রাজু দুরন্ত এক বালক। দেখতে শুনতে, মস্তিষ্কের বুদ্ধিমত্তায় অন্য ছেলেদের থেকে আলাদা। এই ছেলেটা জন্মের মাস দুয়েক পর এপিটাফের মতো শোক দেখতে পায়। নিষ্পাপ একটা শিশু অনাথ হয়ে যায়। রাজুর জন্মের মাস দুয়েকের মাথায় তার বাবার মৃত্যু হয়। সেদিন জানাজার সময় বিছানায় শুয়ে সে হেসেছিল শুধু, কিন্তু তার কান্না কেঁদেছে আকাশ।
রাজুর বাবার নাম নকিব। পেশায় রাজমিস্ত্রি। সংসার চলত তার আয় করা অর্থ দিয়ে। দিন আনে দিন খায়, বিষয়টা ঠিক তেমনি। নকিব এবং মরিয়মের সংসারে ভালোবাসা অনেক। নকিব কোথাও যাওয়ার আগে মরিয়মের কপালে চুমু খায়। রাজু হওয়ার পর দুজনকে চুমু খেতে হয়। এটাও যেন তার
আনন্দের অংশ।
সেদিন সন্ধ্যা ৬টা। আকাশজুড়ে বজ্রপাত, তীব্র হাওয়া বইছে। বিদ্যুৎ নেই। মরিয়ম এবং রাজু ঘরে একা। মরিয়মের টেনশন হচ্ছে। নকিব বাড়ি ফেরেনি। রাত ১০টা বেজে গেল। রাজু ঘুমিয়ে পড়েছে। মরিয়মের ছোট চাচা বৃষ্টি মাথায় ঘর থেকে বের হলো নকিবকে খোঁজার জন্য। কিছু দূর যেতেই টর্চের আলোতে কিছু একটা দেখতে পেল। টর্চ লাইটের আলো নকিবের মুখে। চোখ খোলা, শীতল এক দেহ বৃষ্টিতে ভিজে শুয়ে আছে। তার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে বাজার সদাই! সে তো অনেক আগের কথা।
রাজু এখন ইটভাটায় কামলা দেয়। এখন সে-ই সংসার চালায়। মরিয়ম আগের মতো দেহে শক্তি পায় না। স্বামীর মৃত্যুর পর নির্বোধ হয়ে গেছে। আর বিয়ে করেনি মরিয়ম। রাজুকে নিয়ে জীবন চলমান। সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করতে পারল না। রাজুর বয়স যখন ৬ হলো, তখন তাকে ইটের ভাটায় কাজে দিয়ে দেয় মরিয়ম। কারণ বর্তমানে রাজু ছাড়া তার পরিবারে আর কেউ নেই। স্বামীর মৃত্যুর পর বাপের বাড়ির লোক আর কয়দিন দেখে, তাও আবার মধ্যবিত্ত পরিবারে?
পারিবারিক বিভিন্ন কারণে এ সমাজের অনেক শিশু শৈশব পায় না। তারা শৈশব হারিয়ে ফেলে পারিবারিক অনটন, দারিদ্র্যে। উচ্চবিত্তদের পড়াশোনার নিদারুণ চাপেও ছেলেমেয়েরা শৈশব হারায়। রাজুর বাবার মৃত্যু না হলে রাজুও শৈশব উপভোগ করে দুরন্ত এক বালক হয়ে কৈশোরে পা দিত। সহপাঠীদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলায় সময় পার করে দিত। খেলাধুলার জন্য পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ হলে বাবা-মায়ের বকা শুনত।
সেদিন রাজুকে দেখলাম ১০টি ইট মাথায় করে এপাশ থেকে ওপাশ যাচ্ছে। খানিক থমকে গেলাম! রাজু জন্মের সময় ফুটফুটে এক ছেলে ছিল। সুন্দর এবং মায়াবী ছিল। সেই ছেলেটা এখন একদম কালো হয়ে গেছে রোদে পুড়ে। কোমলতা নেই, রুক্ষ মরুভূমি হয়েছে দেহ। ইটভাটার আগুন, ধুলাতেই যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। রাজুর শরীরটাও যেন শুকিয়ে কাঠ।
রাজুর শৈশবের মৃত্যু হয়েছে কৈশোরে আসার আগে। সে তার শৈশবের দলছুট, লাটিম ঘুরানো, কড়িখেলা, ইচিং বিচিং, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, পুতুল খেলা, লাটিম খেলা এসব দেখেনি। সে দেখেছে জ্বলন্ত আগুনে কীভাবে মাটি দিতে হয়। কত ইঞ্চি ফ্রেম দিলে ইটের সাইজ সুন্দর হয়। কতক্ষণ পোড়ালে ইট টকটকে লাল হয়। আমাদের সমাজে এমন অসংখ্য রাজু আছে যারা তাদের শৈশব হারায় পারিবারিক দায়বদ্ধতায়।
ভোলা
কলি