চকলেট এমন একটি সুস্বাদু খাদ্য, যা ভালোবাসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। চকলেটের এমন জনপ্রিয়তার কারণে এখন বিশ্বব্যাপী চকলেট দিবসও পালিত হয়। বিভিন্ন ছোট-বড় উৎসবে চকলেট দেওয়া হয় উপহার হিসেবে। প্রিয় মানুষের অভিমান ভাঙাতেও চকলেটের জুরি মেলা ভার। বিশেষ করে শিশুরা চকলেট খেতে খুব পছন্দ করে।
চকলেট শুধু পছন্দের খাবারই নয়, এর কিছু গুণাগুণও রয়েছে। বিশ্বজুড়ে বহু ধরনের চকলেট রয়েছে। তার মধ্যে ডার্ক চকলেটের গুণাগুণ অনেক। ডার্ক চকলেটে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে আনা, হার্ট ভালো রাখা ও ব্রেইনের জন্য ডার্ক চকলেট খুবই উপকারী। কিন্তু আমরা ডার্ক চকলেটের ইতিহাস সম্পর্কে কয়জন জানি? ডার্ক শব্দের অর্থ অন্ধকার। এই চকলেটের পেছনেও আছে এক অন্ধকার জগৎ। নামটা যেন সেই অন্ধকার জগতেরই প্রতিনিধিত্ব করে।
পৃথিবীতে লাখ লাখ শিশুশ্রমিক রয়েছে। তার মধ্যে আফ্রিকাতেই প্রায় ৬৫-৭০ লাখ শিশুশ্রমিক রয়েছে। সেসব শিশুশ্রমিকের একটা বড় অংশ কোকো ফার্মের মতো ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় কাজ করে। প্রতিবছর কোকোর শতকরা ৭০ ভাগ উৎপাদিত হয় আইভরিকোস্ট ও ঘানায়। আর এই কোকো উৎপাদনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বেশির ভাগই শিশুশ্রমিক। শিশুরা শৈশব-কৈশোর জলাঞ্জলি দিয়ে বছরের পর বছর কাজ করে যাচ্ছে কোকো ফার্মগুলোয়। প্রতিটি শিশু শ্রমিকের আছে একটা নির্যাতিত করুণ জীবন। আর সেই জীবনের বিনিময়ে আমরা পাচ্ছি সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর ডার্ক চকলেট।
আইভরিকোস্ট ও ঘানার পার্শ্ববর্তী দেশ ও বিভিন্ন অঞ্চল যেমন- বুরকিনা ফাসো, টোগো, নাইজেরিয়া, চিলিসহ পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকার কারণে সেখান থেকে প্রতিনিয়ত পাচার হয়ে আসে হাজার হাজার শিশু। দারিদ্র্যের কারণে নিরুপায় হয়ে অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানকে অল্প কিছু অর্থের বিনিময়ে তুলে দেন দালালদের হাতে। পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ায় পাচারকারী দল সেসব শিশুকে নিয়ে সহজেই পৌঁছে যায় আইভরিকোস্ট ও ঘানার ফার্মগুলোয়। তারপর তারা কোকো ফার্মের মালিকদের কাছে শিশুদের বিক্রি করে দেয় নামমাত্র মূল্যে। তাদের ভেতর অধিকাংশের বয়স ৯-১৬ বছর। যারা একবার এখানে বিক্রি হয়ে যায়, তারা সাধারণত আর নিজের জন্মভূমিতে মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে পারে না। পরিবারের সঙ্গে চিরকালের বিচ্ছেদ হয় তাদের। পালাতে গিয়ে যদি কোকো ফিল্ডের পাহারাদারদের হাতে ধরা পড়ে, তাহলে তাদের জীবনে নেমে আসে ভয়ংকর শাস্তি। এখানে জীবনের কোনো মূল্য নেই বললেই চলে।
ফার্মের মালিকরা তাদের দিয়ে অমানবিক পরিশ্রম করান। একটি শিশু সর্বোচ্চ যত পরিশ্রম করতে পারে, যত পরিশ্রম করলে কোনোমতে প্রাণটা থাকে শুধু, তাদের দিয়ে ততটাই পরিশ্রম করানো হয়। ভোর ৬টা থেকে রাত ৯-১০টা পর্যন্ত চলে তাদের বিরামহীন কাজ। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এত পরিশ্রমের বিনিময়ে তারা কিছুই পায় না। তাদের ঠিকমতো খেতেও দেওয়া হয় না। এত পরিশ্রম করলে স্বাভাবিকভাবেই খুব ক্ষুধা পায় এবং শরীরের অনেক পুষ্টির দরকার হয়। কিন্তু ভীষণ ক্ষুধা পেলে তাদের খেতে দেওয়া হয় ভুট্টা সেদ্ধ আর কলা।
এসব একঘেয়ে খাবার খেয়ে তাদের বেঁচে থাকতে হয় প্রতিকূল পরিবেশে। ফার্মে কাজ করা অনেক শিশু জানতেই পারে না, যেই ডার্ক চকলেট তৈরির পেছনে তাদের এই অমানবিক পরিশ্রম সেই চকলেট খেতে কেমন। এমনকি ক্লান্তিতে অবসন্ন শরীর নিয়ে তারা ঠিকমতো ঘুমানোর সুযোগটুকুও পান না। তাদের ঘুমাতে হয় দরজা জানালাবিহীন বদ্ধ ঘরে।
কোকো ফার্মের জন্য শিশুশ্রমিক বেছে নেওয়ার অন্যতম দুটি কারণ হচ্ছে, কোকো সংগ্রহের জন্য এমন দুর্গম কিছু জায়গায় তাদের যেতে হয় যেখানে শিশুরা ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, তাদের কোনোপ্রকার মজুরি দেওয়া হয় না। মজুরিবিহীন কাজ করানোর জন্য শিশু শ্রমিকের চেয়ে উপযুক্ত আর কী হতে পারে!
কাজ করার সময় এসব শিশুশ্রমিক দুটি দলে ভাগ হয়ে যায়। এক দল চাপাতি দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে, আরেক দল গাছে চড়ে ধারালো চাপাতি দিয়ে কোকো পাড়ে। এসব চাপাতি এত ধারাল যে, তা অনায়াসে একজন মানুষকে খুন করে ফেলতে পারে। তাই কাজ করার সময় অনেক শিশু আহত হয়। এমন কোনো শিশু নেই যাদের শরীরে চাপাতির আঘাতের দাগ দেখা যায় না। কোকো পাড়া হয়ে গেলে তা বস্তায় ভরা হয় এবং সেই ভারী বস্তা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বহন করে নিয়ে আসতে হয়।
আকারে বস্তাগুলো সাধারণত শিশুদের চেয়েও বড় হয় এবং ওজন হয় তাদের চেয়েও অনেক বেশি। জঙ্গলের দুর্গম পথ দিয়ে সেই ভারী বস্তা তাদের বহন করে নিয়ে যেতে হয়। বস্তা নিয়ে দ্রুত না হাঁটলে তাদের আঘাত করা হয়। এমনকি ক্লান্তি পেলে একটু বিশ্রাম নিতে গেলেও চাবুকের আঘাতে জর্জরিত করা হয়। শারীরিকভাবে নির্যাতিত হওয়াটাই তাদের প্রতিদিনের জীবন। এত আঘাত পেতে পেতে আর এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে প্রায় সব শিশুই চর্মরোগের শিকার হয়। তাদের ঠিকঠাক চিকিৎসাও মেলে না।
শিশুশ্রমিকদের ভেতর ৪০ ভাগ মেয়ে রয়েছে। অনেক কিশোরী নিয়মিত ধর্ষিত হয় ফার্ম মালিক, কর্মী ও মজুরদের কাছে। খুব অল্প বয়সেই তারা গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এমনকি নানাবিধ দুরারোগ্য যৌনরোগে আক্রান্ত হয়। দুর্গম অঞ্চলে কাজ হওয়ার কারণে অনেকেই পঙ্গুত্বের শিকার হয়, বিষাক্ত পোকামাকড়ের আক্রমণের শিকার হয়, চোখ অন্ধ হয়ে যায়। কোনো প্রকার নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছাড়াই কোকো ফিল্ডে শিশুদের দ্বারা বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করানো হয়। তাই কীটনাশকের বিষক্রিয়া দ্বারা শিশুরা আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই প্রতিকূল জীবন সহ্য করতে না পেরে অনেক শিশুই মারা যায়। মৃত্যুর পরও তাদের সমাধিস্ত করা হয় না। মরদেহ ফেলে দেওয়া হয় কোনো নর্দমা বা খালে। কখনো তা ছিঁড়ে খায় কোনো পশু।
এই আধুনিক যুগে এসেও বিশ্বের কোথাও কোথাও যে এমন বর্বর ক্রীতদাসের জীবনযাপন করে অসংখ্য মানুষ, তা একই সঙ্গে বিস্ময়কর এবং ভীষণ লজ্জার। শিশুদের এই অমানবিক জীবন থেকে বাঁচানোর জন্য বারবার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেসব পদক্ষেপ বা চুক্তি কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। কিছু সাংবাদিক তাদের মানবেতর জীবন নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে তুলে ধরতে চেয়েছে বিশ্ববাসীর কাছে। বিনিময়ে তাদের কাউকে কাউকে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। ২০০৪ সালে হত্যা করা হয় আইভরিকোস্টের এক সাংবাদিককে এবং ২০১০ সালে আইভরিকোস্ট সরকার ৩টি সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে দেয় এসব নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করার জন্য।
ইন্টারন্যাশনাল কোকোয়া ইনিশিয়েটিভ শিশুশ্রম বন্ধে কাজ করছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যেই তারা শিশুশ্রম বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। শিশুরা এই বর্বর জীবন থেকে মুক্তি পাক। তারা ফিরে পাক প্রকৃত শৈশব, কৈশোর। কাঁধে ভারী কোকোর বস্তার বদলে স্কুলব্যাগ নিয়ে বিদ্যাপিঠে গিয়ে আলো ছড়াক এসব শিশু। তারাও বাঁচার মতো করে বাঁচুক।
কলি