আইসক্রিমের স্বাদ জীবনে একবারও নেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। ছোটবেলায় গ্রামের পথ ধরে আইসক্রিমের গাড়ি চলে যেত। সেই গাড়ির টুংটাং শব্দ আর আইসক্রিমওয়ালার ‘এই মালাই, কুলফি মালাই, আইসক্রিম’ ইত্যাদি হাঁকডাক শুনে সবার ছুটে যাওয়া, আইসক্রিম খেয়ে পোশাক নষ্ট করে মায়ের বকুনি খাওয়া, এসবই মধুর স্মৃতি। কিন্তু অবাক করা তথ্য হচ্ছে, একসময় তা ছিল শুধু অভিজাতদের খাবার। সাধারণ মানুষের সাধ্য বা হাতের নাগালের বাইরে ছিল আইসক্রিম।
আইসক্রিম আবিষ্কারের নির্দিষ্ট কোনো তারিখ বা আবিষ্কারকের নাম নেই। আইসক্রিমের ইতিহাস নিয়ে একটি প্রচলিত গল্প শোনা যায়। আর এই গল্পের সূচনা ধরা হয় ৬২ খ্রিষ্টাব্দে। রোমের রাজা নিরো বাবুর্চির কাছে নতুন মুখরোচক কিছু খেতে চাইলেন। বাবুর্চি তখন রাজার এক কর্মচারীকে পাঠালেন অ্যাপেনাইন পাহাড় থেকে কিছু বরফ নিয়ে আসতে। বাবুর্চি বরফের সঙ্গে বাদাম আর মধু মিশিয়ে রাজাকে পরিবেশন করলেন সেই নতুন খাবার। রাজা কিছুটা ভয়ে ভয়ে মুখে দিলেন এক চামচ। মুখে দিতেই কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলেন। তার পর চোখ খুলেই পরম তৃপ্তি নিয়ে বললেন, ‘ওহে, কোথা পেলে এমন মজাদার জিনিস!’
আইসক্রিমের জন্মস্থান ধরা হয় মূলত চীনকে। চীনের শাং সাম্রাজ্যের রাজা টাঙের সময়কালে আইসক্রিমের মতোই বরফে তৈরি এক ধরনের খাবারের প্রচলন ছিল; যা বানাতে মহিষের দুধ, আটা এবং কর্পূর ব্যবহার করা হতো। টাঙের ৯৪ জন আইসম্যান ছিল, যারা সেই খাবারটি বানাতে সহায়তা করতেন।
ইতালীয় পর্যটক মার্কো পোলো আইসক্রিম তৈরির কৌশলটি চীন থেকে ইউরোপে নিয়ে আসেন। মার্কো পোলো খাবারটি খেয়ে পছন্দ করেন এবং এর কৌশল শিখে নেন। এ খাবারের নাম পরে হয় আইসক্রিম। ১৫৩৩ সালে আইসক্রিম ইতালি থেকে প্রথম ফ্রান্সে আসে এবং সেখান থেকে যায় ইংল্যান্ডে। এরপর আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আইসক্রিম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০০ সাল থেকে আইসক্রিমের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়।
আমেরিকার মতো দেশেও ১৮০০ সালের আগে সাধারণ মানুষ আইসক্রিম খাওয়ার সুযোগ পাননি। দেশটিতে আইসক্রিমের প্রথম বিজ্ঞাপন বের হয় ১৭৭৭ সালে, নিউইয়র্ক গেজেটে। ১৭৯০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন আইসক্রিমের পেছনে প্রায় ২০০ ডলার খরচ করেছিলেন।
১৭ শতকের দিকে ইংল্যান্ডে যখন আইসক্রিম এসেছিল, তখন ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লস তার রাঁধুনিকে ৫০০ পাউন্ড করে উপহার দিতেন, যাতে সে আইসক্রিমের রেসিপি ইংল্যান্ডবাসীর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে।
আইসক্রিমের ইতিহাস নিয়ে তথ্যে ভিন্নতা থাকলেও ইতিহাস গবেষক হাশেম সুফি এক গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘মোগলরাই পৃথিবীকে আইসক্রিম উপহার দিয়েছে’। সম্রাট আকবরের রাজকীয় রান্নাঘরে কোনাকৃতির ধাতব ছাঁচের ভেতর জন্ম হয়েছিল কুলফির। সে থেকে তার আমির-ওমরাহ সবাই কুলফি দিয়ে শরীর জুড়াতে পছন্দ করতেন। মোগলদের বাড়ি বাড়ি কুলফি আইসক্রিম বানানো হতো। এখনকার ভারতেও সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় কুলফি। আমাদের দেশেও এর জনপ্রিয়তা লক্ষ করার মতো।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিস আইসক্রিম খাওয়াকে বেশ উৎসাহিত করেছিলেন আর কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন, ‘আইসক্রিম জীবনে প্রাণের সঞ্চার করে আর বেঁচে থাকার উদ্যমতা জোগায়।’ আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ফুলের মধুর সঙ্গে বরফ দিয়ে খেতে ভালোবাসতেন। এদিকে বাইবেলের রেফারেন্সে রয়েছে, রাজা সোলায়মান ফসল কাটার মৌসুমে বরফ পানীয় খেতে ভালোবাসতেন।
আইসক্রিমের রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফ্লেভার। অনেকের মতে, পৃথিবীতে প্রায় এক হাজার ফ্লেভারের আইসক্রিম পাওয়া যায়। ১৮ শতকে এসে আমেরিকার হাত ধরে আইসক্রিমের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। দুধ, ক্রিম, ভ্যানিলা, স্ট্রবেরি, চকলেট, ম্যাঙ্গো- এমন নতুন নতুন ফ্লেভার মিশিয়ে আধুনিক আইসক্রিম তৈরি করা শুরু হয়। তবে রোমান সম্রাট নিরোর জন্য বাদাম, মধু, বরফ হিমায়িত করে প্রথম আইসক্রিম ফ্লেভার তৈরি করা হয়েছিল।
‘The Art of Making Frozen Desserts’ নামে আইসক্রিমের রেসিপি বই আকারে প্রথম বের হয় ১৭৬৮-৬৯ সালে। ২৪০ পৃষ্ঠার বইটিতে শুধু আইসক্রিমের রেসিপিই ছিল না, এর ধর্মীয় ও দার্শনিক ব্যাখ্যাও ছিল।
সবার জন্য প্রথম বিপুল পরিমাণে আইসক্রিম তৈরি করা হয় ১৮৫১ সালে; যা মেরিল্যান্ডের নাগরিক জ্যাকব ফুসেল নিজের কারখানায় তৈরি করেছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে আইসক্রিমের সহজলভ্যতা তুঙ্গে চলে যায়। ১৯৪৫ সালে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের নাবিকদের জন্য প্রথম ভাসমান আইসক্রিম পার্লার তৈরি হয়। একসময় আইসক্রিম এত জনপ্রিয় হয়ে পড়ল যে, ১৯৮৪ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান পুরো জুলাই মাসকেই ‘ন্যাশনাল আইসক্রিম মান্থ’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
আইসক্রিমের মতো এর ইতিহাসও অনেক আকর্ষণীয়। এটি এমন একটি খাবার, যা খেতে প্রায় সবাই ভালোবাসেন। আইসক্রিমের সঙ্গে যেন আনন্দের যোগসূত্র রয়েছে। আইসক্রিম খেলে মন কেমন ফুরফুরে হয়ে যায়।
কলি