বিচারবিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বেঞ্চ ও সব উপজেলায় বিচারিক আদালত স্থাপনসহ ২৮টি সুপারিশ করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। অন্য সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- অধস্তন আদালতের ওপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব বিলোপ ও সব ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আনা, সুপ্রিম কোর্টের পৃথক সচিবালয় স্থাপন, স্থায়ী সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস ও স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সংস্থা গঠন, চূড়ান্তভাবে দণ্ডিতকে ক্ষমা করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পরিবর্তে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, বিচারাঙ্গনকে দলীয়করণ মুক্ত রাখা।
বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেন সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সংস্কার কমিশনের সদস্যরা।
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ৩৫২ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে ৩২টি অধ্যায়ের মাধ্যমে বিচার বিভাগকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
এদিকে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বিচার বিভাগ স্বাধীন ও কার্যকর করার প্রস্তাব এসেছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘আগের সরকারগুলো বারবার বলেছে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন। কিন্তু কার্যত বিচার বিভাগ কখনোই স্বাধীন ছিল না। এ জন্য কমিশন বলেছে, বিচার বিভাগকে পুরোপুরি স্বাধীন ও কার্যকরভাবে স্বাধীন করতে হবে। এটি ৩৫২ পৃষ্ঠার একটি বড় রিপোর্ট। লিগ্যাল সার্ভিসে স্বচ্ছতা আনার জন্য জাজ অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যাপারে নতুন কিছু রিকমেন্ডেশন দিয়েছে কমিশন। তার আলোকে কিছু কাজও হয়েছে। জাজ এপয়েন্টমেন্টের ব্যাপারে নতুন নীতিমালা নিয়ে আসা হয়েছে।’
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে মামলার পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা আনতে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশনের মতে, বর্তমানে পুলিশের তদন্তে প্রভাব বা পক্ষপাতের অভিযোগ রয়েছে, যা বিচার প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর প্রভাব ফেলে। এ সমস্যা দূর করতে একটি স্বতন্ত্র তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যাতে মামলার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের দায়িত্ব পুলিশের একচ্ছত্র অধীনে না থাকে।
আদালত ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কমিশন বলেছে, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা প্রয়োজন। এটি বাস্তবায়নের জন্য সাংবিধানিক সংশোধনী প্রয়োজন হতে পারে। পাশাপাশি বিচারিক আদালতের কাঠামো সম্প্রসারণ করে উপজেলা পর্যায়ে নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষের বিচারপ্রাপ্তি সহজে নিশ্চিত হয়।
পৃথক সচিবালয় বিষয়ে বলা হয়, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় স্থাপন এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে এসবের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আনতে হবে। সে জন্য বিচার-কর্মবিভাগের সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংশোধন করতে হবে। সংবিধানের ৮৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায়যুক্ত ব্যয়ের আওতায় বিচার-কর্মবিভাগের বিচারক ও কর্মচারীদের পারিশ্রমিক অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
দণ্ডিতকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন নিয়ন্ত্রণ করতে সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আদালতের বিচারে চূড়ান্তভাবে দণ্ডিত অপরাধীকে রাষ্ট্রপতি বা নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক ক্ষমা প্রদর্শনের একচ্ছত্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে বোর্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে ক্ষমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত হবে।
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে মোবাইল কোর্টে পরিচালনার সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে মোবাইল কোর্টের দণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা সংশোধন করে শুধুমাত্র জরিমানার বিধান করতে হবে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের পরিবর্তে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে।
বিচার ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আইনগত সহায়তা সম্প্রসারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। কমিশনের মতে, দরিদ্র জনগোষ্ঠী অনেক সময় আইনি সহায়তা পায় না, যা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টি করে। এ সমস্যা সমাধানে চলমান আইনি সহায়তা কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা কার্যকর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, আইনজীবীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে আদালতের বাইরে রাখা যায়, সে বিষয়েও সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে আদালত অঙ্গন দলীয়করণ মুক্ত থাকে।
আইনি শিক্ষার মানোন্নয়নেও বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশন মনে করে, মেধাবী শিক্ষার্থীদের আইন পেশায় আকৃষ্ট করতে মেডিকেল শিক্ষার মতো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এতে আইনজীবীদের মান উন্নত হবে এবং বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়বে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব সুপারিশ কার্যকর করতে বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন প্রয়োজন। বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিচারকদের স্বতন্ত্রতা নিশ্চিত করা এবং স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কমিশন প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কারের সুপারিশ করেছে।