দেশের বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্র ধ্বংসের জন্য দায়ীদের অন্যতম সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলে এখনো ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সংক্ষিপ্ত রায় ও পূর্ণাঙ্গ রায়ে ব্যাপক রদবদলের ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে রয়েছে তীব্র সমালোচনা।
২০১১ সালের ১০ মে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চের ঘোষিত সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছিল, ‘সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রসপেক্টিভলি (ভবিষ্যতের জন্য) বাতিল ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলো, যা সাধারণত আইনসিদ্ধ নয়। জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন- সংসদ চাইলে আগামী দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে সংসদ ইচ্ছা করলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারকদের বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে পারে।’
সংক্ষিপ্ত এই রায় ঘোষণার পর এ বি এম খায়রুল হক চাকরির মেয়াদ শেষে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেন। রায় ঘোষণার ১৬ মাস পর অবসরে থাকা অবস্থায় ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। পূর্ণাঙ্গ রায়ে পরবর্তী দুই মেয়াদে (দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন) তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বলবৎ থাকার বিষয়টি ছিল না। শুধু তাই নয়, সরকারের মেয়াদ শেষ হলেও সংসদ বহাল থাকার কথা যুক্ত করা হয়। এতে সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ের ব্যাপক অসংগতি নিয়ে সে সময় জোরালো বিতর্ক ও সমালোচনা শুরু হয়।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘১৯৯৬ সালের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর আইন সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি এবং মৌলিক কাঠামোকে নষ্ট করে দেওয়ার কারণে বিতর্কিত আইনটি অসাংবিধানিক, বেআইনি এবং অকার্যকর বলে গণ্য হয়েছে।’
রায়ে তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি সংসদের কর্তৃত্বাধীন। সংসদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাচনের একটি যুক্তিসংগত সময়ের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া যেতে পারে এবং এ সময়টি ৪২ দিন হতে পারে। নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা নতুন মন্ত্রিসভা গঠন না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বাভাবিক এবং সাধারণ কার্যাবলি সম্পাদন করবে। নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনি ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত সব ব্যক্তি এবং প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবে।’
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন (পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি হন), বিচারপতি এস কে সিনহা (পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি এবং সরকারের চাপে পদত্যাগ ও দেশত্যাগে বাধ্য হন ) এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি হন)।
রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তবে বিচারপতি মো. ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে মত না দিয়ে বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেন।
বিচারপতি খায়রুল হকের দেওয়া ওই রায় নিয়ে সেই সময় প্রশ্ন তুলেছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন বিচারপতি, আইনজীবী, রাজনীতিক ও বিশিষ্টজন। অসংগতিপূর্ণ ওই রায় নিয়ে সে সময় সারা দেশে বিভিন্ন মহলে তীব্র সমালোচনা হয়।
দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। ২০১১ সালে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর একই বছর আওয়ামী লীগ সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল রেখে বিদ্যমান সংসদ ও সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান যুক্ত করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে মূলত ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়। এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে গত বছর রিট করা হয়। শুনানি শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সরাসরি না ফেরানোসহ পঞ্চদশ সংশোধনীর কিছু বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে সেগুলো পরবর্তী সংসদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। গতকাল পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
তবে, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাসংক্রান্ত বিচারপতি খায়রুল হকের দেওয়া সেই অসংগতির রায়ের পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন শুনানির জন্য ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছেন আপিল বিভাগ। শিগগিরই শুনানি শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে।