
আমি সম্ভবত একটা ঘোরময় সময়ে বাস করতেছি। মানে এমন একটা ঘোর আমি জীবনভর চাইতাম। কারও দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতে চাইতাম, পার করে দিতে চাইতাম পুরাটা দিন, মাস, বছর।
আগে তো মাঝে-মধ্যেই একলা লাগত খুব। ফোনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতাম- এই ভরা দুপুরে কারে কল করা যায়! মনে হতো বেড়াল পালব না কী! তারে যত্ন করব। কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াব। একলা লাগা কমে যাবে।
ধান ভানতে শিবের গীত গাচ্ছি। আমি আমার চলতি সময়ের কথা লিখতে চাচ্ছি আসলে। একটা সময়ে কাছের বন্ধুদের ভালোবাসতে গিয়ে নিজেরে ভালোবাসার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন এমন একটা সময় যাচ্ছে আমার, আমি আমার, আমার মাতৃত্বের জার্নিটার প্রেমে পড়ছি প্রতিনিয়ত।
মাতৃত্ব কঠিন একটা জার্নি। নিজের জার্নির কথা তো বলব, তার আগে আমার আম্মার কথা বলি। আম্মা তখন অনার্সে পড়তেন কারমাইকেল কলেজে। হবিবর মামা ৩০ আষাঢ় রাতে রংপুর এলেন ৩১ বছর আগে। নানা তার হাতে করে চিঠি পাঠিয়েছেন আম্মাকে, ‘কাল সকালে হবিবরের সঙ্গে বাড়ি চলে এসো’। সারা রাত এ পাশ-ও পাশ করে কাটল। ঘুমাতে পারল না আম্মা। ভাবল কারও কিছু হলো নাকি! কেউ মরে-টরে গেল না তো।
আষাঢ়ের শেষ দিনে রমনা এক্সপ্রেসে চড়ে আম্মা বাড়ির কাছাকাছি স্টেশনে নামলেন। রংপুর থেকে তবকপুরের রাস্তায় ঝমাঝম বৃষ্টি। জামা-জুতায়, হাঁটুকাদা ভেঙে আম্মা যখন বাড়ির সামনে গেলেন, দেখলেন বাড়ির সামনে বিয়ের গেট। কার বিয়ে! বাড়ির ভেতর হলদি বাটা, মসলা বাটা, মেন্দি বাটার আয়োজন। আম্মা জানতে পারলেন আজ তার বিয়ে। অপরিচিত এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আষাঢ় সংক্রান্তিতে আম্মার বিয়ে হলো। এই ভদ্রলোক আমার বাবা।
বিয়ের ঠিক দুই বছর পর আষাঢ় সংক্রান্তিতে, মানে তাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীতে উনারা আমাকে পেলেন রাত ১১টার তুমুল বৃষ্টিতে। রংপুরে আমার জন্ম। কথা ছিল আরও দু-চার দিন বাদে আমি জন্মাব। দিন তারিখকে তুড়ি মেরে, হাসপাতালে নেওয়ার আগেই বড় জ্যাঠার রংপুরের কোয়ার্টারে আমি জন্মালাম।
আমার বাচ্চাবেলাটাকে নতুন করে ফেরত পাওয়ার বাসনা আমার চিরকাল ছিল। মানে যাদের আমি কাছের বন্ধুবান্ধব ভাবি, তারা সবাই জানে মাতৃত্ব নিয়ে কী এক ফ্যান্টাসিতে বাস করতাম আমি।
অলওয়েজ একটা কন্যাসন্তানের মোহ ছিল। যখন জানলাম, যে শিশু আসতেছে জগতে, সে পুত্র, তখন নিজেরে সামলাতে একটু বেগ পেতে হয়েছিল। সেই দিনটার কথা ভাবলে এখন লজ্জা লাগে। মনে হয়, এখন যারে দুহাতের ভেতর পায়েছি তাকে ছাড়া অন্য কাউকে পেলে আমার চলতই না।
কন্যাসন্তানের নাম অনেক দিন আগে ঠিক করা থাকলেও পুত্রসন্তানের নাম ঠিক করিনি সেভাবে। তো, যেদিন জানলাম পুত্র হবে, তার পর দিন সকালে আয়নায় নিজেরে দেখলাম। দেখলাম ঠিক না, তাকিয়ে থাকলাম, পেটের দিকে। শিশু পুত্রের গায়ে হাত রেখে চোখ বন্ধ রাখলাম কিছুক্ষণ। এর পর চোখ খুলে যেই তাকালাম তখন থেকে পুত্রপ্রেম শুরু হলো আমার।
আমি পুত্রপ্রেমে সদা মুগ্ধ জননী। আমি জানতাম, সন্তান জন্ম দেওয়ার পর যেকোনো সময় বিষণ্নতার বিষ আমার গলা টিপে ধরতে পারে। প্রতিটা মাকে এই দশার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, এটা আমি জানতাম। তাই খুব সচেতন ছিলাম এ বিষয়ে। শুরু থেকে আমার শিশুটির সঙ্গে দারুণভাবে সময় কাটানোর চেষ্টা করতাম।
শিশুকে জন্ম দেওয়ার কিছু দিনের ভেতর টের পেয়ে গেলাম মাতৃত্বের যে ফ্যান্টাসিতে এতকাল ভুগেছি, সেটা এত সহজ-সোজা না। আধুনিক প্যারেন্টিংয়ের যুগে আমাকে অনেক সেকেলে নিয়ম মানতে হয়েছিল বলে জার্নিটা আরও কঠিন হয়েছিল শুরুতে। একদম শুরুর দিকে যখন বুক থেকে দুধের ফ্লো ঠিকমতো আসছিল না তখন এক-দুবারের জন্য পুত্রকে বাইরের খাবার খাওয়ানো হয়েছিল। আমি জানতাম, এটা ঠিক কাজ হচ্ছে না। জানতাম, কষ্ট হলেও শিশু মায়ের বুক চুষলেই দুধ নামবে। যাই হোক, আমি ভাগ্যবান যে, বুকে দুধ নেমেছিল। আমাকে ফর্মুলা খাওয়ানোর দিকে যেতে হয়নি।
শুরুর দিনগুলার কথা ভাবলে নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে আমার। বুক চাকা চাকা হয়ে হয়ে থাকা। এটা যে কী অদ্ভুত! বুকের ব্যথায় জ্বর আসাটা যে কী ভয়ংকর, তা কেমলমাত্র মেডিকেলের বইগুলা পড়লে বোঝা যাবে না। যারা এই দশার ভেতর দিয়ে গেছেন, তারা হয়তো জানবেন এই ব্যথার তীব্রতা।
সন্তান জন্ম দেওয়ার পর পর জানলাম, চিকিৎসক হওয়ার পরও কত কত সাধারণ বিষয় আমার অজানা ছিল। যেমন, বাচ্চা যখন একপাশের বুকের দুধ খায় তখন অন্য পাশ দিয়ে দুধ গড়িয়ে পড়তেই থাকে। মাতৃত্বের জার্নিতে এই অনুভূতিটা আমাকে কষ্ট দিয়েছে সব চেয়ে বেশি। অনেকের হয়তো এই ফ্লোটা কম থাকে। আমার ফ্লো বেশি। তাই কষ্ট বেশি হতো। সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর সময় ছাড়াও বাদবাকি পুরোটা রাত-দিনজুড়ে গড়িয়ে পড়ত দুধ।
কবিতায় দুধের নহর শব্দটা পড়লে যেমন এস্থেটিক বিষয় কল্পনায় আসে, বাস্তবিকভাবে এই দশার ভেতর যাওয়াটা ততটাই কঠিন। শুরুতে প্যাডেড ব্রা ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে সেটা দিয়ে সামলানো যেত না। মানে প্রতিদিন আমাকে আট-দশটা সুতি কাপড় ভাঁজ করে ব্যবহার করতে হতো।
গুগল ঘেঁটেও এ বিষয়ে সহজ কোনো তথ্য পাইনি আমি। ঘণ্টা দুয়েক পর পর শিশুকে খাওয়ানো ছাড়াও, ব্রেস্ট পাম্প করে ফেলতে হতো দুধ। মাঝে-মধ্যে এত মায়া লাগত। মনে হতো, অনেক শিশুই মায়ের বুকের দুধ পায় না। ফর্মুলা খেতে হয় তাদের। সেই শিশুদের যদি কোনোভাবে খাবার পাঠানো যেত!
আমি সেই ব্যবস্থা করতে পারিনি। কারণ আমার পরিবারের মা, নানি, খালা কিংবা আরও যারা নারী সদস্য আছেন, তারা বিশ্বাস করেন বুকের দুধ অন্য শিশুকে খাওয়ালে আমার শিশুর অমঙ্গল হবে।
কোনোভাবেই তাদের ধারণা ভাঙাতে পারিনি বলে আমি এই দুধ দিয়ে মিল্ক বাথ দিতাম আমার শিশুরে।
বাজারে কিনতে পাওয়া নামিদামি লোশনের চাইতেও এটা অনেক ভালো কাজ করে। ধীরে ধীরে জানলাম, শিশুর সর্দি হলে বাজারে কিনতে পাওয়া এনসল ড্রপ বা আফরিন পেডিয়াট্রিক ড্রপের চেয়েও বুকের দুধ ভালো কাজ করে। শিশুর শরীরে র্যাশ হলে বুকের দুধ মালিশ করতাম। সেরে যেত। ডায়াপার র্যাশেও বুকের দুধ সবচেয়ে ভালো কাজ করে। আমি ধীরে ধীরে জানলাম বুকের দুধ একটা ম্যাজিক।
দুধের ফ্লো নিয়ে খুশি হওয়ার চেয়ে বিব্রত হয়ে থাকতাম শুরুতে। মানে আমি বাইরে কোথাও যেতে পারতাম না। আমার শিশু কাঁদলেই দুধ যেমন করে গড়িয়ে পড়ে, অন্য শিশু দূরে কাঁদলেও একইভাবে গড়িয়ে পড়ত। জামাকাপড় ভিজে যেত। লোকজনের সামনে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগত। ব্রেন একটা অদ্ভুত জিনিস। বোকাও কিছুটা। কোনটা আমার শিশু, কোনটা অন্যের শিশু এটা তো তার বোঝা উচিত, কিন্তু সে বুঝত না।
সবচেয়ে বেশি সমস্যা হতো শীতে। মানে যে শীতটা পার করছি কিছুদিন আগে সেই সময়ে। পুরা শীতকাল আমি কুড়িগ্রামে কাটিয়েছি। কুড়িগ্রামে আমাদের গ্রামের বাড়িটা টিনশেড। টিনশেডের ঘরগুলায় শীতের তীব্রতা বেশি টের পাওয়া যায়। আর এবারের ঠাণ্ডাটাও ছিল অন্যবারের চেয়ে বেশি। রুম হিটার দিয়ে ঘর গরম করা গেলেও ভেজা বুক নিয়ে থাকতে কষ্ট হতো আমার। বারবার কাপড় বদলিয়েও রেহাই পেতাম না। ভাবতাম, কবে এই দশা কাটাতে পারব!
হতাশ লাগত। নিজেরে বোঝাতাম, হতাশ হওয়া যাবে না। শিশুটার সঙ্গে আরও দারুণ করে সময় কাটাতাম। যাতে নিজের হতাশা দ্রুত কেটে যায়। কেটেও যেত। যখনই তার দিকে তাকাতাম, সে হাসি দিত। মনে হতো, আরেহ, কলিজাটা তো ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে আমার!
একটা বিশেষ মুহূর্ত আমার খুবই পছন্দের। শুরুতে আমি ভাবছিলাম, এটা মনে হয় কেবল আমার সঙ্গেই হয়। খালামণিদের ফোন করে বলতাম, দুধ খেতে খেতে খাওয়া বাদ দিয়ে পুত্র আমার দিকে ক্যামনে যেন তাকায়, আমি তো পুরা পাগল হয়ে যাচ্ছি!
এই দৃষ্টি যে কী দারুণ! কী সুন্দর! একটা মাকে কুপোকাত করার জন্য এর চেয়ে দারুণ আর কিছু আছে কি না, আমি জানি না। খালি অবাক হই। মাতৃত্বের প্রত্যেকটা ভাঁজে ভাঁজে এতকিছু, এতকিছু মাবুদ! শান্তিতে বেড়ালের মতো কুঁইকুঁই করতে মন চায়।
মাতৃত্ব যে কেবল শান্তির, তা তো নয়। কঠিন। খুব কঠিন। খুব খুব খুব কঠিন। এতকাল যে আমি অন্য বাচ্চার হাগু-হিসু দেখলেই সরে যেতাম মুখে হাত চেপে। সেই আমি কত চমৎকারভাবে সামলাতে পারতেছি সবকিছু! অবশ্যই ডায়াপারের অবদান এখানে আছে।
রাতে ঠিকঠাক ঘুম হতো না আমার। ২৪ ঘণ্টায় তিন-চার ঘণ্টা ঘুমাতে পারতাম কেবল। সারাটা দিন খালি মনে হতো কেউ আমার শিশুরে যদি একটু কোলে নিত! যদি দুটো ঘণ্টা কেউ আমারে ঘুমাতে দিত!
শুরুর তিন মাস আমি সব সময় ডায়াপার ব্যবহার করিনি। হাতে গোনা কিছু দিন রাতের বেলা ব্যবহার করতাম। দিনেও করতে চাইছিলাম। কিন্তু আম্মু কিংবা নানি কোনোভাবেই করতে দিচ্ছিলেন না। জার্নিটা ভয়ংকর ছিল সে সময়গুলোতে। একজন নবজাতকের দিনে চৌদ্দ পনেরোবার পটি করা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি দু-তিন দিন পটি না করাটাও স্বাভাবিক। আমার শিশুটি দিনে সাত আটবার করে পটি করত শুরুর দুই মাস। সারাটা দিন কতবার যে শিশুর সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও পরিষ্কার করতে হতো, কত কতবার জামাকাপড় বদলাতে হতো তার হিসাব নেই।
এটা অবশ্যই কঠিন ছিল আমার জন্য। যেহেতু আমি ডায়াপারের সুবিধা, সুফল বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলাম, বারবার তাই কষ্ট সহ্য করা ছাড়া উপায় ছিল না। পরিবারের সদস্যদের ভুলভাল যুক্তি দুই কান দিয়ে শুনতেই হতো। যেমন, ডায়াপার পরলে কোমর চিকন হবে, অমুক হবে, তমুক হবে। তবে আমি যেদিন কঠোর হতে পারলাম, সেই দিনটার কথা মনে পড়ে।
যে মহিলাটি আমাদের কাপড় ধুয়ে দিতেন, তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে তিনি হাইজিন মেইনটেইন করতেন। অন্য সময় করতেন না। প্রায়ই দেখা যেত শুকনো কাপড়ে পটি লেগে আছে কিংবা শিশুটির পেটের অসুখ ভালোই হচ্ছে না। এসব বারবার নোটিস করার পর আমি পরিবারে জানালাম, যেহেতু শিশুটি আমার, কাজেই তার সব সিদ্ধান্ত আমি নেব। আমি অবশ্যই ডায়াপার পরাব। এবং এটাতে কেউ কষ্ট পেলে আমি সেদিকে কান দেব না।
আমার কঠোর হওয়া উচিত ছিল আরও আগে। আমার মা বুঝলেন ডায়াপার পরানোর জন্যই শিশু বেশি সুস্থ থাকে। হিসু করে ভেজা কাপড়ে পড়ে থাকলে শিশুরা আরও বেশি কষ্ট পায়।
যাই হোক, ডায়াপার পরানো শুরু করার পর আমি ভাবতে থাকলাম শিশুটিকে বাইরে খাওয়ানো নিয়ে এত বিব্রত কেন থাকি আমি! কিংবা লোকজনের সামনে গেলে কেনই বা বিব্রত হব! এটা তো খুব দারুণ একটা বিষয়। একটা বড় সুতি ওড়না ব্যাগে রাখা শুরু করলাম। যেহেতু আমাদের দেশে পথে-ঘাটে ব্রেস্টফিডিং কর্নার নেই, তাই যখনই আমার শিশুটি খেতে চাইত তখনই পথে-ঘাটে, ফুটপাতে বসে পড়তাম। ব্যাগ থেকে ওড়না বের করে নিজেরে ঢেকে শিশুকে খাওয়াতাম। কিছুদিনের ভেতর খেয়াল করলাম এটাতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
শিশুকে কখনো বেবি ক্যারিয়ার ব্যাগে, কখনো কোলে, কাঁখে, কান্ধে করে পথে-ঘাটে, যা যা করতে মন চায় তা তা করতে পারি এখন। পারি বলাটা সহজ মনে হলেও এটা মোটেও সহজ নয়। এই যেমন একেবারে বসে না থেকে ঘরে অনলাইনে যে কোর্সটা করতেছি আমি, সেটার ক্লাস শুরু করাটা জটিল ছিল কিছুদিন আগে। আমি সেটাকে সহজ বানিয়েছি। আমার মনে হয়েছে, আমার জন্য উপযোগী হয়ে থাকবে না দুনিয়া। দুনিয়াকে উপযোগী বানিয়ে নিতে হবে।
প্রথম যেদিন ক্লাস করলাম, আমার বাচ্চাটা কাঁদতে ছিল। ক্লাস বাদ দিয়ে তারে কোলে নিয়েছিম বলে স্যার জানালেন, কোর্সটা পরে করেন নাদিয়া। হতাশ হয়ে ভাবলাম, হবে না কিছুই। পরের দিন মনে হলো, না হতাশ হওয়া যাবে না। স্যারকে মেইল করে জানালাম, আমি ক্লাস করতে চাই। শিশুকে নিয়েই কাজে ফিরতে চাই। হয়তো আমার শিশু বিরক্ত করবে, আপনাদের খারাপ লাগবে। কিন্তু একজন নতুন মা যখন কাজে ফিরতে চান, প্রত্যেকের উচিত তাকে সাহায্য করা। আমি খুবই ভাগ্যবান যে, তার ফিরতি মেইল আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করেছে। এখন পুত্রকে নিয়ে ক্লাস করলে তিনি খুশি হন।
যে কাজ করতে সময় লাগত ৩০ মিনিট, সে কাজ আমি তিন ঘণ্টায় করি। কিন্তু খুব আনন্দ নিয়ে করতে পারি কেবলমাত্র পুত্রের জন্য। পুত্রকে কোলে নিয়ে আয়নার সামনে বসে থাকতে থাকতে আমি আমাদের জার্নির প্রেমে পড়ি প্রতিদিন। প্রতিদিন স্নানের আগে আমরা যখন আয়নার সামনে বসে বসে আমাদের চোখ, নাক, মুখ চিনি তখন মনে হয় দুনিয়ায় বেঁচে থাকাটা কী যে সুন্দর।
একটা শিশুকে স্নান করানোর মতন কঠিন এবং আনন্দদায়ক কাজ জগতে কম আছে। স্নানের আগে তেল দিয়ে পুত্রের শরীর মালিশ করি আমি। এর পর স্নানে নিয়ে যাই তাকে। প্রথমে মাথাটা ধুয়ে ফেলার পর এমনভাবে মাথাটাকে মুছে ফেলি যাতে এক বিন্দু পানি না থাকে। তার পর পুরো শরীর ধুয়ে ফেলি। শিশু একটু বড় হয়েছে বলে গোসলটা মজা করে করে। পানিতে হাত-পা ছুড়ে মারে। আধুনিক প্যারেন্টিংয়ের ভিডিওগুলো থেকে আমি শিশুকে স্নান করানো শিখেছি। ওরা নানান খেলনা রাখে পানিতে। যেন সেই খেলনা শিশুকে আকর্ষণ করে। আমি অবশ্য খেলনা রাখি না। গাছের ঝরা পাতা পরিষ্কার করে রাখি। ফুল রাখি। আমি চাই শিশুটির সঙ্গে ফুলের পরিচয় হোক, পানির ঘ্রাণটা চিনুক সে। পাতার রংটা তার মনে ধরুক।
রাতের বেলা বারান্দায় বসে যে গানগুলো আমরা শুনি, সেগুলো শুনতে শুনতে আমরা খল খল করে হাসি। আর নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি। দেখি রাস্তা দিয়ে কে যায়! কে আসে! যে ঘোর আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সেই ঘোরটাই জীবনভর চাইতাম আমি। চাইতাম, একটা শিশুর জন্য ঘরের বারান্দায় পুঁতে রাখব পুঁই গাছ। প্রতিদিন সেখানে পানি দেব। তার পর লতায়-পাতায় বেড়ে উঠবে গাছ। গাছের সতেজতা নিয়ে শিশু বাঁচবে।
একটা শিশু জগতে এসে আমাকে রাজা বানিয়ে দিয়েছে। সারা রাত আমার হাতে মাথা রেখে ঘুমায় সে। তার ঘুম ঘুম মুখ প্রাণ ভরে দেখি। জনম জনম দুই বাহুর ভেতর আমি তাকে রাখতে চাই। তারে চিরদিন বলতে চাই-
‘ভোলা দিনের কাঁদন হাসি,
আঁখির জলে যায় ভাসি, ভালোবাসি’।