মিনিরা যে পাড়ায় বাস করতো তা ছিল সবুজে ঘেরা বিলের পাড় ঘেষা। চারদিকেের প্রকৃতি, জনজীবন ছিল খুবই সাদামাটা ঘরনার। বিলে মাছ ধরা, ধান, সবজি চাষ সাধারণ গ্রামীণ জনপদের আবহের ধারায় প্রবহমান। এখানে প্রায় সকল বাড়িতেই একটা দুটো দেশি মুরগী পালন করতো। দিনকাল ভালোই কাটছিল সকলের। কিন্তু হঠাৎ করেই আগমন ঘটলো দুষ্ট, ধুরন্দর, বড়সড় এক বিড়ালের। দেখতে সাদার মধ্যে কিছুটা কালো ছোপ ছোপ কেমন ভয়ানক বাঘডাশের মতো দেখতে অনেকটা। তাকে দেখলেই সকলে আঁতকে উঠতো। তার খাবারের কোন অভাব ছিল এমনটাতো নয় ; বরং এলাকাবাসী সকলেই মাছের কাঁটা, এটা সেটা তাকে খেতে দিতোই । এসব খেয়ে সে দিনকে দিন ভালোই মোটাতাজা হচ্ছিল আর হয়ে উঠছিল আরও বেশি শক্তিশালী এবং ভয়ানক দেখতে। সে যে প্রথমে এমনটা ছিল তা কিন্তু নয়। সে কিছুটা নিরীহ প্রকৃতিরই ছিল বটে।আর এই নিরীহ ভাব নিয়েই সে কুকর্ম শুরু করে। সহজলভ্য শিকার হাতের কাছে পেয়ে পেয়েই সে এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল।
সকলের বাড়িতে মুরগীর নতুন ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোর প্রতি বিড়ালটার লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। সে নিয়ম করে সকলের মুরগীর বাচ্চাগুলোকে খেতে শুরু করে। তার এই খাওয়া বেড়েই চলে দিনকে দিন। ছোট থেকে শুরু করে বড় মুরগির বাচ্চা কোনটাই বিড়ালটির থাবা থেকে রেহাই পেত না।
বিড়ালটির লোভের অত্যাচারে অতিষ্ট এলাকাবাসী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিনিরা। তাদের অনেক ক্ষতি সে করেছে। কারণ ওদের ছোট বড় সবগুলো বাচ্চাই সে দরজা, জানালা এদিক সেদিন দিয়ে ডুকে ডুকে খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে। এমন করে প্রায় সে প্রতিটি বাড়িতেই থাবা বসিয়ে সবাইকে নিঃস্ব করে ফেলেছে।
মিনির মার আরও বেশিই কষ্ট হয়। কারণ বিড়ালটি তার মুরগির আদুরে পালিত বাচ্চাগুলোকে তৃপ্তি করে খেয়ে নাদুস নুদুস হচ্ছে ; আবার শীতের মধ্যে তারই মাটির চুলোর পাড়ে শুয়ে দিব্যি আরাম করে ঘুমায়ও।
মিনির মা অবশ্য বহুবার একে তাড়ানোর চেষ্টা করেছে। কখনো বা ভয় দেখিয়ে কখনও বা আবার ঝাঁটার বাড়ি দিয়ে ; নয়তো মনের দুঃখে গালমন্দ করে। এতে করে কিছুটা সময় স্বস্তি কিংবা মনের জ্বালা হয়তো মিটতো; কিন্তু তাতে দীর্ঘ জ্বালা মিটতো না অবশ্য। এতে তার কষ্ট বেড়ে আরও তিন গুণ হয়ে যায়। সে একসময় প্রচণ্ড কষ্ট থেকে চিন্তাই করে এই অতিষ্ঠকারীটাকে মেরেই ফেলবে। যদিও সত্যি সত্যি তা করার দুঃসাহসও দেখায় নি। যতই হোক, একটা জীবন্ত প্রাণী তো। ছোট্ট মিনিও বারবার না করে। দরকার কি একটা প্রাণী মেরে অযথা পাপের ভাগীদার হওয়ার? তার শাস্তি সে নিজেই পাবে হয়তো। মিনির এই কথাটিই সত্যিও হলো অবশ্য পরে একদিন।
হঠাৎ একদিন রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক প্রতিবেশী বলে উঠলেন , " আপনাদের রান্নাঘরে এত দু্র্গন্ধ কীসের? " এ কথা শুনে মিনি আর ওর মা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাহলে কি তারা যা ভাবছে তাই ঘটেছে? আরে ঐ বিড়ালটা তো এখানে আয়েশ করে ঘুমায় ; তার মানে! শেষ এক সপ্তাহ আগে রান্না শেষে দরজায় তালা। এরপর কেউ আর ঐদিকে যায়ও নি। মিনির মা দ্রুত রান্নাঘরের দরজার তালা খুললেন। তারা দুজন তো অবাক হয়ে গেলেন! আরেহ এ তো সেই বিড়ালটি! তারমানে ঐদিন রান্নার পরই বিড়ালটি মুরগির বাচ্চা খেয়ে প্রচুর শীতের মধ্যে আয়েশ বেশি করতে গিয়ে একেবারে গরম চুলোর মধ্যেই ডুকে পড়েছিল! তাই এই অবস্থা! একেবারে পোকা কিলবিল করছে পুরো শরীর জুড়ে। তারা দুজন আঁতকে উঠলো যাই হোক না কেন একটা প্রাণীর এ অবস্থা তো তারা কোনভাবেই চায় নি, মুখে যাই বলুক না কেন।
ঘটনাটি শুনে এলাকাবাসী একেকজন একেকরকম প্রতিক্রিয়া দেখালো। কেউ কেউ ত খুবই মর্মাহত হয়ে বললেন, " আহারে বিড়ালটা মরে গেল, যতই হোক একটা জীব তো! " আবার আরেকজন পাশ থেকে বলে উঠলেন," মরছে ঠিকই আছে এর অত্যাচারে আমরা অতিষ্ট, এর পাপের শাস্তিই এ পাইছে।" সবার মুরগী এই একটা বিড়ালের কারণে বাচ্চাহীন। সে এত বেশি লোভী আর লাগামছাড়া ছিল যে সবাই তার উপর অতিষ্ট ছিল। কিন্তু কারও কিছুই করার সাধ্যও ছিল না।
ছোট্ট মিনির বিড়ালটির এই ভয়াবহ পরিণতি দেখে করুণা হচ্ছিল। সে বলে, " আচ্ছা বিড়ালটি যদি এত লোভী আর নির্দয় না হতো তাহলে হয়তো এমনটা নাও ঘটতে পারতো! " মাথায় তখন কেবল একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল - " সমাজের লোভী, নির্দয়,স্বার্থপর মানুষগুলোরও কি শেষে কর্মফলের কারণে এমন পরিণতিই হয় ? " তাদের অতিমাত্রায় - " আরও লাগবে আরও লাগবে , আরও চাই আরও চাই " এই মানসিক ব্যাধির কারণেই তারা নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে আনে কি!