মনা মিয়ার ছোটকাল থেকে মৃগীরোগ। নিম্নবিত্ত পরিবার হওয়ায় কখনো উন্নত চিকিৎসা করাতে পারেননি। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের আর উন্নত চিকিৎসা! এরকম ভেবেই তাদের দিন কাটে। বাবা-মা ও তিন ভাই মিলে তাদের সংসার। বাবা একসময় মানুষের কামলা খেটে সংসার চালাতেন। সন্তানদের একটু বোধ হওয়ার পর এক দিন তিনি লাপাত্তা। আর ফিরে আসেননি।
পরে জানা যায়, তিনি কুষ্টিয়ায় দিব্যি আরেক বিয়ে করে ঘর-সংসার পেতেছেন। এই সংসার, সন্তানদের একটুও খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি। এদের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যেতে থাকে। বড় ভাই মানুষের খেতে কামলার কাজ নেয়। মেজো ভাই মনা মিয়াকে কেউ কাজেও নেয় না। হঠাৎ হঠাৎ তার মৃগীরোগ ওঠে যায়। মনা মিয়া কী করবে ভেবে পায় না। সে নিজে নিজেই গাছকাটার অভিজ্ঞতা অর্জন করে। ভালো খেজুরগাছ কাটতে পারে। গাছের ডাল-আগাছা সাফ করতে পারে।
মনা মিয়া এক দিন জোর করে তার এক চাচার গাছের ডালপালা কেটে দেওয়ার কাজ নেয় চুক্তিতে। চাচা অবশ্য দিতে চায়নি। সে জোর করে নিয়েছে। চাচা বলেও দিয়েছে- তোর তো মৃগীরোগ ওঠে। কোনো অঘটন হলে তার দায়ভার আমার নয়। মনা মিয়া তাতে জোর খাটিয়ে বলেছেন, তার কিছু হবে না। হলেও সেটার দায়ভার তার। মনা মিয়া পাঁচতলা ভবনের উচ্চতা একটি কড়ই গাছের আগায় উঠে তার ডাল কাটা শুরু করে। তিন-চারটা ডাল না কাটতেই তাকে মৃগীরোগ পেয়ে বসে। সে কাঁপতে থাকে। জাপটে ধরে নিজের আত্মরক্ষার রশি। সুঠামদেহী মনা মিয়ার টাল সামলাতে পারেনি সে রশি। শূন্য বিশালাকায় গাছে রশি ছাড়া নিজের আত্মরক্ষার কিছু না পেয়ে সে সোজা ছিটকে পড়ে নিচের বালুর স্তূপে। ভাগ্য ভালো যে হাড়গোড় ভাঙেনি। খানিকটা হাত ছিলে যায়। পরে কয়েকটা গোঙানি দিয়ে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসে। তার চাচা হালকা ওষুধ কিনে দিয়ে এবারের মতো কান ধরে তাকে আর কাজে নেবে না বলে জানায়।
আরও পড়ুন: চলন্ত লঞ্চ থেকে মাঝ নদীতে ঝাঁপ
মনা মিয়ার দুঃখ কেউ বুঝে না। কেউ কাজে নেয় না। কাজ না করলে পেট চলবে কীভাবে? মনা মিয়া এবার জোর করে ধান কাটার কাজ নেয়। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে সে ধান কাটতে নামে। প্রথম দিন ভালোয় ভালোয় কাজ শেষ করে। মৃগীরোগ না আসায় সবাই তার প্রতি আগ্রহ দেখায়।
পারিশ্রমিক পেয়ে সে মায়ের জন্য মুরগি কিনে এনে বলে ভালো করে রান্না করতে। সে নামাজ পড়ে এসে মজা করে খাবে। মনা মিয়ার নামাজের ভালো ঝোঁক। সামনের কাতারে বসে। একেবারে মুয়াজ্জিন সাহেবের পাশে খুব আগ্রহ করে দাঁড়ায়। গভীর মনোযোগ দিয়ে নামাজ পড়ে। সেদিন জোহরের নামাজ পড়তে গিয়ে রুকুতে গিয়ে তার মৃগীরোগ চলে আসে। মুসল্লিরা নামাজ শেষ করে দেখে মনা মিয়া প্রস্রাব করে পুরো কার্পেট ভাসিয়ে ফেলছে। সবাই হায় হায় করে তার ওপর ক্ষেপে যায়। আবার রোগা মানুষ ভেবে কিছু বলতেও পারে না। মুয়াজ্জিন আর মনা মিয়া মিলে পুরো মসজিদ ধুয়ে ফেলে।
মনা মিয়ার বিয়ের বয়স হয়েছে। তার মা অনেক দেখেশুনে তার মতো নিম্নবিত্তের এক মেয়েকে পছন্দ করে। মৃগীরোগের বিষয়টি গোপন রেখে তাদের বিয়ে হয়। প্রথম কয়েকদিন ভালো চলে তাদের সংসার। একসময় তার মৃগীরোগের প্রকোপ বাড়ে। মাঝে মধ্যে গভীর রাতে মৃগীরোগ জেগে ওঠে। তার কম বয়সী বউ ভয়ে তাকে রেখে তার শাশুড়ির কোলে আশ্রয় নেয়। সে পণ করে আর তার স্বামীর কাছে যাবে না। স্বামীর ঘর করবে না। সকাল হলে কাউকে কিছু না বলে বাপের বাড়ি গিয়ে ওঠে। সে আর আসতে চায় না। অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে তাকে তার বাবা-মা ফেরত পাঠায়।
মৃগীরোগ থাকা অবস্থায় নাকি জুতা শুঁকাতে হয়। বাজারে কিছু ছেলে মনা মিয়াকে দেখতে পারত না কেন জানি। এক দিন বাজারে তার মৃগীরোগ উঠলে এই ছেলেগুলো রোগের নাম করে তাকে আচ্ছারকম জুতা পেটা করে। একেবারে রক্তাক্ত করে বাড়িতে পাঠায়। মনা মিয়ার মা বিচার চাইতে গেলে কেউ পাত্তা দেয় না।
মৃগীরোগীদের নাকি পানিতেও সমস্যা। এক শুক্রবার গোসল করতে গিয়ে মনা মিয়া পুকুরে ডুব দিয়ে আর ওঠে না। সঙ্গে গোসল করা ব্যক্তিরা তাকে টেনে তুলে দেখে মনা মিয়ার মৃতপ্রায় অবস্থা। মাথায় পানি আর চামড়ার জুতার গন্ধ শুঁকিয়ে তাকে স্বাভাবিক করে। এভাবেই মনা মিয়ার জীবন চলমান। আশপাশে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি থাকলেও কেউই তার চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসেননি। আদৌ কি মনা মিয়ার পাশে কেউ দাঁড়াবে?
হাটহাজারী, চট্টগ্রাম
হাসান