যেভাবে শুরু
১৯৮৭ সাল। নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার খৈনকুট উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস এইটে পড়েন ড. মোয়াজ্জেম হোসেন। প্রচণ্ড মেধাবী ছাত্র। ইংরেজিও জানেন বেশ। স্যাররা স্নেহ করেন। অন্যান্য ক্লাসে তার গল্প করেন। নিচের ক্লাসের ছাত্ররা তার কাছে পড়া বুঝতে আসে। অল্পতে বুঝে যায় সবাই। এর মধ্যে স্কুল থেকে প্রথম ক্লাস এইটে স্কলারশিপ পেলেন। তার নাম ছড়িয়ে পড়ল পাড়া-মহল্লায়। অন্য স্কুলেও ছড়াল নাম। ছাত্ররা দলবেঁধে আসতে লাগল। তিনি বিনা বেতনে তাদের পড়াতে লাগলেন।
ক্লাস নাইনের সময় ছাত্ররা ব্যাচ আকারে পড়তে চাইল। মোয়াজ্জেম হোসেন পড়ালেন। কেউ কেউ হাতে টাকাও গুঁজে দিল। তবে বেশির ভাগ ছাত্রকেই ফ্রিতে পড়ালেন। এভাবে এইচএসসি পর্যন্ত বিনা বেতনে ছাত্রদের পড়ালেন। সে সময় খৈনকুট উচ্চ বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে শিক্ষকতাও করেছেন কিছু দিন। সরকারি তিতুমীর কলেজে মাস্টার্স পড়াকালে অনেক ছাত্রকে বিনা বেতন পড়িয়েছেন। কেউ কেউ টাকাও দিয়েছিলেন।
ইংলিশ লার্নিং সেন্টার
২০০৩ সালে নিকুঞ্জের খিলক্ষেতে থাকতেন মোয়াজ্জেম। দেখলেন, ইংরেজি নিয়ে ছাত্র ও চাকরিজীবীদের মধ্যে জুজুর ভয়। তিনি পরিচিতদের সঙ্গে আলাপ করে খিলক্ষেতে খুললেন ইংলিশ লার্নিং সেন্টার। পরিচিতরা সেন্টারের কথা ছড়িয়ে দিলেন। ধীরে ধীরে ছাত্রসংখ্যা বাড়ল। এমন লোকও এল, যারা ইংরেজি রিডিংও পড়তে জানেন না। মোয়াজ্জেম তাদের ধরে ধরে শেখালেন। সপ্তাহের তিন দিন শেখাতেন সেখানে। আগের দিন বিষয় নির্ধারণ করে দিতেন। এভাবে আড়াই বছর চালিয়েছিলেন। কারও কাছ থেকে টাকা নেননি।
এখানে পড়তে টাকা লাগে না
২০০৭ সালে নরসিংদীর শিবপুরের জয়নগর কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন ড. মোয়াজ্জেম। থাকতেন জেলা সদরের ব্রাহ্মন্দীতে। নরসিংদীতে ‘এমএইচ ইংলিশ সেন্টার’ নামে প্রতিষ্ঠান খোলেন। বিকালে পড়াতেন সেন্টারে। কিছু দিনের মধ্যে প্রচুর শিক্ষার্থী হলো। অন্য জেলার ছাত্ররাও এল। মোয়াজ্জেম হোসেনের মনে চিন্তা জাগে, ‘কলেজের ছাত্ররা ইংলিশে এত দুর্বল কেন? আমার ছাত্রদের তো প্রাইভেট পড়তে হয় না।’ এই চিন্তা থেকে ২০০৮ সালে নরসিংদী প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ঘোষণা দিলেন, ক্লাসে পড়া না বুঝলে যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি ছাত্রদের নিয়ে বিকাল ও সন্ধ্যায় ব্যাচ করলেন। প্রচুর শিক্ষার্থী জড়ো হলো ব্যাচগুলোয়। সপ্তাহের ছয় দিনই পড়াতে থাকলেন। কাউকে আলাদাও পড়ালেন। অন্য কলেজের ছাত্ররাও এল। ছাত্রদের বেশ কাজে দিল স্যারের এই পদ্ধতি। কারও কাছ থেকেই টাকা নিলেন না। কেউ কেউ টাকা দিতে চাইলেন। তিনি জানালেন, টাকা নিয়ে পড়াবেন না। শিক্ষার্থীরা বলল, ‘মোয়াজ্জেম স্যারের এখানে পড়তে টাকা লাগে না।’ ছাত্রদের পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও সব সময় স্যারের সহযোগিতা নিয়েছেন।
হাজারো ছাত্র তার হাত ধরে ইংরেজিতে ভালো রেজাল্ট করেছেন। ভার্সিটিতে সুযোগ পেয়েছেন। কর্মজীবনে সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আমি শিক্ষার্থীদের ইংরেজির মূল সমস্যার জায়গাটা ধরে পড়াই। বেসিকটা তাদের আগে শিখাই। কেউ যেন ইংরেজিভীতির কারণে ঝরে না পড়ে, সে জন্য বিনা বেতনে পড়াই। আমৃত্যু ছাত্রদের বিনা বেতনে পড়াতে চাই।’
শিক্ষার্থীদের জন্য কলেজ
ক্লাসের বাইরে যেন শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে না হয়, সে জন্য গড়ে তুলেছেন নরসিংদী প্রেসিডেন্সি কলেজ। কলেজে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসা শিক্ষায় পড়ানো হয়। এখানের শিক্ষার্থীদের আলাদা করে প্রাইভেট পড়তে হয় না। শিক্ষকরা ক্লাসের বাইরে সময় দেন। মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও পাবলিক ভার্সিটি ভর্তিচ্ছুদের বছরের শুরু থেকে ক্লাস রুটিনমাফিক ফ্রিতে কোচিং করান। মেধাবী গরিবদের জন্য বিশেষ সুযোগ রয়েছে। তাদের থাকা-খাওয়ারও ব্যবস্থা করেন।
৩৫ হাজার বই বিলি
স্কুলে পড়াকালে বইয়ের নেশা পেয়ে বসেছিল মোয়াজ্জেম হোসেনকে। বইয়ের ক্ষুধা বাড়তে থাকে প্রবলভাবে। বেড়াতে গেলেও বই নিয়ে যেতেন। ১৯৯০ সাল থেকে বই সংগ্রহ করতে থাকেন। নরসিংদী স্টেশন, লাইব্রেরি ঘুরে বই কিনতেন। গ্রামের পরিচিতজনদের কাছ থেকে বই এনে পড়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখতেন। বন্ধুদের পড়তে দিতেন। পাঠচক্র করতেন।
১৯৯০ সাল থেকে মানুষকে বইও দিচ্ছেন মোয়াজ্জেম। এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার বই বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। অবসর পেলেই মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বই দিয়ে আসেন। চলে যান কলেজগুলোতে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বই দেন। শুক্রবার গ্রামে ছোটেন। ব্যাগে থাকে বই। লোকে বলে, বইমানুষ। নরসিংদী শহরের কয়েকটি সেলুন, ফার্মেসি ও ক্লিনিকে বই দিয়েছেন।
নরসিংদী পাবলিক লাইব্রেরি
২০০৭ সালে নরসিংদী শহরে এসে ওঠেন ড. মোয়াজ্জেম। এক রুমে ছাত্র পড়াতেন। রুমের এক কোণে পুরোনো একটি সেলফে নিজের বইগুলো সাজিয়ে রেখে দেন। যারা আগে চলে আসত, তারা সেলফে রাখা বই পড়ত। ছাত্রদের আগ্রহ দেখে নতুন বই কিনতে শুরু করেন। ভাবলেন, লাইব্রেরি গড়বেন। সে জন্য নতুন বই কিনে সেলফে সাজিয়ে রাখেন। একপর্যায়ে বাড়ির দোতলায় লাইব্রেরি শুরু করলেন। নাম নরসিংদী পাবলিক লাইব্রেরি। এখন পাঠাগারে বই আছে প্রায় সাত হাজার। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন খোলা থাকে। বাসায় বই নিতে চাইলে নাম এন্ট্রি করতে হয়।
তার ভাণ্ডার আলোয় ভরা
পাঠাগারে গ্রামীণ পুথির পাণ্ডুলিপি আছে ৩০টি। ১৯৪৭ সালে লেখা তৎকালীন কংগ্রেস নেত্রী ও সংসদ সদস্য কৃষ্ণ বসুর ‘স্মৃতি-বিস্মৃতি’র পাণ্ডুলিপি আছে। ১৯৭৩ সালে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা ‘বঙ্গ-বিষাদ-পুথি’র পাণ্ডুলিপি আছে। নরসিংদীর প্রাচীনতম ইতিহাসের বই শ্রী সুরেন্দ্র মোহন পঞ্চতীর্থ লিখিত, শ্রী দেবকণ্ঠ ভট্টাচার্য্য কর্তৃক প্রকাশিত ‘পূর্ববঙ্গে মহেশ্বরদী’ বইটি আছে। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৬২ বঙ্গাব্দে। শুধু নরসিংদী শহরে নয়, খৈনকুট গ্রামে বাবার নামে ‘শিক্ষানুরাগী সামসুদ্দিন পাবলিক লাইব্রেরি’ গড়ে তুলেছেন মোয়াজ্জেম। সেখানে আড়াই হাজার বই আছে।
বই পড়ার জন্য গড়ে তুলেছেন ‘বই পড়া আন্দোলন বাংলাদেশ’। আন্দোলনের সদস্যরা মানুষকে বইয়ের কথা বলেন। একদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে বই পড়ার দাবিতে নরসিংদী প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করলেন ড. মোয়াজ্জেম। লোকে বলল, ‘এইবার স্যারের মাথা গেল।’
ড. মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়ি নরসিংদীর শিবপুর জেলার খৈনকুটে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করেছেন। ২০১৪ সালে পিএইচডি করেছেন। জয়নগর ডিগ্রি কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদের চাকরি ছেড়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত নরসিংদী প্রেসিডেন্সি কলেজে সার্বক্ষণিক সময় দিচ্ছেন তিনি। লেখালেখিও করেন। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বাইশটি। সম্পাদনাও করেছেন অনেক বই, সাময়িকী ও স্মরণিকা।
তারেক