
ছবির ভেতর দিয়ে দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও প্রেমের কথা বলেন আল আমিন। তিনি একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর পূর্বপারের আদমপুরে ১৯৭৬ সালে তার জন্ম। তার বাবা আদম আলী ছিলেন ট্রেনচালক।
শুরুর গল্প
আল আমিনের পড়াশোনার হাতেখড়ি গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই আঁকিবুঁকি করেন। দাদা সেবার চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী ছিলেন। বাড়িভরা পোস্টার ছিল। পোস্টারের ছবির ওপর সাদা পাতলা কাগজ রেখে কলম দিয়ে আঁকতেন তিনি। এক সময় ছবি আঁকা তার নেশায় দাঁড়িয়ে যায়। গাঁয়ের মাটির ঘরের দেয়ালগুলোয় বাঁশের কঞ্চি, চকখড়ি মাটি ও কাঠি দিয়ে ছবি আঁকতেন। তখন কোনো একটা রিকশার পেছনে অভিনেত্রী বিপাশার ছবি আঁকা দেখেছিলেন। সেই ছবিটি এঁকেছেন অনেকবার।
অষ্টম শ্রেণিতে আর্টের দোকান
প্রাইমারি স্কুল শেষ করে চম্পকনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন আল আমিন। হাতের লেখা সুন্দর ও পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় শিক্ষকরা তাকে স্নেহ করতেন। তাকে আরও আঁকতে উৎসাহ দিতেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্থানীয় বাজারে আর্টের দোকান দিয়ে ফেলেন আল আমিন। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ব্যানার লিখতে থাকেন। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য দেয়ালে স্লোগান লিখতেন। সে সময় গ্রামে ফলের গাছ ছিল প্রচুর। বাদুড় ও বিভিন্ন পাখি ফলমূল খেয়ে যেত। আল আমিন মানুষের হা-করা মুখের ছবি, এলোকেশে মাথার ছবি এঁকে টানিয়ে দিলেন গাছে গাছে। বেশ কাজ দিয়েছিল।
এইচএসসি পাস করার পর আর্ট শিখতে আল আমিন ঢাকায় আসেন। জাজমেন্ট অ্যাড নামের একটি দোকানে ব্যানার লেখার কাজ পান। দোকানি সম্পর্কে তার নানা ছিলেন। সিনিয়র আর্টিস্টদের কাজ দেখে দেখে শিখতে থাকেন তিনি। খেয়াল করতেন তাদের হাত ঘোরানো বা লেখার স্টাইল। দিনের বেলায় যা শিখতেন, রাত জেগে তা প্র্যাকটিস করতেন। মাঝেমধ্যে দেয়ালে রাজনৈতিক স্লোগান লিখতেন। আল আমিন বললেন, ‘আমি আর এক বড় ভাই রাজনৈতিক কর্মীদের আদেশে সারা রাত ঢাকার পথে ঘুরে ঘুরে দেয়াল লিখন করতাম। তারা দেয়ালে রঙ লাগিয়ে যেতেন আর আমরা দ্রুত লিখে যেতাম। এভাবে এক বছর রাতে কাজ করেছি।’
তিতাস আর্ট
এক আত্মীয় মারফত নারায়ণগঞ্জে ‘মিতা আর্ট’ নামের একটি দোকান দেন। সেখানে তিন বছর ছিলেন। তারপর নরসিংদীতে একটা দোকানে চাকরি নেন। ছয় মাস পর আবার নিজের দোকান খোলেন। নাম রাখেন তিতাস আর্ট। ২০২, পশ্চিম ব্রাহ্মন্দীতে দোকানের অবস্থান। নরসিংদী সরকারি কলেজের মূল ভবনের পেছনে গেলেই চোখে পড়বে তিতাস আর্ট। অল্প দিনেই নাম ছড়িয়ে পড়ে। কাজের সুবাদেই নরসিংদীর তরুণ কবি রবিউল আলম নবি, মো. ফয়েজুল কবির এবং সম্পাদক ও সংগঠক আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারা তাকে নতুন নতুন ভাবনা দেন। বিমূর্ত ছবিও আঁকতে বলেন। করতে থাকেন প্রচ্ছদ ডিজাইন। বলেন, ‘তারা খুব প্রশংসা করতেন। উৎসাহ দিতেন। আমাকে হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতেন।’ নরসিংদী সরকারি কলেজের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের দেয়ালিকার প্রচ্ছদ এঁকে পেয়েছেন পুরস্কার।
আল আমিন শিল্পালয়
এর মধ্যে দোকানের নাম বদলে রাখেন আল আমিন শিল্পালয়। সারা দিন ছবি নিয়েই পড়ে থাকেন। ছবি নিয়ে ভাবেন। সমাজের নানা অসঙ্গতি ফুটে উঠতে থাকে তার ছবিতে। অসহায়-নিপীড়িত মানুষের ছবিও আঁকতেন। আঁকেন দেশমাতৃকার ছবি। তার ছবি দেখে খুশি হয়ে কবি আবু হাসান শাহরিয়ার নিজের বাড়িতে আল আমিনকে দাওয়াত করে খাইয়েছেন। ছবির মাধ্যমে আঁকি সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, শ্রেণিবৈষম্য, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, অধিকারবঞ্চিত, অন্যায়ভাবে আহত হওয়া মানুষের কথা- বললেন আল আমিন।
ভাণ্ডারে রতন
আল আমিন বিমূর্ত ছবিই আঁকেন বেশি। প্রয়োজনে মূর্ত ছবিও আঁকেন। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার বিমূর্ত ছবি এঁকেছেন তিনি। তার ছবিঘরে আছে দেড় হাজারের মতো ছবি। ছবিতে আছে দেশপ্রেম, অন্যায়ের প্রতিবাদ, পরিবেশ রক্ষা, সমাজের অসঙ্গতির কথা। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি এঁকে বেশ প্রশংসা পেয়েছেন। পরিবেশ নিয়ে কিছু ছবি এঁকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। কিছু মানুষের ছবি এঁকে দিয়ে বিপুল ভালোবাসা পেয়েছেন।
শিল্পীর বেদনা
ছবি আঁকার নেশা আর মায়ায় পড়ে গেছেন আল আমিন। দিনমান ছবি নিয়েই পড়ে থাকেন। নাওয়া-খাওয়াও ভুলে যান প্রায় সময়। তীব্র অভাব এবং অর্থকষ্ট যখন জীবনকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়, তবুও ছবির নেশা ও মায়া ছাড়তে পারেন না তিনি। এর মধ্যে বাসা ভাড়া বাকি পড়েছে, ছবিঘরের ভাড়াও দিতে পারছেন না। বাড়িওয়ালা দু-এক কথা বললেনও। অন্য পেশায় জড়াতে কেউ কেউ পরামর্শ দিলেন। কিন্তু আল আমিন খেয়ে-না খেয়ে এটা নিয়েই থাকতে চান। ছবিঘরটার বর্তমানে এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বৃষ্টি এলে পানি পড়ে। বাতাস এলে ছবিগুলো মেঝেতে লুটোপুটি খায়।
অর্থাভাবে ছবিগুলো নষ্ট হওয়ার জো হয়েছে। বললেন, ‘জগতে সবচেয়ে বড় এবং ভয়াবহ রকমভাবে আচ্ছাদিত করে রাখে ছবি আঁকার নেশা। নেশা আর মায়ার কারণে এটি ছাড়তে পারছি না। আমার ছবিগুলো বাঁচাতে পারলে শান্তি পেতাম। কেউ যদি আমার পাশে এসে দাঁড়াত।’
কলি