পাখিসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণীর প্রতি তার খুব মায়া। অসংখ্য প্রাণীকে সুচিকিৎসা দিয়ে তিনি সুস্থ করেছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৩০টি সাপ, ১৫০টি টিয়া, ৬টি বক, ৮টি পাতি সরালি, ৮টি ময়না, ৩টি ধনেশ, ৩টি চিল, ২টি শকুন, ৪টি বানর, ৫টি বনবিড়াল, ১টি উড়ন্ত কাঠবিড়ালি, ১৩টি কচ্ছপ, ১৩টি বনমোরগ, ১টি ঈগল উদ্ধার করে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে অবমুক্ত করেছেন। প্রাণীপ্রেমী এই মানুষটি হলেন ডা. আলীমুল রাজী। তার প্রাণীপ্রেমের কথা জানাচ্ছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
ডা. আলীমুল রাজী সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমানে বন্য প্রাণীর রোগ, চিকিৎসা, প্রজনন, উৎপাদন ও পুনরায় বনে ফিরিয়ে দেওয়া, বন্য প্রাণী ও পাখির উদ্ধার কাজ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর পিএইডি করছেন। ২০১৪ সাল থেকে তিনি বন বিভাগের অধীনে শেখ রাসেল অ্যাভিয়ারি ও ইকো পার্কে ভেটেরিনারি চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত আছেন।
যেভাবে শুরু
ছোটবেলায় খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। পাখি ধরতেন। পুষতেনও। তখন থেকেই তার মনে বন্য প্রাণীর প্রতি প্রেমের জন্ম নেয়। বাবার ইচ্ছে ছিল মানুষের চিকিৎসক হবেন। সেটা যখন হতে পারলেন না তখন বাবার পরামর্শে ভেটেরিনারি বিষয়ে ভর্তি হলেন। একদিকে পড়াশোনা অন্য দিকে পশুপাখির জন্য কাজ দুটোই চলল। ভেটেরিনারি সায়েন্সে মানুষ বাদে সব প্রাণীর চিকিৎসা, প্রজনন, খাদ্য নিরাপত্তাসহ সব বিষয় পড়ানো হয়। ফলে বন্য প্রাণীর সেবা-যত্নে রাজী একাডেমিকভাবেই অভিজ্ঞ হয়ে উঠলেন।
শেখ রাসেল অ্যাভিয়ারি ও ইকো পার্ক
বন বিভাগের অধীনে শেখ রাসেল অ্যাভিয়ারি ও ইকো পার্কে ২০১৪ সাল থেকে ভেটেরিনারি চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত আছেন রাজী। রাসেল ইকো পার্কে ৭টি বড় বড় অ্যাভিয়ারি তথা পাখির খাঁচা বিদ্যমান। এখানে ৪ শতাধিক পাখি আছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ম্যাকাও, ধনেশ, ময়না, টিয়া, বার হেডেড গিজ, সরালি, মদন টাক, টার্কি, তিতির, বন মোরগ, পেলিক্যান, রাজহাঁস, দেশি হাস, শালিক, তিলা ঘুঘু, কালেম, সাদা ও সবুজ ময়ূর, মথুরা, বানর, চিত্রা ও মায়া হরিণ, তারকা কচ্ছপ, কবুতর, রিং নেক, কনিউর ইত্যাদি। ইকো পার্কের সব প্রাণীর চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনাসহ সব ধরনের দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন রাজী। রাসেল ইকো পার্কটি দেশে একমাত্র বৃহত্তম পক্ষীশালা।
মথুরা পাখি প্রজনন
খাঁচায় মথুরা পাখি প্রজনন করাতে সফল হয়েছেন রাজী। তিনি জঙ্গল থেকে ডিম সংগ্রহ করে তা কুজে মুরগির মাধ্যমে বাচ্চা ফুটাতে সফল হন। প্রথমে দুটি বাচ্চা পান। পরে তারা ডিম পাড়ে এবং নিজেরাই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটায় বলে রাজী জানান। বর্তমানে পাঁচটি মথুরা পাখি রাসেল ইকো পার্কে রয়েছে। রাজী দাবি করেন, বাংলাদেশে তিনি প্রথম যিনি কিনা এভাবে বন থেকে মথুয়া পাখির ডিম এনে মুরগির তা দেওয়ার মাধ্যমে বাচ্চা উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন।
হাতির বাচ্চা উদ্ধার
প্রাণী উদ্ধারের হাজারো রুদ্ধশ্বাসের ঘটনায় রাজীর অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ। তবে হাতির বাচ্চা উদ্ধারের ঘটনাটি তিনি আজও ভুলতে পারেননি। একবার ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসে খবর আসে, গহীন বনের ভেতর একটি হাতির বাচ্চা কাদামাটির ভেতর পড়ে আছে চার দিন ধরে। দুর্গম পাহাড়ি পথ। প্রায় সাত কিলো হেঁটে ঘটনাস্থলে যখন পৌঁছলেন। তখন মাঝ রাত। কনকনে ঠাণ্ডা। গভীর রাতে হাতির বাচ্চাটিকে টেনে তুললেন সবাই।
পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ফ্লুইড থেরাপি ও ওষুধ দেন। এরপর আগুনের সেঁক দিয়ে সুস্থ করে তোলা হয়। প্রায় ছয় ঘণ্টার সেবা যত্নে বাচ্চা হাতিটি উঠে দাঁড়ায়। এই কাজগুলো করার সময় জীবনহানির শঙ্কা ছিল। রাজী বললেন, অসীম সাহস নিয়ে কাজ করেছি। কারণ, হাতির বাচ্চাটির আশপাশেই ছিল ওর বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। হাতি পরিবারের সদস্যরা কোনোরকম আক্রমণ করলে আমাদের বাঁচার উপায় ছিল না।
হয়তো ওরা বুঝতে পেরেছে যে, আমরা তাদের বাচ্চাকে উদ্ধার করতে আসছি। সকাল বেলা মা হাতি এসে জোরে জোরে আওয়াজ করে বাচ্চাটিকে কাছে টেনে নেয়। বাচ্চাটিও জোরে জোরে আওয়াজ দিতে থাকে। কিছু সময়ের মধ্যেই তারা বনের মধ্যে চলে যায়। রাজী বললেন, মনে হলো ওরা আওয়াজ তুলে আমাদের ধন্যবাদ জানিয়েছে।
আহত বন্য প্রাণীর গল্প
বিভিন্নভাবে আহত বন্য প্রাণী নিয়ে আসা হয় রাজীর কাছে। পেট ফাঁপা, লেজের কিছু অংশ কাটা, চোখ নেই, জালে আটকানো ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে মানুষ সাপ নিয়ে আসে তার কাছে। কখনো কখনো মাথা ফাটা, ডানা ভাঙা অবস্থায় বন মোরগের দেখা পান। শকুন, চিল, ঈগল পান তিনি ডানা পা ভাঙা বা উড়তে পারে না এমন অবস্থায়। নাক মুখ ফাটা, মুখে দাঁত নেই এমন অবস্থায় অনেকেই বন বিড়াল নিয়ে আসেন রাজীর কাছে। তিনি এসব প্রাণী ড্রেসিং করে অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যাথানাশক দেন। প্রয়োজন মনে করলে হাসপাতালে বা কোয়ারেন্টাইন শেডে রাখেন, পরে সুস্থ হলে অবমুক্ত করেন।
হাতি তাড়ানোর উপায়
পার্বত্য এলাকায় হাতির আক্রমণে মানুষ নিহত হয়। আবার কারেন্টের ফাঁদ পেতে হাতি হত্যা করা হয়। এমন অনেক ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। হাতি নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ করেছেন রাজী। তাই এই বিষয়ে তার জানাশোনা বেশ ভালোই। তিনি হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচার কিছু উপায় বাতলে দিলেন। হাতি আসলে তাকে মারতে যাওয়া যাবে না। হাতি আসলে ৩৩৩-এ কল করা উচিত।
এটা বন বিভাগের জরুরি সেবার নাম্বার। এ ছাড়া আগুন জ্বালানো, পটকা, বাজি ফুটানো, জোরে শব্দ করলে হাতি দূরে সরে যায়। আর যদি হাতি তাড়া করে তাহলে নার্ভাস না হয়ে হাতির অবস্থান দেখে সোজা দৌড় না দিয়ে আঁকাবাঁকা করে এলোমেলোভাবে দৌড়াতে হবে। অনেক সময় হাতি চোরাবালি, নরম কাঁদায় পড়ে আটকে যায়। উঠতে পারে না। রাজী এমন অনেক হাতিকে উঠিয়ে সুস্থ করেছেন বলে জানান। তিনি ৪টি হাতির চিকিৎসা, ১০টি হাতি পুশ ব্যাক করেছেন রাঙ্গুনিয়া এলাকায়।
কচ্ছপের মায়ায়
রাজী একবার মারমা গোষ্ঠীর এক ব্যক্তির হাত থেকে একটি কচ্ছপ উদ্ধার করেন। কচ্ছপটি ছিল খুবই দুর্বল। প্রায় ১৩ দিন কোনো খাবারই সে খায়নি। বহু রকমের চিকিৎসাসেবা দেওয়ায় ধীরে ধীরে কচ্ছপটি খাবার খাওয়া শুরু করে। এভাবে প্রায় তিন মাস যত্ন করেন রাজী। এরপর যখন অবমুক্তকরণের সময় এল। তখন রাজীর বুক ফেটে কান্না আসছিল।
কারণ, কচ্ছপটি যেন তার পরিবারের সদস্য বনে গিয়েছিল। অফিসে এসে রাজী প্রথমেই কচ্ছপটির সঙ্গে দেখা করতেন। রাজী বললেন, অবমুক্ত করার পর শুরু হয় আমার কষ্টের সময়। কারণ অফিসে এসে প্রথমে দেখা করতাম কচ্ছপটির সঙ্গে। ওকে ছেড়ে দেওয়ার পর আমি খুব একাকিত্ব বোধ করছি।
গবেষক রাজী
পাখি ও বন্য প্রাণী নিয়ে গবেষণার কাজে রাজী ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব অ্যাডভান্স রিসার্চ ইন বায়োলজিক্যাল সায়েন্সে পাখিবিষয়ক তার দুটি জার্নাল বের হয়েছে। আরও চারটি বের হওয়ার অপেক্ষায় আছে বলে জানান।
এ ছাড়া চবি, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান প্রযুক্তি, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীরা রাসেল ইকো পার্কে আসেন। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। স্যাম্পল সংগ্রহ করেন। এসব কাজে পাশে থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন রাজী। প্রাণী স্বাস্থ্যে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন শান্তি পুরস্কার, পেট এনিম্যাল ও বার্ডস সেরা প্র্যাকটিশনার পুরস্কার।
আগামীর ভাবনা
স্কুল-কলেজপড়ুয়াদের বন্য প্রাণী রক্ষায় সচেতন এবং সম্পৃক্ত করতে হবে। এমনটাই মনে করেন রাজী। তাই আগামী দিনে তিনি স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের বন্য প্রাণী রক্ষায় সচেতন এবং সম্পৃক্ত করার কাজ করবেন বলে জানান।
কলি