সম্প্রতি চীনের একদল বিজ্ঞানী ধানের বিবর্তনের ১ লাখ বছরের অবিশ্বাস্য ইতিহাস উন্মোচন করেছেন। তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, কীভাবে বন্য উদ্ভিদ থেকে চাষের ফসলে রূপান্তরিত হয়েছে ধান। সম্প্রতি বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় ধানের বিবর্তন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ এ তথ্য উঠে এসেছে। যেখানে ধান কীভাবে ক্রমাগত বিবর্তিত হয়েছে, যা মানবসমাজের বিকাশ ও কৃষির উৎপত্তি সম্পর্কে নতুন ধারণা দিয়েছে।
গবেষণায় নিশ্চিত করা হয়েছে, চাষের ধান ‘ওরিজা স্যাটিভা’-এর জন্মভূমি চীন। চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেস (আইজিজিএসিএএস) ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জিওলজি ও জিওফিজিক্স ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণা দল ঝেজিয়াংয়ের শাংশান সাংস্কৃতিক এলাকায় গবেষণাটি পরিচালনা করেছে।
তাদের আবিষ্কার বিশ্বব্যাপী কৃষির উৎপত্তিতে শাংশান সংস্কৃতির গুরুত্ব তুলে ধরেছে। মানুষের জীবনযাপন শিকার ও সংগ্রহ থেকে কৃষিক্ষেত্রে স্থানান্তরের মাধ্যমে মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়েছে। কারণ বর্তমানে বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যার প্রধান খাদ্য ধান, যা চীনা সভ্যতার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
কখন ও কীভাবে মানুষ বন্য ধান ঘরে তুলতে শুরু করেছে, এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে। ধানের উৎপত্তির বিষয়টি গত শতাব্দীতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল। ১৯৭০ এর দশকে চীনের ইয়াংসি নদী অঞ্চলের হেমুডু ও শাংশানের মতো স্থানে আবিষ্কারের মাধ্যমে, বিজ্ঞানীরা অঞ্চলটিকে ধানের উৎপত্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
প্রাচীন নমুনায় বন্য ও চাষাবাদের ধানের মধ্যে পার্থক্য করা, এই গবেষণার প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল। আইজিজিএসিএএসের ড. লু হুয়ুয়ান ও তার দল বছরের পর বছর ধরে ধানের ‘ফাইটোলিথ’ পর্যবেক্ষণ করেছেন। এই ফাইটোলিথগুলো গাছপালায় পাওয়া ক্ষুদ্র সিলিকা কণিকা।
তারা এ গবেষণায় খুঁজে পেয়েছেন, ধানের ‘বুলিফর্ম’ কোষ মাছের আঁশের মতো বিভিন্ন ফাইটোলিথের আকার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ধান আবাদি হয়েছে। এই তথ্যের সাহায্যে গবেষকরা বন্য ও চাষের ধানের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। ধানের ফাইটোলিথ বিশ্লেষণের সঙ্গে তারা আরও কিছু কৌশল যেমন- পরাগ ও কাঠকয়লার বিশ্লেষণ, মাটি পরীক্ষা, শস্যের দানার আকার পরীক্ষা ও প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সম্মিলিত পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে চীনের পুজিয়াং প্রদেশের শাংশান সাইট ও লংইউ প্রদেশের হেহুয়াশান সাইট পরীক্ষা করেছেন।
এই স্থানগুলো বিশ্লেষণ করে গবেষকরা প্রায় ১ লাখ বছরের একটি ধারাবাহিক সময়রেখা তৈরি করেছেন। গবেষণায় ইঙ্গিত মিলেছে, প্রায় ১ লাখ বছর আগে ইয়াংসি অঞ্চলে বন্য ধানের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। প্রায় ২৪ হাজার বছর আগে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্ভবত মানুষ বন্য ধান সংগ্রহ শুরু করে। প্রায় ১৩ হাজার বছর আগে মানুষ বন্য ধানের প্রাক-চাষাবাদ শুরু করে। ১১ হাজার বছর পর চাষের আরও বেশি সাধারণ হয়ে ওঠে, যা পূর্ব এশিয়ায় ধান চাষের শুরুকে চিহ্নিত করে।
এই গবেষণায় আরও উঠে আসে, কৃষিতে পূর্ব এশিয়ায় ধান ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় প্রায় একই সময়ে গড়ে উঠেছিল। এই গবেষণা বিশ্বব্যাপী কৃষি কীভাবে শুরু হয়েছিল সে সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করেছে এবং ধান, জলবায়ু, মানুষের কার্যকলাপ ও সাংস্কৃতিক বিকাশের মধ্যে জটিল সম্পর্ককে তুলে ধরেছে।