কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া অনেক সভ্যতার কথাই আমরা শুনেছি এবং সে হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা থেকে মিলেছে প্রত্নতাত্ত্বিক অনেক নিদর্শন। অর্থাৎ এসব সভ্যতা কাল্পনিক নয় বরং এসব সভ্যতার অস্তিত্ব মিলেছে। আনুমানিক ১৬০০ ও ১৭০০ শতাব্দীতে ইউরোপিয়ানরা বিশ্বাস করত যে, এই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একটা জায়গা আছে, যেখানে অঢেল সম্পদ আছে। শুধু তাই না গোটা শহরটাই স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো। স্থানটির নাম এল ডোরাডো। এর মালিক হওয়ার জন্য মানুষ অতীতে অনেক অভিযান চালিয়েছে এবং এখনো চালাচ্ছে। স্বর্ণের সন্ধানে এসব অভিযানে প্রাণ গেছে অগণিত মানুষের, অনেক মানুষ হয়েছে নিঃস্ব, তবু এই জায়গার সন্ধান এখনো কেউ পায়নি। কারও মতে এল ডোরাডোর অস্তিত্ব নেই আবার কারও মতে সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে স্বর্ণের যত গুপ্ত ভাণ্ডার। কিংবদন্তি এই শহরকে ঘিরে রয়েছে কতই না উপাখ্যান আর নানা কল্পকাহিনি।
এল ডোরাডো স্প্যানিশ শব্দ, যার অর্থ যেটি স্বর্ণ বা স্বর্ণের তৈরি। অনেক আগে দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ায় এক আদিবাসী গোষ্ঠী ছিল যার নাম মুইসকা। মুইসকা ঐতিহ্য অনুসারে, নতুন রাজা নির্বাচন করার পর মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্বর্ণের গুঁড়া মাখিয়ে তাকে গুয়াতাভিতার পবিত্র জলে স্নান করানো হয়। এদেরই বলা হতো এল ডোরাডো। ধীরে ধীরে ব্যক্তি থেকে এই নামটি হয়ে উঠল এক নগরীর। লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে মানুষ মনে করতে লাগল এমন একটি শহর আছে যার পুরোটাই স্বর্ণে মোড়ানো। আনুমানিক ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই বিভিন্ন নথিতে এল ডোরাডোর কথা বিভিন্নভাবে ছড়াতে থাকে। ষোড়শ শতকে সবচেয়ে বিস্তার লাভ করে এ মিথ। বিশেষ করে স্প্যানিশদের মুখেই এই কথা বেশি ছড়াতে শুরু করে। স্বর্ণের শহর এল ডোরাডোর ইতিহাস এবং মিথের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে তারা। মুইসকা জাতির মানুষরা নিচু এলাকা থেকে বসবাসের জন্য দুবার স্থানান্তরিত হয়ে কলম্বিয়ার চুন্দিনামার্কা ও বয়াকা অঞ্চলের উঁচু ভূমিতে আসে যথাক্রমে খ্রিষ্টপূর্ব ১২৭০ ও খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০-৫০০ সালের মধ্যে। এ সময় পৃথিবীতে থাকা অন্য জাতির মানুষেরাও উঁচু ভূমিতে স্থায়ী হয়েছিল। মুইসকা জাতি অ্যাজটেক, মায়া ও ইনকা সভ্যতার মতোই সমৃদ্ধ ছিল। যখন তাদের নতুন নেতা নিযুক্ত হতো, তখন তার দায়িত্ব গ্রহণের আগে অনেক প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। এরকমই একটা প্রথা ছিল যেটায় নতুন রাজাকে লেক গুয়াতাভিতার কাছে আনা হতো, তারপর তাকে নগ্ন করে স্বর্ণের গুঁড়ায় সারা দেহ ঢাকা হতো। তারপর তাকে ভালোভাবে সজ্জিত একটা ভেলায় অনেক স্বর্ণ ও দামি পাথরের সঙ্গে তাকে এবং তার সাথীদের রাখা হতো। তারপর ভেলাটাকে লেকের কেন্দ্রে পাঠানো হতো, যেখানে হবু রাজা তার দেহ থেকে স্বর্ণের গুঁড়াগুলো ধুয়ে ফেলবেন, যে সময়ে রাজার সাথীরা স্বর্ণ ও মূল্যবান পাথরগুলো লেকে নিক্ষেপ করবে। এই প্রথাকে মুইসকার দেবতার প্রতি তাদের ত্যাগ বলে বিবেচনা করা হতো। বাস্তবিক অর্থে এল ডোরাডো কোনো শহর ছিল না, বরং ওই প্রথার মধ্যমণি রাজাকেই এল ডোরাডো বলা হতো। যদিও এল ডোরাডো একমাত্র রাজাকেই বলা হতো, তবে পরবর্তীতে ‘স্বর্ণের হারানো শহর’ বা দ্রুত সম্পদ আহরণ করা যায়, এমন এক কাল্পনিক জায়গাকে নির্দেশ করতেও এ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। গুয়ানার লেক পারিমের কাছে কল্পনার শহরটির ঠিকানা। বহু যুগ ধরে এর খোঁজে হাজার হাজার মানুষের অভিযান চলেছে বলে কথিত আছে।
ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়দের কাছে বাকি পৃথিবীর অনেকটাই অজানা ছিল। গুজবের সঙ্গে কল্পনা মিশে তাদের ধারণা দৃঢ় হয়, কোথাও নিশ্চয়ই স্বর্ণে মোড়া এ শহরটি ঠিকই আছে। ফ্রান্সিসকো পিসারো ১৫৩০ সালে ইনকা সাম্রাজ্য লুট করার পর বাইরের পৃথিবীর সবাই ভাবত, লাতিন আমেরিকার যে জায়গাগুলো এখনো বাইরের মানুষের কাছে অনাবিষ্কৃত, সেখানে কোথাও বিশাল ধন সম্পদের সাম্রাজ্য রয়েছে। এরাই এই স্বর্ণের রাজ্যের গুজব তৈরি করে।
ঠিক সেই সময় অভিযাত্রী কুয়েসাদা গুয়াতাভিটা হ্রদের পানি সেচে চার হাজার স্বর্ণের টুকরো পেয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, প্রতি বছর উৎসবের সময় আদিবাসীরা হ্রদে প্রথানুযায়ী স্বর্ণ নিক্ষেপ করত। এটি তারই যেন ইঙ্গিত দিয়ে যায়। কিন্তু অনেকেই তা বিশ্বাস করেন না। এই সোনার লোভে বহু অঞ্চল থেকে লোকেরা এসেছে। প্রচুর পরিশ্রম করে হ্রদের তলদেশে জোয়ারের সময়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে। অনেকেই এভাবে কিছু স্বর্ণের টুকরো সংগ্রহ করতে পারলেও স্বর্ণের শহর এল ডোরাডোর খোঁজ পাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি।
স্প্যানিশরা যখন লাতিন আমেরিকা জয় করেন, স্থানীয় মুইসকা গোষ্ঠীকে খুঁজে বেরও করেন। লেক গুয়াতাভিতায় খোঁজ চালিয়ে কিছু স্বর্ণ পান। কিন্তু তাতে তাদের আঁশ মেটেনি। একের পর এক ব্যর্থ অভিযানে মানুষ আসতে থাকে সেখানে। সেখানকার আদিম আদিবাসীদের তারা মারধর, অত্যাচার চালাতে থাকে স্বর্ণের খোঁজে। কিন্তু লাভ হয় না। তাদের হাত থেকে রেহাই পেতে তারাও নানারকম গল্পগাথা তৈরি করে। ক্রমশ তা ফুলেফেঁপে স্বর্ণের শহর এল ডোরাডোর রূপ নিল।
১৭৯৯-১৮০৪ সালে আলেকজান্ডার ফন হামবোল্ট লাতিন আমেরিকায় এক দুঃসাহসিক অভিযান করেন। ১৮০১ সালে ৪৫ দিন দুর্গম পথ অতিক্রম করে পৌঁছাতে সক্ষম হন রিও ম্যাগদালেনাতে। কিন্তু সেই স্বর্ণের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে তিনিও ব্যর্থ হন। পরে তিনি শহরটির অস্তিত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করেন।
এল ডোরাডোর সন্ধান পেতে গত ১০০ বছরে অভিযানই হয়েছে অন্তত ১৪টি। এই অভিযানে ইনকা সভ্যতার অনেক নিদর্শন পাওয়া গেলেও দেখা মেলেনি সেই স্বর্ণ শহরের। ২০০১ সালে রোমের এক পাঠাগারে হঠাৎ এক ধুলোমাখা নথি আবিষ্কৃত হয়। তাতে এল ডোরাডো শহরের কথা লেখা রয়েছে। আন্দ্রিয়া লোপেজ নামের এক ধর্মযাজক ১৭ শতকের সেই নথি লিপিবদ্ধ করেছেন বলে জানা যায়। লিপি থেকে জানা যায়, সেই শহরের অমিত ধনসম্পত্তির কথা। কিন্তু শহরটি কোথায় তা সেই লিপিতে খোলাসা করেননি যাজক। শুধু বলেছেন পেরু থেকে ১০ দিনের হাঁটাপথ। কিন্তু পেরুর কোন শহর থেকে বা কোন দিক থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে তার কোনো সঠিক তথ্য লিপি থেকে জানা যায়নি।
জাহ্নবী