ঢাকা ২৪ আষাঢ় ১৪৩২, মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২

কবি আল মাহমুদের বর্ণাঢ্য সাহিত্য জীবন

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৪, ০৮:১২ পিএম
আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৪, ০৮:১৯ পিএম
কবি আল মাহমুদের বর্ণাঢ্য সাহিত্য জীবন
অলংকরণ : নাজমুল মাসুম

‘বধূ বরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহা মাতৃকূল 
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল’  (সোনালি কাবিন)

১১ জুলাই বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি আল মাহমুদের ৮৮তম জন্মদিন। তার পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তবে আল মাহমুদ নামেই তিনি অধিক পরিচিত। আল মাহমুদ একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্ভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সরকারবিরোধী সংবাদপত্র ‘দৈনিক গণকণ্ঠ (১৯৭২-১৯৭৪) পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

১৯৫০-এর দশকে যে কয়েকজন লেখক বাংলা ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন তাদের মধ্যে মাহমুদ একজন। লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কবি আল মাহমুদ তার অনবদ্য গল্প ও উপন্যাসের জন্যও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মীর আবদুর রব ও মাতা রওশন আরা মীর। তার দাদার নাম আব্দুল ওহাব মোল্লা। যিনি হবিগঞ্জ জেলায় জমিদার ছিলেন। কুমিল্লার দাউদকান্দি সাধনা হাইস্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন। মূলত এই সময় থেকেই তার লেখালেখির শুরু। আল মাহমুদ বেড়ে উঠেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি মধ্যযুগীয় প্রণয়োপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করে ঢাকায় আসার পর কাব্য সাধনা শুরু করেন এবং ষাটের দশকেই স্বীকৃতি ও পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেন।

সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে ১৯৫৪ সালে আল মাহমুদ ঢাকা আগমন করেন। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকার মধ্যে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৫৫ সাল কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী ‘কাফেলা’ পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। দৈনিক ইত্তেফাকে মফস্বল বার্তা সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেন আল মাহমুদ।

১৯৭১ সালে তিনি ভারত গমন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। যুদ্ধের পর দৈনিক গণকণ্ঠ নামক পত্রিকায় প্রতিষ্ঠা-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। সম্পাদক থাকাকালীন সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে এক বছরের জন্য কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়।

২০০৯ সালে বরিশাল সফরকালে তরুণ লেখকদের সঙ্গে কবি আল মাহমুদের এ ছবিটি তুলেছেন সাংবাদিক আযাদ আলাউদ্দীন 

 

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোট গল্প ‘পানকৌড়ির রক্ত’ প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর তিনি পরিচালক হন। পরিচালক হিসেবে ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৫৪ সাল অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স থেকে তার কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম পরিচিত হয়ে ওঠে এবং তাকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩) সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর কালের কলস (১৯৬৬), সোনালি কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬) কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৩ সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’।

তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নরনারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন করেন। নারী ও প্রেমের বিষয়টি তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা ও ভোগের লালসাকে তিনি শিল্পের অংশ হিসেবেই দেখিয়েছেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় লোকজ শব্দের প্রয়োগ তার অনন্য কীর্তি।

১৯৬৮ সালে ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম ‘সোনালি কাবিন’। ১৯৭০-এর দশকের শেষার্ধে তার কবিতায় বিশ্বস্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস উৎকীর্ণ হতে থাকে; এর জন্য তিনি প্রগতিশীলদের সমালোচনার মুখোমুখি হন। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’। 

উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬), আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া, অদৃশ্যবাদীদের রান্নাবান্না, Selected Poems- Al Mahmud (১৯৮১), দিনযাপন, দ্বিতীয় ভাঙ্গন, একটি পাখি লেজ ঝোলা, পাখির কাছে ফুলের কাছে, আল মাহমুদের গল্প, গল্পসমগ্র, প্রেমের গল্প, যেভাবে বেড়ে উঠি (আত্মজীবনী), কিশোর সমগ্র, কবির আত্মবিশ্বাস, কবিতাসমগ্র, কবিতাসমগ্র-২, পানকৌড়ির রক্ত (গল্পগ্রন্থ), সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধ বণিক, ময়ূরীর মুখ, না কোন শূন্যতা মানি না, নদীর ভেতরের নদী, প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা, প্রেম প্রকৃতির দ্রোহ আর প্রার্থনা কবিতা, প্রেমের কবিতা সমগ্র, উপমহাদেশ, বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ, কবিতার জন্য সাত সমুদ্র, উপন্যাস সমগ্র-১, উপন্যাস সমগ্র-২, উপন্যাস সমগ্র-৩, তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে (২০১৫) ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড় (রূপকথা), ত্রিশেরা, উড়াল কাব্য। কবি আল মাহমুদের একমাত্র মহাকাব্য ‘এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না’। বইটি প্রকাশ করেছে সরলরেখা প্রকাশনা সংস্থা। 

আল মাহমুদ ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দা নাদিরা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে। এর মধ্যে এক ছেলে কয়েক মাস আগে মারা গেছেন। 

২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে ঢাকার ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কবি আল মাহমুদ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। 

পুরস্কার ও সম্মাননাস্বরূপ পেয়েছেন- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮), জয় বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ূন কবীর স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), কাজী মোতাহার হোসেন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৬), কবি জসীম উদ্দীন পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৬), নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০), ভানুসিংহ সম্মাননা পদক (২০০৪), লালন পুরস্কার (২০১১), বাসাসপ কাব্যরত্ন (২০১৭) প্রভৃতি।

আহমদ ছফা: তার দর্শন ও জীবনবোধ

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৫, ০৭:২৬ পিএম
আহমদ ছফা: তার দর্শন ও জীবনবোধ
আঁকা: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

আহমদ ছফা বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, কবি, ঔপন্যাসিক ও সমাজচিন্তক। সমাজ সংসারে এমন কিছু মানুষ থাকেন, যারা স্বেচ্ছায় জনকল্যাণের প্রয়োজনে সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন, আহমদ ছফা ছিলেন তাদের অন্যতম। প্রচলিত জীবনব্যবস্থার প্রতি অনীহ তার সাহিত্যে মানবমুক্তির কথামালা প্রতিধ্বনিত। চলমান রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি শোষণ, বঞ্চনা ও মানুষের মর্মবেদনা উপন্যাস, ছোটগল্প ও বিশ্লেষণমূলক রচনায় প্রতিপাদ্য করেছেন। বাংলাদেশে আহমদ ছফা বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাঙালির রাষ্ট্রভাবনা ও মানুষের মুক্তির লড়াই-এ জনসম্পৃক্তির বিষয়টি তার সাহিত্যে প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসে (১৩৭১), বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১), শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ (১৯৮৯), নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ (১৯৯৫), সংকটের নানান চেহারা (১৯৯৫), যদ্যপী আমার গুরু (১৯৯৮), বাংলাভাষা: রাজনীতির আলোকে, উপন্যাস: ওঙ্কার (১৯৭৫), একজন আলী কেনানের উত্থানপতন (১৯৮৮), মরণ বিলাস (১৯৮৯), অলাতচক্র, (১৯৯৩), সূর্য তুমি সাথী (১৯৮৭), অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬), পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ (১৯৯৬), গল্পগুচ্ছ: নিহত নক্ষত্র (১৯৬৯), দোলা আমার কনকচাঁপা (১৯৬৮), অনুবাদ, তানিয়া (মূল: পিলিটিভ) (১৯৬৭), ফাউস্ট (১৯৮৬)। এ ছাড়া উপন্যাস সমগ্র, নির্বাচিত প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকারভিত্তিকগ্রন্থ, আহমদ ছফার কবিতা (২০০০)।

আহমদ ছফার সাহিত্যে সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ প্রকট। সমাজ, রাষ্ট্র, মানুষকে স্পর্শ করে আছে রাজনীতি। তিনি রাজনীতিসচেতন সাহিত্যিক, ১৯৬৭-তে প্রকাশিত ‘সূর্য তুমি সাথী’ উপন্যাসে গ্রাম ও গ্রামের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন, মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম ও সমাজপরিবর্তনকে আমরা প্রত্যক্ষ করি। সাতবাড়িয়া গ্রামের হাসিম গোকুলের ছেলে কাজী বাড়ির মেয়ে জরিনার প্রেমে পড়ে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়। গ্রামের মানুষ এ বিষয় নিয়ে নানা সমালোচনায় মত্ত। ক্ষুধা, দরিদ্রতা, বাঁচার লড়াইয়ের সঙ্গে গ্রামীণ জনপদে ধর্মবিশ্বাস যুক্ত হয়। পশ্চাৎপদ মানুষের দিন যাপন ছফা মমতার সঙ্গে বিবৃত করেছেন। অভিমান করে হাকিম গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর একটি নিখুঁত বর্ণনা আহমদ ছফা এ উপন্যাসে দিয়েছেন। গ্রাম ঘিরে যাদের স্বপ্ন, সংগ্রাম ও দিনযাপন তারা কীভাবে খোলস থেকে বেরিয়ে পড়ে, মূল থেকে বিচ্যুত হয়। এসব বিবরণ, ব্যাখ্যা ও পর্যবেক্ষণ তার সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আগ্রাসন; পরবর্তী সময়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার পূর্বাপর ঘটনাবলি গাভী বিত্তান্ত, অলতচক্র, একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন পর্বে বিস্তৃত পরিসরে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। আহমদ ছফা সুস্থ রাজনৈতিক চিন্তাধারার সঙ্গে বাঙালির দিনযাপনকে যুক্ত করেছেন তার উপন্যাস গল্পের কাহিনির সঙ্গে। ‘ওঙ্কার’ উপন্যাসে জীবনবীক্ষণ, যা আঞ্চলিক ভৌগোলিক অবস্থান থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বৃহৎ পরিসরে সম্পর্ক তৈরি করে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস ‘ওঙ্কার’-এ নারীমুক্তির বার্তা স্পষ্ট। ‘অলাত চক্র’ উপন্যাসে অন্য এক নারী তায়েবা ক্যানসার আক্রান্ত। তার মৃত্যু প্রতীকী ব্যবহার করা হয়েছে।

ষাট দশকে, উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনা গণ-অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ আহমদ ছফা তার উপন্যাসে ধারণ করেছেন। ভোলার তামাপুকুর গ্রামে আলী কেনানের আবির্ভাব। গভর্নরের পিয়ন আলী কেনানের দোর্দণ্ড প্রতাপ। চাকরিচ্যুত হয়ে পীর সেজে ঢাকার মাজারে তার তেলেসমাতি একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন পর্বে বিবৃত। ঊনসত্তর, সত্তর ও পরবর্তী সময়ে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক ঘটনার ঘূর্ণি আহমদ ছফা তার উপন্যাসে ধারণ করেছেন।

‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসে ক্ষমতাধর মানুষদের ক্ষমতা প্রয়োগের ছলচাতুরী সুবিধা ভোগের কলাকৌশল উঠে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চপদে আসীন ব্যক্তি, উচ্চশিক্ষিত ও ডিগ্রিধারী মানুষদের চালচলন, ক্ষমতালিপ্সা ও তাদের চারপাশের কাচের দেয়ালে যাদের বসবাস, আহমদ ছফা গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। ঠিকাদার ঘোরে। মাস্তান ঘোরে। অর্থের লালসায় মত্ত একদল মানুষ কীভাবে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বন্দি করে ছফা আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়েছেন। সমাজ ও পরিপার্শ্বের মানুষ তার কাছে ধরা দেয়। সমাজ একদিনে পচনের দিকে যায় না। মানুষের লোভ, রিরংসা কাম ও অর্থলিপ্সুতার কাছে পরাজিত হয় মূল্যবোধ ও মানবতা। আবার মানুষই উদ্ধার করে কল্যাণ ও সুন্দরকে। আহমদ ছফা রচিত প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এ বুদ্ধিজীবীদের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে যথার্থভাবে। আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি সামাজিক জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণি সুবিধা ভোগ করে বেশি, নিজের স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে সত্য ও মিথ্যা মিশিয়ে যা বলেন, তাতে তাদের মতলববাজি মনোভাবের প্রকাশ ঘটে। ছদ্মনাম ব্যবহার করে তার বিবৃতি দেন, নিবন্ধ রচনা করেন ও ভাষ্য পরিবেশন করেন। নিজেকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রেখে তারা বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করেন। আবার কখনো কখনো সাধন মানুষদের কাছে নিজেদের অবস্থান অনেক উঁচুতে চিহ্নিত করেন। 

আহমদ ছফা প্রচলিত রাজনৈতিক মতবাদে আস্থাশীল ছিলেন না। তার অপছন্দ প্রতিজীবীদের। আহমদ ছফা বুদ্ধিজীবীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মানসিক চিন্তাধারা সম্পর্কে মতামত তুলে ধরেছেন। মধ্যবিত্তের শ্রেণি চরিত্রে তাদের স্ববিরোধিতার উদাহরণ আমাদের চারপাশে বিস্তর। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিবর্তনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার প্রতিভাস লক্ষণীয়। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের একীভূত হওয়া স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুদ্ধিজীবীরা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। আহমদ ছফা তার প্রবন্ধ গ্রন্থে উল্লেখ করেন:

‘কবি-সাহিত্যিক লেখকেরা গর্ভিণী নারীর মতো। তারা জাতির গড়ে ওঠার, বেড়ে ওঠার, বেঁচে থাকার ভ্রূণ কণা অন্তর্লোকে ধারণ করে থাকেন। জাতীয় জীবনে যা ঘটে গেছে অতীতে, যা বর্তমানে ঘটেছে সব সৃজনশীল অন্তর্লোকে তরঙ্গিত হয়, তারই আলোকে অনেক সময় তারা ভাবের আবেশে সামনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে- এই হতে যাচ্ছে। এবং এই-ই হবে। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন কবি, তেমন সাহিত্যিক, তেমন উপন্যাস লিখিয়ে কিংবা গাল্পিক কি আছেন? নেই আমাদের যে ক’জন নামকরা কবি কিংবা সাহিত্যিক আছেন, তাদের বেশির ভাগের প্রতি মানুষ খুব শ্রদ্ধার মনোভাব পোষণ করে না। বাংলাদেশে আজকের দিনে লেখকেরা-কবিরা সামাজিক দিক দিয়ে বোধ হয় সম্মানহীনজীব। তারা পত্রিকার রবিবাসরীয় সংখ্যার জোগানদার, রেডিও-টেলিভিশনের অঙ্গসজ্জা ও বিকৃত রুচিহীন নীরস পাঠ্যপুস্তক প্রণেতার অধিক কিছু নন।’ (বুদ্ধিবৃত্তিক নতুন বিন্যাস, পৃঃ ২১-২২,
প্রকাশকাল : ১৩৭৯)।

আহমদ ছফা ব্যক্তিগত দুর্বলতা প্রাধান্য দেননি। সাধারণ জনতার কাতারে গিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে জাতীয় নেতৃবৃন্দের অবস্থান ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। ইতিহাসের নির্মমতা, প্রাণবন্ত, সরস ও বিশ্লেষণমূলক আলোচনা তিনি নির্মোহভাবে করেছেন। এটা ঠিক বাঙালি যে স্বপ্ন দেখেছিল স্বাধীন দেশে তা পূরণ হয়নি।

আহমদ ছফা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী রাজনীতিতে যুক্ত হননি। তার সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা তাকে ঐতিহ্য অন্বেষণ, স্বজাতির বীরত্বগাথা ও মানুষে মানুষে সম্প্রীতির সম্পর্ক নির্মাণে প্রাণিত করেছে। ব্যক্তি বন্দনায় তিনি ব্যস্ত হননি। বরং সমালোচনা ও বিশ্লেষণে মগ্ন তার সত্তা সত্য প্রকাশে উচ্চকিত থেকেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, গোটে, রবীন্দ্র, পাকিস্তানের সমাজ ও রাজনীতির বহুতল খুঁড়ে তিনি গবেষণার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন।

বিশ শতকের বাঙালি মুসলমানদের জাগরণের ইতিহাস গৌরবের। রবীন্দ্রভাবনা, দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, দস্তয়েভস্কি, বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শনের প্রতিক্রিয়া ও সুলতানের চিত্রকলার বিশেষায়িত নানা দিক ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ গ্রন্থে আহমদ ছফা তুলে ধরেছেন। পুথিসাহিত্যের বিপুল সম্পদ মুসলমানদের কাছে কীভাবে ধরা দিল তার বিচার-বিশ্লেষণ। ফার্সি-উর্দু চর্চা পলাশীর যুদ্ধের পরের সময়ের জাগরণ নিয়ে তিনি বিস্তর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র হোসেন মিয়া কীভাবে তার অস্তিত্ব রক্ষায় সংগ্রামে নিয়োজিত থাকে; বহুবিবাহ-জেলে পল্লিতে অবাধ যাতায়াত আবার সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জনের মোহতাকে গ্রাস করে না। হোসেন মিয়া, স্বভাব কবি লালন শাহ, হাছন রাজার মতো হাজার কবির একজনকে আবিষ্কার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন। ছফা এই চরিত্রের ব্যবচ্ছেদে তার বিচার-বিশ্লেষণ বন্দি করেন।

বাঙালি মুসলমানের মনগ্রন্থে নিবন্ধগুলো আহমদ ছফা বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা ও ছোট কাগজের জন্য রচনা করেছিলেন। গবেষণা নিবন্ধ রচনার ক্ষেত্রেও যে মনোযোগ যে বিচার ও যে বুদ্ধিমত্তার স্ফুরণ ঘটে তার সবটুকুই এ গ্রন্থে উপস্থিত। একুশে ফেব্রুয়ারি বাহাত্তরে যে বিভায় উদ্ভাসিত হয়েছিল, তা নিয়েও ছফা তার সজ্ঞান ব্যাখ্যা-বক্তব্য উদগীরণ করেছেন।

ছফার বক্তব্য: আজ বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাভাষী মানুষ বায়ান্নের শহিদদের স্মরণ করছেন। একটি জনযুদ্ধে জয়ের আনন্দ নিয়ে, একটি নতুন সম্ভাবনাময় শোষণমুক্ত সুসভ্য সমাজ সৃজনের দৃঢ় আকাঙ্খা স্পন্দিত অন্তরে-একটি প্রবল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি ফ্যাসিবাদী সেনাবাহিনীর নির্মম নৃশংস ইতিহাসের নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ডের করুণতম বেদনায় আপুত বাংলাদেশের মানুষ বাংলাভাষী মানুষ-সমগ্র বাঙালি জাতি রাইফেল কামান, মেশিনগান ধরা কড়া পরা হাত, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার বিসর্জিত প্রাণ শহিদদের অম্লান স্মৃতির প্রতি সম্মাননায় পরস্পর যুক্ত করেছেন (একুশে ফেব্রুয়ারি উনিশশ বাহাত্তর, পৃঃ ৯০)।
আহমদ ছফা অনগ্রসর জাতির অগ্রবর্তীতে কুসংস্কার প্রতিবন্ধক উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি স্বজাতি, স্বধর্ম ও স্বকর্মে বাঙালির আত্মপরিচয়ের নানা দিক তুলে ধরেছেন। সংস্কার, বিশ্বাস ও পশ্চাৎপদ জীবনাচরণ থেকে বেরিয়ে এসে আলোর দিকে অভিযাত্রায় তিনি এ জাতির মনোযোগ অগ্রগণ্য বিবেচনা করেছিলেন। আহমদ ছফা সমাজ ও চারপাশের মানুষের জীবন জিজ্ঞাসায় আন্দোলিত ছিলেন। তিনি মহৎ জীবন দর্শনের অধিকারী ছিলেন। তার লেখায় সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণ ও শুভ্রতার প্রকাশ ঘটেছে। সাহিত্যিক হিসেবে মানুষ হিসেবে আহমদ ছফা নিষ্ঠার সঙ্গে মানবকল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন।

কঠিন বাস্তবতার দিকে আমরা এখন এগিয়ে যাচ্ছি। এই বাস্তবতার আঁচ অনুভব করার সময় সবার মনে পড়ে আহমদ ছফার মতো সাহিত্যিক ও অভিভাবকের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।

আহমদ ছফা ছিলেন নির্ভীক সাহিত্যিক। তার সাহিত্যে সাধারণ মানুষের মুক্তি প্রণোদনা প্রবলভাবে উপস্থিত ছিল। সমাজ রূপান্তর প্রয়াসী ছফা সমাজের অভ্যন্তরের পচন নির্মূল করতে নিরন্তর লিখেছেন। তিনি ছিলেন সমাজচিন্তক ও দার্শনিক লেখক। তার সাহিত্য পাঠ তরুণ প্রজন্মকে জীবন, জগৎ ও মানুষকে জানার সুযোগ করে দেবে। পাঠক তার সামনে উপস্থাপিত কাজটি শনাক্ত করার সুযোগ পাবে তার সাহিত্য কীর্তি থেকে। আহমদ ছফা বাংলা সাহিত্যে অনুসরণীয় একজন সাহিত্যিক। তার সাহিত্যে মানবমুক্তি, জীবন অন্বেষার উপাদান সমৃদ্ধ। তার স্বপ্ন ও আকাঙ্খা বিস্তৃত।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক

সাহিত্যসভার কবিতা

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৫, ০১:১৭ পিএম
সাহিত্যসভার কবিতা

রোদের সংঘাত

সুমন সাহা 

রোদের সংঘাতে নবদম্পতির- 
কেড়ে নিলে প্রাণ; লুকানো গল্প
প্রচারিত হয়ে ওঠে।
সময় জানে! দিনরাত্রি বুঝেও বোঝেনি;
আনন্দ হারায় কাছের মানুষের কথায় 

সাহিত্যসভার কবিতা

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ১০:১৫ এএম
সাহিত্যসভার কবিতা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

অপরূপ সমুদ্র জলে!

চিরঞ্জীব চ্যাটার্জী

সবশেষ তুমি কবে ফুটেছিলে মনে নেই,
তবে খুব মনে আছে প্রথম ফুটেছিলে কবে; প্রথম সে ফুল পূর্ণ বিকশিত হলে জ্যোৎস্না ডুবে ছিল চাঁদে-
খুব মনে আছে, খুব...
পৃথিবীর রূপ সেকি অপরূপ সমুদ্র জলে!

সাহিত্যসভার কবিতা

প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫, ০৯:০৮ এএম
আপডেট: ২৫ জুন ২০২৫, ০৯:৫০ এএম
সাহিত্যসভার কবিতা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

বৃষ্টি বিলাস

আলমগীর কবির

বৃষ্টি এসে বাড়ায় জলের ঢেউ 
নদীর কান্না দেয় বাড়িয়ে। 
বৃষ্টি এসে বাড়ায় বুকের ক্ষত।
আকাশ রেখেছে পুষে কত জল বুকে তার?
কে কাকে দিয়েছে মেঘের আকাশ যত্ন করে উপহার 
আমি না তুমি?
সাক্ষী বর্ষাকাল। 
কে কাকে দিয়েছে বিরহের দ্বার খুলে 
সাক্ষী আষাঢ়ে ফোটা প্রথম শাপলা প্রথম কদম ফুল।

মেঘের আকাশ জল কি চোখের 
ধার নিতে চাও?
না চেয়ো না ধার,
কত যত্নে চোখের পাতায় ধরে রাখি মেঘ,
বুকের গভীরে ক্ষত।
কারো দেওয়া গোপন আঘাতের চিহ্ন।  

বাবা

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ১২:৩৪ পিএম
আপডেট: ২২ জুন ২০২৫, ১২:৩৮ পিএম
বাবা
গ্রাফিকস: মেহেদী হাসান

 

পিঠে পেট ঠেকেছে, আনন্দ বেসাতির কমতি নেই 

তবু খোল-করতাল বাজে আনন্দ উপচে,

রোদে পুড়ে, ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে আনন্দের খোঁজে 

একটা মানুষ জীবন যুদ্ধে লড়ে যায় অহর্নিশি 

প্রসন্নতার আলপথে খুঁজে ঘাম ঝরা কষ্টের সুখ 

চোখের দীপ্র জ্যোতিতে প্রিয় সন্তানের মুখ।

টানপোড়েন ও বাবা যেন সাঁকো বাধা সেতু 

জীবন-নদীর দুই তীর আপত্যস্নেহে বেঁধে রাখে,

নদীর জল কোথাও খরোস্রোতা, কোথাও ধীর-লয় 

রোদে পুড়ে, ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে 

বাবারা এমনি, বহমান নদী।