আবদুল্লাহ আল-মামুন
জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় অভিযুক্ত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (২ জুলাই) তিনি রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ তা মঞ্জুর করেন। যদিও তিনি অভিযুক্ত, তবে রাজসাক্ষী হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তিনি খালাস পেতে পারেন। আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
গত বছরে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে তার নির্দেশে পুরো পুলিশ বাহিনী সারা দেশে সক্রিয় ছিল। আন্দোলন ঠেকাতে মারণাস্ত্র ব্যবহার থেকে শুরু করে পুলিশের সব ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটেছে তার অধীনেই। তবে তিনিও সরকারপ্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক পুলিশ বাহিনীকে পরিচালনা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে তিনিসহ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুদজ্জামান খান কামাল অভিযুক্ত হয়েছেন। তিনি অভিযোগের দায় স্বীকার করে সব আসামির অপরাধ ও সব ঘটনার সত্য তুলে ধরতে রাজসাক্ষী হয়েছেন।
রাজসাক্ষী হওয়ায় তিনি খালাস পাবেন কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল গতকাল খবরের কাগজকে বলেছেন, ‘রাজসাক্ষী হিসেবে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন খালাস পাবেন। তার আবেদন মঞ্জুর হওয়ার পর থেকে তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে বিবেচিত হবেন। তিনি যদি মূল আসামিদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সাক্ষ্য দেন, তাহলে তার কোনো সাজা হবে না।’
গতকাল ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তিনিও তার দোষ স্বীকার করেছেন। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, সেই অপরাধের সবকিছুই তার জানার কথা। সব তথ্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালকে সহায়তার মাধ্যমে তিনি অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেছেন। সুতরাং চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন পরবর্তী সময়ে এই ট্রাইব্যুনালে সুবিধাজনক সময়ে তার বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনাসহ সব অপরাধ কাদের মাধ্যমে, কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল, সেই তথ্য উদ্ঘাটনে সাহায্য করবেন। সে হিসেবে তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে গণ্য হবেন। তিনি এখন কারাগারেই থাকবেন। বক্তব্য গ্রহণের পর তার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন ট্রাইব্যুনাল। অ্যাপ্রুভার হওয়ার কারণে তার নিরাপত্তাসংকটের আশঙ্কায় যথাযথ নিরাপত্তা চেয়ে তিনি ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেছেন। নিরাপত্তার বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল পরবর্তী সময়ে যথাযথ আদেশ দেবেন। রাজসাক্ষী হিসেবে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলায় ক্ষমা পেতে পারেন কিংবা ট্রাইব্যুনাল অন্য কোনো আদেশ দিতে পারেন। এটা পুরোপুরি আদালতের এখতিয়ার।’
উল্লেখ্য, ‘রাজসাক্ষী’ শব্দটি এসেছে মূলত ‘রাজা’ ও ‘সাক্ষী’ শব্দ দুটি থেকে। সাক্ষ্য আইন প্রণয়নের সময় রাজার রাজ্য প্রথা ছিল। সেই সময় এ ধরনের সাক্ষীকে রাজসাক্ষী বলা হতো। এখন রাজাও নেই, রাজত্ব প্রথাও নেই। এখন রাষ্ট্র। তাই রাজসাক্ষীকে বর্তমানে রাষ্ট্রের সাক্ষী হিসেবে গণ্য করা হয়। অপরাধের সঙ্গে যুক্ত কোনো আসামি রাজি হলে তাকে রাষ্ট্রের পক্ষে সাক্ষী করা হয়। আইন অনুসারে এখনো তাকে রাজসাক্ষী বা অ্যাপ্রুভার বলা হয়। কোনো আসামি রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে রাজি হলে প্রথমে তাকে রাজসাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং পরে কারাগারে রাখা হয়, যাতে অন্য কোনো আসামি বা ব্যক্তি তাকে প্রভাবিত করতে না পারে অথবা তার কোনো ক্ষতি করতে না পারে।
রায় ঘোষণার আগেই বিচার চলাকালে অপরাধটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা সে সম্পর্কে গোপন তথ্যের অধিকারী কোনো ব্যক্তির অপরাধের সব ঘটনা, মূল অপরাধী ও সহায়তাকারী হিসেবে জড়িত সব অপরাধী সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও সত্য ঘটনা প্রকাশ করে সাক্ষ্য প্রদান সম্পন্ন হলে আদালত রাজসাক্ষীকে ক্ষমা করতে পারেন। তবে রাজসাক্ষী ইচ্ছাকৃতভাবে অত্যাবশ্যক কোনো কিছু গোপন করে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে বা যে শর্তে ক্ষমা করা হয়েছিল সেই শর্ত পালন না করলে আদালত রাজসাক্ষীরও বিচার করতে পারবেন। যে অপরাধের বিষয়ে রাজসাক্ষীকে ক্ষমা করা হয়েছিল, আদালত সেই অপরাধের বিষয়ে তার বিচার করতে পারবেন। তবে রাজসাক্ষীকে অন্য আসামিদের সঙ্গে একত্রে বিচার করা যাবে না।