আমাদের সংসারের ইতিটা হয়েছিল ঠিক এভাবেই- ‘হয় তুমি থাকো, না হয় তোমার বাবার বাড়ি চলে যাও’। তার এই কথার মাঝে আমি সেদিন আমার জন্য এতটুকু মায়া দেখিনি। আমিও চলে গেলাম ছলছল চোখ দুটো মুছে।
আমাদের ছিল প্রেমের বিয়ে। প্রথমে আমার শ্বশুরবাড়ির কেউ মেনে না নিলেও পরে তারা যৌতুক দাবি করেন এবং তাতে আমার বাবা সম্মতি জানান। আমি ছিলাম আমার বাবার একমাত্র মেয়ে। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। পরিবারে বড় ভাই না থাকার যন্ত্রণা কী, সেটা আমার বাবা মারা যাওয়ার পর বুঝতে পারি।
সব নিয়ম মেনেই আমাদের বিয়ে হয়। শায়ান তার পরিবারের বড় ছেলে। বলতে গেলে বাবা-মায়ের বাধ্য ছেলে। আমার প্রতি তার টান থাকলেও সেটা যেন দেখাতে নেই। আমার বিয়ের কয়েকদিন না যেতেই শুরু হয় তুমুল ঝামেলা, আমার দেবরের বিয়ে নিয়ে। আমার শাশুড়ি তার ছেলেকে বলতে লাগল কোন ফকিন্নির মেয়ে আনছিস, কিছুই তো পেলাম না। আর দেখ আমার ছোট ছেলে কত বড় লোকের মেয়ে বিয়ে করেছে। পান থেকে চুন কিছুই বাদ দেয়নি, সবই দিয়েছে।
এর পর থেকে আমার স্বামী ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগল। অফিস থেকে আসার সঙ্গে সঙ্গে কত শত নালিশ প্রস্তুত থাকত। একদিন হঠাৎ আমার জা চিৎকার করতে লাগল। সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখি, সে পা পিছলে পড়ে গিয়েছে উঠোনে। সেদিন সবাই আমাকে বকাঝকা করল উঠোন ঝাড়ু দিইনি বলে। অথচ রোজকার সব কাজ আমিই করি। সেদিন শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, তাই আর ঝাড়ু দেওয়া হয়নি। আমার স্বামী আমার ওপর প্রথম হাত তুলল এ কারণে। এভাবেই ধীরে ধীরে তার মাঝে পরিবর্তন দেখতে পাই। প্রতিদিন তার অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ আমি আর নিতে পারি না। মাঝে মাঝে নেশা করে এসে আমার গায়ে হাত ওঠায়। এতকিছুর পরও সহ্য করেছিলাম, কারণ তখন আমার সন্তান গর্ভে।
আমি কখনো চাইনি আমার পরিবারের কেউ জানুক আমার এ অবস্থার কথা। তবু কীভাবে যেন আমার বাবা জানতে পারল। মায়ের ফোনে জানতে পারলাম, আমার বাবা হাসপাতালে স্ট্রোক করে মারা গেছেন। বাবার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে দৌড়ে গেলাম। মা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে। বিলাপ করতে করতে বলল, তোর সুখের জন্য তোর বাবা কী না করল। শেষে মানুষটা তোর এ যন্ত্রণা নিতে পারল না। তাই তো এভাবে চলে গেল। সেদিন স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির কেউ আমার বাবাকে দেখতে এল না।
বাবা মারা যাওয়ার পর আমার স্বামীর বাড়ি গিয়ে জানতে পারি, তারা কেউ আর আমায় রাখবে না। এভাবে আমাদের সম্পর্কে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় যৌতুক নামের অনাচার। যা আমার জীবনের সব সুখকে অসুখে পরিণত করেছে।
ঠিকানা পাওয়া যায়নি
কলি