আজ একটা মহামিলনের দৃশ্য নিজ চোখে দেখবো বলে ঢাকা থেকে ছুটে এসেছি রাজশাহী। রাজশাহী থেকে জেবা আপার গাড়ি নিয়ে তার পরিবার সহ যাচ্ছি নওগাঁর মান্দা উপজেলায়। আমি বসেছি জানালার পাশের সিটে, আমার পাশেই জেবা আপা। গাড়ি চালাচ্ছে আপার একমাত্র ছেলে জোবায়ের, তার পাশের সিটে বসেছে রাশেদ ভাই; জেবা আপার জীবনসঙ্গী।
মান্দার দিকে আমাদের গাড়িটা যত এগিয়ে যাচ্ছে, জেবা আপা যেন ততো অস্থির হয়ে উঠছে, স্বভাবতই তিনি মানুষ হিসেবে ততোটা স্থির প্রকৃতির নন। কতক্ষণ পরপর চোখ মুছছেন আলগোছে। তার যেন আর তর সইছে না। এই অশ্রু অতীতের অনুশোচনার যা তিনি এত বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন, নাকি কাঙ্খিত মানুষটার সঙ্গে দেখা হওয়ার ও ক্ষমা চেয়ে কিছুটা ভারমুক্ত হওয়ার আনন্দের, কে জানে। আমি মাঝেমাঝে তাকিয়ে দেখছি, কিন্তু বলছি না কিছুই। থাক, মানুষটা কাঁদুক আজ, কত কান্না জমিয়ে রেখেছেন তিনি বুকের ভেতর। আজকের দিনে অন্তত তাকে কাঁদতে নিষেধ করবো না। এমনিতেও আমি কাউকে কাঁদতে দেখলে বাঁধা দেই না। সত্যিকারের কান্না সুন্দর, তা প্রকাশ্যে হোক কিংবা অপ্রকাশ্যে।
কয়েক বছর আগে একবার নওগাঁ এসেছিলাম। সেবার পতিসরের রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি আর বদলগাছির পাহাড়পুর বিহার দেখতে এসেছিলাম। তখন আমার ভ্রমনসঙ্গী ছিলো আজকের এই মানুষগুলোই। সেদিনই আপার কাছে প্রথম শুনেছিলাম জুলেখার কথা এবং সেদিনও জুলেখার কথা বলতে বলতে আপা কেঁদে ফেলেছিলো। কিছু কিছু দুঃখ বছরের পর বছর ধরে সজীব থাকে, আমরা কেবল তা চাপা দিয়ে রাখি জীবনের প্রয়োজনে। তারপর বিভিন্ন সময় কথাপ্রসঙ্গে আপা জুলেখার স্মৃতিচারণ করেছে। একজন গৃহপরিচারিকাকেও যে এত ভালোবাসা যায়, তা আপাকে না দেখলে বোঝা কঠিন। তবে জুলেখার সঙ্গে তিনি একটা অন্যায় করে ফেলেছিলেন। সেই অন্যায়ের বয়স প্রায় ঊনত্রিশ বছর।
এত বছরে বহুবার তিনি অনুতপ্ত হয়েছেন, মনে মনে হাজার বার ক্ষমা চেয়েছেন জুলেখার কাছে, কিন্তু জুলেখাকে খুঁজে বের করে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস পাননি কখনো। আজ যখন তার বয়স ষাট পেরিয়েছে, শরীরে দানা বেঁধেছে নানাবিধ অসুখ, তখন তার খুব করে মনে হচ্ছে একবার জুলেখার সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমা না চাইতে পারলে সে মরেও শান্তি পাবে না। তার ইচ্ছে পূরণ করতেই রাশেদ ভাই কষ্ট করে জুলেখার বর্তমান ঠিকানা যোগাড় করেছেন। আজ সেই ঠিকানার উদ্দেশ্যেই যাত্রা।
জেবা আপার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ভার্চুয়াল জগতে। তবে সম্পর্ক যেন কিছুটা আপন বোনের মতো। আপার কাছে জুলেখার গল্প শুনতে শুনতে কোথাও একটা আমারও মায়া পড়ে গিয়েছিলো। আমার মনে হতো, আপার মতো আমিও তার সঙ্গে অন্যায় করে ফেলেছি, আমারও দেখা করা দরকার তার সঙ্গে। এমন কেন মনে হতো জানি না। হয়তো দরিদ্র হতভাগ্য জুলেখার সঙ্গে যেই অন্যায় আচরণ করেছিলো আপা, যার জন্য জুলেখা তীব্র অভিমান আর কষ্টে রাতের অন্ধকারে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়েছিলো, অবচেতন মনে আঁকা জুলেখার সেই অসহায় করুণ মুখ আমার ভেতর ঘরে কড়া নাড়তো নিঃশব্দে। আর তাই আমাকে যখন বলা হলো জুলেখার খোঁজ পেয়েছে অবশেষে, দেখা করতে যাবে মান্দাতে, ছুটে এলাম সবকিছু ফেলে। এই মহামিলনের দিন আমাকে যে উপস্থিত থাকতেই হবে।
১৯৯২ সাল। রাশেদ ভাইয়ের চাকরি ট্রান্সফার হলো নওগাঁ জেলায়। জেবা আপার সঙ্গে তার যৌথ জীবন প্রায় চার বছরের তখন। নওগাঁ শহরেই তার কর্মস্থল বা অফিস। কাজের প্রয়োজনে যদিও নওগাঁর সব উপজেলাতেই তাকে যেতে হতো, তবে অফিস শহরে থাকায় বাসা ভাড়াও নিলেন শহরে। নওগাঁর ঐ বাসায় জেবা আপা আর রাশেদ ভাই ছাড়া কেউ থাকতো না। রাশেদ ভাইয়ের অফিস থেকে ফেরার কোনো নির্দিষ্ট সময় ছিলো না। কাজের জন্য তাকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো, কাজের চাপ থাকলে সময়ের কোনো ঠিকঠিকানা থাকতো না, মাঝেমাঝে ফিরতে বেশ রাতও হতো। যদিও এসব চাপ চাইলেই অনেকটা এড়িয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু তিনি তার কাজের প্রতি সৎ থাকতেন সবসময় এবং কাজটাকে খুব ভালোওবাসতেন, তাই নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই এত পরিশ্রম করতেন। আর কেউ না থাকার দরুণ তিনি অফিসে চলে গেলে আপাকে একাই থাকতে হতো বাসায়।
এভাবে সময় কাটতে চাইতো না। আর তাছাড়া রাশেদ ভাইয়ের যখন ফিরতে দেরি হতো, তখন নতুন শহরে সন্ধ্যের পর ঐ খালি বাসায় আপা ভয় পেতো। এদিকে নওগাঁ যাওয়ার কিছুদিন পরই আপা গর্ভধারণ করে প্রথমবারের মতো। তখন আপা রাশেদ ভাইকে জানায়, সর্বক্ষণ তার পাশে থাকার জন্য এবং সব কাজ করে দেওয়ার জন্য একজন গৃহপরিচারিকা যেন রাখা হয়। তারপর রাশেদ ভাই তার অফিসের বাগানের মালিকে বলে একজন কাজের লোক খুঁজে দিতে। মালির বাড়ি ছিলো মান্দা উপজেলায়। তার গ্রামের এক দরিদ্র মেয়ে জুলেখা, বয়স বারো কিংবা তেরো। ঐটুকু বয়সে একজন মানুষ ছুটে বেড়াবে, মা-বাবার আদরে আহ্লাদে থাকবে, স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে করতে বড় হতে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দারিদ্র্যের অস্বাভাবিকতায় জুলেখা মান্দার বেনীমাধবপুর গ্রামের সবুজ ছেড়ে এসে পড়লো নওগাঁ শহরে গৃহপরিচারিকার কাজে। যদিও নওগাঁ ছিমছাম, শান্ত সুন্দর শহর। সেখানেও আছে সবুজের সমারোহ। তবুও বেনীমাধবপুর গ্রামে যেই প্রাণ চঞ্চলতা ছিলো, তা কী আর শহরে মেলে। ঐটুকু বয়সে কারো শেকড় ছেড়ে আসার কথা নয়, কিন্তু জীবনের চাকা ঘোরানোর প্রয়োজনে কত কী ছেড়ে আসতে হয় হতভাগ্য মানুষদের!
জেবা আপার চড়ুই পাখির সংসার। খুব বেশি কাজ ছিলো না। তবে তিনি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করতেন। তাই জুলেখাকে সবসময় বাড়িঘর চকচকে রাখতে হতো। রোজকার রান্নাও তাকে করতে হতো। যদিও রান্নায় পটু হবার মতো বয়স তার ছিলো না, তবে যা রান্না করতো তাতে চালিয়ে নেওয়া যেতো। জেবা আপা তাকে বলে বলে নতুন নতুন রান্না শেখাতেন। গর্ভাবস্থায় অনেককিছুই খেতে ইচ্ছে হয় কিংবা খাওয়াটা প্রয়োজন, জুলেখা সেসব রান্না করে দিতো, না পারলে শিখে নিতো। অবসর সময়ে দুজন মিলে গল্প করতো। জেবা আপা বরাবরই খুব গল্পপ্রিয় মানুষ, তিনি কথা বলতে খুব ভালোবাসেন। যদিও জুলেখার সঙ্গে তার বেশ কিছুটা বয়সের ব্যবধান ছিলো, তবুও বাসায় যেহেতু আর কেউ থাকতো না সারাদিন, তাই দুজন মিলেই রাজ্যের গল্প করতো।
দেখতে দেখতে সময় ঘনিয়ে এলো। জেবা আপার কোলে স্বর্ণকমল ফুটিয়ে হেসে উঠলো জোবায়ের। রাশেদ ভাই আর জেবা আপার প্রেমের বিয়ে। বউকে খুব ভালোবাসতেন বলেই তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে ছেলের নাম রেখেছিলেন। জোবায়ের হওয়ার পর আপার পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তার জানায়, আপা আর কোনদিন সন্তান গ্রহণ করতে পারবে না। এমনিতেই প্রথম সন্তান নিয়ে আদর আহ্লাদের সীমা থাকে না, তারওপর মেনোপজ হয়ে যাওয়ার দরুণ এই একমাত্র সন্তান নিয়ে আপা খুব সেনসিটিভ হয়ে পড়েছিলেন। সবার কোলে জোবায়েরকে দিতেন না, নিজের কাছে রাখতে চাইতেন বেশি বেশি। জোবায়ের একটু ব্যথা পেলেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। একমাত্র ছেলের কান্না তো দূরের কথা; একটু মলিন মুখও যেন তার সহ্য হতো না। না চাইতেই ছেলের সামনে সবকিছু এনে হাজির করতেন। পৃথিবীর যেকোনো কিছুর বিনিময়ে তিনি তার সন্তানকে আনন্দে রাখতে চাইতেন।
অন্য কাউকে ততোটা ভরসা করতে না পারলেও রাশেদ ভাই আর জুলেখাকে তিনি খুব ভরসা করতেন। কিন্তু রাশেদ ভাই তো সময় পেতেন না তেমন, তাই জুলেখাই ছিলো তার সবচেয়ে বড় সহায়। আস্তে আস্তে জোবায়ের বড় হতে থাকলো, কথা বলতে শিখলো, দাঁড়াতে শিখলো, হাঁটতে শিখলো। মাত্র আড়াই বছর বয়সে তেইশটা বাংলা ছড়া মুখস্ত করে ফেললো সে। এর পেছনে অবশ্য পুরো অবদানটাই জুলেখার। সে খুব যত্ন করে রোজ জোবায়েরকে ছড়া শিখিয়েছে। একজন বাচ্চা লালন পালন করতে যাবতীয় যা কাজ করা দরকার, সবই সে করেছে। জোবায়েরের সঙ্গে তার সম্পর্কের বন্ধনটা ছিলো অন্যরকম। সে হয়তো তাকে মনিবের সন্তান হিসেবে মানুষ করেনি, নিজের ভাইয়ের মতো ভেবেই আদর যত্নে বড় করেছে একটু একটু করে। আসলে একদম শেকড় থেকে কোনো বাচ্চাকে লালনপালন করতে শুরু করলে তার প্রতি একটা নাড়ির মতো টান তৈরি হয়ে যায়। জুলেখারও তাই হয়েছিলো। জোবায়েরকে ছাড়া সে এক মুহূর্তও থাকতে চাইতো না। তাকে কখনো যদি বলা হতো মান্দাতে নিজের গ্রামে গিয়ে ঘুরে আসতে, সে যেতে চাইতো না জোবায়েরকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে তাই। জোবায়েরের অবশ্য জুলেখার কথা কিছুই মনে নেই। ঐ বয়সের কোনো স্মৃতি সাধারণত মনে থাকে না কারো। তবে সে তার মা-বাবার কাছে জুলেখার গল্প শুনে শুনে একটা আত্মিক টান অনুভব করে। সেও চায়, যে তাকে মাতৃস্নেহে কয়েকটা বছর লালনপালন করেছে, তার সঙ্গে জীবনে একবার হলেও দেখা হোক। জোবায়ের শুনেছে, সে নাকি জুলেখাকে জুলেখা বলে ডাকতে পারতো না, জোহা বলে ডাকতো। সে ভেবে রেখেছে, কখনো দেখা হলে তাকে ছোটবেলার মতো জোহা বলেই ডাকবে, তারপর জড়িয়ে ধরবে বুকের ভেতর।
১৯৯৫ সাল। নওগাঁতে এক রাতে বিনা নোটিশে বন্যার প্লাবনে ভেসে গেলো সব। ছোট যমুনার উপচে পড়া পানি ছড়িয়ে পড়লো শহর, গ্রাম সব জায়গায়। জেবা আপারা যেই বাসায় থাকতো, সেটা ছিলো দোতলা বাসা। এক রাতের ভেতর তাদের বাসার নিচতলা পানিতে ভরে গেলো। ভাগ্যিস তারা দোতলায় থাকার দরুণ ঘরের ভেতর পানি প্রবেশ করতে পারেনি। জোবায়েরের তখন তিন বছর বয়স। রাশেদ ভাইয়ের সরকারি চাকরি, অফিস ছুটি দেয়নি, বন্যার পানি ভেঙে রোজ অফিস করতে যেতে হয়। আপাদের বাসার পেছনে ছিলো একটা জামরুল গাছ। সেই গাছের সাথে একটা দশ বারো বছর বয়সী ছেলে রোজ নৌকা বাঁধতো। সেই নৌকাতেই রাশেদ ভাই অফিসে যাতায়াত করতো। একদিন আপা তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘রোজ নৌকায় মানুষ পারাপার করে সারাদিনে কত টাকা পাও’? ছেলেটা বললো, ‘একশ টাকার মতো’। তারপর আপা তাকে বললো, ‘তোমাকে রোজ আমি একশ টাকা দিবো, তুমি রাশেদকে আনা নেওয়া করা ছাড়া বাকিটা সময় এখানেই নৌকা নিয়ে বসে থাকবে। বাকি যাদের দরকার তারা অন্য নৌকায় পার হবে, সমস্যা নেই’। ছেলেটা রাজি হয়ে গেলো। আসলে ঐ ভয়াবহ বন্যার সময় কখন কী প্রয়োজন হয় কিংবা কখন কী বিপদ আপদ হয়, তা তো বলা যায় না। সেই আশঙ্কা থেকেই ছেলেটাকে কাছে কাছে থাকতে বলা, যাতে প্রয়োজনে ডাকলেই সহযোগিতা পাওয়া যায়।
বন্যার ভেতর একদিন রাতে শুরু হলো ঝুমবৃষ্টি। বিরামহীন বৃষ্টি নেমেই যাচ্ছে, থামার কোনো লক্ষণ নেই। বৃষ্টির জন্য সেই রাতে রাশেদ ভাই বাসায় ফিরতে পারলেন না, থেকে গেলেন তার কলিগদের কোয়ার্টারে। তখন তো এমন মোবাইল ফোন ছিলো না, টেলিফোন আর চিঠির যুগ ছিলো, টেলিফোনও সব জায়গায় সহজলভ্য ছিলো না। রাশেদ ভাইয়ের কোনো খোঁজ না পেয়ে জেবা আপা চিন্তায় অস্থির হয়ে গেলেন। এদিকে বন্যার জন্য বিগত কয়েকদিন ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে সর্বত্র। হারিকেন জ্বলছে ঘরের এক কোণে। অন্ধকার রাতে বৃষ্টির বিরামহীন শব্দে জোবায়ের ভয় পেয়ে ক্রমাগত কেঁদেই যাচ্ছিলো। জুলেখা কিছুতেই তাকে শান্ত করতে পারছিলো না। নৌকার মাঝি যেই ছেলেটা, বল্টু তার নাম, তাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো বৃষ্টির জন্য সে তার নিজের বাড়িতে চলে গেছে। জেবা আপা ঘরময় পায়চারি করছিলো, জানালা খুলে বারবার দেখার চেষ্টা করছিলো রাশেদ ভাই আসে কিনা। বাইরে বিদ্যুৎ চমকানোর আলো জ্বলতে থাকলেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলো না জেবা আপা। রাশেদ ভাইয়ের কোনো বিপদ হলো কিনা, সেই ভেবে তার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছিলো।
তখন প্রায় মধ্যরাত। জোবায়েরের কান্না কিছুটা কমেছে, তবে সে ঘুমাতে পারছে না ভয়ে। কোনো খাবারই সে খেতে চাচ্ছিলো না। জোবায়েরের খিচুড়ি পছন্দ বলে সেই মধ্যরাতেই জুলেখা ওর জন্য পাতলা খিচুড়ি রান্না করে। একদম গরম খিচুড়ি চুলা থেকে নামিয়ে বাটিতে করে জোবায়েরের সামনে নিয়ে আসে। খিচুড়ি একটু ঠান্ডা হলেই সে খাওয়াতো। কিন্তু খিচুড়ি দেখে যাতে জোবায়ের খুশি হয়, কান্না থামায়, তাই দেরি না করে গরম খিচুড়িই নিয়ে আসে। দেখা মাত্রই চোখের পলকে জোবায়ের সেই গরম খিচুড়ির ভেতর হাত ডুবিয়ে দেয়। আর তারপরই তার ভয়ানক চিৎকার শুরু হয়। জেবা আপা আর জুলেখা দুজনই ঘটনার আকস্মিকতায় খাবড়ে যায়। গরমে জোবায়েরের হাত পুড়ে যায়। বাসায় কোনো ঔষধ না থাকায় কিছুতেই তার যন্ত্রণা কমানো যায় না। বন্যার ভেতর ঐ বৃষ্টির রাতে কাউকে দিয়ে যে ঔষধ আনিয়ে নেবে, সেই উপায়ও নেই। রাগে, দুঃখে সেই রাতে জেবা আপা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। প্রথমে জোরে একটা চড় বসিয়ে দেয় জুলেখার গালে। তারপর বাটির সেই গরম খিচুড়ি জুলেখার মাথায় ঢেলে দেয়। শুধু তাই নয়, রান্নাঘর থেকে পাতিল এনেও পুরো খিচুড়িটা তার গায়ে ঢেলে দেয়, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে জুলেখাকে। শারিরীক আর মানসিক যন্ত্রণায় জুলেখা কুঁকড়ে যেতে থাকে। সেদিন শারিরীক কষ্টের চেয়ে সে বোধয় মানসিক কষ্টই পেয়েছিলো বেশি। তাই শরীরের দহনজ্বালা নিয়েও সে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে সব অপমান, অবজ্ঞা সহ্য করেছে। তার দুচোখ বেয়ে ঝরেছে ব্যথাদের অশ্রু, কিন্তু সে একটা টুঁ শব্দও করেনি।
ভোররাতের দিকে জোবায়েরকে কোনরকমে ঘুম পাড়ানো গেলে ক্লান্তিতে জেবা আপারও চোখ বুজে আসে। সকালে যখন ঘুম ভাঙে, তখন বৃষ্টি শেষে ধবধবে পরিবেশ চারপাশে, পেছনের দরজা খোলা, জুলেখা নেই কোথাও। জুলেখার থাকার ঘরে সবকিছু যেমন ছিলো, তেমনই পড়ে আছে। জেবা আপার বুঝতে আর কিছু বাকি রইলো না। ঐ বৃষ্টির রাতে বন্যার থইথই পানি ভেঙে জুলেখা চলে গেছে। অনেক অভিমানে বুকভরা কষ্ট নিয়ে শত শত বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় নিয়ে সে চলে গেছে। সে আর ফিরবে না কোনদিনও!
ঐদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে রাশেদ ভাই সব জানতে পেরে ব্যথিত হয়। জেবা আপাকে বলেন, ‘তুমি কাজটা একদম ঠিক করোনি। জানি তোমার মাথা ঠিক ছিলো না, তাই বলে যেই ছোট্ট মেয়েটা এই কয়েকটা বছর আমাদের এত উপকার করলো, জোবায়েরকে এত স্নেহ দিয়ে লালনপালন করলো, তার সঙ্গে এমন অমানবিক আচরণ করা ঠিক হয়নি। এটা ওর প্রাপ্য নয়। তোমার ক্ষমা চাওয়া উচিত ওর কাছে’। মাথা ঠান্ডা হওয়ার পর জেবা আপা বলেছিলো, ‘বন্যা শেষ হোক, তারপর ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। মান্দাতে যাবো ওর কাছে ক্ষমা চাইতে’।
কিন্তু জেবা আপার আর মান্দা যাওয়া হয়নি। কারণ, বন্যার পরই রাশেদ ভাইকে নওগাঁ থেকে ট্রান্সফার করে দেয়া হয় রংপুরে। বদলি হয়ে চলে যাওয়ার ব্যস্ততায় আর সময় সুযোগ হয়ে ওঠেনি জুলেখার কাছে যাওয়ার। এ জগৎ সংসারে জুলেখারা তো ততোটাও গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, তাদের কাছে ছুটে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার একটা আভ্যন্তরীণ তাড়া থাকবে!
দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর কেটে যায়। জোবায়ের এখন তার বাবার মতো প্রকৌশলী হয়ে বেরিয়েছে সদ্য। রাশেদ ভাইয়ের চুল পেকে গেছে অনেকটা। জেবা আপা বাইরে থেকে আগের মতোই ফিটফাট দেখতে, তবে তার ভেতরে বয়স বাড়ার মাশুলস্বরূপ কিছু অসুখ বাসা বেঁধেছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই আপা ভাবছিলো জুলেখাকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করে ক্ষমা চাইবে। রাশেদ ভাই কয়েক জেলা ঘুরে এখন কিছু বছর যাবৎ রাজশাহীতে আছেন, এখানেই বাড়ি গাড়ি করে থিতু হয়েছেন, সামনেই তার অবসরে যাওয়ার সময়। বউয়ের কথা রাখতে সে অনেক কষ্টে খুঁজে বের করেছে নওগাঁ অফিসের সেই বাগানের মালীকে। তিনিই তাকে জানিয়েছেন, জুলেখা এখনো মান্দাতেই আছেন। তবে মা-বাবার বাড়িতে নেই, বৈবাহিক কারণে স্বামীর বাড়িতে থাকে, বেনীমাধবপুরের পাশের গ্রাম শালবনীতে।
আমরা প্রথমে বেনীমাধবপুরে গেলাম। সেখান থেকে ঐ মালী চাচাকে নিয়ে চললাম শালবনীর দিকে। তিনি আমাদের একটা দারিদ্র্যের ছাপ লেগে থাকা মলিন বাড়ি দেখিয়ে গাড়ি থামাতে বললেন। মালী চাচার মতো আমরেও সবাই কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম, বাড়ি ভর্তি এত মানুষ কেন? জেবা আপার মনে কু ডাক ডাকতে শুরু করেছে। তার পা যেন আর চলছে না। তবু কষ্ট করে নিজের শরীরটাকে বয়ে নিয়ে শালবনীর সেই ঝরা পাতার উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সেখানে ধবধবে সাদা কাফনে জড়ানো একটা মৃতদেহ ঘিরে বসে আছে কিছু মানুষ। জানতে দেরি হলো না, এত বছর ধরে যার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থেকেছেন, যার জন্য ছুটে এসেছেন এতটা পথ, সে স্বর্গের পাখি হয়ে উড়ে গেছে আজ দুপুরের নির্জনতায়। জেবা আপা কান্নায় ভেঙে পড়লেন, আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। রাশেদ ভাই নিঃশব্দে চোখ মুছছে আর মালী চাচাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘এটা কী হলো চাচা? এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না’। জোবায়েরের গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে আছে। জোহা বলে ডেকে আর জড়িয়ে ধরা হলো না মানুষটাকে। জুলেখা দেখতে পেলো না তার ছোট্ট জোবায়ের আজ কত বড় হয়ে গেছে। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছি জেবা আপাকে ধরে। যেই জুলেখাকে কোনদিন দেখিনি, তার জন্য আমার ভেতরের পৃথিবীটা যেন ওলটপালট হয়ে গেলো। কী অসীম শক্তি এই অব্যখ্যায়িত ভালোবাসার!
জেবা আপাকে নিয়ে গেলাম জুলেখার কাছে। সে কাফনের কাপড় সরিয়ে জুলেখার মুখটা দেখলো, হাত বুলালো সারা মুখে। বারো-তেরো বছর বয়সী সেই হতদরিদ্র অভাগী জুলেখার জন্য তার অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগলো বুকের ভেতর। কিছুতেই তার কান্না থামছে না। জুলেখার কাছে ক্ষমা চাইতে না পারার আক্ষেপ তাকে অনেক বেশি ভেঙে দিয়ে গেলো এক মুহূর্তে। জুলেখা সারাজীবন একটা ক্ষত বয়ে বেড়ালো, ভুল বুঝলো তাকে, সেই ভুল ভাঙানোর আর সুযোগ হলো না। জুলেখা জানতেও পারলো না কত অজস্র রাতদিন জেবা আপা অনুশোচনায় ভুগেছে, কত আশা নিয়ে সে তার কাছে ছুটে এসেছিলো একটু ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়ার জন্য। আরেকটু সময় বেঁচে থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো? এই প্রশ্নের উত্তর জেবা আপার মতো আমিও জানি না। শুধু জানি, জুলেখা একটা আশ্চর্য প্রদীপ হয়ে আমাদের মনে জেগে থাকবে চিরকাল!
শালবনীতে সন্ধ্যা নামছে। কুপিবাতি জ্বালানো হয়েছে জুলেখার ঘরে। কিন্তু আজ সে গৃহে প্রবেশ করবে না, তার ঠিকানা বদলে গেছে। বাড়ির পেছনে একটা বাঁশের ঝাড়, তার সাথে কলতলা, ফসলের মাঠ। সেখানেই জুলেখার জন্য একটু জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছে। ঐ বৃষ্টির রাতে তুমুল অভিমান আর যন্ত্রণায় যেই ছোট্ট জুলেখা জেবা আপার ঘর ছেড়েছিলো, তাকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে কবরে শায়িত হতে দেখছেন তিনি। সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে। আমি বললাম, ‘ফিরে চলো আপা। এখানে আর তোমার কোনো পিছুটান রইলো না’। রাশেদ ভাই চিরকালই জেবা আপার অনুভূতিকে যত্নে লালন করেন। তিনি বললেন, ‘তুমি কী আজকের রাতটা জুলেখার এই বাড়িতে থেকে যেতে চাও? তাতে কী তুমি একটু প্রশান্তি পাবে? তাহলে আমরা থেকে যাবো’। জেবা আপা উঠে দাঁড়ালো। জুলেখার কবর থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে নিজের আঁচলে বাঁধলো। তারপর জোবায়েরকে বললো, ‘গাড়িতে উঠে বসো। আমরা এক্ষুনি চলে যাবো’। আমরা সবাই গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করলো। গোটা রাস্তায় জেবা আপা একটা কথাও বললেন না। বাকিরাও প্রয়োজন ছাড়া কথা বললো না। সবাই এক একটা ব্যথার পাহাড় বুকের ভেতর নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলো রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। পেছনে পড়ে রইলো শালবনী, বেনীমাধবপুর আর আমাদের জুলেখা!