
বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম ও তার পরিবারের সদস্যদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন আদালত। নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা বাকিরা হলেন- ওবায়দুল করিমের স্ত্রী আরজুদা করিম, ছেলে সালমান ওবায়দুল করিম ও মেয়ে জেরিন করিম।
সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দেন।
দুদকের সহকারী পরিচালক আমিনুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
দুদকের আবেদনে বলা হয়েছে, ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তার কোম্পানির বিরুদ্ধে অর্থপাচারসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য-প্রমাণে অভিযোগের স্বপক্ষে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। অভিযোগ সংশ্লিষ্টরা অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে তথ্য রয়েছে। তাই তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ওবায়দুল করিম ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়। আর্থিক খাতের গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নির্দেশে তাদের সব অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। এর আগে ওবায়দুল করিম ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি ও আর্থিক দুর্নীতি বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)।
ব্যবসায়িক জগতে ওবায়দুল করিমের আবির্ভাব ঘটে ১৯৯৩ সালে কোহিনূর কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিজ নেওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৯৪ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেড। ১৯৯৬ সালে যখন দেশের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের বিপর্যয় হয়, তখন ওরিয়ন তার শেয়ারহোল্ডারদের জন্য বড় লভ্যাংশ এবং বোনাস শেয়ার ঘোষণা করে। এতে শেয়ারের দাম বহুগুণ বেড়ে যায়। তবে শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের পর ওরিয়ন কোনো লভ্যাংশ বা বোনাস শেয়ার দেয়নি। এতে ওরিয়নের বিরুদ্ধে মামলা করে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন। কিন্তু পরে মামলাটি অনিষ্পন্ন অবস্থায় অকার্যকর হয়ে যায়। সে সময়ে শেয়ারবাজারের কারসাজির জন্য অনুসন্ধান চালায় দুদক। কিন্তু সে অনুসন্ধানের কোনো প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।
এর পর থেকে ওবায়দুল করিমের দুর্নীতি আর অপকর্ম বেড়ে যায় বহুগুণ। ‘বেলহাসা’ নামের এক বিদেশি কোম্পানিকে কৌশলে পার্টনার বানিয়ে সেই কোম্পানি হাইজ্যাক করেন তিনি। ২০০৩ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক (ইউএই) বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেই ক্ষান্ত হননি। প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে কোম্পানিটিই হাইজ্যাক করেন। এ নিয়ে মামলাও করে বেলহাসা। মামলায় জালিয়াতি, প্রতারণা ও নথি গায়েবের মতো ঘটনাও ঘটে। এ ছাড়া হাইজ্যাক করা ওই কোম্পানির নামে ব্যাংক থেকে ১৬৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ওবায়দুল করিম।
জানা গেছে, যখন যে সরকারই থাকুক না কেন প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি, সরকারি আমলার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে দুর্নীতি করেই টিকে ছিলেন এতগুলো বছর। একের পর এক মামলা, আদালতের রায়ে অর্ধশত বছর সাজাপ্রাপ্ত হলেও তাকে ধরা যায়নি। তবে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই প্রথমবার তাকে অনেকটা বেকায়দায় পরতে হয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে সপরিবারে দেশ থেকে পালানোর পথ খুঁজছিলেন ওবায়দুল করিম। বিষয়টি জানতে পেরে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করেন দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবসায়িক পার্টনার বানিয়ে টেন্ডার বা প্রতিযোগিতা ছাড়াই গত ১৫ বছরে ৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় বড় প্রকল্প বাগিয়ে নেন। শুরুতে তিন বছর মেয়াদে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলেও দফায় দফায় এই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এভাবেই ১৫ বছর ধরে লুটপাট করে চলেছেন ওরিয়নের ওবায়দুল করিম। একই কেন্দ্র সরকারের কাছে একাধিকবার বিক্রি করা হয়। এসব কেন্দ্রের মোট বিনিয়োগের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগকারী দেন, বাকিটা ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে মেটানো হয়। ইক্যুইটি ইনভেস্টমেন্টের ওপর দেওয়া হয় মুনাফা (রিটার্ন অব ইক্যুইটি)। সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় শোধ করলেও কেন্দ্রটা বেসরকারি কোম্পানিরই রয়ে যায়। পরে মেয়াদ বাড়ানো হলেও একই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে নির্মাণ ব্যয় পরিশোধ করা হয়।
এভাবে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মাধ্যমে দেশে লুটপাট হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এসব অপকর্মে সহযোগী হিসেবে ওবায়দুল করিম বেছে নিয়েছেন বিগত সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের। এর মধ্যে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে বেছে নিয়েছেন তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী মির্জা আজমকে। তাকে ৪০ শতাংশ শেয়ার দেওয়া হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে ওবায়দুল করিমের শেয়ার ৬০ শতাংশ। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত ডাচবাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ব্যবসায়িক পার্টনার করা হয়েছে ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ নাসিমকে। তাকে ৩০ শতাংশ ছেড়ে দিয়ে ৭০ শতাংশ নিজে রেখেছেন। ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগাঁও লিমিটেডের ৪ শতাংশ শেয়ার নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমানকে, ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ সাবেক মন্ত্রী মির্জা আজমকে দিয়ে ব্যবসায়িক পার্টনার বানানো হয়েছে। বাকি ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ার নিজে রেখেছেন। এ ছাড়া ওরিয়ন পাওয়ার রূপসা লিমিটেডের ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ শেয়ার দিয়ে মির্জা আজমকে পার্টনার বানানো হয়েছে।
দুবাইয়ে সম্পদের পাহাড়
দেশের টাকা চুরি করে দুবাইয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ওবায়দুল করিম। দুবাইয়ের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেলহাসাকে ফাঁদে ফেলে জালিয়াতি, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন হাজার কোটি টাকা। আবার সেই টাকা পাচার করেছেন খোদ দুবাইয়ে। পাচার করা টাকায় দুবাইয়ের অভিজাত এলাকায় কিনেছেন বিলাসবহুল হোটেল, ফ্ল্যাট, বাড়ি ও জমিজমা। ওবায়দুল করিমের নামে দুবাইয়ে যেসব সম্পদ রয়েছে, তার কোনোটিই তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে কেনা হয়নি। দুবাইয়ে চার তারকা মানের একটি হোটেল কেনার রেজিস্ট্রেশন নথিতে তিনি নিজেকে আলবেনিয়ার নাগরিক পরিচয় দিয়েছেন। আলবেনিয়ার করপোরেট রেজিস্ট্রির নথিতে তার মালিকানাধীন একটি কোম্পানি অ্যাগ্রি প্রোডাক্টসে ইউরোপের নাম উল্লেখ রয়েছে। যা ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে গোল্ডেন পাসপোর্ট স্কিমের মাধ্যমে তাকে নাগরিকত্ব দিয়েছে আলবেনিয়া। একটি বিনিয়োগ কর্মসূচির অধীনে তাকে নাগরিকত্ব পাইয়ে দিয়েছে সাইপ্রাস সরকার। এ ক্ষেত্রে তাকে সাইপ্রাস সরকারের গবেষণা ও ভূমি উন্নয়ন তহবিলে ২ লাখ ইউরো বা প্রায় আড়াই লাখ ডলার এবং সাইপ্রাসের রিয়েল এস্টেটে প্রায় ২০ লাখ ইউরো বা প্রায় ২৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করতে হয়েছে।
এমন অনেক দুর্নীতি ও অপকর্মের বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে। সেই সব প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্তের সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক, সিআইডি, এনবিআর ও বিএফআইইউসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী ও তদন্ত সংস্থা।