করে, যার ফলে আট বছর ধরে যুদ্ধ শুরু হয়। জার্মান সহ পশ্চিমা কোম্পানিগুলি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে তাদের সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়।
১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে, গুজব ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে যে, ইরাক পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। ইসরাইল, যারা ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের শাসনকে ইরানি ধর্মীয় নেতাদের চেয়ে বেশি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করত, তারাই ১৯৮১ সালে ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিতে বোমা হামলার জন্য ইরানের দেয়া গোপন তথ্য কাজে লাগায়।
এরপর, ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এবং নিজস্ব পারমাণবিক জ্বালানি তৈরির জন্য পাকিস্তান, চীন এবং রাশিয়া থেকে প্রযুক্তি আমদানি শুরু করে। ইরানের শাসকগোষ্ঠী আশা করতে শুরু করে যে, তারা প্রমাণ করবে যে ইরান উচ্চ প্রযুক্তির প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম, এবং এর পারমাণবিক কর্মসূচি ইরানি জাতির শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির জনক হিসেবে পরিচিত আকবর এতেমাদ বিশ্বাস করতেন যে, অন্য দেশগুলো কীভাবে তাদের পারমাণবিক নীতি অনুসরণ করবে তা নির্ধারণ করার অধিকার কোনও দেশের নেই। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পরে তিনি সেই অবস্থান থেকে বের হয়ে আসেন।
সাম্প্রতিক ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত ইরানের পারমাণবিক সংস্থার নেতৃত্বদানকারী ফেরেদুন আব্বাসিও প্রকাশ্যে বলেন যে, 'সরকার যদি চায় তবে ইরানকে দ্রুত অস্ত্র-গ্রেড সমৃদ্ধকরণের স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। এর আগেও জরুরি পরিস্থিতিতে তেহরানেরও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা রয়েছে, এই সত্যটি ইরানি কর্মকর্তারা কখনও অস্বীকার করেননি।'
'আরও ভালো চুক্তি করতে' ট্রাম্পের বৃথা আশা
২০০৩ সালে আইএইএ পরিদর্শক এবং স্যাটেলাইট নজরদারি ইরানের গোপন সামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি অনুসরণের ইঙ্গিত দেয়। তৎকালীন জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জোশকা ফিশার, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের তার প্রতিপক্ষদের ইরানের সাথে আলোচনা শুরু করতে রাজি করান, যার লক্ষ্য ছিল IAEA-এর সহায়তায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা।
দীর্ঘ ১২ বছর ধরে আলোচনার পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং তিনটি ইউরোপীয় শক্তি ইরানের সাথে একটি বিস্তৃত পারমাণবিক চুক্তিতে পৌঁছেছে যা JCPOA নামে পরিচিত।
তবে, ২০১৮ সালে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি আরও ভালো চুক্তি অর্জনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে সেই চুক্তি থেকে সরিয়ে নেন। ইরান ধীরে ধীরে তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যায় এবং ২০১৯ সালে উচ্চ-স্তরের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করে।
বর্তমানে, ইরানে প্রায় ৪০০ কিলোগ্রাম (৮৮০ পাউন্ডেরও বেশি) উচ্চ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে এবং তেজস্ক্রিয় উপাদান প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য অনেক উন্নত সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহৃত হয়।
ইরানের জন্য শিক্ষা হিসেবে লিবিয়া
যুক্তরাষ্ট্র যতই দাবি করুক যে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এখন বিলুপ্ত কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে বলেছেন যে, ইরান তার পারমাণবিক স্থাপনা পুনর্নির্মাণ করছে দ্বিগুণ আকারে।
ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরিতে অবস্থিত মিডলবেরি ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ বিশেষজ্ঞ জেফ্রি লুইস বলেন, ‘ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি পুনরায় চালু করার এবং পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা ধরে রেখেছে।’
লুইস খুব জোর দিয়ে বলেন যে ‘এমন অনেক স্থাপনা আছে যেখানে বোমা হামলা হয়নি।’ এছাড়া নিকট ভবিষ্যতে ইরানের আপস করার সম্ভাবনা খুবই কম।
কেলসি ডেভেনপোর্টের মতে, ভবিষ্যতে ইরানের দৃষ্টিভঙ্গি লিবিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মতো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইরান সম্ভবত লিবিয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের সংকল্প দৃঢ করেছে, যেখানে মুয়াম্মার গাদ্দাফি দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি ত্যাগ করেন, এনপিটিতে ভালো অবস্থানে ফিরে আসেন। কিন্তু পরে তিনি পশ্চিমা-সমর্থিত শক্তির হাতেই উৎখাত হন।
অন্যদিকে, উত্তর কোরিয়া ২০০৩ সালে পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি ত্যাগ করে, তাদের নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে এবং সেই সরকার - এখন কিম জং উনের নেতৃত্বে - দৃঢ়ভাবে ক্ষমতায় রয়েছে।
সুলতানা দিনা/