পৃথিবীতে গাছ মানুষের অন্যতম বন্ধু। মানুষের অতি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন আসে গাছ থেকে। ফলমূল সরবরাহের পাশাপাশি গাছ আমাদের ছায়া দেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঢাল হিসেবে কাজ করে। তাই উদ্ভিদ বা গাছের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব বহু পুরোনো। সেই গাছকে শিল্প হিসেবে ব্যবহার করার ইতিহাসও বেশ পুরোনো। তেমনই এক শিল্প বনসাই। বৃহৎ গাছকে ছোট করে বাড়িতে সাজিয়ে রাখার পদ্ধতি বনসাই। বাসাবাড়িতে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এটি। প্রায় হাজার বছরের পুরোনো এই শিল্প এখনো বেশ জনপ্রিয়।
বনসাই শব্দটি মূলত জাপানি শব্দ। চিনা শব্দ ‘পেনজাই’ থেকে এই শব্দের উৎপত্তি। বড় কাণ্ডযুক্ত এবং লম্বা গাছ খাটো করে টবে বা পাত্রে চাষ করা হয় বা বেড়ে উঠে তাকে বনসাই বলা হয়। বনসাই শব্দের ‘বন’ শব্দটি দ্বারা যে পাত্রে বনসাই রাখা হয় তাকে বোঝায়। বনসাই অর্থ ‘পাত্রের মধ্যে গাছ’। খাটো এবং ছোট আকারে চাষ করা গাছগুলো বনসাই নামে পরিচিত। যেসব গাছের বৃদ্ধি ধীরে ধীরে হয়, গাছের কাণ্ড মোটা হয় সেগুলোকে বনসাই করা হয়। যেমন বটগাছ, তেঁতুলগাছ, শিরীষ, নিমগাছ ইত্যাদি গাছের বনসাই করা হয়।
বনসাই গাছের ইতিহাস পাওয়া যায় প্রাচীন মিসরে। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় পাত্রে বা টবে গাছ বা বিভিন্ন ধরনের গাছের চারা উৎপাদন করা হতো। মিসরের ফারাওরা তাদের বাগানে পাত্রের মধ্যে খেজুর, জলপাই এবং অন্যান্য গাছের বাগান করত। প্রাচীন ভারতেও টবে গাছ উৎপাদনের ইতিহাস পাওয়া যায়। কিন্তু টবে বনসাই গাছের উৎপাদন করা হয় প্রথম চীনে। প্রায় হাজার বছর আগে প্রাচীন চীনে বনসাই গাছের উৎপত্তি হয়। চিনা ভ্রমণকারীরা পাহাড়ের চূড়ায় দেখতে পেত বড় গাছের আকৃতির মতো ছোট ছোট গাছ। আবহাওয়ার কারণে ছোট হয়ে যাওয়া গাছগুলো তারা সংগ্রহ করে নিয়ে আসত। চীনাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল বৃহৎ গাছগুলোকে ছোট আকারে রূপ দিলে এক ধরনের অতিপ্রকৃত শক্তি এতে জন্ম নেবে। চীনারা একে নাম দিয়েছিল ‘পেনজাই’। যেখানে পেন হলো ছোট থালা বা ট্রে আকৃতির পাত্র।
চীনাদের বামন আকৃতির গাছ তাদের বিভিন্ন চিত্রকর্মেও খুঁজে পাওয়া যায়। তারা এমনভাবে বনসাই করত যাতে গাছগুলোর শিকড় দেখতে বিভিন্ন পৌরাণিক জীবের সঙ্গে মিলে যায়। চীনের পেনজাই জাপানে বনসাই হয় চীনের সন্ন্যাসীদের কল্যাণে। চীনা সন্ন্যাসীরা জাপানে যান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। তখন তারা উপহার হিসেবে নিয়ে যান ছোট ছোট বনসাই গাছ। এদিকে জাপানিরা এই গাছের গুণমুগ্ধ হয়ে সাদরে গ্রহণ করে তা। জাপানে একে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। পরবর্তীতে জাপান থেকে বনসাই ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে। দুনিয়াব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বনসাই গাছ।
বাংলাদেশেও বনসাই বেশ জনপ্রিয়। একটু খরচে হলেও শৌখিন মানুষ বনসাই নিতে পছন্দ করেন। বাংলাদেশে বনসাই নিয়ে সংগঠনও আছে ‘বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটি’ নামে। বনসাই চাষ করতে প্রথমে গাছের বৈশিষ্ট্য জেনে নিতে হবে। বনসাই চাষের ক্ষেত্রে দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। তার পর মাটির সঙ্গে জৈব সার যুক্ত করতে হবে। পানি নিষ্কাশন যাতে ভালো হয়, তাই মাটিতে বিভিন্ন উপাদান যোগ করতে হবে। কম্পোস্ট সার, ইটের গুঁড়ো, বালি, পাথরের গুঁড়ো, পোড়ামাটির গুঁড়ো, ছাই ইত্যাদি মেশানো উচিত। টবের নিচে দুটো ছিদ্র থাকবে যাতে পানি নিষ্কাশন হয় এবং গাছের বৃদ্ধি কমিয়ে রাখবে। বনসাই গাছের জন্য চারা বীজ থেকে অথবা কলম থেকেও সংগ্রহ করা যায়। নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করা যায়। তার পর ছোট টবে স্থাপন করতে হবে তা। বনসাইয়ের জন্য ছোট টবই যথেষ্ট। টবের নিচে দুটো ছিদ্র থাকবে। বনসাই রোপণ করা হয় সাধারণত বর্ষাকালে।
বনসাইয়ের চারা বিভিন্ন নার্সারিতে পাওয়া যায়। তাছাড়া বিভিন্ন সময় কৃষি প্রদর্শনীতেও চারা পাওয়া যায়। বট, বকুল, শিমুল, পাকুড়, তেঁতুল, শিরীষ, বাবলা ইত্যাদি গাছ থেকে বনসাই তৈরি করা হয় বাংলাদেশে।
বনসাইয়ের চারা বিভিন্ন দামের হয়ে থাকে। ৩ হাজার থেকে শুরু করে লাখ টাকা দামের হয়ে থাকে বনসাইয়ের চারা। নিয়ম মেনে পরিচর্যা করলে সঠিকভাবে বেড়ে উঠে বাসাবাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে বনসাই।
কলি