আদিকালে বনে-জঙ্গলে বসবাস করত মানুষ। ধীরে ধীরে এই মানবজাতি সভ্য হয়েছে। যুগে যুগে এসেছে বিভিন্ন সভ্যতা, সভ্যতার পরিবর্তন। সিন্ধু সভ্যতা, রোমান সভ্যতার মতোই আরেকটি সভ্যতা হলো ইনকা সভ্যতা। ১৫ শতকে ইনকা সভ্যতার সূচনা হয় দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালার দক্ষিণে কুজকো অঞ্চলে।
ইনকা শাসকরা ছিলেন অভিজাত রাজকীয় বংশের। সম্রাটকে বলা হতো ইনকা। পরে অবশ্য সভ্যতার নামই হয়ে যায় ইনকা। সম্রাটের অন্য নাম সাপা ইনকা। ‘ইনকা’ শব্দের অর্থ ‘সূর্য দেবতার সন্তান’। ইকুয়েডর, পেরু, বলিভিয়া, উত্তর পশ্চিম আর্জেন্টিনা, উত্তর চিলি ও দক্ষিণ কলম্বিয়া ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ইনকা সভ্যতা বরাবরই বিস্মিত করে আধুনিক মানুষকে। ইনকা সভ্যতার মানুষ তাদের মনের ভাব প্রকাশ করত দড়ির গিঁটের মাধ্যমে। কী রঙের সুতা, কতগুলো গিঁট কিংবা দুটি গিঁটের দূরত্ব কত- এসব দেখেই তারা অন্যের ভাব ও ভাষা বুঝতেন। এগুলোকে ‘খিপু’ বলে। ইনকাদের আদিপুরুষরা শিকার করতে পছন্দ করত। পরে তারা ধীরে ধীরে কৃষির দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইনকাদের প্রধান খাদ্য ছিল ভুট্টা ও আলু। তারা ভুট্টা থেকে এক ধরনের পানীয় তৈরি করত যার নাম ছিল ‘চিচা’। পেরুতে অবশ্য এই ‘চিচা’ এখনো জনপ্রিয়। এ ছাড়া তারা ওল, নীল শ্যাওলা, কাঁচা মরিচ খেত। মাংসের মধ্যে খেত গিনিপিগ ও ছাগল জাতীয় লামার মাংস। সাগরের নিকটবর্তী এলাকার মানুষ সামুদ্রিক মাছ খেত।
ইনকা সভ্যতায় অনেক শিশুকে খুঁজে পাওয়া যেত না। শিশু হারানোর রহস্য যেন দিন দিন মানুষকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু এই রহস্যেরও সমাধান হয়। জানা গেছে, দেব-দেবীর সন্তুষ্টির জন্য তারা ‘কাপাকোচা’ নামের একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে শিশুদের বলি দিত। দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার আগে ইনকারা বিভিন্নভাবে তাদের শিশুদের মোটাতাজা করত। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ব্যাপক খননকাজের ফলে ২০০১ সালে ইনকাদের বলির শিকার তিন শিশুর দেহাবশেষের সন্ধান পাওয়া গেছে। যদিও তারা বিষয়টি প্রকাশ করেছেন আরও আট বছর পরে। এই তিন শিশুর বয়স ১৫, ৬ এবং ৭ বছর। তিনজনের মধ্যে দুজন মেয়ে এবং একজন ছেলে শিশু ছিল। এমনকি এদের মধ্যে একজন রাজকুমারীও ছিল। ইনকাদের বিশ্বাস ছিল তিনটি জগতের ওপর। উচ্চ জগৎ, মধ্য জগৎ এবং নিম্ন জগৎ। উচ্চ জগৎ হলো স্বর্গ। তারা বিশ্বাস করত পুণ্যবান এবং রাজারা মৃত্যুর পর স্বর্গে যাবেন। সেখানে রয়েছে অসীম সুখ। মধ্য জগৎ হলো পৃথিবী। ইনকারা বিশ্বাস করত তারা তাদের কর্ম অনুযায়ী মৃত্যুর পর এখানে তার ফল ভোগ করবে এবং নিম্ন জগৎ হলো নরক; যেখানে মৃত্যুর পর পাপীরা ফল ভোগ করবে।
ইনকা সাম্রাজ্য পরিচালনা করত রাজকীয় পরামর্শসভা। পুরোহিত প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সেনাপতির সমন্বয়েই গড়ে উঠত রাজকীয় পরামর্শসভা। এরা সর্ম্পকে আত্মীয়। সম্রাটরা বিয়ে করতেন আপন বোনকে। পুত্রদের মধ্য থেকে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করতেন। সাধারণত বড় ছেলেই সম্রাট হতো। ইনকা অভিজাতদেরও কাউন্সিল ছিল। তারা সাম্রাজ্য পরিচালনায় সাহায্য করত। ইনকা যোদ্ধারা অন্য নগর আক্রমণ করে জয় করলেও স্থানীয় শাসনকর্তাকে হত্যা করত না যদি সে শাসনকর্তা ইনকা আইন মেনে চলত, বিদ্রোহ না করত, কর দিত আর শস্যভান্ডার মজুত রাখত। ইনকাদের কর ব্যবস্থা ছিল কঠোর। মেয়েদের নির্দিষ্ট পরিমাণে কাপড় বুনতে হতো। পুরুষেরা কাজ করত সৈন্যবিভাগে কি খনিতে। জনগণকে কর দিতে হতো। হাতে পয়সা না থাকলে রাষ্ট্রীয় কাজ করে কর শোধ করে দিত। কিংবা পোশাক তৈরি করে বিক্রি করে কর দিত।
ইনকা সভ্যতার মানুষ অনেক রংচঙে পোশাক পরত। রং ও নকশা তাদের পোশাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব রং ও নকশা ছিল, যা তাদের আলাদা পরিচয় বহন করত। লাল, হলুদ এবং কালো রঙের বিভিন্ন শেড ছিল ইনকা পোশাকের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। উজ্জ্বল রঙের কাপড় এবং জটিল জ্যামিতিক নকশা ছিল উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়। তবে তাদের পোশাক মূলত উল এবং তুলা দিয়ে তৈরি করা হতো। উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা আলপাকা এবং ভিকুনার উল দিয়ে তৈরি পোশাক পরত, যা ছিল খুবই মসৃণ ও আরামদায়ক। সাধারণ মানুষ লামার উল ব্যবহার করত, যা ছিল কম দামি। তুলা ব্যবহার করা হতো গরম আবহাওয়ায় হালকা পোশাক তৈরির জন্য। ইনকা সভ্যতার পোশাক শুধু তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ নয়, বরং তাদের সংস্কৃতি এবং সামাজিক কাঠামোরও প্রতিফলন ছিল। তাদের পোশাকের মধ্য দিয়ে তাদের কৃষ্টি, ঐতিহ্য এবং সামাজিক স্তরের প্রতিচ্ছবি দেখা যেত।
ইনকারা খাদ্য সঞ্চয়ে বেশ সাফল্য দেখিয়েছিল। সাম্রাজ্যজুড়ে অসংখ্য সরকারি খাদ্যভাণ্ডার ছিল। এ ছাড়া সাধারণ মানুষকে খাদ্য সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করা হতো। এই প্রক্রিয়ায় তাদের প্রায় পাঁচ থেকে সাত বছরের খাদ্য মজুতের ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, খাদ্যশস্য মজুতের কলাকৌশল রপ্ত করেছিল বলেই ইনকা সভ্যতা নাকি অত উন্নত স্তরে পৌঁছেছিল। শস্য ছাড়াও তারা মাংস শুকিয়ে নোনা করে রাখত।
জাহ্নবী