নোয়াখালীর জেলা শহর মাইজদীর পৌরপার্ক ঘেঁষে জীর্ণশীর্ণ একটি একতলা ভবন। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এই বাড়ির বিশেষত্ব। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা মেলে একদল প্রাণোচ্ছল তরুণের। তাদের মধ্যে কেউ ব্যস্ত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাঠদানে, কেউ করছে লাইব্রেরির তদারকি, কেউবা ব্যস্ত স্পেশাল চাইল্ডদের থেরাপি নিয়ে। বলছিলাম জয়বাংলা অ্যাওয়ার্ড-২০২৩ জেতা নোয়াখালীর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বপ্ন-এক চিলতে হাসির জন্যে’-এর কথা।
শিক্ষা, সুবিধাবঞ্চিত ও প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি বর্তমানে ৮টি প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে ‘স্বপ্ন এক চিলতে হাসির জন্যে’ নামের এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের চলমান প্রজেক্টগুলো হলো ১০ টাকায় শিক্ষা, স্মাইল ফর স্পেশালস, উৎসবে নতুন জামা, স্বপ্নলোকে পাঠাগার, সেফ টাচ রং টাচ, আই অ্যাম ভিকটিম, প্রজেক্ট উৎসবে এক বেলা ভালো খাবার এবং প্রজেক্ট রোদ্দুর।
শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, শুরুর গল্পটা মোটেও সহজ ছিল না মফস্বলের এই সংগঠনের জন্য। ২০১৩ সালে একঝাঁক স্বপ্নবাজ ও সাহসী তরুণ-তরুণী নোয়াখালী জিলা স্কুলের বারান্দায় মাইনুল হাসান শিমুলের নেতৃত্বে নিজেদের পকেটের ক্ষুদ্র অর্থ দিয়ে শুরু করেন এই স্বপ্নযাত্রা। সবাই মিলে দশ হাতকে এক হাতে রূপান্তরিত করে স্বপ্ন দেখল সবার মুখে এক চিলতে হাসি ফোটানোর।
কিন্তু বাধ সাধে মফস্বলের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের একসঙ্গে পাওয়ার চ্যালেঞ্জ। পাওয়া গেলেও ছিল সেই শিশুদের অভিভাবকদের এ ব্যাপারে সম্মত করানো এবং শিক্ষার গুরুত্ব বোঝানোসহ বহু বাধা-বিপত্তি। এই সমস্যা উত্তরণে স্বপ্নবাজ তরুণরা পরিকল্পনা করে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার মাধ্যমে তাদের সবাইকে অভিভাবকসহ এক ছাদের নিচে জড়ো করবে। উদ্দেশ্য ছিল এসব শিশুর অভিভাবককে শিক্ষার গুরুত্ব ও তাদের অভিপ্রায় সম্পর্কে জানানো। এভাবেই বুকের ভেতরে অগাধ বিশ্বাস আর অদম্য উচ্ছ্বাস নিয়ে তারা মাঠে নেমেছিল উৎসবে ‘একটি নতুন জামার প্রজেক্ট নিয়ে’। সেবারের ঈদে ২৫৬ বাচ্চাকে নতুন ঈদ জামা দিয়ে এবং তাদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়ে শুরু হয় পথযাত্রা। সেই থেকে আজ অবধি তাদের স্বপ্ন দেখা থেমে থাকেনি।
প্রথম যখন নতুন জামার প্রজেক্টটি শুরু করা হয় তখন একটি রঙিন, ঝকঝকে ও নতুন পোশাক পেয়েই খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল শিশুর দল। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভরা এই হাসি মুখগুলো নেশা ধরিয়ে দেয় স্বপ্নবাজদের, তাই প্রতিবার তারা আরও বড় পরিসরে ও নতুন উদ্যম নিয়ে হাসি ফোটানোর এই কর্মযজ্ঞে নেমে পড়ে। আর ১১ বছর ধরে চলছে এই হাসি ফোটানোর নিয়মিত প্রচেষ্টা।
জরিপের মাধ্যমে পুরো জেলা থেকে সংগ্রহ করে সুবিধাবঞ্চিত প্রত্যেকটি শিশু, তাদের লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান ও প্রয়োজনীয় বৃত্তি প্রদান করে সারা বছর মনিটরিংয়ে রাখে স্বপ্নবাজরা। এই স্বপ্নবাজদের হাত ধরেই প্রতিবছরই ঈদ এবং শারদীয় দুর্গাপূজায় নোয়াখালীর হাজার হাজার শিশু সাজে রঙিন জামায়।
শিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতেও বরাবরই সচেষ্ট ছিল সংগঠনটি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে, পার্কে, বিদ্যালয়ের আঙিনায় পড়ানো থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের আঙিনায় ২০১৭ সালের ২৬ জুলাই তারা চালু করে প্রজেক্ট ‘১০ টাকায় শিক্ষা’। যেখানে তাদের ভলান্টিয়াররা ১০ টাকার বিনিময়ে পাঠদান করায় সেসব বাচ্চাকে, যাদের অভিভাবক অক্ষরজ্ঞানহীন এবং বাচ্চাদের অন্যত্র পড়ানোর সামর্থ্য রাখে না। সেসব বাচ্চাকে এই সংগঠনটি প্রান্তিক পর্যায়ের বিদ্যালয় থেকে খুঁজে এনে পাঠদান করিয়ে থাকে। সহশিক্ষা কার্যক্রমেও তাদের এগিয়ে রাখার জন্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
২০২০ সালে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের মেধার বিকাশ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে চালু করে প্রজেক্ট ‘স্মাইল ফর স্পেশালস।’ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাও মাঝে মধ্যে বাবা-মায়ের জন্য হয়ে ওঠে গলার কাঁটা। আর সেই সঙ্গে তারা যদি হয় অটিজম আক্রান্ত, তাহলে তো কথাই নেই। কী নিদারুণ কষ্ট যে পায় এই বাচ্চাগুলো। সমাজের চোখে বোঝা হয়ে, গলগ্রহ হয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকে। ভালো চিকিৎসা তো দূরের কথা, একটু সুন্দর ব্যবহারও জোটে না অনেকের কপালে। এই ফুটফুটে স্পেশাল বাচ্চাদের নিয়েই তৈরি করা হয়েছে স্মাইল ফর স্পেশালস, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত স্পেশাল বাচ্চাগুলোর মুখে হাসি ফোটানো। এখানে মাসিক ১০ টাকার বিনিময়ে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সাধারণ জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে দেওয়া হয় বিভিন্ন ধরনের স্পেশাল থেরাপি এবং উন্নত চিকিৎসা। শুধু তাই নয় এই স্পেশাল চাইল্ডদের জন্য আরও রয়েছে প্রি-স্কুলিংয়ের ব্যবস্থা, যেন ওরা কোনোভাবেই মূলস্রোত থেকে ছিটকে না পড়ে। যেহেতু দূরদূরান্ত থেকে অনেক শিশু আসে এবং ওদের যাতায়াত হয়ে পড়ে ব্যয়বহুল, তাই এই প্রজেক্টের আওতাধীন শিশুদের যাতায়াতের জন্য দুটি ভ্যানেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যে সংগঠনটি চালু করে প্রজেক্ট ‘সেফ টাচ, রং টাচ’। যার মাধ্যমে এই সংগঠনের ভলান্টিয়াররা নোয়াখালীর প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করে কোন ধরনের স্পর্শ তাদের জন্য নিরাপদ এবং কোনটি নিরাপদ নয়। এ ছাড়া এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়লে তাদের কী করা উচিত সেই সম্পর্কেও অবহিত করে। কোনো শিশু হ্যারাসমেন্টের শিকার হলে প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং এবং অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে উঠান বৈঠক চলে বছরজুড়ে।
২০১৭ সালে নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা প্রতিরোধে আইনি সুবিধা ও ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে চালু করে ‘প্রজেক্ট আই অ্যাম ভিকটিম’। যেখানে নির্যাতনের শিকার সুবিধাবঞ্চিত নারীদের আইনের লড়াইয়ে সাহায্য করার পাশাপাশি সাইকোলজিক্যাল ট্রমা থেকে বের করে আনার জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের সুবিচার পাইয়ে দেওয়া এবং তাদের স্বাবলম্বী করে তোলাই এর মূল উদ্দেশ্য।
এসবের বাইরে পাঠাগার নিয়েও কাজ করেছে সংগঠনটি। নোয়াখালী জেলার মাইজদী শহরে সম্প্রতি চালু করেছে ‘স্বপ্নলোক পাঠাগার’। এখানে অল্প অল্প করে ভারী হচ্ছে তাদের বইয়ের ভান্ডার। শিশু-কিশোররা এখন ডিজিটাল ডিভাইসের বদলে মুখ গুঁজতে পারবে বইয়ের দুনিয়ায়। ওদের হাত ধরেই এই শহরে ফিরে আসবে ঠাকুরমার ঝুলির মজার মজার সব গল্প কিংবা তিন গোয়েন্দার সঙ্গে পাড়ি জমাবে নতুন কোনো রহস্যের খোঁজে।
‘স্বপ্ন এক চিলতে হাসির জন্যে’কে স্বনির্ভর করার তাগিদে রোদ্দুর ‘প্রজেক্ট রোদ্দুর’-এর জন্ম হয়েছিল। এই প্রজেক্টের আওতায় ‘স্বপ্ন এক চিলতে হাসির জন্যে’-এর ভলান্টিয়াররা নিজস্ব ডিজাইনে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বিক্রয় করত। একটা সময় রোদ্দুরের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘প্রজেক্ট ১০ টাকায় শিক্ষা’-এর বাচ্চাদের মায়েরা। স্বপ্নবাজদের তত্ত্বাবধানে তারা তৈরি করেন বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পসামগ্রী। রোদ্দুরের বেশির ভাগ তৈরি করা পণ্য কেনেন তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরাই এবং এর সম্পূর্ণ লভ্যাংশ ব্যয় করা হয় নিজেদের এই সংগঠনের ব্যয় নির্বাহে।
করোনা মহামারিও কিন্তু দমিয়ে রাখতে পারেনি এই স্বপ্নবাজের দলকে। করোনার সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোয় তারা প্রথমেই চালু করেছিল হ্যান্ড স্যানিটাইজেশান বুথ, করেছিল বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ। এ ছাড়া সবাইকে মহামারি সম্পর্কে সতর্ক করানোর লক্ষ্যে জায়গায় জায়গায় লাগানো হয়েছিল লিফলেট। করোনা মহামারি যখন ভয়াবহ আকার ধারণ করে, তখন তারা চালু করেছিল ইমার্জেন্সি ফুড রেসপন্স। যার আওতায় নোয়াখালীর বিভিন্ন জায়গায় তারা বিনামূল্যে পৌঁছে দিয়েছিল চাল, ডাল, শুকনো খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সঙ্গে পৌঁছে দিয়েছিল ওষুধের মতো জরুরি সামগ্রীও।
এ ছাড়া উৎসবে সবার জন্যে এক বেলা ভালো খাবার নিশ্চিত করতে ২০২২ ও ২০২৪-এ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় আয়োজন করা হয় সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য এক বেলা ভালো খাবারের বন্দোবস্ত।
‘স্বপ্ন - এক চিলতে হাসির জন্যে’র প্রতিষ্ঠাতা মাইনুল হাসান শিমুল বলেন, এই মুহূর্তে নোয়াখালীতে তীব্র বর্ষণের ফলে সৃষ্ট বন্যায় ২ লাখ পানিবন্দি মানুষের মধ্যে জরুরি খাবার ও ওষধ সরবরাহ করছি আমরা। ইমার্জেন্সি ফুড রেসপন্স নামক প্রজেক্ট নিয়ে, হটলাইন তৈরির মাধ্যমে আমাদের সংগঠনের সদস্যরা ছুটছেন প্রত্যেকটি মানুষের দুয়ারে। নোয়াখালীর যে প্রান্ত থেকেই ফোন করা হচ্ছে সেখানেই ছুটছে টিম স্বপ্ন। পাশাপাশি খাল ও নালা পরিষ্কারে কাজ করছে আমাদের আরেকটি দল, যেন দ্রুত এই পানি নেমে যায়।
স্বপ্নবাজদের এই সুদীর্ঘ পথচলা কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না। বারবার হোঁচট খেয়েছে তারা। জেলা শহরের বুকে তাদের এই ছোট্ট অফিসে পরপর দুবার চুরি হয়। খোয়া যায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। কিন্তু এরপরও থেমে থাকেনি স্বপ্ন দেখা, স্বপ্নবাজরা আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কারণ তারা চান এই সমাজের বুকে শিশুদের আগে সুবিধাবঞ্চিত কোনো বিশেষণ যেন আর না যোগ হয়। এই পৃথিবীর সব শিশুর মৌলিক অধিকারগুলো যেন নিশ্চিত হয়, তারা যেন রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ায় পৃথিবীজুড়ে। এই স্বপ্নবাজরা বিশ্বাস করে, তারা একদিন ঠিকই পারবেন। তাই স্বপ্ন দেখতে দেখতে ডালপালা মেলে তারা এগিয়ে যান। কারণ, সামনে পাড়ি দিতে হবে বিশাল সমুদ্দুর।
কলি