বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী একজন রাজনীতিবিদ। তিনি মুক্তিযুদ্ধে বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তি, যিনি ১৯৭১-এর যুদ্ধে বাঘা সিদ্দিকী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য ব্যতিরেকেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে ঢাকা আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। তার অসীম সাহসিকতার কারণে তাকে বঙ্গবীর নামে ডাকা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক, তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজ-এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগের সিনিয়র সহসম্পাদক শেহনাজ পূর্ণা
খবরের কাগজ: যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে কি না, কতটুকু হয়েছে?
কাদের সিদ্দিকী: যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি, সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। স্বাধীন দেশ এমন হবে, এটা জানলে স্বাধীনতার সময় যারা জেনে হোক, না জেনে হোক, উন্মাদনায় হোক- যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছে তাদের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ শামিল হতো না। ঝড়-তুফান এলে যেমন ক্ষতি হয়, কেউ জড়িয়ে না থাকলেও তেমন ক্ষতি হয়। সেরকমভাবে যারা মারা গেছে, অসখ্য মানুষ যারা আমাদের গ্রামের ভাষায় বললে ‘হেলে মেলে’ অর্থাৎ যারা আগে-পিছে কোনোখানেই ছিল না, এরকম লাখো মানুষ মারা গেছে। তাদের আত্মীয়-স্বজন, আপনজন কেউই তাদের মৃত্যুর জন্য কোনোরকম খেদ ব্যক্ত করেনি। বরং তারা খুশি হয়েছে এটা ভেবে যে, ‘আমার সন্তান, আমার আত্মীয়, আমার পিতা-মাতার জীবনের বিনিময়ে একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি।’ তারা ভেবেছে, এর বিনিময়ে আমার দেশের মানুষের অধিকার, সম্মান, জীবনের মর্যাদা ইত্যাদি সবকিছুই রক্ষা পাবে। যদি এই মানুষগুলো তখন বুঝতে পারত যে, এর কোনোটাই হবে না, তাহলে এতো লোক স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত না।
কিছুদিন আগে একটা অসম্ভব বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু সেই বিপ্লব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ বলেছেন, দ্বিতীয় স্বাধীনতা। মানুষ খুব বিপদে পড়লে অথবা অসুবিধায় পড়লে অনেক সময় বলা হয়, বিপদ কেটেছে অথবা নবজন্ম হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা অমন হালকা বিষয় নয়। মানুষের জন্মের পরে যেমন অবধারিত মৃত্যু অর্থাৎ জন্ম বারবার হয় না। কোনো দেশের স্বাধীনতাও ঠিক তেমন। একটি জাতির স্বাধীনতা বারবার হয় না। আবেগী অনেক কথাবার্তা হতে পারে। আমি অনেকদিন নির্বাসনে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৬ বছর দেশের বাইরে ছিলাম। এরশাদের পতনের পর ১৯৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বরে দেশে ফিরে আসি। ১৬ বছর পরে ১৬ ডিসেম্বর আমি দেশে ফিরলে আমাকে দেখে প্রথম ড. কামাল হোসেন, আমীর-উল-ইসলাম, সিরাজুল হকসহ অনেকেই জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আমরা বিজয় অর্জন করেছি। কিন্তু আমরা দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি কথাটা অযৌক্তিক। একই সঙ্গে বলতে হয়, এ ধরনের কথাবার্তা বলা অনুচিত। এতে দ্বিধা তৈরি হয়। আমরা স্বাধীনতা একবারই অর্জন করেছি এবং তা ১৯৭১-এ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা সফল হয়েছেন, দুই দিন পরে এ কথার জন্য তাদেরও হয়তো জবাবদিহি হতে হবে এবং তারা নিন্দিত হবেন। দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হলে তাদেরও চলে যেতে হবে। সে জন্যই বলছি, যে স্বপ্ন নিয়ে, যে আশা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সবাই করেছেন- তা সফল হয়নি। তবে একটা সফলতা আমাদের মানতেই হবে যে, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকে যুদ্ধ করেছি। অনেক কষ্ট করেছি, কারাবরণ করেছি, জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করেছি। আজকে যে যত ফুটানিই করুক, পাকিস্তানের হাত থেকে দেশ মুক্ত না হলে অনেকে ভিক্ষা করে খেত। যারা বড় বড় বাড়িতে থাকে, কোটি টাকার গাড়িতে চড়ে, তাদের রিকশায় চড়ার পয়সা থাকত না। আমরা দেশের মানুষের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। দেশের সম্মানের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। আমরা মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। আমরা এমন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করিনি। কাজেই বলব, যুদ্ধ জয়ের আনন্দ আমাদের ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্ন আমাদের আজও পূরণ হয়নি।
খবরের কাগজ: আপনি কাদেরিয়া বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন, সম্মুখযুদ্ধ করেছেন, সেই যুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতি যদি কিছু বলেন।
কাদের সিদ্দিকী: আমরা যেখানে যুদ্ধ করেছি সেটা টাঙ্গাইলে- তখন গণমুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। এর প্রধান ছিলেন আমার বড় ভাই আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী এমপি। আমরা তার নেতৃত্বে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম। কিন্তু তার পর অনেককে খুঁজে না পেয়ে আমাদের নাম বেশি এসেছে। আমাদের কালিহাতির চারানে যুদ্ধ হয়েছে। সে সময় ৫-৭ জন আর্মি মারা গেছে। সবখানে খবর হয়ে যায়, মুক্তিবাহিনী আর্মি মেরে ফেলেছে! কারা মারল? তখন নাম হলো কাদের সিদ্দিকীর দল। বল্লায় বিরাট যুদ্ধ হয়েছে। কে করেছে? কাদের সিদ্দিকীর দল। কাদের সিদ্দিকী এখানে কোনো বাহিনী বানায়নি। কাদের সিদ্দিকীর নাম থেকে মুখে মুখে আপনা আপনিই কাদেরিয়া বাহিনী হয়ে গেছে। এর পর অনেক নেতাই পালিয়ে গেছে , কাদের সিদ্দিকী পালায়নি। যুদ্ধের সময় যেহেতু লোকেরা বলেছে কাদের সিদ্দিকীর দল যুদ্ধ করছে। কাজেই কাদের সিদ্দিকী সব জায়গায় আছে। দ্বিতীয়ত হলো- যুদ্ধবিগ্রহের সময় অনেকাংশে নেতারা পেছনে থাকে। কাদের সিদ্দিকী সবসময় প্রথম সারিতে থেকেছে। এই একটাই হলো বৈশিষ্ট্য। কাদের সিদ্দিকী কাউকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে পেছনে থাকেনি। আর কোনো সময় তা প্রয়োজনও পড়েনি।
খবরের কাগজ: মুক্তিযুদ্ধের কোন স্মৃতি আপনাকে বেশি নাড়া দেয়?
কাদের সিদ্দিকী: জীবনের পথে নতুন কিছু থাকে, আমরা বলি, হঠাৎ! সেই হঠাৎ ভালো অথবা খারাপ সেটাকে আলোড়িত করে। আমাদের জীবন এমন গতানুগতিক, জীবনে কখনো তা ভাবার সুযোগ হয়নি যে, কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ। আমাদের সবটাই ভালো। কারণ যেদিন থেকে রাজনীতিতে এসেছি, মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারলেই ভালো মনে হয়েছে। এই দুনিয়ার মানুষ আমাকে চিনত না। কখনো বলত না যে, এই নামে একটা মানুষ আছে। অনেকেই হয়তো জানে না, আমার ডাক নাম বজ্র। ছেলেবেলায় আমার কাছে মনে হতো, কী একটা নাম দিয়েছে, আকাশ থেকে পড়ে, বজ্র। এখন কিন্তু আমার কাছে খুব প্রিয় নাম ‘বজ্র’। আমি একটা যুদ্ধ করেছিলাম চারানের পর, বল্লায়। সেটাই আমাদের প্রথম সাকসেস বা সাফল্য বলা যায়। পাকিস্তান আর্মি আমরা ধরে এনেছিলাম। আমাদের সতীর্থরা তখন বলেছিল- ‘বজ্র, আমরা দেশটা জ্বালাব’। আমরা দেশ স্বাধীন করব। আমার বাবা খুব রাগী মানুষ ছিলেন। তার পরও বলব, আমার বাবা ছিলেন শ্রেষ্ঠ মানুষ। তিনি সব সময় নৈতিকতার প্রমাণ দিয়েছেন। টাকাওয়ালারা তাকে কখনোই নীতিভ্রষ্ট করতে পারতেন না। আমি যেহেতু পড়াশোনায় খুব একটা মনোযোগী ছিলাম না, যে কারণে আমি হয়তো একটা রিকশাওয়ালা হতাম, না হয় গরুর রাখাল হতাম। আমাদের বাড়িতে প্রচুর গরু ছিল। একসময় আমাদের বাড়িতে ৫০টি গরু ছিল। সেগুলোর ঘাস খাওয়াতে মাঠে নিয়ে যেতে আমার ভালো লাগত। এবং আমি খুব ভীতু ছিলাম। আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে আমার পা কাঁপত। হায় হায়- আমি তখন পুলিশ দেখেও ভয় পেতাম! লতিফ সিদ্দিকী ও আমি একই মায়ের সন্তান। মাঝে মাঝে মনে হতো তাঁর এতো সাহস, আমার সাহস নেই কেন! এরকম করে করেই একসময় স্লোগান দিতে শিখেছিলাম, পোস্টার লাগাতে শিখেছিলাম। তখন থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয়। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসতাম। আমি একেবারে চেহারা-চরিত্রে অনেকটাই ভালো বলতে হবে, ফেলে দেওয়ার মতো না আর কী। কিন্তু আমি কখনো কোনো মেয়ের প্রেমে পড়িনি। আমার প্রেম ছিল রাজনীতি, আজও তাই। আমার প্রেম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে আমি দেশকে ভালোবাসতে শিখেছিলাম। যখন আমি এই মাটিতে হাত দিই, মনে হয় আমি আমার মায়ের গায়ে হাত দিয়েছি। এখনকার নেতারা সবাই মুখে অনেককিছুই বলতে পারে, শুধু কোনোকিছুই তাদের উপলব্ধিতে নেই। সে জন্য বলব, একটা জায়গায় পৌঁছানোর জন্য একটু সময় লাগে। আপনি যখন বললেন, আপনি যুদ্ধে গেলেন কখন। আমি তো যুদ্ধে যাইনি। আমি তো সবসময় যুদ্ধেই আছি। যুদ্ধ হওয়ারও আগে আমাদের অধিকারের জন্য, ভোটের জন্য চিৎকার করেছি। ভোটের মর্যাদা যখন পাকিস্তান রাখেনি, তার বিরুদ্ধে আমরা অসহযোগ করেছি। অসহযোগেও যখন কাজ হয়নি, তারা আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমাদের অনেক নেতা হয়তো টিকতে পারেনি- ভয় পেয়ে চলে গেছে। আমরা তখন ছোট ছিলাম, আমাদের অতটা ভয় করেনি। আমরা অস্ত্র নিয়ে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। যুদ্ধ করতে করতে দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। সে সময় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভার ছবি বড় করে প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। এর পর বঙ্গবন্ধু এলেন। একসময় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো! আজও দেশের গণমানুষের মুক্তি হলো না। আজ আমার কাছে সবই বেদনাবিধুর স্মৃতি।
খবরের কাগজ: মুক্তিযুদ্ধে ভারত যদি সহযোগিতা না করত, তাহলে কী হতে পারত?
কাদের সিদ্দিকী: মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সমর্থন না থাকলে আমাদের আরও অনেক সময় লাগত। আমাদের আরও অনেক বেশি ক্ষতি হতো। আরও গভীরভাবে বলা যেতে পারে, তাহলে ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীন হতাম না। হয়তো বা ২০৭১ সালে হতাম অথবা এখন ২০২৪ সালে হতাম। কিন্তু ’৭১-এ আমরা স্বাধীন হতাম না। আমরা হয়তো ভুলে গেছি, আমাদের ১ কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। তারা আশ্রয় নিতে না পারলে আরও অন্তত ৫০ লাখ লোক মারা যেত। আমরা যে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছি, আমাদের তো কিছুই ছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমরা যেভাবে যুদ্ধ করেছি- যা একদমই আলাদা, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও হয়নি। সারা দেশ আমাদের মতো হতে পারলে, তাহলে ভারতের কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু সেটা হতে আমাদের কমপক্ষে আরও ৫০ বছর লাগত। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতাম ও ভেঙে পড়তাম। আবার হয়তো ৫ বছর পর দাঁড়াতাম অথবা আরেকজন দাঁড়াত। এই যে ব্যাপারগুলো হতো, এজন্য আমরা না হলেও আরও ২০ বছর পিছিয়ে পরতাম- এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ক্ষেত্রে ভারতের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা একটা দেশের জন্য আরেকটা দেশের সহযোগিতা, আমি বলব শ্রেষ্ঠ সহযোগিতা। এর চাইতে আন্তরিক, এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ সহযোগিতা হতে পারে না। আমাদের অনেক মানুষ আছে, গভীরে না গিয়ে ওপরে থেকে ছটফট করে। পাকিস্তান যখন হয়েছিল, তার আগে আমাদের এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক প্রীতি ছিল। যদিও ব্রিটিশরা দেশ ছাড়ার আগে এখানে নানাভাবে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দিয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৬ সালে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ বলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একটা ডাক দিয়েছিলেন। বাড়ির পাশে একজন হিন্দু মুচি যে কিছুই জানে না, ওকে মুসলমান বানিয়ে মেরে ফেলা হলো। পাশের ঘরে দর্জি মুসলমান, হিন্দু বলে মেরে ফেলা হলো। শত বছর একসঙ্গে তারা আছে পরস্পরের সঙ্গী হয়ে। তাদের মধ্যে বিভেদ নেই। বিগ্রহ নেই। এখানে পাকিস্তান, ওপাশে ভারত। যত রকমের ম্যাকানিজম লাগে তা করেছে তথাকথিত ক্ষমতাবানরা। বলা বাহুল্য, ভারত পাকিস্তানের শত্রু। এর মধ্যে ১৯৬৫ সালে একটা যুদ্ধ হয়েছে, ভারত-পাকিস্তান। সেই যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) ৪ থেকে ৫ হাজারের বেশি সৈন্য ছিল না। ভারত যদি ইচ্ছে করত ১০ মিনিটেই পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিতে পারত। ফলে ভারতের প্রতি এখানকার মানুষের একটা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মনে জাগে। এর পর যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন বহু মানুষ ভারতে যেতে দ্বিধা করেছে। বিশেষ করে অনেক মুসলমান ভারতে যেতে দ্বিধা করেছে। তার পরও এত লোক ভারতে গেছে, ভারত তাদের নৈতিকভাবেই আশ্রয় দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আন্তরিকভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। ভারতের বিজয়ের কোনো ইতিহাস ছিল না। পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৯৪৮ সালে প্রথম যুদ্ধ হয় ভারত-পাকিস্তানের এবং সেটা কাশ্মীরে। যেখানে ভারত জেতেনি। কারণ পাকিস্তান তখন অর্ধেক কাশ্মীর দখল করে নিয়েছিল। ১৯৬২ সালে চীন-ভারতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখনো ভারত জেতেনি, হেরেছে। ১৯৬৫ সালেও ভারত হেরেছে। ভারতের খাতায় বিজয় লেখা ছিল না। ১৯৭১-এ লাখ লাখ বাঙালি জীবন দিয়ে পাকিস্তানিদের একেবারে নাস্তানাবুদ করেছিল। সেই প্রথম ভারত বাঙালির একটা মহান বিজয় অর্জনের ক্ষেত্রে অংশ গ্রহণ করেছিল। যে বিজয়ের ফল আজকে ভারত ভোগ করছে বাংলাদেশকে শাসন ও শোষণের মধ্য দিয়ে। এটা খুবই দুঃখজনক।
খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন, ভারত সহযোগিতা করেছে নিজেদের স্বার্থে?
কাদের সিদ্দিকী: সবাই নিজের স্বার্থের জন্যই কাজ করে। আমাকে যখন মারছে, আমাকে যখন হত্যা করছে- আমি কি ভারতের স্বার্থে ভারতে আশ্রয় নিতে সেখানে গিয়েছিলাম? মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি যখন মারা যাচ্ছি, আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তাহলে আমি ভারতে গিয়েছিলাম ভারতকে সাহায্য করতে? নাকি আমি আমার জীবন রক্ষার জন্য ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সবাই তার নিজের স্বার্থেই কাজ করে। ভারতেরও মহান স্বার্থ আছে। আমাদেরও স্বার্থ ছিল। পাকিস্তানকে হারানোর জন্য ভারতের সহযোগিতা নিয়েছি। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিহীন লোকেরা মাথা নিচু করে, মাথা নত করে সেই সম্পর্ক নষ্ট করছে। আমরা ভারতের সঙ্গে সমমর্যাদা দেখতে চেয়েছি। বিমাতাসুলভ অথবা বড় ভাই ছোট ভাই হতে চাইনি। আমি ওখানে এমন কোনো নেতা দেখিনি, বড় ভাই ভোট ভাইয়ের আচরণ তারা করে। আমরা তো অসহায় অবস্থায় ছিলাম। কিন্তু আমার সঙ্গে একদিনের জন্যও অমর্যাদাকর কথা হয়নি। এখন আমরা নিজে গিয়ে যদি চাকর হই, তাদের দয়া চাই, ভিক্ষা চাই- ওদের কী দোষ আছে? এখানে বলব, আমাদের বর্তমান নেতা এবং ওদের বর্তমান নেতাদের অনেক ত্রুটি আছে। আমাদের ত্রুটি অনেক বেশি। দেশে একটা সরকার থাকে। সেই সরকারই কি সেই দেশ? কখনো নয়। যদি তাই হতো, তাহলে এখানে শেখ হাসিনার সরকার ছিল- তাহলে এখন সে কোথায় গেল? কখনো কখনো সরকার আসে দেশকে চালাবার জন্য আবার চলেও যায়। তাদের জনতার কথা মাথায় রেখেই গদিনশীল হতে হবে। জনতার বিরুদ্ধে গেলে গদি ছেড়ে চলে যেতে হবে। এই গদির মায়া ত্যাগ করে জনতার প্রতি মায়া দেখাতে হবে। মনে রাখতে হবে, জনগণকে বোকা ভাবে যারা, তারাই আসলে বোকার স্বর্গে বসবাস করছে।
খবরের কাগজ: বর্তমান সময়কে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
কাদের সিদ্দিকী: ভারত-বাংলাদেশের সুসম্পর্ক থাকা ভালো। কোনো ব্যক্তির জন্য অথবা কোনো দলের জন্য সে সম্পর্কটা সীমার বাইরে চলে যাওয়া ঠিক নয়। যা আওয়ামী লীগের হোক, বিএনপির হোক, জামায়াতের হোক, আমাদের হোক- এটা উচিত নয়। কিন্তু সেটাই হচ্ছে। ভালো করে একটা পরিবার চালাতে ধৈর্যের দরকার হয়। সহনশীলতা লাগে। পরস্পরকে মানতে হয়। আর একটা রাষ্ট্র চালাতে ধৈর্য লাগবে, সহনশীলতা লাগবে- এটা সবাইকে বুঝতে হবে। নানান মত-পথ একত্র করে চলতে হবে। আমার বোন শেখ হাসিনা সাড়ে পনেরো বছর ক্ষমতায় ছিলেন। সব বিরোধী দলকে নিয়ে এক দিনের জন্য মিটিং করেছেন কি? করেননি। উনি ক্ষমতালোভী হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের ধ্বংস ডেকে এনেছেন। দেশে ১৫ লাখের মতো রোহিঙ্গা আছে। দুবার রোহিঙ্গা ঢুকেছে আমাদের দেশে। একবার জিয়াউর রহমানের সময়, আরেকবার শেখ হাসিনার সময়। এটা একটা জাতীয় সমস্যা। সেই সমস্যায় তিনি সব দলকে ডাকতে পারতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জয় প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন। তাকে ভারতে একটা সময় বলা হতো দ্বিতীয় গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে তাকে সারা পৃথিবী ঘোরানো হয়েছে। সেই সুবিধাটাও ভারত মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে পেয়েছে। শেখ হাসিনা যাওয়ার ৬-৭ দিন পরে সব দলকে নিয়ে নরেন্দ্র মোদি বৈঠক করেছেন। এখন যে সরকার বাহাদুররা আছেন- আমি ড. ইউনূসকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ মনে করি। উনার সঙ্গে আমার অনেকবারই দেখা হয়েছে। ইতিমধ্যে ১০০ দিন হয়ে গেছে। মাঝে-মাঝেই শুনি, তিনি সব দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন। তাঁর কাছে আমার প্রশ্ন, তিনি কী আমাদের খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছেন? আমাদের সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক দল হতে হবে। মানুষের ভোটে নির্বাচিত হলে তখনই সেই দল নিবন্ধিত হলো, না হলে হলো না, এগুলো কোনো কথা নয়। মূলকথা হচ্ছে, রাজনীতি করার জন্য কারও সার্টিফিকেট নেওয়া লাগবে, এটা কোনো গণতান্ত্রিক পথ নয়। জনতাই সবচেয়ে বড় সার্টিফিকেট। জনগণ চাইলে আমাদের গদিতে বসাবে। জনগণ না চাইলে গদি ছেড়ে চলে যেতে হবে।
খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এখনো রচিত হয়নি?
কাদের সিদ্দিকী: একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার ৫০ বছর পর সঠিক কিছু শুরু হয়। ১০০ বছর আগে কোনো সঠিক ইতিহাস রচিত হয় না। কারণ ইতিহাসের ওপর সমকালের প্রভাব থাকা- সেটাকে ঠিক ইতিহাস বলে না। এর অনেকটা দুর্বলতা থাকে- এটা থাকবে। পৃথিবীর কোথাও গণতান্ত্রিক শক্তি সশস্ত্র আন্দোলন করে দেশ স্বাধীন করেনি। এখানে ২৩-২৪ বছর গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে, যেখানে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সশস্ত্র যুদ্ধ। যারা এই ২৩ বছর সফলতার সঙ্গে, প্রচণ্ড সফলতার সঙ্গে তারা রাজনীতি করে মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা পর্যন্ত নিয়ে গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষভাবে তাদের অনেকেরই ভূমিকা ছিল না। এমনকি তারা অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে একদম সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। সাধারণ মানুষ কখনো রাষ্ট্র পরিচালনা করে না, করেওনি। যারা যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের হারিয়েছে প্রত্যেকেই যোদ্ধা। সেখানে ছিল সাধারণ মানুষ। যুদ্ধ পরিচালনা করেছে সাধারণ মানুষ। যুদ্ধ শেষে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন নেতারা। এরা কেউই গণমানুষের নেতা হয়ে উঠতে পারেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যথার্থ নেতা হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাজউদ্দিন আহমেদ একজন যথার্থ নেতা। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জিয়াউর রহমান ছিলেন যথার্থ নায়ক। কাদের সিদ্দিকী যথার্থ নেতা ছিলেন। কিন্তু সমস্যা হলো কাদের সিদ্দিকী যুদ্ধের অবস্থা পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। জিয়াউর রহমান নিয়ে যাননি। যুদ্ধের অবস্থা তৈরি না হলে অর্থাৎ ৭ মার্চ না হলে, ২৫ মার্চ না হলে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধেই থাকতেন না। তিনি পাকিস্তান যোদ্ধা হয়ে থাকতেন। তাহলে কাদের সিদ্দিকী ও জিয়াউর রহমানের মধ্যে কোথাও নিশ্চয়ই পার্থক্য আছে। অন্যদিকে কিন্তু সশস্ত্র যোদ্ধা হিসেবে জিয়াউর রহমান ছিলেন দক্ষ। এগুলো জানতে ও মানতে হবে। তবে সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই ৯ মাসের যুদ্ধে এগিয়ে এসেছেন অতি সাধারণ মানুষ। যাদের রাজনৈতিক নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। আমাদের নেতারা ফিরলেন দেশে। আমার মতো যারা ভালো যুদ্ধ করেছেন তারা অনেকে নেতা হয়ে গেলেন। মানুষের বিপদের সময় পাশে ছিলেন, তারা নেতা হয়ে গেলেন।
খবরের কাগজ: আমরা জানি, ইতিহাস সত্যটাকে ধারণ করে, মিথ্যাকে ছুড়ে ফেলে- ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আপনার অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
কাদের সিদ্দিকী: ইতিহাস সবসময় সত্যকে ধারণ করে, মিথ্যাকে বর্জন করে- এ কথাটা সত্য। ইতিহাসেরও একটা সৌভাগ্য আছে। যার সৌভাগ্য, সে ইতিহাসে স্থান পায়। যার সৌভাগ্য হয় না, তার স্থান নেই। যাকে সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় সহনশীলতায়, নিঃসন্দেহে ইতিহাস সে পথেই এগিয়ে যায়। তার পর একসময় সঠিক ইতিহাস বেরিয়ে আসে। আমার যতটুকু জায়গা ততটুকু আমি পাবই। আমি তো ফাঁকি দিইনি। আমি যদি যুদ্ধে ফাঁকি দিতাম তাহলে পেতাম না। আমার সবচেয়ে বড় অবস্থান আমি কোনো অবস্থাতেই কোনো সরকারের গোলামি করিনি, যা অনেক নেতাই করে নিজেদের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন, এবং আমরা তা দেখেছি। শেখ হাসিনার এ রকম দশা কেন? প্রধান কারণ- মানুষ ভোট দিতে পারেনি, তিন তিনবার, একটা ভোটও দিতে পারেনি। এবং যারা আজকে কোটাবিরোধী আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা, তাদের ভুলত্রুটির জন্যও তারা প্রশ্নবিদ্ধ হবেন সত্য। তাদের কাজ প্রশংসনীয়। তারা যদি ধৈর্য রাখতে পারেন, তারা অমর হয়ে থাকবেন। কেন তারা জয়ী হয়েছেন? এখানে তাদের তেমন কোনো কৃতিত্ব নেই। তাদের কোনো সংগঠনও নেই। কিন্তু তারা জয়ী হয়েছেন। মানুষ শেখ হাসিনার ওপরে ভীষণভাবে অসন্তুষ্ট হয়েছে এবং সেই অসন্তুষ্টি ৫ আগস্টের মধ্যদিয়ে ফুটে উঠেছে। মানুষ ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। এগুলোকে মনে রাখতে হবে। খুব ভালোমতো হিসাব করতে হবে। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী আমার বোন শেখ হাসিনা দিন শেষে অপমানজনকভাবে পালিয়ে গেলেন কেন, সেটা সবাইকে ভাবতে হবে। মানুষ ছোট হোক, বড় হোক, উপার্জন যা খুশি তাই হোক, কেউ কারও গোলাম নয়। মানুষকে সম্মান দিতে হবে। রাষ্ট্রনেতাদের সেই শিক্ষাটুকু থাকতে হবে।
খবরের কাগজ: বঙ্গবন্ধু ও মওলানা ভাসানীকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কাদের সিদ্দিকী: বঙ্গবন্ধুর জায়গায় বঙ্গবন্ধু। হুজুর ভাসানী তার থেকে হাজার গুণ ওপরে। প্রকাশ্য রাজপথে বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীকে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েও পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেন। শেখ মুজিব সবাই হবে না। যত কথাই বলা হোক, তাঁর মধ্যে কৃষ্টি, সভ্যতা, ভদ্রতা অনেক কিছু ছিল। শুধু মওলানা ভাসানীই নন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা- এরা শেখ মুজিবের নেতা। আমার সঙ্গে অনেকের বিরোধ এই খানে। আমি বড় হয়েছি। কিন্তু আমাকে যারা বড় করেছেন, তারা আমার থেকে এগিয়ে। বাবার থেকে সন্তান কোনোদিন বড় হতে পারে না। সন্তানের ঋণ বাড়ে, অনেকে বলে বড় হয়েছি- ঠিক আছে তুমি বড় হয়েছ, কিন্তু তোমার বাবা-মা-ই বড় করেছে। এটা শেখ মুজিবের জানা ছিল।
খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন এই জাতি করতে পেরেছে?
কাদের সিদ্দিকী: না, কখনো করেনি। এ জন্য করেনি যে, এখানে স্বার্থ জড়িত ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন করলে, সম্মান করলে ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যারা নেতা ছিলেন, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ তারা অনেকেই নেতা ছিলেন না। মুক্তিযোদ্ধা আর দলীয় নেতার মধ্যে সামাজিক মর্যাদার একটা পার্থক্য রয়েছে। আমাদের টাঙ্গাইলের মান্নান ভাইয়ের চাইতে বড় নেতা হয় না। তিনি আসল নেতা। লতিফ সিদ্দিকীর কাছে আমি শিশু ছিলাম। কিন্তু একসময় তিনি একটা মিটিং দিলে ১০ হাজার লোক হলে, আমি একটা মিটিং দিলে ৫ লাখ লোক হয়েছে। আগে লোকে বলত- লতিফ সিদ্দিকীর ভাই। তার পর একসময় আমি কাদের সিদ্দিকী হয়েছি। এরকম বহু উদাহরণ আছে।
খবরের কাগজ: খেতাব দেওয়ার ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীতে খেতাব (বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক) বেশি দেওয়া হয়েছে- এ কাতারে বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব দেওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলার শিকার হয়েছে কি না?
কাদের সিদ্দিকী: আমাদের বাঙালিদের সবচেয়ে বড় দোষ হচ্ছে, আমরা সময়ের কাজ সময়ে করি না। সেভাবে গুরুত্বও দিই না। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে আমরা যেভাবে লোকজনকে ডাকাডাকি করেছি। যুদ্ধশেষে সেভাবে আর গুরুত্ব দিইনি। এখন এভাবে যদি বলা হয়, যেহেতু আর্মি ইউনিটি ছিল অর্থাৎ এরা সংঘবদ্ধ ছিল এবং যুদ্ধবিগ্রহের কাজে সেহেতু তাদের সরকার বাহাদুররা দায়িত্ব দিয়েছে, এ বিষয়ে তাদের অতটা অভিজ্ঞতাও ছিল না। সে জন্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সেভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ আর্মির লোকেরা কাজ করেছে ৫-৬ হাজার এবং যুদ্ধের সময় আরও ১০-১৫ হাজার ট্রেনিং দিয়ে ওই সময়ে তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৭৫ জন খেতাব পেয়েছে। আমাদের বীরউত্তম হচ্ছে ৬৮ জন। এর মধ্যে কয়েকজন বাঙালি, আর সবই মিলিটারি। ১৭৫ জন বীরবিক্রম। তার মধ্যে ১২-১৩ জন সাধারণ, আর সবই মিলিটারি। তার মধ্যে আমার দলেরই তিনজন। এই তিনজনের মধ্যে একজন মিলিটারি ছিল। এই খেতাবটা বিবেচনা করে দেওয়া হয়নি। বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব যাদের দেওয়া হয়েছে তাদের আরও বড় খেতাব দিক, কিন্তু এর চাইতেও অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করা লোক আছে এবং ছিল। তাদের তালিকার মধ্যেই রাখা হয়নি। এখন যে তালিকা করা হচ্ছে- অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এলে বিএনপি, তার পর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তো আছেই। আমি তো বলব, সে-ই একজন মুক্তিযোদ্ধা যে দেশকে ভালোবেসেছে। প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের মানুষকে সহযোগিতা করেছে। তাদের রাজাকারের তালিকায় নাম আছে কি?যাদের নাম নেই, এমন ১০০ জনও যদি মুক্তিযোদ্ধা হয়, আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ যারা দেশের প্রত্যক্ষ দালালি করেনি, আলবদর হয়নি, আমার মনে হয় এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। যারা পরোক্ষভাবে যুদ্ধে বিজয়লাভে সহযোগিতা করেছে, আমার মতে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার প্রাপ্তি- প্রথমত আমার দেশকে আমার মায়ের মতো মনে হয়। আমার মা-ই আমাকে বাঁচিয়েছেন। আমি আমার মায়ের কাছ থেকে আদব পেয়েছি। আমার বিদ্যা ছিল না, বুদ্ধি ছিল না, শুধু বয়সে বড় হয়েছি। মা যখন অধৈর্য হয়ে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বলত বজ্র, আমার কষ্ট হয় নারে! তুই এমন করিস কেন? তোকে যখন বকা দিই, মারি, তখন আমার খারাপ লাগে। দেশকে আমার মায়ের মতোই মনে হয়। ওটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া।
খবরের কাগজ: একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বর্তমান বাংলাদেশকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কাদের সিদ্দিকী: আমরা বাংলাদেশ চেয়েছিলাম- সাধারণ মানুষের বাংলাদেশ। গরিব-দুঃখী মানুষের সম্মানের বাংলাদেশ। আমি এখনো তাই চাই। আমি তেলা মাথায় তেল দিতে চাই না। ২২ পরিবার থেকে ২২ লাখ অথবা ২২ হাজার পরিবারের হাজার হাজার কোটি টাকা থাকবে, আর আমার একজন রিকশাওয়ালার ৫০ টাকা থাকবে না- এমন দেশ আমি চাই না। যদি একজন ঋণখেলাপির ১ কোটি টাকা থাকে, তাহলে আমি নিশ্চয়ই ভাবব, একটি রিকশাওয়ালারও ১ লাখ টাকা থাকবে। আমি চাই আমার খাওয়া-পরা, আমার ছেলেমেয়ের নিরাপত্তা, আমার স্বাভাবিক চাহিদা যাতে মেটে, সেটা দেখতে হবে। আমার যদি ১ হাজার টাকায় দিন যায়, সেই জায়গায় যদি আমি ২ হাজার টাকা পাই, তাহলে আমার খুশি হওয়ার কথা। ৩ হাজার টাকা পেলে আরও খুশি হওয়ার কথা। ৪ হাজার টাকা হলে আরও খুশি হওয়ার কথা। ৫ হাজার টাকা হলে আরও আনন্দ হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা অকারণে ৫ লাখ হলে সে ক্ষেত্রে সেই আনন্দ নিরানন্দে রূপ নেবে। কারণ আমি সেটা সামলাতে পারব না। একজন মানুষ যে দিনে ৫০০ টাকা উপার্জন করে, সেই মানুষ যদি দিনে ৫০ হাজার টাকা উপার্জন করতে শুরু করে, তাহলে তার বউকে আর পছন্দ হবে না। তার মাকে অশিক্ষিত মনে হবে। তার ছেলেগুলোকে ড্যাবড্যাবা মনে হবে। কিন্তু ১ হাজার টাকায় যার সংসার চলে, সে যদি ৫ হাজার টাকা রোজগার করে, তাহলে তার সংসারে সাচ্ছন্দ্য আসবে। সে ছেলেমেয়েকে ভালো জায়গায় পড়াতে পারবে, ঘরটাকে একটু ভালো করা ইত্যাদি সবকিছুই করতে পারবে। তার যদি কারণ ছাড়াই চুরি করে কোটি কোটি টাকা হয়, ওই সময় সে যখন ওই টাকার সঠিক ব্যবহার করতে শিখবে না, তখনই ঝামেলাটা হবে। সেজন্য বলছি, আমাদের দেশে চুরির টাকা, আর উপার্জনের টাকায় পার্থক্য আছে। আপনি যখন পরিশ্রম করে উপার্জন করবেন, তখন সেটা আপনার কাছে ইবাদতের মতো মনে হবে।
খবরের কাগজ: আপনি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?
কাদের সিদ্দিকী: আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার প্রত্যাশা একটাই এবং তা খুবই ছোট চাওয়া। এই স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষের মর্যাদা, জীবনের নিরাপত্তা, সম্পদের নিরাপত্তা, সম্মানের নিরাপত্তা থাকবে। যে যত বড়ই হোক আইনের ঊর্ধ্বে কারোরই স্থান নয়। মানুষ যেন ছায়ার মতোই আইনের কাছে সঠিক আশ্রয়টুকু পায়। বিগত অনেকগুলো বছর; শেখ হাসিনার ১৬ বছর, খালেদা জিয়ার ১০ থেকে ১২ বছর, এরশাদের স্বৈরশাসন অর্থাৎ এই দিনগুলোতে কোথাও সত্যিকারের শান্তি ও সুশাসন ছিল না। এদের কারও সময়ই আইন আইনের মতো চলেনি। আইন ক্ষমতাবানদের কথা অনুসারে, নির্দেশমতো চলছে। আমার কথা, আইন চলবে আইনের মতো। আমার প্রত্যাশা থাকবে,এই অস্থির সমস্যা সংকুল পরিবেশ কাটিয়ে গণমানুষের জীবনমানের উত্তরণ ঘটবে। দেশে শান্তি ফিরে আসবে। মানুষ সম্মানের সঙ্গে দুমুঠো খেয়ে-পরে বাঁচবে। এই দেশে কেউ আর ক্ষমতাবানের রূপে দানব হয়ে উঠবে না। বরং ক্ষমতার মোহ কাটিয়ে দেশের সেবক হয়ে দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতাটুকু যথাযথভাবে পূরণ করে যাবে। আমার চাওয়া এটুকুই।
খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কাদের সিদ্দিকী: আপনাকেও ধন্যবাদ।