নব্বই দশকের কথা। তখন তরুণ বয়স। সবেমাত্র ছড়া-কবিতা লেখা শুরু করেছি। লিখতে লিখতে অনেক ছড়া-কবিতা জমা হতে থাকে। এগুলো এখন কী করা যায়। ভাবছি আর ভাবছি। তখনকার সময়ে আমাদের বাড়ির কাছেই শেখ আলী আকবর নামে একজন বয়োবৃদ্ধ কাকু ছিলেন যিনি সংবাদপত্রে লেখালেখি করতেন। তাকে গিয়ে ধরলাম। আমার কবিতা-ছড়া আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখালাম। তিনি আমাকে উৎসাহ দিতে থাকলেন।
তিনি বললেন, আমি তোমাকে পত্রিকা অফিসে নিয়ে যাব। সেখানে শিশু পাতায় তোমার লেখা কবিতা ছাপা হবে। আমার তো আর তর সয় না।
বললাম, কাকু কবে নিয়ে যাবেন?
কাকু বললেন, আগামী রবিবার যাব।
রবিবার সকাল সকাল রেডি হয়ে বসে আছি। তিনি এসে আমাকে ডাকতেই বেরিয়ে পড়লাম তার সঙ্গে। কাঠপট্টি লঞ্চ ঘাট থেকে ছোট লঞ্চে চড়ে বসলাম। লঞ্চ নদী পানি কেটে এগিয়ে চলছে। তখকার সময়ে পৌনে দুই ঘণ্টা সময় লাগত ঢাকার সদরঘাট পৌঁছাতে।
সদরঘাট নেমে প্রথমে কোর্ট কাচারী এলাকা থেকে শিঙাড়া আর আর চা খেয়ে নিলাম। তখন এক কাপ দুধ চা ছিল ৩ টাকা। খেতে অনেক স্বাদ ছিল। ঘন দুধের চা বলে কথা।
নাশতা শেষ করে বাসে চড়ে চলে এলাম পল্টন এলাকার দৈনিক সমাচার পত্রিকায়। সেখানে কবিতা দিয়ে আমাকে নিয়ে আসল ইত্তেফাকের দাদা ভাইয়ের কচি কাঁচা শিশু পাতায়। সেখানে শিশুদের ছোট গল্প দিয়ে দুপুরে হোটেলে গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেলাম। এক প্লেট গরুর মাংস তখনকার সময় ২৫ টাকায় পাওয়া যেত। সারা দিন ঘুরে বিকেলে চলে এলাম পাটুয়াটুলী। সেখানে দৈনিক সবুজ বাংলা অফিসে কবিতা পাঠের আসর বসে। কবিতা পাঠের আসরে তখন উপস্থিত থাকতেন নামকরা কবিরা। কবিতা পাঠের আসর শেষে এবার বাড়ি ফেরার পালা।
আরো পড়ুন: দেয়াল
তাড়াহুড়ো করে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে চলে এলাম। সন্ধ্যার পর আর ছোট লঞ্চ চলাচল করে না এ লাইনে। এবার বাড়ি যেতে হলে বড় তিনতলা বিশিষ্ট লঞ্চে বসতে হবে। অগত্যা সময় নষ্ট না করে লঞ্চের নিচতলার এক পাশে বেঞ্চে বসলাম। আমার কাকু আলী আকবরের কাঁধে সবসময় একটা ব্যাগ থাকে। ব্যাগের ভেতর একটি খেরো খাতা যাতে সারা জীবনের গল্প আর কবিতা লেখা রয়েছে। আর পুরোনো টুকিটাকি কাগজ। ব্যাগটা বেঞ্চে রেখে কাকু আমার জন্য ঝালমুড়ি আনতে গেছেন কাছেই। কাকু ব্যাগের কাছ থেকে একটু সরতেই ঝপাৎ করে কিছু একটা পড়ার শব্দ পেলাম। চেয়ে দেখি কাকুর ব্যাগ নেই। সেই ব্যাগ নিয়েই ছিনতাইকারী পানির মধ্যে ঝাঁপ মেরেছে। আমি কিছুটা বিচলিত বোধ করলাম। কাকুকে দেখি হাসছে!
জিজ্ঞেস করলাম, কাকু হাসছেন কেন
তিনি বললেন, ছিনতাইকারীর জীবনের মতো শিক্ষা হয়েছে। ব্যাগে তো কিছুই নেই। আছে শুধু কবিতা আর কাগজপত্র। এ কথা শুনে আমার মনটাও ছিনতাইকারীর জন্য মায়া লাগল। কী রিস্ক নিয়েই না অন্ধকার নদীতে ঝাঁপ দিল। কিন্তু এত কসরত করেও কোনো কড়ির দেখা ছিনতাইকারী পাবে না। এটা একটা কথা হলো!
তখনকার সময়ে সদর ঘাটে ওত পেতে থাকা ছিনতাইকারীরা এভাবেই নারীদের কানের দুল ছিঁড়ে নিয়ে চলন্ত নদীতে ঝাঁপ দিত। কারও কাপড়-চোপড়বোঝাই ব্যাগ নিত। কান ছিঁড়ে দুল নেওয়ার সময় কান থেকে অনেকেরই রক্ত পড়তে দেখতাম। তাই সদর ঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে সবাই সচেতন থাকত। আলীর টেক এবং বক্তাবলী এলাকা ছিল এ ছিনতাইকারীদের রুটম্যাপ। সেখানে তাদের জন্য নৌকা নিয়ে অন্য গ্রুপ অপেক্ষা করত। ঝাঁপ দেওয়ার কিছু পরেই তাদের নৌকায় তুলে নিত।
সে ঘটনার প্রায় দুই যুগ হতে চলল। লঞ্চ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার আর ঘটনা ঘটছে না বললেই চলে। কিন্তু সদর ঘাটে ছিনতাই থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনৈতিক কাজের কথা এখনও শোনা যায়।
মিরাপাড়া, রিকাবীবাজার, মুন্সীগঞ্জ
কলি