বিশ্বব্যাপী ধূমপান না করেও ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ রোগের অন্যতম কারণ হতে পারে বায়ুদূষণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ক্যানসার গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের (আইএআরসি) মতে, কখনো সিগারেট বা তামাক সেবন না করেও ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা এখন ঘটছে। ফুসফুসের ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী ক্যানসারজনিত মৃত্যুর পঞ্চম সর্বোচ্চ কারণ।
বায়ুদূষণ ও অ্যাডেনোকার্সিনোমা বাড়াচ্ছে ঝুঁকি
ধূমপান না করা ব্যক্তিদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অ্যাডেনোকার্সিনোমা নামে এক ধরনের ক্যানসার দেখা যায়। বিশ্বজুড়ে পুরুষ ও নারীদের মধ্যে এই ক্যানসার ক্রমশ বাড়ছে। সম্প্রতি ল্যানসেট রেসপিরেটরি মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত আইএআরসির গবেষণা অনুসারে, ২০২২ সালে বায়ুদূষণের কারণে প্রায় ২ লাখ মানুষ অ্যাডেনোকার্সিনোমায় আক্রান্ত হয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে চীনে বায়ুদূষণের কারণে অ্যাডেনোকার্সিনোমার হার সবচেয়ে বেশি ছিল।
ফুসফুসের ক্যানসার শনাক্ত ও ঝুঁকি কমানোর তাগিদ
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক সাক্ষাৎকারে আইএআরসির ক্যানসার সার্ভিল্যান্স শাখার প্রধান ও গবেষণা দলের প্রধান ড. ফ্রেডি ব্রে বলেন, এই ফলাফল ফুসফুসের ক্যানসারের পরিবর্তিত ঝুঁকির কারণ পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়। যেসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধূমপানকে ফুসফুসের ক্যানসারের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, সেখানে বায়ুদূষণের মতো সম্ভাব্য কারণগুলো চিহ্নিত করার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, ‘ধূমপানের হার কমে যাওয়ার ফলে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে ধূমপান করেন না এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্যানসার শনাক্তের হার বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ কতটা সফল হবে, তার ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতে অ্যাডেনোকার্সিনোমার প্রকোপ কমবে কি না।’
বিশ্বজুড়ে ফুসফুসের ক্যানসার এখনো সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যুর কারণ হিসেবে রয়ে গেছে। ২০২২ সালে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২৫ লাখ মানুষ। তবে সাম্প্রতিক দশকে ক্যানসারের ধরনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে।
নারীদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের হার বাড়ছে
আইএআরসি জানিয়েছে, ফুসফুসের ক্যানসারের চারটি প্রধান উপপ্রকারের মধ্যে অ্যাডেনোকার্সিনোমা পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে।
২০২২ সালের তথ্যমতে, বিশ্বে পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ ও নারীদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল অ্যাডেনোকার্সিনোমা। ২০২০ সালে এই হার যথাক্রমে ৩৯ শতাংশ ও ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ ছিল। আইএআরসি জানিয়েছে, অ্যাডেনোকার্সিনোমা ধূমপান না করা ব্যক্তিদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে।
যদিও গত ৪০ বছরে বেশির ভাগ দেশে পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের হার কমেছে, তবে নারীদের মধ্যে এই প্রবণতা উল্টো বাড়ছে। বর্তমানে পুরুষদের মধ্যে ক্যানসারের হার বেশি হলেও, ২০২২ সালে ৯ লাখ নারী এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। ২০২৩ সালে দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, কীভাবে যুক্তরাজ্যে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা প্রথমবারের মতো পুরুষদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীদের এখন স্তন ক্যানসারের মতো ফুসফুসের ক্যানসার নিয়েও সতর্ক হওয়া উচিত।
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কৌশল
ধূমপানের ধরন ও বায়ুদূষণের মাত্রা ক্যানসারের ঝুঁকিকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, বায়ুদূষণের সঙ্গে অ্যাডেনোকার্সিনোমার সংযোগ রয়েছে। তবে ধূমপান ছাড়া বিশ্বব্যাপী ঠিক কত শতাংশ ফুসফুসের ক্যানসার বায়ুদূষণের কারণে হচ্ছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে প্রমাণ থেকে জানা যায় এটি বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা ফুসফুসের ক্যানসারের কারণ সম্পর্কে আরও জানার জন্য চেষ্টা করছেন। বিজ্ঞানীরা এখন আরও গভীরভাবে গবেষণা করছেন, ধূমপান ছাড়াও কী কী কারণ এ রোগের জন্য দায়ী।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘বায়ুদূষণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আংশিকভাবে অ্যাডেনোকার্সিনোমার ক্রমবর্ধমান প্রাধান্যকে ব্যাখ্যা করে, যা বিশ্বব্যাপী ধূমপান না করা ব্যক্তিদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসারের ৫৩ থেকে ৭০ শতাংশের জন্য দায়ী।’
ব্রে বলেন, কীভাবে ফুসফুসের ক্যানসার এবং অন্তর্নিহিত ঝুঁকির কারণগুলো বিকশিত হচ্ছে? আমরা কীভাবে বিশ্বব্যাপী ফুসফুসের ক্যানসারকে সর্বোত্তমভাবে প্রতিরোধ করতে পারি সে সম্পর্কে সূত্র সরবরাহ করে এই গবেষণা।’
গবেষকরা মনে করেন, ফুসফুসের ক্যানসার ও এর ঝুঁকির পরিবর্তনশীল ধরন বোঝার মাধ্যমে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। ড. ব্রে বলেন, ‘ধূমপানের অভ্যাস পরিবর্তন ও বায়ুদূষণের মাত্রা কমানো- এ দুটি কৌশল ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীতিনির্ধারকদের এখন উচ্চ ঝুঁকির জনগোষ্ঠীর জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ ও বায়ুদূষণ প্রতিরোধ নীতিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান