যদি বলি, একটি জলপাই গাছের বয়স ৩ হাজার বছর! হয়তো বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। কিন্তু বাস্তবেই এমন বয়সের একটি গাছ রয়েছে গ্রিসের ক্রিটের চানিয়ার কিসামোসের আনো ভাউভস গ্রামে। এখন থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে বাণিজ্যিকভাবে জলপাই চাষ শুরু হয় এখানে। দ্বীপের ভাউভস গ্রামের জলপাই গাছটি সেই সময়ের বলেই ধারণা।
গাছটির সঠিক বয়স নির্ণয় করা যায় না। কারণ এটা কখন লাগানো তা অন্যান্য অনেক গাছের মতোই কোথাও লেখা নেই। তবে ক্রিট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এটি ৪ হাজার বছর পুরোনো বলে অনুমান করেছেন। গাছের কাছে আবিষ্কৃত জ্যামিতিক সময়কালের দুটি কবরস্থানই এর বয়সের সম্ভাব্য সূচক। প্রতি বছর আনুমানিক ২০ হাজার মানুষ গাছটি দেখতে আসেন।
এত বয়স হওয়া সত্ত্বেও জলপাই গাছটিতে ফল ধরে চলছে। যদিও এর ফলন আগের মতো অত বেশি নয়। এ গাছের জলপাই দিয়ে তেল তৈরি করা হয়, যা স্থানীয় এবং পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণের বিষয়। একটি গাছের বয়স ২ হাজার বা ৩ হাজার বছর, এমনটা শুনলে যে কারও ধারণা করা খুবই স্বাভাবিক যে, গাছটি হয়তো শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে। কিন্তু গ্রিসের এই জলপাই গাছটি তেমন নয়। গাছটি আজও সজীব। ঝকঝকে সবুজ পাতার ডালগুলো চারপাশে শোভা ছড়িয়ে যেন বলছে- বয়স কোনো ব্যাপার নয়।
প্রায় ২৩০০ বছর আগে আয়ারল্যান্ডে এক ব্যক্তির নাম ছিল ওল্ড ক্রোগান ম্যান (আইরিশ ভাষায় Seanfhear Chruacháin)। লৌহযুগের ওই ব্যক্তিটির উচ্চতা প্রায় সাড়ে ৬ ফুট, অর্থাৎ তার সময়ের অন্যদের তুলনায় বেশ লম্বা। তবে ওল্ড ক্রোগান ম্যান বৃদ্ধ ছিলেন না। মারা যাওয়ার সময় তার বয়স ছিল বিশের কোঠায়। অনেকের মতে, ওল্ড ক্রোগান ম্যান ছিলেন রাজা অথবা রাজপুত্র। তার মৃতদেহ ২০০৩ সালে আয়ারল্যান্ডের ক্রোগান হিলের একটি পিট বগের ভেতরে পাওয়া যায়।
পিট বগ হলো বিশেষ এক ধরনের উদ্ভিদ বা শ্যাওলা দিয়ে ঘেরা খাদের ভূগর্ভস্থ জলাভূমি। শ্যাওলাগুলো ওই জলাভূমির গর্ত বা পকেটগুলো খুব ঠাণ্ডা, অম্লীয় ও অক্সিজেন মুক্ত রাখে। ফলে সেখানে কোনো পদার্থ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এসব পিট বগে ধাতব জিনিস, ঝুড়ি, মানুষের দেহাবশেষ, মাখনসহ বিভিন্ন যন্ত্র সংরক্ষণ করা হতো।
এই সংরক্ষণ এতটাই নিখুঁত হয়েছিল যে, শুরুতে সবাই ধারণা করেছিল লোকটিকে সম্প্রতি খুন করা হয়েছে। কারণ অনেক সময়ই কোনো খুনের অপরাধ ধামাচাপা দিতে এই বগগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।
ড্রেনেজ খাদ খনন করতে গিয়ে শ্রমিকরা ওল্ড ক্রোগান ম্যানকে খুঁজে পাওয়ার সময় প্রথমে এমনটিই মনে হয়েছিল। পরীক্ষা করার পর জানা যায়, ওল্ড ক্রোগান ম্যান কোনো আধুনিক ব্যক্তি নয়। তবে তাকে খুন করাই হয়েছে।
লোকটির ম্যানিকিউরড নখের কারণে অনুমান করা হয়, তিনি কায়িক শ্রমে নিয়োজিত ছিলেন না, সম্ভবত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। মৃত্যুর আগে অন্তত ৪ মাস তিনি আমিষসমৃদ্ধ খাবার খেয়েছিলেন বলে গবেষণায় দেখা গেছে। ওই দেহাবশেষের নামকরণ করা হয় ক্রোগান হিলের নামানুসারে।
তাকে প্রাচীন একটি পাহাড়ের পাদদেশে কোনো বগে সমাহিত করা হয়েছিল, যা রাজার অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হতো। আর ওই সময় বগগুলোকে সীমানা হিসেবে মনে করা হতো।
২০১৪ সালের এক ডকুমেন্টারি বলছে, ওল্ড ক্রোগান ম্যান একজন রাজা বা রাজপুত্র ছিলেন। তিনি খারাপ আবহাওয়া বা ফসলের কারণে বলির শিকার হন। ওই প্রাচীন উপজাতিরা হয়তো বিশ্বাস করত যে, এটি রাজার ব্যর্থতার কারণে হয়েছিল এবং এর জন্য তিনিই দায়ী।
বগে মৃতদেহ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, বেশ আচারিক উপায়ে হত্যা করা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, মানব বলিদান ওল্ড ক্রোগান মানুষের সংস্কৃতির একটি স্বীকৃত অংশ ছিল। ওই উপজাতির কোনো লিখিত ভাষা ছিল না। তাই তাকে কেন হত্যা করে বগে ফেলা হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানার উপায় নেই। বিতর্ক রয়েছে, ওই সময়ের লোকেরা জানত যে বগ খাদ্য পচন থেকে রক্ষা করে। এক ধরনের হিমায়ন হিসেবে বগের মধ্যে তারা মাখন সংরক্ষণ করত। নাকি মাখনকেও বলি হিসেবে বোঝানো হয়েছিল, কে জানে!
ধারণা করা হয়, ওল্ড ক্রোগান ম্যান ৩৬২ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ থেকে ১৭৫ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে মারা গিয়েছিলেন। সম্ভবত বুকে ছুরিকাঘাতে তার মৃত্যু হয়। তার শিরোশ্ছেদ করা হয়েছিল এবং তার দেহ অর্ধেক কেটে ফেলা হয়েছিল। তার একটি বাহুতে আঘাত রয়েছে। এটা প্রমাণ করে, তিনি নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন।
এমনও হতে পারে, তিনি জানতেন ফসল খারাপ হলে তার ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে! তিনি স্বেচ্ছা মৃত্যুতে যেতে পারেন। আত্মত্যাগের আগে একটি প্রতীকী শেষ খাবার খেয়েছিলেন, যাতে তার মৃত্যু পরিস্থিতির উন্নতি করে।
আবার তার বাহুতে আবিষ্কৃত ক্ষতটিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, তিনি আক্রমণকারীদের থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে এটা নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব নয়।
বর্তমানে ওল্ড ক্রোগান ম্যানকে আয়ারল্যান্ডের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে প্রদর্শনে রাখা হয়েছে। যারা তাকে হত্যা করেছিল, তারা কেউই হয়তো আন্দাজ করতে পারেনি যে তার দেহ এতদিন পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে।
বিশ্বের অনেক ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক প্রথার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে রয়েছে অনেক গাছ। এসব গাছকে শক্তিদায়ক, রোগমুক্তি এবং কখনো কখনো ঐশ্বরিক জগতের মাধ্যম হিসেবেও দেখা হয়। জনপ্রিয় ব্রিটিশ সংগীতশিল্পী জাহ্নবী হ্যারিসন এরকম সাতটি পবিত্র গাছের কথা বলেছেন, যেখানে প্রাচ্যের পদ্মফুল থেকে শুরু করে পাশ্চাত্যের পুদিনা গাছও রয়েছে।কিন্তু পবিত্র বলে বিবেচিত এসব উদ্ভিদের বিশেষত্ব কী? অতীতে মানুষ এসব গাছকে যতটা আবশ্যক বলে মনে করত, এখনো কি সেরকম ভাবে? এসব গাছের প্রভাবই-বা কী? সবচেয়ে বড় কথা, এসব গাছের এত গুরুত্ব কেন?
সবচেয়ে পবিত্র বলে মনে করা হয়, এরকম সাতটি গাছের বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো-
১. পদ্ম ফুল পদ্ম ফুল হচ্ছে এমন একটি উদ্ভিদ, যেটির একেক স্তরের পাপড়ি প্রাচ্যের ধর্মীয় শিক্ষা বা সংস্কারে বিভিন্ন অর্থ বহন করে।হিন্দুদের কাছে চমৎকার এই ফুলটি জীবন, উর্বরতা আর পবিত্রতার প্রতীক। ফুলটিকে পবিত্র বলে মনে করে বৌদ্ধরাও।কাদার ওপর জন্ম নেওয়া এই সুন্দর ফুলটি যেন নির্লিপ্ততারও প্রতীক। যদিও এই উদ্ভিদের শেকড় কাদার ভেতর, কিন্তু ফুলটি পানির ওপরে ভেসে থাকে।
গল্পগাথা প্রচলিত রয়েছে যে, ভগবান বিষ্ণুর নাভির ভেতর থেকে পদ্মের জন্ম আর ব্রহ্মা এর কেন্দ্রে বসে থাকেন। অনেকে বিশ্বাস করেন, ঈশ্বরের হাত আর পা পদ্ম ফুলের মতো এবং তার চোখ ফুলের পাপড়ির মতো। হিন্দু ধর্মে বলা হয়, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই পদ্মের পবিত্র আত্মা রয়েছে।
২. মিসলটো বর্তমানে মিসলটো ক্রিসমাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়, কিন্তু প্রাচীন কেল্টিক ধর্মীয় নেতাদের ক্রিয়াকর্মে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল এই উদ্ভিদ।
তারা বিশ্বাস করত, সূর্য দেবতা টারানিসের সংস্পর্শ রয়েছে মিসলটোর মধ্যে, ফলে যে গাছে মিসলটো জন্ম নেবে বা যে ডালে সেটি ছড়াবে, সেটিও পবিত্র বলে বিবেচিত হবে। শীতের সময় যখন সূর্য সবচেয়ে দূরে থাকে, সেদিন প্রধান ধর্মযাজক সাদা কাপড় পরে একটি স্বর্ণের কাস্তে দিয়ে ওক গাছ থেকে পবিত্র মিসলটো কেটে সংগ্রহ করতেন। এই বিশেষ গাছ এবং তার ফল ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম বা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
তখন বিশ্বাস করা হতো যে এর জাদুকরী ক্ষমতা রয়েছে। মিসলটোর একটি অংশই রোগ সারাতে পারে, যেকোনো বিষের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে, মানব শরীরে উর্বরতা বৃদ্ধি করতে পারে এবং ডাইনির ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে। তবে সত্যি কথা হলো, এটা পুরোটাই ভুল ধারণা। বরং পেটে গেলে মিসলটো বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
৩. পেয়টে পেয়টে হলো ছোট, কাণ্ডহীন একপ্রকার ক্যাকটাস, যেটি টেক্সাস এবং মেক্সিকোর মরুভূমিতে জন্মে থাকে। সহস্রকাল ধরে প্রাচীন গোত্র বা আদিবাসী মানুষজন এই গাছটিতে তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করে আসছে।
মেক্সিকোর হুইকোল ইন্ডিয়ান আর অনেক আদিবাসী আমেরিকান গোত্র বিশ্বাস করত যে, পেয়টে একটি পবিত্র উদ্ভিদ, যা তাদের ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগে সাহায্য করবে।
ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এর ব্যবহার এক ধরনের মোহ বা আবেশ তৈরি করে, ফলে অনেকেই কল্পনা জগতে বা অলৌকিক জগতে বিচরণ করছেন বলে মনে করেন। তবে পেয়টের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার ভক্ত শুধু আদিবাসী গোত্রের সদস্যরাই নন। পেয়টের এই মাদকতার কারণে সেটি ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর বাইরে শিল্পী, সংগীতশিল্পী আর লেখকদের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ১৯৫০ সালের পর থেকে এই ক্যাকটাসটির খবর তারা পায়।
৪. তুলসী হিন্দু ধর্মে বলা হয়, কৃষ্ণ এবং তার ভক্তদের সেবা করার জন্য বৃন্দাবনের একজন অভিভাবক হিসেবে দেবী বিরিন্দাই তুলসীপাতা হিসেবে জন্ম নেন। আবার প্রাচীন গ্রন্থে বলা হয়, কৃষ্ণ নিজেই তাকে তুলসী আকারে গ্রহণ করেছেন। ফলে যেখানেই এই গাছটির জন্ম হোক না কেন, সেটিকে পবিত্র বলে বিবেচিত বৃন্দাবনের মাটি বলেই মনে করা হয়। পৃথিবীজুড়ে লাখ লাখ হিন্দু তাদের প্রতিদিনের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে, মন্দিরে বা বাসায়, তুলসী গাছের পাতা ব্যবহার করেন।
৫. ইয়ু গাছ সারা বছর ধরে সবুজ থাকে এমন একটি দেবদারু জাতের গাছ ইয়ু, যেটি হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকতে পারে। অনেকেই এই গাছটিতে পুনর্জন্ম এবং অনন্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখেন। এর কারণ, এই গাছের ভেঙে বা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া ডালপালা থেকে নতুন গাছের জন্ম হতে পারে। এমনকি পুরোনো গাছের গুড়ির ভেতর থেকেও নতুন একটি ইয়ু গাছের জন্ম হতে পারে, তাই অনেকে একে পুনর্জন্মের উদাহরণ হিসেবেও মনে করেন।
খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে ইয়ু একটি প্রতীকী গাছ- মারা যাওয়া স্বজনদের কফিনে ইয়ু গাছের অঙ্কুর দেওয়া হয় এবং অনেক চার্চের পাশে এই গাছটি দেখা যায়।
তবে খ্রিষ্টান ধর্মেরও আগে থেকে অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী এই গাছটিকে পূজা করে আসছে। তারা সেসব স্থানে তাদের প্রার্থনা কেন্দ্র নির্বাচন করত, যেখানে আগে থেকেই ইয়ু গাছ রয়েছে।
৬. গাজা রাস্তাফারি ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছে গাজার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা বিশ্বাস করে, বাইবেলে যে জীবনের গাছের কথা বলা হয়েছে, গাজা গাছ হচ্ছে সেই গাছ, এ কারণে এটি পবিত্র।
যদিও গাজার অনেক নাম রয়েছে, তবে এই ধর্মের লোকজন এটিকে ‘পবিত্র ভেষজ’ বলে ডেকে থাকে। যেমন বাইবেলের ২২:২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জাতিদের মুক্ত করার জন্যই এ ভেষজ।’ তারা মনে করে, এই ভেষজ তাদের ঈশ্বরের কাছাকাছি নিয়ে যায় আর তাদের ভেতরের আধ্যাত্মিক শক্তিকে বাড়িয়ে দেয়।
তাদের ভাষায় এই জ্ঞান উদ্ভিদ অনেক রীতিনীতির সঙ্গে গ্রহণ করা হয়। সিগারেট বা পাইপের ভেতর ঢুকিয়ে এর ধোঁয়া নেওয়ার সময় নানা ধর্মীয় আচার পালন করা হয়।
৭. পুদিনা পিৎজা বা পাস্তা সসে যে জিনিসটা সবচেয়ে আগে পাওয়া যাবে, তা হলো এই পুদিনা পাতা। অর্থোডক্স খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে এবং গ্রিক চার্চে এটি একটি পবিত্র ভেষজ হিসেবে গণ্য করা হয়।
পুদিনা ইংরেজি নাম ‘বাসিল’ এসেছে গ্রিক শব্দ ‘রাজকীয়’ থেকে। অর্থোডক্স খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করেন, যেখানে যিশু খ্রিষ্টের রক্ত পড়েছিল, সেখানেই এই গাছটির জন্ম হয়েছিল। এ কারণেই খ্রিষ্ট ধর্মের অনেক অনুষ্ঠানে পুদিনা পাতার উপস্থিতি দেখা যায়। পবিত্র পানি পরিশোধন করতে যাজকরা পুদিনা পাতার ব্যবহার করেন এবং ধর্মসভায় পুদিনা গাছ ভেজানো পানি ছিটানো হয়।
চার্চের বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ক্রসের সঙ্গে পুদিনা গাছ থাকে এবং ছোট ছোট ডালপালা হাতে হাতে দিয়ে দেওয়া হয়। অনেকে এসব ডালপালা পানিতে ভিজিয়ে রাখেন, যাতে সেটি নতুন শেকড় ছাড়ে, তারা সেগুলো আশীর্বাদ হিসেবে নিজেদের বাড়িতে লাগিয়ে রাখতে পারেন।
পৃথিবীতে গাছ মানুষের অন্যতম বন্ধু। মানুষের অতি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন আসে গাছ থেকে। ফলমূল সরবরাহের পাশাপাশি গাছ আমাদের ছায়া দেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঢাল হিসেবে কাজ করে। তাই উদ্ভিদ বা গাছের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব বহু পুরোনো। সেই গাছকে শিল্প হিসেবে ব্যবহার করার ইতিহাসও বেশ পুরোনো। তেমনই এক শিল্প বনসাই। বৃহৎ গাছকে ছোট করে বাড়িতে সাজিয়ে রাখার পদ্ধতি বনসাই। বাসাবাড়িতে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এটি। প্রায় হাজার বছরের পুরোনো এই শিল্প এখনো বেশ জনপ্রিয়।
বনসাই শব্দটি মূলত জাপানি শব্দ। চিনা শব্দ ‘পেনজাই’ থেকে এই শব্দের উৎপত্তি। বড় কাণ্ডযুক্ত এবং লম্বা গাছ খাটো করে টবে বা পাত্রে চাষ করা হয় বা বেড়ে উঠে তাকে বনসাই বলা হয়। বনসাই শব্দের ‘বন’ শব্দটি দ্বারা যে পাত্রে বনসাই রাখা হয় তাকে বোঝায়। বনসাই অর্থ ‘পাত্রের মধ্যে গাছ’। খাটো এবং ছোট আকারে চাষ করা গাছগুলো বনসাই নামে পরিচিত। যেসব গাছের বৃদ্ধি ধীরে ধীরে হয়, গাছের কাণ্ড মোটা হয় সেগুলোকে বনসাই করা হয়। যেমন বটগাছ, তেঁতুলগাছ, শিরীষ, নিমগাছ ইত্যাদি গাছের বনসাই করা হয়।
বনসাই গাছের ইতিহাস পাওয়া যায় প্রাচীন মিসরে। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় পাত্রে বা টবে গাছ বা বিভিন্ন ধরনের গাছের চারা উৎপাদন করা হতো। মিসরের ফারাওরা তাদের বাগানে পাত্রের মধ্যে খেজুর, জলপাই এবং অন্যান্য গাছের বাগান করত। প্রাচীন ভারতেও টবে গাছ উৎপাদনের ইতিহাস পাওয়া যায়। কিন্তু টবে বনসাই গাছের উৎপাদন করা হয় প্রথম চীনে। প্রায় হাজার বছর আগে প্রাচীন চীনে বনসাই গাছের উৎপত্তি হয়। চিনা ভ্রমণকারীরা পাহাড়ের চূড়ায় দেখতে পেত বড় গাছের আকৃতির মতো ছোট ছোট গাছ। আবহাওয়ার কারণে ছোট হয়ে যাওয়া গাছগুলো তারা সংগ্রহ করে নিয়ে আসত। চীনাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল বৃহৎ গাছগুলোকে ছোট আকারে রূপ দিলে এক ধরনের অতিপ্রকৃত শক্তি এতে জন্ম নেবে। চীনারা একে নাম দিয়েছিল ‘পেনজাই’। যেখানে পেন হলো ছোট থালা বা ট্রে আকৃতির পাত্র।
চীনাদের বামন আকৃতির গাছ তাদের বিভিন্ন চিত্রকর্মেও খুঁজে পাওয়া যায়। তারা এমনভাবে বনসাই করত যাতে গাছগুলোর শিকড় দেখতে বিভিন্ন পৌরাণিক জীবের সঙ্গে মিলে যায়। চীনের পেনজাই জাপানে বনসাই হয় চীনের সন্ন্যাসীদের কল্যাণে। চীনা সন্ন্যাসীরা জাপানে যান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। তখন তারা উপহার হিসেবে নিয়ে যান ছোট ছোট বনসাই গাছ। এদিকে জাপানিরা এই গাছের গুণমুগ্ধ হয়ে সাদরে গ্রহণ করে তা। জাপানে একে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। পরবর্তীতে জাপান থেকে বনসাই ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে। দুনিয়াব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বনসাই গাছ।
বাংলাদেশেও বনসাই বেশ জনপ্রিয়। একটু খরচে হলেও শৌখিন মানুষ বনসাই নিতে পছন্দ করেন। বাংলাদেশে বনসাই নিয়ে সংগঠনও আছে ‘বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটি’ নামে। বনসাই চাষ করতে প্রথমে গাছের বৈশিষ্ট্য জেনে নিতে হবে। বনসাই চাষের ক্ষেত্রে দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। তার পর মাটির সঙ্গে জৈব সার যুক্ত করতে হবে। পানি নিষ্কাশন যাতে ভালো হয়, তাই মাটিতে বিভিন্ন উপাদান যোগ করতে হবে। কম্পোস্ট সার, ইটের গুঁড়ো, বালি, পাথরের গুঁড়ো, পোড়ামাটির গুঁড়ো, ছাই ইত্যাদি মেশানো উচিত। টবের নিচে দুটো ছিদ্র থাকবে যাতে পানি নিষ্কাশন হয় এবং গাছের বৃদ্ধি কমিয়ে রাখবে। বনসাই গাছের জন্য চারা বীজ থেকে অথবা কলম থেকেও সংগ্রহ করা যায়। নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করা যায়। তার পর ছোট টবে স্থাপন করতে হবে তা। বনসাইয়ের জন্য ছোট টবই যথেষ্ট। টবের নিচে দুটো ছিদ্র থাকবে। বনসাই রোপণ করা হয় সাধারণত বর্ষাকালে।
বনসাইয়ের চারা বিভিন্ন নার্সারিতে পাওয়া যায়। তাছাড়া বিভিন্ন সময় কৃষি প্রদর্শনীতেও চারা পাওয়া যায়। বট, বকুল, শিমুল, পাকুড়, তেঁতুল, শিরীষ, বাবলা ইত্যাদি গাছ থেকে বনসাই তৈরি করা হয় বাংলাদেশে।
বনসাইয়ের চারা বিভিন্ন দামের হয়ে থাকে। ৩ হাজার থেকে শুরু করে লাখ টাকা দামের হয়ে থাকে বনসাইয়ের চারা। নিয়ম মেনে পরিচর্যা করলে সঠিকভাবে বেড়ে উঠে বাসাবাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে বনসাই।
বিশ্বের প্রতিটি দেশেরই আছে নিজস্ব কিছু নিয়মনীতি। এই যেমন আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা উদ্ভট কিছু রীতি অনুশীলন করে। যেগুলো অন্যদের কাছে উদ্ভট, হাস্যকর কিংবা অমানবিক বলে মনে হয়। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজার ও শাদ। দেশ দুটির অংশে থাকা সাহারা মরুভূমিতে বাস করে যাযাবর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ওডাআবে।
সারা বছর এ উপজাতির মানুষ ছোট ছোট পরিবার নিয়ে গড়া কয়েকটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় সাহারা মরুভূমির মরূদ্যানগুলোতে। পশুপালনই এদের মূল জীবিকা। ওডাআবে উপজাতির নারী ও পুরুষরা তাদের সৌন্দর্য নিয়ে ভীষণ গর্বিত। পুরুষরা মনে করে তারাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ। এমনকি তাদের রূপচর্চায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই তারা সর্বদা সঙ্গে আয়না নিয়ে ঘোরে।
নাইজারের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ওডাআবে যুগ যুগ ধরে পালন করে আসছে ‘বউ চুরি উৎসব’। খানিকটা অবাক করা হলেও সত্যিই এমনও এক ধরনের উৎসব পালিত হয় পশ্চিম আফ্রিকায়।
উৎসবে ‘অন্যের বউকে চুরি’ করেন সেখানকার পুরুষরা। এ কারণেই এটি ‘বউ চুরির উৎসব’ নামেই পরিচিত। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী লোকেরা একে ‘গেরেওল উৎসব’ বলে থাকেন। তবে অন্যের বউকে চুরি করা হলেও এতে নেই কোনো শাস্তি।প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয় ‘বউ চুরির উৎসব’, চলে এক সপ্তাহ ধরে।
বউ চুরি প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার প্রায় ৬ ঘণ্টা আগ থেকে সাজগোজ করেন পুরুষরা। মুখে মাখেন লাল মাটি, চোখে লাগান কাজল, ঠোঁটে দেন লাল লিপস্টিক। একই সঙ্গে নাকে সাদা বা হলুদ রেখা টানেন, আবার মাথার চুলে বিনুনি করে পুঁতি ও কড়ি লাগান। মাথায় পড়েন উটপাখির পালক। অন্যের বউকে চুরি করে পুরুষের ক্ষমতা প্রদর্শন করাই ‘গেরেওল উৎসব’-এর মূল আকর্ষণ। ওডাআবে পুরুষদের ধারণা, তাদের সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে চোখের ধবধবে সাদাভাব, লম্বা নাক ও ঝকঝকে সাদা দাঁতে। এভাবেই পুরুষরা প্রতিযোগিতার জন্য নিজেদের তৈরি করেন।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, যেসব পুরুষ অন্যের বউকে নিয়ে পালান, তাদের স্ত্রীরাও এই উৎসবে অংশ নেন। আগের সম্পর্ক ভেঙে নতুন করে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখেন। যা বিভিন্ন ধর্ম ও সামাজিক আইনে অবৈধ। উৎসবে নাচ-গান ও হই-হুল্লোড়ের পাশাপাশি চলে খাওয়াদাওয়া।
এই প্রতিযোগিতায় বিচারক হন এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সেরা তিনজন বিবাহিত নারী। তারাই সেরা পুরুষদের বেছে নেন। আর বাছাইয়ের পর সেরা পুরুষরা তাদের পছন্দসই নারীকে বেছে নিতে পারেন। ওডাআবে সমাজে এই অমানবিক কর্মকাণ্ডই বৈধ বলে বিবেচিত।
এই প্রতিযোগিতার পরই শুরু হয় বউ চুরি উৎসব। নৃত্য প্রতিযোগিতা চলাকালীন পুরুষরা নাচের মাধ্যমে নারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন। অনেক নারীই তাদের সঙ্গী হিসেবে পেতে চান। তবে নৃত্যরত পুরুষ যাকে চান তাকে তিনি পরে খুঁজে নেন।
প্রতিযোগিতা শেষে ওই নারীকে ভিড়ের মধ্যে খুঁজে সুযোগ নিয়ে তার কাঁধে টোকা দেন। সেই ডাকে সাড়া দেন নারীও। এর পর পরস্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যান ওই পুরুষ। বউ চুরি করে ধরা না পড়লে ওই নারীর সমাজ স্বীকৃত দ্বিতীয় স্বামী হয়ে যান পুরুষটি।
এদিকে ওই নারীর সংসারে রেখে যাওয়া সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্ব নেয় তার পরিবার। এই উৎসবটি তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য প্রতিবছরের সেপ্টেম্বর মাস নিয়ে তাদের জল্পনা-কল্পনা থাকে তুঙ্গে।
এ ছাড়া ওডাআবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মেয়েরা বিয়ের আগে যার সঙ্গে ইচ্ছে সম্পর্কে যেতে পারেন। এসব বিষয় তাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক ও বৈধ। আবার বিয়ের পরও তারা যত খুশি স্বামী রাখতে পারেন।
আমাদের সংসারের ইতিটা হয়েছিল ঠিক এভাবেই- ‘হয় তুমি থাকো, না হয় তোমার বাবার বাড়ি চলে যাও’। তার এই কথার মাঝে আমি সেদিন আমার জন্য এতটুকু মায়া দেখিনি। আমিও চলে গেলাম ছলছল চোখ দুটো মুছে।
আমাদের ছিল প্রেমের বিয়ে। প্রথমে আমার শ্বশুরবাড়ির কেউ মেনে না নিলেও পরে তারা যৌতুক দাবি করেন এবং তাতে আমার বাবা সম্মতি জানান। আমি ছিলাম আমার বাবার একমাত্র মেয়ে। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। পরিবারে বড় ভাই না থাকার যন্ত্রণা কী, সেটা আমার বাবা মারা যাওয়ার পর বুঝতে পারি।
সব নিয়ম মেনেই আমাদের বিয়ে হয়। শায়ান তার পরিবারের বড় ছেলে। বলতে গেলে বাবা-মায়ের বাধ্য ছেলে। আমার প্রতি তার টান থাকলেও সেটা যেন দেখাতে নেই। আমার বিয়ের কয়েকদিন না যেতেই শুরু হয় তুমুল ঝামেলা, আমার দেবরের বিয়ে নিয়ে। আমার শাশুড়ি তার ছেলেকে বলতে লাগল কোন ফকিন্নির মেয়ে আনছিস, কিছুই তো পেলাম না। আর দেখ আমার ছোট ছেলে কত বড় লোকের মেয়ে বিয়ে করেছে। পান থেকে চুন কিছুই বাদ দেয়নি, সবই দিয়েছে।
এর পর থেকে আমার স্বামী ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগল। অফিস থেকে আসার সঙ্গে সঙ্গে কত শত নালিশ প্রস্তুত থাকত। একদিন হঠাৎ আমার জা চিৎকার করতে লাগল। সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখি, সে পা পিছলে পড়ে গিয়েছে উঠোনে। সেদিন সবাই আমাকে বকাঝকা করল উঠোন ঝাড়ু দিইনি বলে। অথচ রোজকার সব কাজ আমিই করি। সেদিন শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, তাই আর ঝাড়ু দেওয়া হয়নি। আমার স্বামী আমার ওপর প্রথম হাত তুলল এ কারণে। এভাবেই ধীরে ধীরে তার মাঝে পরিবর্তন দেখতে পাই। প্রতিদিন তার অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ আমি আর নিতে পারি না। মাঝে মাঝে নেশা করে এসে আমার গায়ে হাত ওঠায়। এতকিছুর পরও সহ্য করেছিলাম, কারণ তখন আমার সন্তান গর্ভে।
আমি কখনো চাইনি আমার পরিবারের কেউ জানুক আমার এ অবস্থার কথা। তবু কীভাবে যেন আমার বাবা জানতে পারল। মায়ের ফোনে জানতে পারলাম, আমার বাবা হাসপাতালে স্ট্রোক করে মারা গেছেন। বাবার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে দৌড়ে গেলাম। মা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে। বিলাপ করতে করতে বলল, তোর সুখের জন্য তোর বাবা কী না করল। শেষে মানুষটা তোর এ যন্ত্রণা নিতে পারল না। তাই তো এভাবে চলে গেল। সেদিন স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির কেউ আমার বাবাকে দেখতে এল না।
বাবা মারা যাওয়ার পর আমার স্বামীর বাড়ি গিয়ে জানতে পারি, তারা কেউ আর আমায় রাখবে না। এভাবে আমাদের সম্পর্কে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় যৌতুক নামের অনাচার। যা আমার জীবনের সব সুখকে অসুখে পরিণত করেছে।