বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্তে সমুদ্রের বরফের অবস্থান ও পরিবর্তন বিশ্লেষণকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার চলতি মাসের শেষে এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ স্যাটেলাইট তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ও সরবরাহ বন্ধ করতে যাচ্ছে, যা বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এতে উভয় মেরুতে দ্রুত পরিবর্তনগুলো ট্র্যাক করা আরও কঠিন হবে।
সমুদ্রের বরফের অবস্থা ট্র্যাক করা বিজ্ঞানীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি বৈশ্বিক উষ্ণতা কীভাবে গ্রহকে প্রভাবিত করছে তা বুঝতে সাহায্য করে। সমুদ্রের বরফ সূর্যের শক্তিকে মহাকাশে প্রতিফলিত করে ফিরিয়ে দেয়। তবে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি রেকর্ড হওয়ায় গ্রহের আরও বেশি অংশ সূর্যের শক্তির সংস্পর্শে আসছে। এর ফলে আরও উষ্ণতা বাড়ছে।
ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডোতে অবস্থিত ন্যাশনাল স্নো অ্যান্ড আইস ডেটা সেন্টার (এনএসআইডিসি) বিশ্বজুড়ে সমুদ্রের বরফের পরিমাণ প্রায় রিয়েলটাইমে ট্র্যাক করার জন্য ‘সি আইস ইনডেক্স’ রক্ষণাবেক্ষণ করে। গত সপ্তাহে দুটি আপডেটে কেন্দ্রটি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগ ৩১ জুলাই থেকে স্যাটেলাইটগুলোর ডেটা প্রক্রিয়াকরণ ও সরবরাহ বন্ধ করে দেবে।
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে আসছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যয় কমানোর নীতিতে সরকারের বিভিন্ন স্তরে জলবায়ুবিষয়ক কার্যক্রম প্রভাবিত হয়েছে। তাদের আশঙ্কা ছিল, সমুদ্রের বরফের ডেটা লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।
এ সিদ্ধান্তে বৈশ্বিক জলবায়ু গবেষণায় এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্টার্কটিক প্রোগ্রাম পার্টনারশিপের গবেষক ড. অ্যালেক্স ফ্রেজার বলেন, ‘এই ডেটা হলো আমাদের পৃথিবীর বরফের হৃদস্পন্দন। এটি আমাদের সতর্ক সংকেত দেয়। এখন আমরা সেই ধারাবাহিকতা হারাতে বসেছি।’
এনএসআইডিসি জানিয়েছে, তারা বিকল্প উচ্চ-রেজুলেশনের স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহারের চেষ্টা করছে। তবে তা বর্তমান তথ্যের সঙ্গে সরাসরি তুলনীয় নাও হতে পারে।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের চারপাশে বরফের রেকর্ড পরিমাণ হ্রাসের কারণে আরও বেশি হিমশৈল ছুটে যাচ্ছে। এর ফলে বরফের স্তর দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং তা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াতে পারে। যদিও সমুদ্রের বরফ গললে সরাসরি সমুদ্রপৃষ্ঠ বাড়ে না, তবে ভাসমান বরফস্তরের ক্ষয় জীবাশ্মভিত্তিক বরফের ওপর প্রভাব ফেলছে।
গ্লাসিয়োলজিস্ট ড. সু কুক বলেন, ‘বরফস্তরগুলো যেন বোতলের কর্কের মতো কাজ করে। এরা মূল ভূখণ্ডের বরফকে আটকে রাখে। কিন্তু সেগুলো ভেঙে গেলে অভ্যন্তরীণ বরফ দ্রুত সমুদ্রে চলে যেতে পারে।’
রেকর্ড পরিমাণ বরফ হ্রাসের প্রভাব পড়েছে জীববৈচিত্র্যের ওপরও। ২০২২ সালে বরফের হঠাৎ ভাঙনের ফলে প্রায় ৭ হাজার এম্পেরর পেঙ্গুইন ছানা মারা যায়। কারণ তাদের তখনও জলরোধী পালক গজায় নাই।
যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর এক মুখপাত্র জানান, ডিফেন্স মেটিওরোলজিক্যাল স্যাটেলাইট প্রোগ্রামের (ডিএমএসপি) তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ৩১ জুলাই বন্ধ হবে, যা ২০২৬ সালে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হওয়ার কথা ছিল। তিনি বলেন, ‘পুরোনো সেন্সরগুলোর কার্যকারিতা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আইটি আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারছে না বলে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময় এলো যখন অ্যান্টার্কটিকার বরফ হার নতুন রেকর্ড গড়ছে। এনএসআইডিসির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ওয়াল্ট মেয়ার জানান, ‘আমরা একটি মানসম্মত বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব। তবে দীর্ঘমেয়াদি রেকর্ডের ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হবে।’
সমুদ্রের বরফ পর্যবেক্ষণ শুধু বৈজ্ঞানিক তথ্য নয়, বরং এটি আমাদের ভবিষ্যৎ পরিবেশের এক প্রকার পূর্বাভাস। এই পর্যবেক্ষণ বন্ধ হলে তা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সূত্র: দ্য গার্ডিয়াণ