ঢাকা ৩০ পৌষ ১৪৩১, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

৭ ডিসেম্বর: হানাদার হটিয়ে শত্রুমুক্ত হয় পাঁচ জেলা

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:২২ এএম
আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:২৭ এএম
৭ ডিসেম্বর: হানাদার হটিয়ে শত্রুমুক্ত হয় পাঁচ জেলা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

মহান মুক্তিযুদ্ধে ৭ ডিসেম্বর দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে দেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের প্রবল বিক্রমে নোয়াখালী, কুড়িগ্রাম, গোপালগঞ্জ, শেরপুর, চুয়াডাঙ্গা শহর শত্রুমুক্ত হয়।

এদিন মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ৩য় বেঙ্গলের দুটি কোম্পানি ও ডাউকি সাব-সেক্টর রাধানগর নিয়ন্ত্রণে নেন। পরে তারা গোয়াইনঘাট হয়ে সালুটিকরে সিলেট বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হন। ভোরে সিলেট বিমানবন্দরে ছত্রীসেনা নামায় ভারতীয় মিত্রবাহিনী। ফলে সিলেট বিমানবন্দর ও আশপাশের এলাকা শত্রুমুক্ত হয়।

কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল বিবির বাজার, ভাটপাড়া ও বাঘেরচর দিয়ে এসে কুমিল্লা বিমানবন্দরের হানাদার ঘাঁটিতে ত্রিমুখী হামলা চালায়। একপর্যায়ে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী বিমানবন্দর ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় হানাদার বাহিনী পিছু হটে। ময়মনসিংহে আফসার বাহিনীর সঙ্গে পাক হানাদারদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। টিকতে না পেরে পাক সেনারা পালিয়ে যায়। 

৭ ডিসেম্বর বিকেলে বগুড়া ও রংপুর সড়কের করতোয়া সেতুর দখল নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও যৌথ বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে হানাদার বাহিনীর ৩৫ জন সৈন্য হতাহত হয়। এদিন সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল ও সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মোংলা ও সুন্দরবনের বিশাল এলাকা হানাদারমুক্ত করেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৬ এএম
আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৬ এএম
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মুক্তিযুদ্ধ
ড. মুহাম্মদ ইউনূস

১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য টেনিসে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত ছিলেন বাংলাদেশে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যুক্তরাষ্ট্রে জন্মভূমির স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সংগঠনে নেমে পড়েন তিনি। স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন জোগাতে বাঙালিদের সংগঠিত করা ও তহবিল সংগ্রহের পাশাপাশি মার্কিন প্রশাসনসহ জাতিসংঘে কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তিনি বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে মুক্তিকামী মানুষের খবর পৌঁছে দিতে সেখানকার স্থানীয় পত্রিকা ও টেলিভিশনের সম্পাদক এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কাজটি তিনি নিয়মিত করেছেন। অধ্যাপক ইউনূস প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সমর্থন জোগাতে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার পরিচালনা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশভিলে তার নিজ বাড়ি থেকে প্রকাশ করতেন ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’। খবর বাসসের।

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ মুক্তিযুদ্ধকালীন তার ঘটনাবহুল দিনের কথা উল্লেখ করেছেন নিজের লেখা ‘গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন’ আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো এবং সে সময়ে আমার দেশে ফেরার একটা পরিকল্পনা ছিল, তা বানচাল হয়ে গেল। 

মুক্তিযুদ্ধের কাজে আমি সমর্পণ করলাম। অন্য সব বাঙালির মতো আমার নজর ঢাকার দিকেই নিবদ্ধ ছিল। সেই ভয়ংকর দিনটিতে ঘরে ফিরে রেডিওতে খবর শুনলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালিদের দমন করতে নেমে পড়েছে।’

মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় পরের দিন ২৬ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশভিলে এক বাড়িতে বাঙালিদের সমবেত হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস লিখেছেন, ‘ঠিক এক ঘণ্টার মধ্যে প্রবাসী এক বাঙালির বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। আমাকে নিয়ে বৃহত্তর ন্যাশভিলের পূর্ব পাকিস্তানের ছয় বাঙালি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আশু কর্তব্য স্থির করাই ছিল সবার উদ্দেশ্য। 

বাঙালিদের সেই বৈঠকে তিনটি বিষয় তখন স্থির হয়-

১. আমরা স্থানীয় টেলিভিশন কেন্দ্রের সাংবাদিক ও স্থানীয় দৈনিক সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সঙ্গে যোগাযোগ করব এবং বাংলাদেশের স্বার্থে তাদের সমর্থন চাইব।

২. আমরা প্রত্যেকে এক হাজার ডলার দিয়ে একটা তহবিল গঠন করব, যাতে এখানকার কাজের খরচ চালিয়ে নেওয়া যায়।

৩. বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া অবধি আমাদের বেতনের ১০ শতাংশ আমরা ওই তহবিলে জমা দেব। প্রয়োজনে সাহয্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করব। 

ড. ইউনূসের কথায়, ‘যতদূর সম্ভব খবর সংগ্রহ করতে শুরু করলাম। সামগ্রিক অবস্থার কোনো স্পষ্ট চিত্র আমাদের সামনে ছিল না। আর সহ্য হলো না আমার। সমবেত বাঙালিদের উদ্দেশে বললাম, ‘যতটা দরকার তার বিস্তারিত বিবরণ আমরা সংগ্রহ করেছি। বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। এখন আমাদের স্থির করতে হবে আমরা নতুন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলাম কি না। আমি আমার সিদ্ধান্ত সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই। আমি নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা দিলাম। কেউ ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে যোগ দিতে পারেন, যারা বাংলাদেশের সঙ্গে হাত মেলাবেন না তারা আমার চোখে পাকিস্তানি, বাংলাদেশের শত্রু।’

তিনি বলেন, ‘চারিদিক নীরব। আমি যেভাবে সমর্থনের প্রশ্ন তুলেছি তাতে সবাই অবাক হয়ে গেছে। এক রকম অপ্রত্যাশিত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবাই বাংলাদেশের পক্ষ নিল। ‘বাংলাদেশ নাগরিক সমিতি’ গঠন করে তখনই ন্যাশভিলের সংবাদপত্রে ও টেলিভিশনের সাংবাদিক সম্মেলনে সে কথা প্রচার করার প্রস্তাব দিলাম।’

অধ্যাপক ইউনূস মুক্তিযুদ্ধে তার সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়ে আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন’-এ আরও লেখেন- ‘পরের দিন ২৭ মার্চ আমরা স্থানীয় টেলিভিশন কেন্দ্র ও দৈনিক সংবাদপত্রের সাংবাদিক বৈঠক ডাকলাম। আমি ‘বাংলাদেশ নাগরিক সমিতি’র সচিব ও দলের মুখপাত্র নির্বাচিত হলাম। স্থানীয় টেলিভিশন কেন্দ্র আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে খবর পরিবেশনের সুযোগ পায় না। তারা আমাদের প্রতিবেদন উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করল। আমরা তাদের কাছে হয়ে উঠলাম তাজা আন্তর্জাতিক খবর সরবরাহকারী, যে খবরের সঙ্গে আবার স্থানীয় কিছু মানুষজন জড়িত আছেন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বাকি পাঁচজন সবাই শহরের হাসপাতালের ডাক্তার। আমরা সবাই একযোগে নিজেদের এমন একটি দেশের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করছি, যার এখনো জন্মই হয়নি। কী রোমাঞ্চকর সংবাদ!’

তিনি লিখেছেন, ‘সংবাদপত্রের পক্ষ থেকে আমাদের সাক্ষাৎকার ছাপা হলো। ছবি ছাপা হলো। স্থানীয় সংবাদে আমার একটি সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকার নেওয়া হলো। আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- ‘টেনেসিবাসীদের জন্য আপনার কোনো বার্তা আছে কি? ‘হ্যাঁ, অব্শ্যই আছে’- আমি উত্তর দিলাম। বললাম- ‘দয়া করে আপনাদের প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটের সদস্যদের অনুরোধ করে বার্তা পাঠান, যাতে অবিলম্বে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা যায়। আপনাদের পাঠানো অস্ত্রশস্ত্র নির্দোষ নিরস্ত্র বাংলাদেশের নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করতে সাহায্য করছে। আপনাদের এই নির্দয় গণহত্যা বন্ধ করতে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য আপনাদের প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ জানান।

তিনি লিখেছেন, ২৯ মার্চ ওয়াশিংটনে বাঙালিদের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নিতে এর আগের দিন ২৮ মার্চ আমি ওয়াশিংটনে পৌঁছে যাই। এরপর ২৯ মার্চ বিকেলে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য আমরা সবাই সমবেত হলাম ক্যাপিটল ভবনের সিঁড়িতে। আমার বানানো ফেস্টুন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দূর-দূরান্ত থেকে বহু বাঙালি এসেছিলেন বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিতে। নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, ডেট্রয়েটের বাঙালিরা সমবেত হন।

অধ্যাপক ইউনূস লিখেছেন, ‘ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। ক্যাপিটল হিলের সিঁড়িতে সে বিক্ষোভ প্রদর্শন এক ঐতিহাসিক ঘটনা। আমেরিকান আইনসভার সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলাম আমরা।’ 

তিনি আরও লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ-শামসুল বারী ও আমার ওপর ভার পড়ল ওয়াশিংটনের সব দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করার। রাষ্ট্রদূত ও তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে আমাদের সমস্যা তাদের ব্যাখ্যা করা ও বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য অনুরোধ জানানো। আমাদের দুজনের পক্ষেই সেই অভিজ্ঞতা খুব রোমাঞ্চকর হয়েছিল। এক দিনে অনেকগুলো দূতাবাসে যেতাম আমরা নাগরিক কমিটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে।’ তিনি অন্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সমর্থন জোগাতে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার পরিচালনা করেন।

শামসুল বারী ন্যাশভিলের তার বাড়ি থেকে ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’ পত্রিকার প্রথম প্রকাশ করেন। তার হাত থেকে সম্পাদকের কার্যভার আমি গ্রহণ করি। তার পর থেকে এই পত্রিকা ন্যাশভিলে ৫০০ নম্বর প্যারাগন মিলস রোডে আমার বাড়ি থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। আমার ফ্ল্যাট হয়ে ওঠে তার প্রধান যোগাযোগ কেন্দ্র। লম্বা প্রচার অভিযান সেরে ফিরে আসার পর ফোন বাজার বিরাম ছিল না। ফোন আসত উত্তর আমেরিকার নানা শহর থেকে, ইংল্যান্ড থেকে। প্রত্যেক প্রবাসী বাঙালি প্রতিদিনের যুদ্ধের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর জানার জন্য উদ্গ্রীব থাকতেন।

ওয়াশিংটনে বাঙালিদের প্রচেষ্টায় ক্যাপিটল হিলের কাছে (যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সংসদ) বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র স্থাপিত হয়। হাউস ও সিনেটের প্রচার অব্যাহত রাখার জন্য প্রথম দিকে তথ্যকেন্দ্রের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ড. ইউনূস ‘বাংলাদেশবান্ধব সমিতি’ স্থাপনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

অধ্যাপক ইউনূস তার বইয়ে লেখেন, ‘সেই ৯ মাসের সংগ্রামে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ সম্বন্ধে একটি পরিষ্কার চিত্র আমাদের মনে তৈরি হয়ে গেছিল। যত দিন যাচ্ছিল, সে চিত্র স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছিল। আমরা চেয়েছিলাম গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনমত প্রকাশের সুযোগ। ইচ্ছানুযায়ী জীবনযাত্রা নির্বাচনের স্বাধীনতার আস্বাদ মানুষকে দিতে চেয়েছিলাম। আশা করেছিলাম মানুষ দারিদ্র্যের কবল থেকে মুক্তি পাবে। প্রত্যেক নাগরিকের শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমরা সেই জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলাম, যে জাতি বিশ্বের দরবারে মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।’

অধ্যাপক ইউনূস আরও লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ বিজয়ী হলো। আমি দেশে ফিরে দেশকে নতুন করে গঠনের কাজে ব্রতী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বুঝলাম এবার আমার ফেরার সময় এসেছে। দেশ গঠনের কাজে অংশগ্রহণ করার ডাক এসেছে। নিজের মধ্যে নিজের প্রতি একটা তাড়না অনুভব করলাম।’

পরে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে নিযুক্ত হন। একসময় সমাজে পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক মানুষের কল্যাণে গড়ে তোলেন গ্রামীণ ব্যাংক।

নাটোরমুক্ত দিবস ২১ ডিসেম্বর

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৫৩ পিএম
আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০৪ পিএম
নাটোরমুক্ত দিবস ২১ ডিসেম্বর
নাটোরের উত্তরা গণভবনে ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পনের চিত্র ও দলিল

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ এলাকা হানাদারমুক্ত হলেও নাটোর মুক্ত হয় ২১ ডিসেম্বর। 

একই দিন নাটোরের উত্তরা গণভবনে ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এ জেলা মুক্ত হয়।

পাকিস্তান বাহিনীর নাটোর ব্যারাক কমান্ডার পিএ ১৭০২ ব্রিগেডিয়ার নওয়াব আহমেদ আশরাফ ভারতীয় বাহিনীর আইসি ৪৫৫১ ব্রিগেডিয়ার রঘুবীর সিং পান্নুর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় নাটোর ছিল পাকিস্তান হানাদারদের ২নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার। এখান থেকেই দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনা করত পাকিস্তানি বাহিনী। ২১ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের আগ পর্যস্ত সম্পূর্ণ নাটোর ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে। জেলার উত্তরা গণভবন ছাড়াও আনসার কোয়ার্টার, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজ, নাটোর রাজবাড়ি, পিটিআই, নাটোর মহারাজা জেএন উচ্চ বিদ্যালয়, ভকেশনাল স্কুল, দিঘাপতিয়া কালীবাড়ি ও বর্তমান উপজেলা পরিষদ 
কার্যালয় ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি। 

এ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সদর উপজেলার ফুলবাগান, ছাতনী, দত্তপাড়া, মোহনপুর, লালবাজার, কাপুড়িয়াপট্টি, শুকলপট্টি, মল্লিকহাটি, বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া ক্যাথলিক মিশন, গুরুদাসপুর উপজেলার নাড়িবাড়ি, সিংড়া উপজেলার হাতিয়ানদহ, কলম এবং লালপুর উপজেলার গোপালপুরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল চত্বরসহ ২০ জায়গায় গণহত্যা চালায়। 

১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বগুড়া, দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, ঈশ্বরদী, নবাবজগঞ্জ বিভিন্ন জায়গা থেকে পাকিস্তানি সেনারা নাটোরের পিটিআই স্কুল, আনসার হল, রিক্রিয়েশন ক্লাব, এনএস সরকারি কলেজ, নাটোর রাজবাড়ি ও দিঘাপতিয়া উত্তরা গণভবনে (তৎকালীন গভর্নর হাউস) আশ্রয় নেয়। এরপর ২১ ডিসেম্বর উত্তরা গণভবন চত্বরে পাকিস্তানি বাহিনীর নাটোর ব্যারাক কমান্ডার পিএ ১৭০২ ব্রিগেডিয়ার নওয়াব আহমেদ আশরাফ ভারতীয় বাহিনীর আইসি ৪৫৫১ ব্রিগেডিয়ার রঘুবীর সিং পান্নুর কাছে আত্মসমর্পণ করে। 

এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ১৫১ জন অফিসার, ১৯৮ জন জেসিও, ৫ হাজার ৫০০ সৈনিক, ১ হাজার ৮৫৬ জন আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য তাদের ৯টি ট্যাংক, ২৫টি কামান ও ১০ হাজার ৭৭৩টি ছোট অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। 

নাটোরের বীরপ্রতীক সোলায়মান আলী বলেন, পাকিস্তানি সেনারা নাটোরের যেসব জায়গায় গণহত্যা চালিয়েছিল তার কিছু জায়গায় গণকবর ও মিনার নির্মিত হলেও তার যথোপযুক্ত তত্ত্বাবধান নেই। বর্তমান সদর উপজেলা পরিষদের (মুক্তিযুদ্ধকালীন মিলিটারি পুলিশ হেডকোয়ার্টার) ভেতরের শিমুলতলায় এখনো কোনো শহিদ স্মৃতি নির্মিত হয়নি, তালিকা হয়নি গণকবরে শায়িত শহিদদের, সংরক্ষিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি- যা সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরের পরিত্যক্ত ভবন সংস্কার করে করা যায়। সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়নি নাটোরের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। 

শুধু বিশেষ দিন পালন ও শহিদদের স্মরণের মধ্যেই কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রাখলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই ইতিহাস ভুলে যাবে দাবি করে এ ব্যাপারে তিনি সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ কামনা করেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাটোরের সদস্য শাহরিয়ার তামিম জানান, ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর নাটোর পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হলেও দ্বিতীয় স্বাধীনতার স্বাদ পায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনে নাটোরের আটজন শহিদ হন। আহত হয়ে এখনো বিছানায় কাতড়াচ্ছেন অনেকেই।

হাজারও প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতার সূর্য যেন আর কখনোই অস্তমিত না হয়, সে জন্যে দেশের শাসন ক্ষমতাকে ফ্যাসিজমমুক্ত রাখতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

কামাল/পপি/

৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে চাঁদপুরে বিজয় দিবস উদযাপন

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:০৭ পিএম
আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:২৯ পিএম
৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে চাঁদপুরে বিজয় দিবস উদযাপন
চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বিজয় দিবসে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ছবি : খবরের কাগজ

৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে ১৯৭১ সালের বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে চাঁদপুরে মহান বিজয় দিবস উদযাপন করা হয়েছে।

সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের মুক্তিযোদ্ধা সড়কে লেকের পাড় ‘অঙ্গীকার’ পাদদেশে বীর শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।

জেলা প্রশাসনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর, রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ এই বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়।

চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষে জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন, পুলিশ প্রশাসনের পক্ষে (এসপি) মুহম্মদ আব্দুর রকিব, নৌ-পুলিশের পক্ষে (এসপি) সৈয়দ মোশফিকুর রহমান পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

এরপর পর্যায়ক্রমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন- চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চাঁদপুর পৌরসভা, সদর উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা।   

চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকের নেতৃত্বে অঙ্গীকার পাদদেশে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এ সময় জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

বিজয় দিবসে দিনব্যাপী কর্মসূচির আয়োজন করেছে জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জেলার আট উপজেলা প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন পৃথক কর্মসূচির আয়োজন করেছে।

ফয়েজ/সুমন/

বিশেষ সাক্ষাৎকার: বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৩ পিএম
আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:২৭ পিএম
যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী একজন রাজনীতিবিদ। তিনি মুক্তিযুদ্ধে বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তি, যিনি ১৯৭১-এর যুদ্ধে বাঘা সিদ্দিকী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য ব্যতিরেকেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে ঢাকা আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। তার অসীম সাহসিকতার কারণে তাকে বঙ্গবীর নামে ডাকা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক, তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজ-এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগের সিনিয়র সহসম্পাদক শেহনাজ পূর্ণা

খবরের কাগজ: যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে কি না, কতটুকু হয়েছে?
কাদের সিদ্দিকী: যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি, সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। স্বাধীন দেশ এমন হবে, এটা জানলে স্বাধীনতার সময় যারা জেনে হোক, না জেনে হোক, উন্মাদনায় হোক- যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছে তাদের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ শামিল হতো না। ঝড়-তুফান এলে যেমন ক্ষতি হয়, কেউ জড়িয়ে না থাকলেও তেমন ক্ষতি হয়। সেরকমভাবে যারা মারা গেছে, অসখ্য মানুষ যারা আমাদের গ্রামের ভাষায় বললে ‘হেলে মেলে’ অর্থাৎ যারা আগে-পিছে কোনোখানেই ছিল না, এরকম লাখো মানুষ মারা গেছে। তাদের আত্মীয়-স্বজন, আপনজন কেউই তাদের মৃত্যুর জন্য কোনোরকম খেদ ব্যক্ত করেনি। বরং তারা খুশি হয়েছে এটা ভেবে যে, ‘আমার সন্তান, আমার আত্মীয়, আমার পিতা-মাতার জীবনের বিনিময়ে একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি।’ তারা ভেবেছে, এর বিনিময়ে আমার দেশের মানুষের অধিকার, সম্মান, জীবনের মর্যাদা ইত্যাদি সবকিছুই রক্ষা পাবে। যদি এই মানুষগুলো তখন বুঝতে পারত যে, এর কোনোটাই হবে না, তাহলে এতো লোক স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত না। 

কিছুদিন আগে একটা অসম্ভব বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু সেই বিপ্লব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ বলেছেন, দ্বিতীয় স্বাধীনতা। মানুষ খুব বিপদে পড়লে অথবা অসুবিধায় পড়লে অনেক সময় বলা হয়, বিপদ কেটেছে অথবা নবজন্ম হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা অমন হালকা বিষয় নয়। মানুষের জন্মের পরে যেমন অবধারিত মৃত্যু অর্থাৎ জন্ম বারবার হয় না। কোনো দেশের স্বাধীনতাও ঠিক তেমন। একটি জাতির স্বাধীনতা বারবার হয় না। আবেগী অনেক কথাবার্তা হতে পারে। আমি অনেকদিন নির্বাসনে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৬ বছর দেশের বাইরে ছিলাম। এরশাদের পতনের পর ১৯৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বরে দেশে ফিরে আসি। ১৬ বছর পরে ১৬ ডিসেম্বর আমি দেশে ফিরলে আমাকে দেখে প্রথম ড. কামাল হোসেন, আমীর-উল-ইসলাম, সিরাজুল হকসহ অনেকেই জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আমরা বিজয় অর্জন করেছি। কিন্তু আমরা দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি কথাটা অযৌক্তিক। একই সঙ্গে বলতে হয়, এ ধরনের কথাবার্তা বলা অনুচিত। এতে দ্বিধা তৈরি হয়। আমরা স্বাধীনতা একবারই অর্জন করেছি এবং তা ১৯৭১-এ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা সফল হয়েছেন, দুই দিন পরে এ কথার জন্য তাদেরও হয়তো জবাবদিহি হতে হবে এবং তারা নিন্দিত হবেন। দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হলে তাদেরও চলে যেতে হবে। সে জন্যই বলছি, যে স্বপ্ন নিয়ে, যে আশা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সবাই করেছেন- তা সফল হয়নি। তবে একটা সফলতা আমাদের মানতেই হবে যে, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকে যুদ্ধ করেছি। অনেক কষ্ট করেছি, কারাবরণ করেছি, জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করেছি। আজকে যে যত ফুটানিই করুক, পাকিস্তানের হাত থেকে দেশ মুক্ত না হলে অনেকে ভিক্ষা করে খেত। যারা বড় বড় বাড়িতে থাকে, কোটি টাকার গাড়িতে চড়ে, তাদের রিকশায় চড়ার পয়সা থাকত না। আমরা দেশের মানুষের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। দেশের সম্মানের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। আমরা মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। আমরা এমন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করিনি। কাজেই বলব, যুদ্ধ জয়ের আনন্দ আমাদের ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্ন আমাদের আজও পূরণ হয়নি। 

খবরের কাগজ: আপনি কাদেরিয়া বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন, সম্মুখযুদ্ধ করেছেন, সেই যুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতি যদি কিছু বলেন। 
কাদের সিদ্দিকী: আমরা যেখানে যুদ্ধ করেছি সেটা টাঙ্গাইলে- তখন গণমুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। এর প্রধান ছিলেন আমার বড় ভাই আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী এমপি। আমরা তার নেতৃত্বে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম। কিন্তু তার পর অনেককে খুঁজে না পেয়ে আমাদের নাম বেশি এসেছে। আমাদের কালিহাতির চারানে যুদ্ধ হয়েছে। সে সময় ৫-৭ জন আর্মি মারা গেছে। সবখানে খবর হয়ে যায়, মুক্তিবাহিনী আর্মি মেরে ফেলেছে! কারা মারল? তখন নাম হলো কাদের সিদ্দিকীর দল। বল্লায় বিরাট যুদ্ধ হয়েছে। কে করেছে? কাদের সিদ্দিকীর দল। কাদের সিদ্দিকী এখানে কোনো বাহিনী বানায়নি। কাদের সিদ্দিকীর নাম থেকে মুখে মুখে আপনা আপনিই কাদেরিয়া বাহিনী হয়ে গেছে। এর পর অনেক নেতাই পালিয়ে গেছে , কাদের সিদ্দিকী পালায়নি। যুদ্ধের সময় যেহেতু লোকেরা বলেছে কাদের সিদ্দিকীর দল যুদ্ধ করছে। কাজেই কাদের সিদ্দিকী সব জায়গায় আছে। দ্বিতীয়ত হলো- যুদ্ধবিগ্রহের সময় অনেকাংশে নেতারা পেছনে থাকে। কাদের সিদ্দিকী সবসময় প্রথম সারিতে থেকেছে। এই একটাই হলো বৈশিষ্ট্য। কাদের সিদ্দিকী কাউকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে পেছনে থাকেনি। আর কোনো সময় তা প্রয়োজনও পড়েনি।

খবরের কাগজ: মুক্তিযুদ্ধের কোন স্মৃতি আপনাকে বেশি নাড়া দেয়?
কাদের সিদ্দিকী: জীবনের পথে নতুন কিছু থাকে, আমরা বলি, হঠাৎ! সেই হঠাৎ ভালো অথবা খারাপ সেটাকে আলোড়িত করে। আমাদের জীবন এমন গতানুগতিক, জীবনে কখনো তা ভাবার সুযোগ হয়নি যে, কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ। আমাদের সবটাই ভালো। কারণ যেদিন থেকে রাজনীতিতে এসেছি, মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারলেই ভালো মনে হয়েছে। এই দুনিয়ার মানুষ আমাকে চিনত না। কখনো বলত না যে, এই নামে একটা মানুষ আছে। অনেকেই হয়তো জানে না, আমার ডাক নাম বজ্র। ছেলেবেলায় আমার কাছে মনে হতো, কী একটা নাম দিয়েছে, আকাশ থেকে পড়ে, বজ্র। এখন কিন্তু আমার কাছে খুব প্রিয় নাম ‘বজ্র’। আমি একটা যুদ্ধ করেছিলাম চারানের পর, বল্লায়। সেটাই আমাদের প্রথম সাকসেস বা সাফল্য বলা যায়। পাকিস্তান আর্মি আমরা ধরে এনেছিলাম। আমাদের সতীর্থরা তখন বলেছিল- ‘বজ্র, আমরা দেশটা জ্বালাব’। আমরা দেশ স্বাধীন করব। আমার বাবা খুব রাগী মানুষ ছিলেন। তার পরও বলব, আমার বাবা ছিলেন শ্রেষ্ঠ মানুষ। তিনি সব সময় নৈতিকতার প্রমাণ দিয়েছেন। টাকাওয়ালারা তাকে কখনোই নীতিভ্রষ্ট করতে পারতেন না। আমি যেহেতু পড়াশোনায় খুব একটা মনোযোগী ছিলাম না, যে কারণে আমি হয়তো একটা রিকশাওয়ালা হতাম, না হয় গরুর রাখাল হতাম। আমাদের বাড়িতে প্রচুর গরু ছিল। একসময় আমাদের বাড়িতে ৫০টি গরু ছিল। সেগুলোর ঘাস খাওয়াতে মাঠে নিয়ে যেতে আমার ভালো লাগত। এবং আমি খুব ভীতু ছিলাম। আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে আমার পা কাঁপত। হায় হায়- আমি তখন পুলিশ দেখেও ভয় পেতাম! লতিফ সিদ্দিকী ও আমি একই মায়ের সন্তান। মাঝে মাঝে মনে হতো তাঁর এতো সাহস, আমার সাহস নেই কেন! এরকম করে করেই একসময় স্লোগান দিতে শিখেছিলাম, পোস্টার লাগাতে শিখেছিলাম। তখন থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয়। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসতাম। আমি একেবারে চেহারা-চরিত্রে অনেকটাই ভালো বলতে হবে, ফেলে দেওয়ার মতো না আর কী। কিন্তু আমি কখনো কোনো মেয়ের প্রেমে পড়িনি। আমার প্রেম ছিল রাজনীতি, আজও তাই। আমার প্রেম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে আমি দেশকে ভালোবাসতে শিখেছিলাম। যখন আমি এই মাটিতে হাত দিই, মনে হয় আমি আমার মায়ের গায়ে হাত দিয়েছি। এখনকার নেতারা সবাই মুখে অনেককিছুই বলতে পারে, শুধু কোনোকিছুই তাদের উপলব্ধিতে নেই। সে জন্য বলব, একটা জায়গায় পৌঁছানোর জন্য একটু সময় লাগে। আপনি যখন বললেন, আপনি যুদ্ধে গেলেন কখন। আমি তো যুদ্ধে যাইনি। আমি তো সবসময় যুদ্ধেই আছি। যুদ্ধ হওয়ারও আগে আমাদের অধিকারের জন্য, ভোটের জন্য চিৎকার করেছি। ভোটের মর্যাদা যখন পাকিস্তান রাখেনি, তার বিরুদ্ধে আমরা অসহযোগ করেছি। অসহযোগেও যখন কাজ হয়নি, তারা আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমাদের অনেক নেতা হয়তো টিকতে পারেনি- ভয় পেয়ে চলে গেছে। আমরা তখন ছোট ছিলাম, আমাদের অতটা ভয় করেনি। আমরা অস্ত্র নিয়ে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। যুদ্ধ করতে করতে দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। সে সময় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভার ছবি বড় করে প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। এর পর বঙ্গবন্ধু এলেন। একসময় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো! আজও দেশের গণমানুষের মুক্তি হলো না। আজ আমার কাছে সবই বেদনাবিধুর স্মৃতি। 

খবরের কাগজ: মুক্তিযুদ্ধে ভারত যদি সহযোগিতা না করত, তাহলে কী হতে পারত?
কাদের সিদ্দিকী: মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সমর্থন না থাকলে আমাদের আরও অনেক সময় লাগত। আমাদের আরও অনেক বেশি ক্ষতি হতো। আরও গভীরভাবে বলা যেতে পারে, তাহলে ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীন হতাম না। হয়তো বা ২০৭১ সালে হতাম অথবা এখন ২০২৪ সালে হতাম। কিন্তু ’৭১-এ আমরা স্বাধীন হতাম না। আমরা হয়তো ভুলে গেছি, আমাদের ১ কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। তারা আশ্রয় নিতে না পারলে আরও অন্তত ৫০ লাখ লোক মারা যেত। আমরা যে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছি, আমাদের তো কিছুই ছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমরা যেভাবে যুদ্ধ করেছি- যা একদমই আলাদা, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও হয়নি। সারা দেশ আমাদের মতো হতে পারলে, তাহলে ভারতের কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু সেটা হতে আমাদের কমপক্ষে আরও ৫০ বছর লাগত। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতাম ও ভেঙে পড়তাম। আবার হয়তো ৫ বছর পর দাঁড়াতাম অথবা আরেকজন দাঁড়াত। এই যে ব্যাপারগুলো হতো, এজন্য আমরা না হলেও আরও ২০ বছর পিছিয়ে পরতাম- এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই ক্ষেত্রে ভারতের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা একটা দেশের জন্য আরেকটা দেশের সহযোগিতা, আমি বলব শ্রেষ্ঠ সহযোগিতা। এর চাইতে আন্তরিক, এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ সহযোগিতা হতে পারে না। আমাদের অনেক মানুষ আছে, গভীরে না গিয়ে ওপরে থেকে ছটফট করে। পাকিস্তান যখন হয়েছিল, তার আগে আমাদের এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক প্রীতি ছিল। যদিও ব্রিটিশরা দেশ ছাড়ার আগে এখানে নানাভাবে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দিয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৬ সালে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ বলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একটা ডাক দিয়েছিলেন। বাড়ির পাশে একজন হিন্দু মুচি যে কিছুই জানে না, ওকে মুসলমান বানিয়ে মেরে ফেলা হলো। পাশের ঘরে দর্জি মুসলমান, হিন্দু বলে মেরে ফেলা হলো। শত বছর একসঙ্গে তারা আছে পরস্পরের সঙ্গী হয়ে। তাদের মধ্যে বিভেদ নেই। বিগ্রহ নেই। এখানে পাকিস্তান, ওপাশে ভারত। যত রকমের ম্যাকানিজম লাগে তা করেছে তথাকথিত ক্ষমতাবানরা। বলা বাহুল্য, ভারত পাকিস্তানের শত্রু। এর মধ্যে ১৯৬৫ সালে একটা যুদ্ধ হয়েছে, ভারত-পাকিস্তান। সেই যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) ৪ থেকে ৫ হাজারের বেশি সৈন্য ছিল না। ভারত যদি ইচ্ছে করত ১০ মিনিটেই পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিতে পারত। ফলে ভারতের প্রতি এখানকার মানুষের একটা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মনে জাগে। এর পর যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন বহু মানুষ ভারতে যেতে দ্বিধা করেছে। বিশেষ করে অনেক মুসলমান ভারতে যেতে দ্বিধা করেছে। তার পরও এত লোক ভারতে গেছে, ভারত তাদের নৈতিকভাবেই আশ্রয় দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আন্তরিকভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। ভারতের বিজয়ের কোনো ইতিহাস ছিল না। পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৯৪৮ সালে প্রথম যুদ্ধ হয় ভারত-পাকিস্তানের এবং সেটা কাশ্মীরে। যেখানে ভারত জেতেনি। কারণ পাকিস্তান তখন অর্ধেক কাশ্মীর দখল করে নিয়েছিল। ১৯৬২ সালে চীন-ভারতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখনো ভারত জেতেনি, হেরেছে। ১৯৬৫ সালেও ভারত হেরেছে। ভারতের খাতায় বিজয় লেখা ছিল না। ১৯৭১-এ লাখ লাখ বাঙালি জীবন দিয়ে পাকিস্তানিদের একেবারে নাস্তানাবুদ করেছিল। সেই প্রথম ভারত বাঙালির একটা মহান বিজয় অর্জনের ক্ষেত্রে অংশ গ্রহণ করেছিল। যে বিজয়ের ফল আজকে ভারত ভোগ করছে বাংলাদেশকে শাসন ও শোষণের মধ্য দিয়ে। এটা খুবই দুঃখজনক।

খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন, ভারত সহযোগিতা করেছে নিজেদের স্বার্থে?
কাদের সিদ্দিকী: সবাই নিজের স্বার্থের জন্যই কাজ করে। আমাকে যখন মারছে, আমাকে যখন হত্যা করছে- আমি কি ভারতের স্বার্থে ভারতে আশ্রয় নিতে সেখানে গিয়েছিলাম? মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি যখন মারা যাচ্ছি, আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তাহলে আমি ভারতে গিয়েছিলাম ভারতকে সাহায্য করতে? নাকি আমি আমার জীবন রক্ষার জন্য ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সবাই তার নিজের স্বার্থেই কাজ করে। ভারতেরও মহান স্বার্থ আছে। আমাদেরও স্বার্থ ছিল। পাকিস্তানকে হারানোর জন্য ভারতের সহযোগিতা নিয়েছি। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিহীন লোকেরা মাথা নিচু করে, মাথা নত করে সেই সম্পর্ক নষ্ট করছে। আমরা ভারতের সঙ্গে সমমর্যাদা দেখতে চেয়েছি। বিমাতাসুলভ অথবা বড় ভাই ছোট ভাই হতে চাইনি। আমি ওখানে এমন কোনো নেতা দেখিনি, বড় ভাই ভোট ভাইয়ের আচরণ তারা করে। আমরা তো অসহায় অবস্থায় ছিলাম। কিন্তু আমার সঙ্গে একদিনের জন্যও অমর্যাদাকর কথা হয়নি। এখন আমরা নিজে গিয়ে যদি চাকর হই, তাদের দয়া চাই, ভিক্ষা চাই- ওদের কী দোষ আছে? এখানে বলব, আমাদের বর্তমান নেতা এবং ওদের বর্তমান নেতাদের অনেক ত্রুটি আছে। আমাদের ত্রুটি অনেক বেশি। দেশে একটা সরকার থাকে। সেই সরকারই কি সেই দেশ? কখনো নয়। যদি তাই হতো, তাহলে এখানে শেখ হাসিনার সরকার ছিল- তাহলে এখন সে কোথায় গেল? কখনো কখনো সরকার আসে দেশকে চালাবার জন্য আবার চলেও যায়। তাদের জনতার কথা মাথায় রেখেই গদিনশীল হতে হবে। জনতার বিরুদ্ধে গেলে গদি ছেড়ে চলে যেতে হবে। এই গদির মায়া ত্যাগ করে জনতার প্রতি মায়া দেখাতে হবে। মনে রাখতে হবে, জনগণকে বোকা ভাবে যারা, তারাই আসলে বোকার স্বর্গে বসবাস করছে।

খবরের কাগজ: বর্তমান সময়কে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
কাদের সিদ্দিকী: ভারত-বাংলাদেশের সুসম্পর্ক থাকা ভালো। কোনো ব্যক্তির জন্য অথবা কোনো দলের জন্য সে সম্পর্কটা সীমার বাইরে চলে যাওয়া ঠিক নয়। যা আওয়ামী লীগের হোক, বিএনপির হোক, জামায়াতের হোক, আমাদের হোক- এটা উচিত নয়। কিন্তু সেটাই হচ্ছে। ভালো করে একটা পরিবার চালাতে ধৈর্যের দরকার হয়। সহনশীলতা লাগে। পরস্পরকে মানতে হয়। আর একটা রাষ্ট্র চালাতে ধৈর্য লাগবে, সহনশীলতা লাগবে- এটা সবাইকে বুঝতে হবে। নানান মত-পথ একত্র করে চলতে হবে। আমার বোন শেখ হাসিনা সাড়ে পনেরো বছর ক্ষমতায় ছিলেন। সব বিরোধী দলকে নিয়ে এক দিনের জন্য মিটিং করেছেন কি? করেননি। উনি ক্ষমতালোভী হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের ধ্বংস ডেকে এনেছেন। দেশে ১৫ লাখের মতো রোহিঙ্গা আছে। দুবার রোহিঙ্গা ঢুকেছে আমাদের দেশে। একবার জিয়াউর রহমানের সময়, আরেকবার শেখ হাসিনার সময়। এটা একটা জাতীয় সমস্যা। সেই সমস্যায় তিনি সব দলকে ডাকতে পারতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জয় প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন। তাকে ভারতে একটা সময় বলা হতো দ্বিতীয় গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে তাকে সারা পৃথিবী ঘোরানো হয়েছে। সেই সুবিধাটাও ভারত মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে পেয়েছে। শেখ হাসিনা যাওয়ার ৬-৭ দিন পরে সব দলকে নিয়ে নরেন্দ্র মোদি বৈঠক করেছেন। এখন যে সরকার বাহাদুররা আছেন- আমি ড. ইউনূসকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ মনে করি। উনার সঙ্গে আমার অনেকবারই দেখা হয়েছে। ইতিমধ্যে ১০০ দিন হয়ে গেছে। মাঝে-মাঝেই শুনি, তিনি সব দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন। তাঁর কাছে আমার প্রশ্ন, তিনি কী আমাদের খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছেন? আমাদের সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক দল হতে হবে। মানুষের ভোটে নির্বাচিত হলে তখনই সেই দল নিবন্ধিত হলো, না হলে হলো না, এগুলো কোনো কথা নয়। মূলকথা হচ্ছে, রাজনীতি করার জন্য কারও সার্টিফিকেট নেওয়া লাগবে, এটা কোনো গণতান্ত্রিক পথ নয়। জনতাই সবচেয়ে বড় সার্টিফিকেট। জনগণ চাইলে আমাদের গদিতে বসাবে। জনগণ না চাইলে গদি ছেড়ে চলে যেতে হবে।

খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এখনো রচিত হয়নি?
কাদের সিদ্দিকী: একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার ৫০ বছর পর সঠিক কিছু শুরু হয়। ১০০ বছর আগে কোনো সঠিক ইতিহাস রচিত হয় না। কারণ ইতিহাসের ওপর সমকালের প্রভাব থাকা- সেটাকে ঠিক ইতিহাস বলে না। এর অনেকটা দুর্বলতা থাকে- এটা থাকবে। পৃথিবীর কোথাও গণতান্ত্রিক শক্তি সশস্ত্র আন্দোলন করে দেশ স্বাধীন করেনি। এখানে ২৩-২৪ বছর গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে, যেখানে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সশস্ত্র যুদ্ধ। যারা এই ২৩ বছর সফলতার সঙ্গে, প্রচণ্ড সফলতার সঙ্গে তারা রাজনীতি করে মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা পর্যন্ত নিয়ে গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষভাবে তাদের অনেকেরই ভূমিকা ছিল না। এমনকি তারা অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে একদম সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। সাধারণ মানুষ কখনো রাষ্ট্র পরিচালনা করে না, করেওনি। যারা যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের হারিয়েছে প্রত্যেকেই যোদ্ধা। সেখানে ছিল সাধারণ মানুষ। যুদ্ধ পরিচালনা করেছে সাধারণ মানুষ। যুদ্ধ শেষে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন নেতারা। এরা কেউই গণমানুষের নেতা হয়ে উঠতে পারেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যথার্থ নেতা হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাজউদ্দিন আহমেদ একজন যথার্থ নেতা। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জিয়াউর রহমান ছিলেন যথার্থ নায়ক। কাদের সিদ্দিকী যথার্থ নেতা ছিলেন। কিন্তু সমস্যা হলো কাদের সিদ্দিকী যুদ্ধের অবস্থা পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। জিয়াউর রহমান নিয়ে যাননি। যুদ্ধের অবস্থা তৈরি না হলে অর্থাৎ ৭ মার্চ না হলে, ২৫ মার্চ না হলে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধেই থাকতেন না। তিনি পাকিস্তান যোদ্ধা হয়ে থাকতেন। তাহলে কাদের সিদ্দিকী ও জিয়াউর রহমানের মধ্যে কোথাও নিশ্চয়ই পার্থক্য আছে। অন্যদিকে কিন্তু সশস্ত্র যোদ্ধা হিসেবে জিয়াউর রহমান ছিলেন দক্ষ। এগুলো জানতে ও মানতে হবে। তবে সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই ৯ মাসের যুদ্ধে এগিয়ে এসেছেন অতি সাধারণ মানুষ। যাদের রাজনৈতিক নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। আমাদের নেতারা ফিরলেন দেশে। আমার মতো যারা ভালো যুদ্ধ করেছেন তারা অনেকে নেতা হয়ে গেলেন। মানুষের বিপদের সময় পাশে ছিলেন, তারা নেতা হয়ে গেলেন। 

খবরের কাগজ: আমরা জানি, ইতিহাস সত্যটাকে ধারণ করে, মিথ্যাকে ছুড়ে ফেলে- ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আপনার অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
কাদের সিদ্দিকী: ইতিহাস সবসময় সত্যকে ধারণ করে, মিথ্যাকে বর্জন করে- এ কথাটা সত্য। ইতিহাসেরও একটা সৌভাগ্য আছে। যার সৌভাগ্য, সে ইতিহাসে স্থান পায়। যার সৌভাগ্য হয় না, তার স্থান নেই। যাকে সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় সহনশীলতায়, নিঃসন্দেহে ইতিহাস সে পথেই এগিয়ে যায়। তার পর একসময় সঠিক ইতিহাস বেরিয়ে আসে। আমার যতটুকু জায়গা ততটুকু আমি পাবই। আমি তো ফাঁকি দিইনি। আমি যদি যুদ্ধে ফাঁকি দিতাম তাহলে পেতাম না। আমার সবচেয়ে বড় অবস্থান আমি কোনো অবস্থাতেই কোনো সরকারের গোলামি করিনি, যা অনেক নেতাই করে নিজেদের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন, এবং আমরা তা দেখেছি। শেখ হাসিনার এ রকম দশা কেন? প্রধান কারণ- মানুষ ভোট দিতে পারেনি, তিন তিনবার, একটা ভোটও দিতে পারেনি। এবং যারা আজকে কোটাবিরোধী আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা, তাদের ভুলত্রুটির জন্যও তারা প্রশ্নবিদ্ধ হবেন সত্য। তাদের কাজ প্রশংসনীয়। তারা যদি ধৈর্য রাখতে পারেন, তারা অমর হয়ে থাকবেন। কেন তারা জয়ী হয়েছেন? এখানে তাদের তেমন কোনো কৃতিত্ব নেই। তাদের কোনো সংগঠনও নেই। কিন্তু তারা জয়ী হয়েছেন। মানুষ শেখ হাসিনার ওপরে ভীষণভাবে অসন্তুষ্ট হয়েছে এবং সেই অসন্তুষ্টি ৫ আগস্টের মধ্যদিয়ে ফুটে উঠেছে। মানুষ ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। এগুলোকে মনে রাখতে হবে। খুব ভালোমতো হিসাব করতে হবে। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী আমার বোন শেখ হাসিনা দিন শেষে অপমানজনকভাবে পালিয়ে গেলেন কেন, সেটা সবাইকে ভাবতে হবে। মানুষ ছোট হোক, বড় হোক, উপার্জন যা খুশি তাই হোক, কেউ কারও গোলাম নয়। মানুষকে সম্মান দিতে হবে। রাষ্ট্রনেতাদের সেই শিক্ষাটুকু থাকতে হবে।

খবরের কাগজ: বঙ্গবন্ধু ও মওলানা ভাসানীকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কাদের সিদ্দিকী: বঙ্গবন্ধুর জায়গায় বঙ্গবন্ধু। হুজুর ভাসানী তার থেকে হাজার গুণ ওপরে। প্রকাশ্য রাজপথে বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীকে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েও পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেন। শেখ মুজিব সবাই হবে না। যত কথাই বলা হোক, তাঁর মধ্যে কৃষ্টি, সভ্যতা, ভদ্রতা অনেক কিছু ছিল। শুধু মওলানা ভাসানীই নন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা- এরা শেখ মুজিবের নেতা। আমার সঙ্গে অনেকের বিরোধ এই খানে। আমি বড় হয়েছি। কিন্তু আমাকে যারা বড় করেছেন, তারা আমার থেকে এগিয়ে। বাবার থেকে সন্তান কোনোদিন বড় হতে পারে না। সন্তানের ঋণ বাড়ে, অনেকে বলে বড় হয়েছি- ঠিক আছে তুমি বড় হয়েছ, কিন্তু তোমার বাবা-মা-ই বড় করেছে। এটা শেখ মুজিবের জানা ছিল।

খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন এই জাতি করতে পেরেছে?
কাদের সিদ্দিকী: না, কখনো করেনি। এ জন্য করেনি যে, এখানে স্বার্থ জড়িত ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন করলে, সম্মান করলে  ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যারা নেতা ছিলেন, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ তারা অনেকেই নেতা ছিলেন না। মুক্তিযোদ্ধা আর দলীয় নেতার মধ্যে সামাজিক মর্যাদার একটা পার্থক্য রয়েছে। আমাদের টাঙ্গাইলের মান্নান ভাইয়ের চাইতে বড় নেতা হয় না। তিনি আসল নেতা। লতিফ সিদ্দিকীর কাছে আমি শিশু ছিলাম। কিন্তু একসময় তিনি একটা মিটিং দিলে ১০ হাজার লোক হলে, আমি একটা মিটিং দিলে ৫ লাখ লোক হয়েছে। আগে লোকে বলত- লতিফ সিদ্দিকীর ভাই। তার পর একসময় আমি কাদের সিদ্দিকী হয়েছি। এরকম বহু উদাহরণ আছে। 

খবরের কাগজ: খেতাব দেওয়ার ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীতে খেতাব (বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক) বেশি দেওয়া হয়েছে- এ কাতারে বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব দেওয়ার ক্ষেত্রে অবহেলার শিকার হয়েছে কি না?
কাদের সিদ্দিকী: আমাদের বাঙালিদের সবচেয়ে বড় দোষ হচ্ছে, আমরা সময়ের কাজ সময়ে করি না। সেভাবে গুরুত্বও দিই না। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে আমরা যেভাবে লোকজনকে ডাকাডাকি করেছি। যুদ্ধশেষে সেভাবে আর গুরুত্ব দিইনি। এখন এভাবে যদি বলা হয়, যেহেতু আর্মি ইউনিটি ছিল অর্থাৎ এরা সংঘবদ্ধ ছিল এবং যুদ্ধবিগ্রহের কাজে সেহেতু তাদের সরকার বাহাদুররা দায়িত্ব দিয়েছে, এ বিষয়ে তাদের অতটা অভিজ্ঞতাও ছিল না। সে জন্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সেভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ আর্মির লোকেরা কাজ করেছে ৫-৬ হাজার এবং যুদ্ধের সময় আরও ১০-১৫ হাজার ট্রেনিং দিয়ে ওই সময়ে তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৭৫ জন খেতাব পেয়েছে। আমাদের বীরউত্তম হচ্ছে ৬৮ জন। এর মধ্যে কয়েকজন বাঙালি, আর সবই মিলিটারি। ১৭৫ জন বীরবিক্রম। তার মধ্যে ১২-১৩ জন সাধারণ, আর সবই মিলিটারি। তার মধ্যে আমার দলেরই তিনজন। এই তিনজনের মধ্যে একজন মিলিটারি ছিল। এই খেতাবটা বিবেচনা করে দেওয়া হয়নি। বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব যাদের দেওয়া হয়েছে তাদের আরও বড় খেতাব দিক, কিন্তু এর চাইতেও অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করা লোক আছে এবং ছিল। তাদের তালিকার মধ্যেই রাখা হয়নি। এখন যে তালিকা করা হচ্ছে- অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এলে বিএনপি, তার পর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তো আছেই। আমি তো বলব, সে-ই একজন মুক্তিযোদ্ধা যে দেশকে ভালোবেসেছে। প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের মানুষকে সহযোগিতা করেছে। তাদের রাজাকারের তালিকায় নাম আছে কি?যাদের নাম নেই, এমন ১০০ জনও যদি মুক্তিযোদ্ধা হয়, আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ যারা দেশের প্রত্যক্ষ দালালি করেনি, আলবদর হয়নি, আমার মনে হয় এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। যারা পরোক্ষভাবে যুদ্ধে বিজয়লাভে সহযোগিতা করেছে, আমার মতে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার প্রাপ্তি- প্রথমত আমার দেশকে আমার মায়ের মতো মনে হয়। আমার মা-ই আমাকে বাঁচিয়েছেন। আমি আমার মায়ের কাছ থেকে আদব পেয়েছি। আমার বিদ্যা ছিল না, বুদ্ধি ছিল না, শুধু বয়সে বড় হয়েছি। মা যখন অধৈর্য হয়ে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বলত বজ্র, আমার কষ্ট হয় নারে! তুই এমন করিস কেন? তোকে যখন বকা দিই, মারি, তখন আমার খারাপ লাগে। দেশকে আমার মায়ের মতোই মনে হয়। ওটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া।

খবরের কাগজ: একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বর্তমান বাংলাদেশকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কাদের সিদ্দিকী: আমরা বাংলাদেশ চেয়েছিলাম- সাধারণ মানুষের বাংলাদেশ। গরিব-দুঃখী মানুষের সম্মানের বাংলাদেশ। আমি এখনো তাই চাই। আমি তেলা মাথায় তেল দিতে চাই না। ২২ পরিবার থেকে ২২ লাখ অথবা ২২ হাজার পরিবারের হাজার হাজার কোটি টাকা থাকবে, আর আমার একজন রিকশাওয়ালার ৫০ টাকা থাকবে না- এমন দেশ আমি চাই না। যদি একজন ঋণখেলাপির ১ কোটি টাকা থাকে, তাহলে আমি নিশ্চয়ই ভাবব, একটি রিকশাওয়ালারও ১ লাখ টাকা থাকবে। আমি চাই আমার খাওয়া-পরা, আমার ছেলেমেয়ের নিরাপত্তা, আমার স্বাভাবিক চাহিদা যাতে মেটে, সেটা দেখতে হবে। আমার যদি ১ হাজার টাকায় দিন যায়, সেই জায়গায় যদি আমি ২ হাজার টাকা পাই, তাহলে আমার খুশি হওয়ার কথা। ৩ হাজার টাকা পেলে আরও খুশি হওয়ার কথা। ৪ হাজার টাকা হলে আরও খুশি হওয়ার কথা। ৫ হাজার টাকা হলে আরও আনন্দ হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা অকারণে ৫ লাখ হলে সে ক্ষেত্রে সেই আনন্দ নিরানন্দে রূপ নেবে। কারণ আমি সেটা সামলাতে পারব না। একজন মানুষ যে দিনে ৫০০ টাকা উপার্জন করে, সেই মানুষ যদি দিনে ৫০ হাজার টাকা উপার্জন করতে শুরু করে, তাহলে তার বউকে আর পছন্দ হবে না। তার মাকে অশিক্ষিত মনে হবে। তার ছেলেগুলোকে ড্যাবড্যাবা মনে হবে। কিন্তু ১ হাজার টাকায় যার সংসার চলে, সে যদি ৫ হাজার টাকা রোজগার করে, তাহলে তার সংসারে সাচ্ছন্দ্য আসবে। সে ছেলেমেয়েকে ভালো জায়গায় পড়াতে পারবে, ঘরটাকে একটু ভালো করা ইত্যাদি সবকিছুই করতে পারবে। তার যদি কারণ ছাড়াই চুরি করে কোটি কোটি টাকা হয়, ওই সময় সে যখন ওই টাকার সঠিক ব্যবহার করতে শিখবে না, তখনই ঝামেলাটা হবে। সেজন্য বলছি, আমাদের দেশে চুরির টাকা, আর উপার্জনের টাকায় পার্থক্য আছে। আপনি যখন পরিশ্রম করে উপার্জন করবেন, তখন সেটা আপনার কাছে ইবাদতের মতো মনে হবে। 

খবরের কাগজ: আপনি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?
কাদের সিদ্দিকী: আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার প্রত্যাশা একটাই এবং তা খুবই ছোট চাওয়া। এই স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষের মর্যাদা, জীবনের নিরাপত্তা, সম্পদের নিরাপত্তা, সম্মানের নিরাপত্তা থাকবে। যে যত বড়ই হোক আইনের ঊর্ধ্বে কারোরই স্থান নয়। মানুষ যেন ছায়ার মতোই আইনের কাছে সঠিক আশ্রয়টুকু পায়। বিগত অনেকগুলো বছর; শেখ হাসিনার ১৬ বছর, খালেদা জিয়ার ১০ থেকে ১২ বছর, এরশাদের স্বৈরশাসন অর্থাৎ এই দিনগুলোতে কোথাও সত্যিকারের শান্তি ও সুশাসন ছিল না। এদের কারও সময়ই আইন আইনের মতো চলেনি। আইন ক্ষমতাবানদের কথা অনুসারে, নির্দেশমতো চলছে।  আমার কথা, আইন চলবে আইনের মতো। আমার প্রত্যাশা থাকবে,এই অস্থির সমস্যা সংকুল পরিবেশ কাটিয়ে গণমানুষের জীবনমানের উত্তরণ ঘটবে। দেশে শান্তি ফিরে আসবে। মানুষ সম্মানের সঙ্গে দুমুঠো খেয়ে-পরে বাঁচবে। এই দেশে কেউ আর ক্ষমতাবানের রূপে দানব হয়ে উঠবে না। বরং ক্ষমতার মোহ কাটিয়ে দেশের সেবক হয়ে দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতাটুকু যথাযথভাবে পূরণ করে যাবে। আমার চাওয়া এটুকুই।  

খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কাদের সিদ্দিকী: আপনাকেও ধন্যবাদ।

স্বাধীনতার অবিনাশী ইতিহাস ও আমরা

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ পিএম
স্বাধীনতার অবিনাশী ইতিহাস ও আমরা
অলংকরণ : নাজমুল মাসুম
ইতিহাস যথার্থ অর্থে জাতির অহংকার, অর্জন ও ঐতিহ্য। এর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলে যুক্তিবাদী মানুষের সঙ্গে বোধহীন প্রাণীর পার্থক্য থাকে না। ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা হয় না। কিন্তু কোনো জাতি ইতিহাস-সচেতন না হলে ক্রমান্বয়ে সে বীর্যশূন্য, ঐতিহ্যশূন্য, সভ্যতাবিবর্জিত জনসমষ্টিতে পরিণত হয়।
 
ইতিহাসে সব জাতিগোষ্ঠীরই কিছু দিকনির্দেশনা থাকে, থাকে এমন অনেক সত্যের খুঁটি গাড়া, যা থেকে ছিটকে পড়া মানেই আপন অহংকারের বৃন্ত থেকে খসে পড়া। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রায় ২০০ বছর ধরে ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছে। এই দীর্ঘ ঔপনিবেশিক সময়ে আমরা দুই ধরনের মানুষ দেখেছি। এক. এ দেশেরই একশ্রেণির সেবাদাস- যারা নিজের সুবিধার্থে দাসত্বকে বরণ করে নিয়েছে। দুই. অন্যদিকে আরেকটি দল- যারা নিজেদের বর্তমানকে তুচ্ছ করে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করে জাতীয় মর্যাদা ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে, এমনকি মৃত্যুবরণ করেছে।
 
যদিও দুই পক্ষই ইতিহাসের অংশ, তবু ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশ হচ্ছে লড়াকু পক্ষকেই ঐতিহ্য বলে বরণ করে নেওয়া। আরও যে শিক্ষা ইতিহাস দেয়, তা হচ্ছে, সেই দাস মনোবৃত্তির মানুষের বিরুদ্ধে সতর্ক থেকে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে নির্মাণ করা। কারণ ইতিহাস বন্য শাসনব্যবস্থাকে ঘৃণ্য করতে শেখায়।
 
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে চীনের মাটিতে জাপ বাহিনীর নৃশংসতা চেপে রেখে নানাবিধ বৃত্তান্ত ছাপা হয়েছিল জাপানি স্কুলের পাঠ্যসূচিতে। এটি ছিল নতুন প্রজন্মের কাছে জাপানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা ঢাকার অপচেষ্টা। কিন্তু সচেতন চৈনিক জাতি ইতিহাসের মিথ্যাচার মেনে নেয়নি। তারা তীব্র প্রতিবাদ করেছে। তীব্র প্রতিবাদ এসেছে কোরিয়ান জনগোষ্ঠীর কাছ থেকেও। সেই প্রতিবাদের ভাষা এতই প্রবল ছিল যে, সামান্য কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে বিতর্কিত জাপানি পুস্তক বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে।
 
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান নাৎসি বাহিনীর বুট, বোমা ও বুলেটে ফ্রান্সের প্যারিস নগরী প্রকম্বিত হয়েছিল। হিটলার বাহিনীর নির্মমতায় রক্তস্নাত হয়েছিল ইউরোপের বহু জনপদ। লাখ লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল পোল্যান্ডসহ নানা ইউরোপীয় জনপদে। নাৎসি বাহিনীর প্রবল বোমায় লন্ডন নগরী কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সেই জার্মানির সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক আবারও গড়ে উঠেছে। কারণ সমকালীন বাস্তবতা ও জীবনযাপনের স্বার্থেই সম্পর্কের পুনঃস্থাপন করতে হয়।
 
কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, জার্মানির এককালীন যুদ্ধবাজ ভূমিকাকে সবাই ভুলে গেছে। হিটলার আজও ইউরোপ তথা বিশ্বের তাবৎ জনগোষ্ঠীর কাছে নিষ্ঠুরতম যুদ্ধবাজ। নাৎসি বাহিনী আজ, হয়তো অনাদিকাল ধরে পরিচিত হবে বর্বর-ফ্যাসিবাদী সেনাবাহিনীর পরিচয়ে।
 
ইতিহাস গড়ে ওঠে যুগ ও শতাব্দীর বৃহৎ ঘটনাপঞ্জি আশ্রয় করে। ইতিহাসকে নতুন করে লেখা যায় না। বাঙালি এ ভূখণ্ডে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, সে তার ইতিহাস। ধর্ম ও সামরিক ধর্মতন্ত্রের নামে গড়ে ওঠা পাকিস্তানি শাসকের নিপীড়ন শোষণের বিরুদ্ধে গণমানুষের দীর্ঘ সংগ্রাম পূর্ব বঙ্গের জনইতিহাস। পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে বাঙালি গণমানুষের রক্তাক্ত লড়াই, যা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, তা আরেক ইতিহাস।
 
ইতিহাসের শিক্ষা আরও আছে। শুধু ধর্মের বাঁধন থাকলেই এক জাতি হয় না, এর সঙ্গে অনস্বীকার্য যুক্ত ভাষা, সংস্কৃতি ও সম্পদ বণ্টনের গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা। যে পাকিস্তান বাংলাদেশকে ২৪ বছর শাসন ও শোষণ করেছে, নির্যাতন করেছে- সে পাকিস্তানের সঙ্গে যুগের চাহিদাতেই পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে গোড়ামির স্থান নেই। কিন্তু এ সম্পর্ক কখনোই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে আমাদের বিচ্যুত করতে পারে না। এ সম্পর্ক শোষণের কথা ভুলে নয়, লাখ মানুষের রক্ত ভুলে নয়, ওদের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা ভুলে নয়, পাকিস্তানি শাসকদের হাতে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হত্যাকে ভুলে নয়।
 
তেমনি গণচীনের সঙ্গে আমাদের আধুনিক জীবন গড়ে উঠবে সুসম্পর্কের। কূটনৈতিক বা অর্থনীতির প্রশ্নে হোক, সে সম্পর্ক নিবিড় হবে- সেটিই কাম্য। কিন্তু এ সম্পর্কের নামে জাতি যেন সে ইতিহাস ভুলে না যায় যে, চীন, যুক্তরাষ্ট্রের মতোই, বাংলাদেশের জন্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তির বিরোধিতা করতে ‘ভেটো’ পর্যন্ত প্রয়োগ করেছিল! 
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করার পেছনে গণচীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের যে যুক্তি ছিল তা কোনো মানবিক বা সভ্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়নি। সৎ ও সত্যের স্বার্থে অবশ্যই মানতে হবে, বৃহৎ শক্তির দুর্ভাগ্যজনক সেই নীতি-অবস্থান আমাদের জাতির ন্যায্য অধিকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। ধর্ম ও পাকিস্তানের অখণ্ডতার নামে বাংলাদেশের মাটিতে তাদের সেনা ও দেশীয় অনুচরদের নিষ্ঠুরতা সমর্থন করে তারা যে অমানবিকতা দেখিয়েছে, যে অধর্ম করেছে, তাকে আমাদের ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া যাবে না কখনো। এর পরও বলব- এদের সবার সঙ্গেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা যুগের চাহিদাকেই পূরণ করবে।
 
ভারত শুধু বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ নয়, বাংলাদেশের সীমান্তঘেরা পড়শিও। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে ভারতের গণমানুষ ও সরকারের অবদান আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ অংশ। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিনির্মাণ হবে পারস্পরিক স্বার্থ ও সম্মানবোধের ভিত্তিতে। একাত্তরের রক্তমাখা বন্ধুত্ব, যা জাতির স্বাধীনতা লাভে সহায়ক, তাকে অস্বীকার করে ইতিহাস বিস্মৃত জাতি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যুক্তি নেই । এটিও মনে রাখা জরুরি যে, পাকিস্তানি গণহত্যা থেকে বাঁচতে ভারতের মাটিতে সেদিনকার পূর্ববঙ্গ বা পূর্বপাকিস্তান থেকে ১ কোটি মানুষ আশ্রয় নিয়ে জীবন বাঁচিয়েছিল, হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, যা ইতিহাসের আরেক অধ্যায়। 
 
আমাদের ইতিহাসের বেশকিছু চিরঞ্জীব ইতিহাস স্মারক আছে। আছে ১৬ ডিসেম্বরের মহান বিজয় দিবস, ২৬ মার্চের মহান স্বাধীনতা দিবস, ২৫ মার্চের গণহত্যা দিবস এবং রমনার উদ্যানে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের মতো আরও অনেক বড় ঘটনা, যা চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর। এগুলোকে আঘাত করার মানে ইতিহাসকে অমান্য করা।
 
কারণ স্বাধীনতার ইতিহাস ভুলে যাওয়া কোনো ঠুনকো বিষয় নয়। এর সৃষ্টি অগণিত গণমানুষের রক্ত-সংগ্রামে, যার পরিণতি আসে ১৯৭১ সালে। অতএব, কোনো সরকারের পতনে বা কারও উত্থানে কখনো এর নড়চড় হতে পারে না। যদি তা করা হয় তা হবে আত্মঘাতী। দেশ ও সমাজ পরিবর্তনশীল, অনস্বীকার্যভাবেই। সরকার যাবে সরকার আসবে। যুগে যুগে গণতন্ত্র উদ্ধার বা সুশাসন লাভে বা পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম হবে। এসব ঘটনা কখনো জাতীয় জীবনকে নাড়িয়ে দেবে, কখনো পাল্টে দেবে, কখনো নতুন পথের সন্ধান দেবে। কিন্তু তা কোনোভাবেই জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাসকে পাল্টে দিতে পারে না। যারা পালটাতে চান তারা জাতির চলার পথকেই কেবল কণ্টকাকীর্ণ করেন না, বরং বিপন্ন করেন। জানা প্রয়োজন ইতিহাস এক মহাশক্তিধর মহীরুহ, তাকে অবজ্ঞা করা যায় না। কারণ এর অন্তর্নিহিত মহাশক্তিই ইতিহাসের ঘাতকদের প্রতিহত করে, পর্যুদস্ত করে। 
 
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে যারা বিকৃত করতে চান তারা দেশপ্রেমিক নন। নানা মত ও পথে বিভক্ত হয়েও দেশপ্রেমিক হওয়ার প্রধান শর্ত- জাতীয় ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান নেতা, যিনি তার বন্দিদশায় সাময়িক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের প্রাণশক্তি, সর্বাধিনায়ক। অতএব, সেই শেখ মুজিবকে অস্বীকার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব নয় কখনো। যদি কেউ তা করতে চান তারা জাতির চলার পথকেই কেবল কণ্টকাকীর্ণ করেন না, একই সঙ্গে বিপন্ন করেন।
 
তবে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকারের সাফল্য ও সমালোচনা মেনে নিতে হবে। প্রবল ষড়যন্ত্র চলেছে সদ্য যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। একদিকে পরাশক্তি আমেরিকার প্রতিশোধস্পৃহা, অন্যদিকে দেশের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী এবং পরাজিত বাহিনীর দোসরদের অপতৎপরতা, যার সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধী ও প্রগতিবিরোধী চক্র আবারও জায়গা করে নিয়েছে। একপর্যায়ে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে প্রায় সপরিবারে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের স্বাভাবিক অগ্রযাত্রা বিপন্ন হয়েছে। 
 
স্বাধীনতার বয়স এরই মধ্যে পাঁচ দশকেরও বেশি হয়েছে। একাত্তরের পরে জন্ম লাভ করা শিশুও আজ পরিপূর্ণ মানুষ। নানা বিপণ্নতার পরও বাংলাদেশ বেশ খানিকটা এগিয়েছে। অগ্রগতি ঘটেছে যোগাযোগ, উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে। জ্ঞানবিজ্ঞান, সামাজিক সূচক ও খেলাধুলায় বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। এর পরও শঙ্কার কারণ আছে। এর প্রধান কারণ জাতির মনোজগতে নতুন করে কলঙ্ক বিছিয়ে চলেছে ধর্মান্ধতা ও উগ্র সাম্প্রদয়িকতা! একই সঙ্গে থাবা বিস্তার করেছে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। এ এক দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা যাকে অস্বীকার করা হলে বা আত্মতুষ্ট হলে, সব অর্জন ব্যর্থ হবে। 
 
নতুন নাগরিকদের অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে, যে মূল্যবোধ ও আদর্শের ওপর ভিত্তি করে একাত্তরের সফল মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তার যেন পতন না ঘটে। দেখতে হবে, কী সেই চেতনা কিংবা আদর্শ যাকে প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে এ মাটির লাখ লাখ যুবক রাইফেল ধরেছিল, মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিল, জীবন উৎসর্গিত করেছিল। কারণ, যে দেশের জন্ম রক্তাক্ত সংগ্রামে, সেই সংগ্রামের আদর্শকে নির্বাসিত করে আর যা-ই হোক- বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একাত্তরের বিজয় বাঙালি জাতির হাজার বছরের প্রত্যাশার শ্রেষ্ঠতম অর্জন। 
 
এ ভূখণ্ডের মানুষ বিদেশি ও স্বদেশি শোষণের মাঝে বসবাস করে এসেছে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। সামন্তপ্রভুদের নির্যাতনও আমাদের ইতিহাসের অংশ। মনে রাখতে হবে, শত বছরের চেষ্টা ও রক্তপাতের পরও বাঙালি কখনোই স্বাধীনতার মুখ দেখেনি ১৯৭১-এর আগে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অর্থ এই ভূখণ্ডের মুক্তিকামী মানুষের জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম স্বদেশভূমি বিনির্মাণের সাধনা এবং সেই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখা। 
 
আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও তার চেতনার কথা বলি, তখন ভাবতে হবে, মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকে ভাঙতে হয়েছিল কেন? কেন বাঙালিকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও তার সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছিল? নতুন প্রজন্মকে অবশ্যই জানতে হবে, কী ছিল সেই বঞ্চনা ও নিষ্পেষণের ইতিহাস, যা জাতিকে বিদ্রোহী হতে বাধ্য করেছিল। 
 
বুঝতে হবে, কোন প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের মাটিতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা পেয়েছিল বাঙালি, ধর্মের দোহাই দিয়েও যা টিকিয়ে রাখা যায়নি। কারণ একই দেশে বসবাস করে কেবল ধর্মের নামে সংখ্যালঘু একটি সম্প্রদায় বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে শোষণ করবে, অপমানিত করবে এবং মর্যাদাহীন করে তুলবে, তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটিও জানতে হবে কেন এ দেশেরই একশ্রেণির ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মানুষ জাতীয় স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করে বর্বর দখলদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণহারে হত্যা ও নারী নির্যাতনে যোগ দিয়েছিল! 
 
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা জাতির মূল সংবিধানে গ্রন্থিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে, স্বাধীনতার মাত্র ১০ মাসের মাথায়। এ ছিল এক বিস্ময়কর জাতীয় সাফল্য। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। মূলত এ বিষয়গুলোকেই সংক্ষিপ্ত অর্থে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা বলতে পারি, যদিও পরবর্তী রাজনৈতিক উত্থান-পতনে অনেকেই এর ভিন্ন বিশ্লেষণে গিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের চেষ্টা করেছেন। 
 
দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার রক্তার্জিত মূল্যবোধগুলোকে পরবর্তী সময়ে নির্বাসিত করা হয়েছিল। যে কারণগুলোর জন্য এ দেশের লাখো তরুণ অস্ত্র হাতে তুলে শহিদ হয়েছেন, লাখো মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন, লাখো নারী নির্যাতিত হয়েছেন- সে কারণগুলো সর্বত্রই উপেক্ষিত থেকেছে বহুকাল। গণতন্ত্রের চেহারা যে কী করুণ হয়েছিল তা আমরা দেখেছি। সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রের বিন্দু-বিসর্গ পর্যন্ত ছিল না, জাতীয়তাবাদ পর্যন্ত বিতর্কিত করা হয়েছিল। শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রত্যাশা পরিণত হয়েছিল দিবাস্বপ্নে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে হবে। অতএব, প্রয়োজন নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের বর্মে, দেশপ্রেমের বর্মে দীক্ষিত করা। 
 
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও চিন্তাবিদ