কতটা পুড়লে পূর্ণ হবে প্রণয়
কতটা ক্ষয়িষ্ণু হলে প্রণয়ের হবে জয়।
তালগাছের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে
কত দিন অপেক্ষা করব, হাত দুটি বাড়িয়ে
বাদুড় ঝুলার মতো কতকাল ঝুলতে হবে চন্দ্রমুখী
পরস্পরকে চলো হৃদয়ে বাঁধি, হতে চাই চিরসুখী।
কতটা পুড়লে পূর্ণ হবে প্রণয়
কতটা ক্ষয়িষ্ণু হলে প্রণয়ের হবে জয়।
তালগাছের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে
কত দিন অপেক্ষা করব, হাত দুটি বাড়িয়ে
বাদুড় ঝুলার মতো কতকাল ঝুলতে হবে চন্দ্রমুখী
পরস্পরকে চলো হৃদয়ে বাঁধি, হতে চাই চিরসুখী।
বহুমাত্রিক জীবন
সারমিন চৌধুরী
স্বপ্নপোড়া জীবনের গল্পে অদৃশ্য সীমানা
সহস্রকাল দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে ঠাঁই খুঁজি
তোমার অন্দরমহলে পরিপাটি সংসার,
উঠতি গেরস্তি সুখসমৃদ্ধির ষোলোকলা পূর্ণ;
বসন্ত লুটোপুটি খায় তোমার বাগান বিলাসে-
অনেক মানে এই বহুমাত্রিক জীবন বোধে কিংবা
আমি বুঝতে পারিনি ভিতরকার ছলাকলা!
আমিহীন তোমার বেঁচে থাকা এতটা সহজ?
বহু সময়ের পরিক্রমায় যখন বোধদয়টা হলো
তখন আঘাতের চেয়েও বেশি স্বস্তি পেলাম
কারণ, এখন রোজরোজই মিথ্যা অভিনয়-
চোখের প্রতিবিম্বে প্রদর্শিত হয় না।
ঋণী
হাদিউল ইসলাম
একদা দিয়েছ খুলে পুলকের দ্বার
দিয়েছিলে সেথা প্রবেশাধিকার
তার পর স্বর্গে যেরকম, ছুড়ে দিল বায়বীয়
কাঁটা ও কুসুমে আমার ঈশ্বর
সন্দেহজনক বসন্তবাতাসে আমি বহু উড়িয়েছি
একান্ত রোদ্দুর, অশ্রুকণা দিন মুছেছি পাষাণে-
স্বাদু পৃথিবীর অনেক লবণে আমি ঋণী
যা পেয়েছি, তা আমি মুছে যাওয়া অক্ষরে লিখিনি
হিংসা
মাঈনউদ্দীন আহমেদ মাহী
প্রিয়তা,
তুমি হয়তো জেনে গেছ,
আমাদের মন একটা বোমারু বিমান!
যখন তখন বিস্ফোরিত হতে পারে।
অথচ দেখ, কী আশ্চর্য রকমভাবে
প্রতিদিনই আমি নিকোটিনের ধোঁয়ায়
নিজেকে উড়িয়ে দিচ্ছি ওই আকাশে।
প্রিয়তা, আমরা এখন সভ্যর বদলে
অসভ্য হচ্ছি দিনকে দিন
চিলের ওড়া দেখে আমাদের হিংসা হয়
কেন হিংসা হয় বলতে পারবে?
কালের শিলালিপি
সাকিব জামাল
আদিম যুগের শিলালিপি বীভৎস!
মধ্যযুগের শিলালিপি রক্তরং লাল!
আধুনিক যুগে স্বপ্ন ছিল,
শান্তির রঙে রাঙাবে আসমানি নীলে
উড়বে শাদা পায়রা অবিনাশী মানবতার গানে।
অথচ ক্লান্ত পৃথিবী, ক্লান্ত মানুষের প্রাণ
বারবার দ্যাখে চোখে- রং বদলায়নি তার!
আদিম আর মধ্যযুগেই
ঘুরপাক খায় কালের শিলালিপি
অমানবিক চিত্রকলা খোদাই করা গায়।
কবিতা-নতুন-আঁচলে
প্রদীপ ভট্টাচার্য
সেও ভেসে যায় গড্ডালিকায়,
দুঃখকে দুঃখ দিয়ে ভাসায়;
এমনি দুঃখ-সুধা তার বুকে।
ফেণিল উচ্ছ্বাসে ডোবায় ফসল,
জীবনের যত লেনদেন, বোঝাপড়া;
নিজের মধ্যে নিজেকে।
অবশেষে অদৃশ্য হাতছানি
মনের হাঁড়িতে ফোটে উষ্ণতায়;
জীবন-মরণ খেলায় মেতে ওঠে।
কতিপয় অবুঝ বালকের মিছিলে,
শ্মশান নেমে আসে মৃত্যু ক্ষুধায়;
পুরনো সেই- নতুন আঁচলে।
করোনারি আর্টারি
দ্বীপ সরকার
হৃৎপিণ্ডের চারপাশে ছড়িয়েছে প্রশাখার নদী-
পরাগের কুসুমে হরদম বেলুনের মতো
বিচলিত ফড়িং সশব্দে নাড়ছে ডানা
ধুকপুকিয়ে ওঠা নদীর ঢেউ মাড়িয়ে
কোথায় যায় রক্তের কুসুমনালির মহাসড়কে-
ক্রীয়াশীল বেলুনে
উঠছে নামছে ইসিজির চিকন চিকন দাগ
তাবৎ রক্ত- জটিল ধাঁধার স্রোতে
কখন আটকে যাবে নীল পদ্ম
তখন আমাকেও থেমে যাতে হবে।
একি তুমি
চিরঞ্জীব চ্যাটার্জী
বিকেলের নির্জন সাগর কিনারে হে বিভ্রম হাঙ্গর,
তোমার উচ্চকিত গ্রীবায় আমি বিনোদন খুঁজি...
কিন্তু আমার উদ্ভাসিত চৈতন্যে তখনই ছেদ পড়ে-
যখন পশ্চাতে শুনি, ‘একি তুমি নারী,
একাকী কেন এই নির্জন সমুদ্রসৈকতে।’
রান্নাবান্না
সায়্যিদ লুমরান
তোমারও নিজস্ব একটা পৃথিবী আছে। তবে এর কোনো ভৌগোলিক
সীমা এবং দ্রাঘিমা নেই।
সেই গ্রহে-
ইচ্ছে হলেই মধ্য দুপুরে সূর্য ডুবিয়ে দিতে পার দীর্ঘ এক ঘুম,
অথবা হতে পার কোনো মৃত বা জীবিতের মুখোমুখি।
ডেকেও আনতে পার শ্রাবণের মাঝামাঝি পৌষকে,
যদি তোমার হঠাৎ শীতের রোদ্দুরকে খুব বেশি মনে পড়ে যায়।
এবং নীলনকশাও আঁকতে পার ঈশ্বরকে হত্যার, আর রূপান্তরের
পর হয়ে উঠতে পার- প্রতিনিধি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী।
রক্তক্ষরণ
নকুল শর্ম্মা
গল্প জমে না চায়ের চুমুকে-
রাহুগ্রাসে হারিয়ে গেছে গল্প বলার উপন্যাস,
ভালোবাসার চোরাগলি বেয়ে হয় না তোমার উপস্থিতি।
চাঁদের মুখে মেঘের ভিটেবাড়ি-
জোছনার আলো ঢাকা পড়েছে বৃষ্টির ঘন বর্ষায়,
আমার বুকে রৌদ্রতপ্ত চৈত্রের বসবাস।
অপেক্ষার দুয়ারে বৈষম্যের খিলকাটি-
অবেলায় ঝরে পড়ে শরতের স্নিগ্ধ শিউলি,
ব্যথার পাহাড়ে উল্টো কাঁটার নির্লজ্জ তিরস্কার।
গান থেমে যায় কণ্ঠের ক্ষত আঘাতে-
হৃদয়ের থরে থরে ভালোবাসার রক্তক্ষরণ,
নির্বাক চেয়ে থাকা সীমাহীন জিজ্ঞাসায় সমুদ্র পানে।
হলুদিয়া পাখি
ইফতেখার হোসেন সিদ্দিকী
সেই কবে কোন ঠিকানায়
বসেছিল এক হলুদিয়া পাখি
গেয়েছিল শুধু বিরহের গান,
কোন পথ ধরে চলে যায়
নক্ষত্র বীথিকা দূর থেকে দূরে
অঘ্রাণে কেউ তো দিয়েছিল শিস
তবুও দূরে যায়, যায় উড়ে।
একচুল
এস ডি সুব্রত
মরতে মরতেও বেঁচে থাকি
আশ্চর্য তুমুল,
আচমকা প্রবল প্রতাপে কীভাবে জানি
নিমেষেই উড়িয়ে দিই
জীবনের যত দুঃখ যন্ত্রণা ভুল,
কেবল অশরীরী ভালো লাগা পেলে একচুল।
বিভাজনের প্রাচীর
আলমগীর কবির
এত কেন বিভেদ চারপাশে।
বিভেদের স্ফুলিঙ্গ পোড়ায় ভালোবাসার দেয়াল।
এত ঘৃণা কেন চারপাশে?
ঘৃণার কাঁটায় রক্তাক্ত হয় মন।
চলতে চলতে থমকে দাঁড়াই!
সামনে দেখি বিভাজনের প্রাচীর!
এত আঁধার কেন চারদিকে
একনিমিষে ঢেকে ফেলে চাঁদের হাসি মুখ!
অথবা অন্য আরও কিছুর জন্য
আল জাবিরী
তোমার কাটাছেঁড়া কথাগুলো
আমি জোড়া লাগিয়ে
তৈরি করি কবিতা।
আমার কবিতা সরলভাবে চলে
ঠিক তোমার মতো।
আবার কখনো সখনো
কবিতার বুক ছিঁড়ে
গজিয়ে ওঠে সবুজ পাহাড়
খেয়াল করলেই দেখবে গহিন অরণ্য
মাঝখানে কলকল করে
ছুটে চলে
সুন্দরী ঝরনাধারা।
কবিতা লিখতে গেলে
বারবার
তোমার কাছে ফিরে আসতে হয়
আমাকে।
হয়তো কোনো জুতসই উপমার জন্য
কিংবা ছন্দের দ্যোতনার জন্য
অথবা
অন্য আরও কিছুর জন্য।
অসহ্য স্বাধীনতা
সাজু কবীর
নাকদড়ি ছেঁড়া ষাঁড় তেড়ে আসে লম্ফঝম্প দিয়ে
তাগড়া ত্রাসে সন্ত্রস্ত পায়রারা উড়াল দেয় নিরুদ্দেশে
ঘুঘুদল নৃত্য ছেড়ে প্রাণভয়ে দ্রুত লুকোয় সরষে খেতে
তীক্ষ্ণ দাঁতে পয়মাল মাঠের সবুজ ভালোবাসা
এ কেমন ইচ্ছেসুখ! বলো, এ কেমন স্বাধীনতা!
অরক্ষিত রক্তবিল যেন জলৌকার সুরক্ষিত গোলাবাড়ি
লালপদ্ম নীল হয়, কাণ্ডে তার শুষ্ক মরুভূমি
খলসে নেই, পুঁটি নেই; বক নেই, নির্বাক ডাহুক ডাহুকি
শ্যাওলার দামে দমবন্ধ বিলের জীবনে পরাজয়ের গ্লানি।
অনুক্ষণ হানা দেয় সংসারের মৌচাকে দুর্বৃত্ত
কাফনমোড়া ইজ্জত মড়িঘরে শুয়ে থাকে নিত্য
বেজন্মা পেশিওয়ালা পাগলা কুকুর হয়ে ছোটে
‘ঘা খাওয়া অধিকার’ প্রতিনিয়ত মাথা কুটে মরে।
লুটেরা জাগ্রত সদা
তল্লাটে তল্লাটে লুট হয় স্বাধীনতা,
লুট হয় নাগরিক, জ্বালার জলে নগর ভাসে
দস্যুদের হুইসিলে ‘মানবিক বন্দর’ থরথর কাঁপে।
সভ্য বলে দাবি করি অথচ নিরুদ্দেশ সভ্যতা
কেউ মারে, কেউ মরে; কেউবা নির্বিঘ্ন, কেউবা শৃঙ্খলে বাঁধা
এ কেমন স্বাধীনতা! এ যেন অসহ্য স্বাধীনতা!
পুড়েছে তো বাংলাদেশের হৃদয়
ইদরিস আলী মধু
মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায় না মাথার ওপর ধোঁয়ার উত্তাপ
সম্মুখে যাওয়া যায় না কাঁটার দেয়াল
টাঙানো
পেছনে ফেরা যায় না দাউদাউ আগুনসন্ত্রাস ঘিরে নেমেছে।
কারা আগুন দিল
কারা মেতে উঠল এমন ঘৃণ্য ধ্বংসলীলায়।
কোনো অগ্নিদাতা জানে কি বত্রিশ নম্বর, জানে কি মুজিব
জানে কি মুক্তিযুদ্ধ
জানে কি বাংলাদেশের ইতিহাস?
বাঙালির প্রাণ, স্বাধীনতার রোপিত স্বপ্ন- বীজ, সৌর্য- বীর্য আর কতক্ষণ জীবিত থাকতে পারে।
দেখতে দেখতে পিতার খাট, আলনা, আলমেরা, চশমা, পাঞ্জাবি, প্রিয় পাইপ, জুতা, সিঁড়িতে রক্তের দাগ পুড়ে ছাই।
কে বলেছে বত্রিশ নম্বর পুড়েছে
পুড়েছে তো বাংলাদেশের হৃদয়।
আজ একটা মহামিলনের দৃশ্য নিজ চোখে দেখবো বলে ঢাকা থেকে ছুটে এসেছি রাজশাহী। রাজশাহী থেকে জেবা আপার গাড়ি নিয়ে তার পরিবার সহ যাচ্ছি নওগাঁর মান্দা উপজেলায়। আমি বসেছি জানালার পাশের সিটে, আমার পাশেই জেবা আপা। গাড়ি চালাচ্ছে আপার একমাত্র ছেলে জোবায়ের, তার পাশের সিটে বসেছে রাশেদ ভাই; জেবা আপার জীবনসঙ্গী।
মান্দার দিকে আমাদের গাড়িটা যত এগিয়ে যাচ্ছে, জেবা আপা যেন ততো অস্থির হয়ে উঠছে, স্বভাবতই তিনি মানুষ হিসেবে ততোটা স্থির প্রকৃতির নন। কতক্ষণ পরপর চোখ মুছছেন আলগোছে। তার যেন আর তর সইছে না। এই অশ্রু অতীতের অনুশোচনার যা তিনি এত বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন, নাকি কাঙ্খিত মানুষটার সঙ্গে দেখা হওয়ার ও ক্ষমা চেয়ে কিছুটা ভারমুক্ত হওয়ার আনন্দের, কে জানে। আমি মাঝেমাঝে তাকিয়ে দেখছি, কিন্তু বলছি না কিছুই। থাক, মানুষটা কাঁদুক আজ, কত কান্না জমিয়ে রেখেছেন তিনি বুকের ভেতর। আজকের দিনে অন্তত তাকে কাঁদতে নিষেধ করবো না। এমনিতেও আমি কাউকে কাঁদতে দেখলে বাঁধা দেই না। সত্যিকারের কান্না সুন্দর, তা প্রকাশ্যে হোক কিংবা অপ্রকাশ্যে।
কয়েক বছর আগে একবার নওগাঁ এসেছিলাম। সেবার পতিসরের রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি আর বদলগাছির পাহাড়পুর বিহার দেখতে এসেছিলাম। তখন আমার ভ্রমনসঙ্গী ছিলো আজকের এই মানুষগুলোই। সেদিনই আপার কাছে প্রথম শুনেছিলাম জুলেখার কথা এবং সেদিনও জুলেখার কথা বলতে বলতে আপা কেঁদে ফেলেছিলো। কিছু কিছু দুঃখ বছরের পর বছর ধরে সজীব থাকে, আমরা কেবল তা চাপা দিয়ে রাখি জীবনের প্রয়োজনে। তারপর বিভিন্ন সময় কথাপ্রসঙ্গে আপা জুলেখার স্মৃতিচারণ করেছে। একজন গৃহপরিচারিকাকেও যে এত ভালোবাসা যায়, তা আপাকে না দেখলে বোঝা কঠিন। তবে জুলেখার সঙ্গে তিনি একটা অন্যায় করে ফেলেছিলেন। সেই অন্যায়ের বয়স প্রায় ঊনত্রিশ বছর।
এত বছরে বহুবার তিনি অনুতপ্ত হয়েছেন, মনে মনে হাজার বার ক্ষমা চেয়েছেন জুলেখার কাছে, কিন্তু জুলেখাকে খুঁজে বের করে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস পাননি কখনো। আজ যখন তার বয়স ষাট পেরিয়েছে, শরীরে দানা বেঁধেছে নানাবিধ অসুখ, তখন তার খুব করে মনে হচ্ছে একবার জুলেখার সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমা না চাইতে পারলে সে মরেও শান্তি পাবে না। তার ইচ্ছে পূরণ করতেই রাশেদ ভাই কষ্ট করে জুলেখার বর্তমান ঠিকানা যোগাড় করেছেন। আজ সেই ঠিকানার উদ্দেশ্যেই যাত্রা।
জেবা আপার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ভার্চুয়াল জগতে। তবে সম্পর্ক যেন কিছুটা আপন বোনের মতো। আপার কাছে জুলেখার গল্প শুনতে শুনতে কোথাও একটা আমারও মায়া পড়ে গিয়েছিলো। আমার মনে হতো, আপার মতো আমিও তার সঙ্গে অন্যায় করে ফেলেছি, আমারও দেখা করা দরকার তার সঙ্গে। এমন কেন মনে হতো জানি না। হয়তো দরিদ্র হতভাগ্য জুলেখার সঙ্গে যেই অন্যায় আচরণ করেছিলো আপা, যার জন্য জুলেখা তীব্র অভিমান আর কষ্টে রাতের অন্ধকারে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়েছিলো, অবচেতন মনে আঁকা জুলেখার সেই অসহায় করুণ মুখ আমার ভেতর ঘরে কড়া নাড়তো নিঃশব্দে। আর তাই আমাকে যখন বলা হলো জুলেখার খোঁজ পেয়েছে অবশেষে, দেখা করতে যাবে মান্দাতে, ছুটে এলাম সবকিছু ফেলে। এই মহামিলনের দিন আমাকে যে উপস্থিত থাকতেই হবে।
১৯৯২ সাল। রাশেদ ভাইয়ের চাকরি ট্রান্সফার হলো নওগাঁ জেলায়। জেবা আপার সঙ্গে তার যৌথ জীবন প্রায় চার বছরের তখন। নওগাঁ শহরেই তার কর্মস্থল বা অফিস। কাজের প্রয়োজনে যদিও নওগাঁর সব উপজেলাতেই তাকে যেতে হতো, তবে অফিস শহরে থাকায় বাসা ভাড়াও নিলেন শহরে। নওগাঁর ঐ বাসায় জেবা আপা আর রাশেদ ভাই ছাড়া কেউ থাকতো না। রাশেদ ভাইয়ের অফিস থেকে ফেরার কোনো নির্দিষ্ট সময় ছিলো না। কাজের জন্য তাকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো, কাজের চাপ থাকলে সময়ের কোনো ঠিকঠিকানা থাকতো না, মাঝেমাঝে ফিরতে বেশ রাতও হতো। যদিও এসব চাপ চাইলেই অনেকটা এড়িয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু তিনি তার কাজের প্রতি সৎ থাকতেন সবসময় এবং কাজটাকে খুব ভালোওবাসতেন, তাই নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই এত পরিশ্রম করতেন। আর কেউ না থাকার দরুণ তিনি অফিসে চলে গেলে আপাকে একাই থাকতে হতো বাসায়।
এভাবে সময় কাটতে চাইতো না। আর তাছাড়া রাশেদ ভাইয়ের যখন ফিরতে দেরি হতো, তখন নতুন শহরে সন্ধ্যের পর ঐ খালি বাসায় আপা ভয় পেতো। এদিকে নওগাঁ যাওয়ার কিছুদিন পরই আপা গর্ভধারণ করে প্রথমবারের মতো। তখন আপা রাশেদ ভাইকে জানায়, সর্বক্ষণ তার পাশে থাকার জন্য এবং সব কাজ করে দেওয়ার জন্য একজন গৃহপরিচারিকা যেন রাখা হয়। তারপর রাশেদ ভাই তার অফিসের বাগানের মালিকে বলে একজন কাজের লোক খুঁজে দিতে। মালির বাড়ি ছিলো মান্দা উপজেলায়। তার গ্রামের এক দরিদ্র মেয়ে জুলেখা, বয়স বারো কিংবা তেরো। ঐটুকু বয়সে একজন মানুষ ছুটে বেড়াবে, মা-বাবার আদরে আহ্লাদে থাকবে, স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে করতে বড় হতে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দারিদ্র্যের অস্বাভাবিকতায় জুলেখা মান্দার বেনীমাধবপুর গ্রামের সবুজ ছেড়ে এসে পড়লো নওগাঁ শহরে গৃহপরিচারিকার কাজে। যদিও নওগাঁ ছিমছাম, শান্ত সুন্দর শহর। সেখানেও আছে সবুজের সমারোহ। তবুও বেনীমাধবপুর গ্রামে যেই প্রাণ চঞ্চলতা ছিলো, তা কী আর শহরে মেলে। ঐটুকু বয়সে কারো শেকড় ছেড়ে আসার কথা নয়, কিন্তু জীবনের চাকা ঘোরানোর প্রয়োজনে কত কী ছেড়ে আসতে হয় হতভাগ্য মানুষদের!
জেবা আপার চড়ুই পাখির সংসার। খুব বেশি কাজ ছিলো না। তবে তিনি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করতেন। তাই জুলেখাকে সবসময় বাড়িঘর চকচকে রাখতে হতো। রোজকার রান্নাও তাকে করতে হতো। যদিও রান্নায় পটু হবার মতো বয়স তার ছিলো না, তবে যা রান্না করতো তাতে চালিয়ে নেওয়া যেতো। জেবা আপা তাকে বলে বলে নতুন নতুন রান্না শেখাতেন। গর্ভাবস্থায় অনেককিছুই খেতে ইচ্ছে হয় কিংবা খাওয়াটা প্রয়োজন, জুলেখা সেসব রান্না করে দিতো, না পারলে শিখে নিতো। অবসর সময়ে দুজন মিলে গল্প করতো। জেবা আপা বরাবরই খুব গল্পপ্রিয় মানুষ, তিনি কথা বলতে খুব ভালোবাসেন। যদিও জুলেখার সঙ্গে তার বেশ কিছুটা বয়সের ব্যবধান ছিলো, তবুও বাসায় যেহেতু আর কেউ থাকতো না সারাদিন, তাই দুজন মিলেই রাজ্যের গল্প করতো।
দেখতে দেখতে সময় ঘনিয়ে এলো। জেবা আপার কোলে স্বর্ণকমল ফুটিয়ে হেসে উঠলো জোবায়ের। রাশেদ ভাই আর জেবা আপার প্রেমের বিয়ে। বউকে খুব ভালোবাসতেন বলেই তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে ছেলের নাম রেখেছিলেন। জোবায়ের হওয়ার পর আপার পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তার জানায়, আপা আর কোনদিন সন্তান গ্রহণ করতে পারবে না। এমনিতেই প্রথম সন্তান নিয়ে আদর আহ্লাদের সীমা থাকে না, তারওপর মেনোপজ হয়ে যাওয়ার দরুণ এই একমাত্র সন্তান নিয়ে আপা খুব সেনসিটিভ হয়ে পড়েছিলেন। সবার কোলে জোবায়েরকে দিতেন না, নিজের কাছে রাখতে চাইতেন বেশি বেশি। জোবায়ের একটু ব্যথা পেলেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। একমাত্র ছেলের কান্না তো দূরের কথা; একটু মলিন মুখও যেন তার সহ্য হতো না। না চাইতেই ছেলের সামনে সবকিছু এনে হাজির করতেন। পৃথিবীর যেকোনো কিছুর বিনিময়ে তিনি তার সন্তানকে আনন্দে রাখতে চাইতেন।
অন্য কাউকে ততোটা ভরসা করতে না পারলেও রাশেদ ভাই আর জুলেখাকে তিনি খুব ভরসা করতেন। কিন্তু রাশেদ ভাই তো সময় পেতেন না তেমন, তাই জুলেখাই ছিলো তার সবচেয়ে বড় সহায়। আস্তে আস্তে জোবায়ের বড় হতে থাকলো, কথা বলতে শিখলো, দাঁড়াতে শিখলো, হাঁটতে শিখলো। মাত্র আড়াই বছর বয়সে তেইশটা বাংলা ছড়া মুখস্ত করে ফেললো সে। এর পেছনে অবশ্য পুরো অবদানটাই জুলেখার। সে খুব যত্ন করে রোজ জোবায়েরকে ছড়া শিখিয়েছে। একজন বাচ্চা লালন পালন করতে যাবতীয় যা কাজ করা দরকার, সবই সে করেছে। জোবায়েরের সঙ্গে তার সম্পর্কের বন্ধনটা ছিলো অন্যরকম। সে হয়তো তাকে মনিবের সন্তান হিসেবে মানুষ করেনি, নিজের ভাইয়ের মতো ভেবেই আদর যত্নে বড় করেছে একটু একটু করে। আসলে একদম শেকড় থেকে কোনো বাচ্চাকে লালনপালন করতে শুরু করলে তার প্রতি একটা নাড়ির মতো টান তৈরি হয়ে যায়। জুলেখারও তাই হয়েছিলো। জোবায়েরকে ছাড়া সে এক মুহূর্তও থাকতে চাইতো না। তাকে কখনো যদি বলা হতো মান্দাতে নিজের গ্রামে গিয়ে ঘুরে আসতে, সে যেতে চাইতো না জোবায়েরকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে তাই। জোবায়েরের অবশ্য জুলেখার কথা কিছুই মনে নেই। ঐ বয়সের কোনো স্মৃতি সাধারণত মনে থাকে না কারো। তবে সে তার মা-বাবার কাছে জুলেখার গল্প শুনে শুনে একটা আত্মিক টান অনুভব করে। সেও চায়, যে তাকে মাতৃস্নেহে কয়েকটা বছর লালনপালন করেছে, তার সঙ্গে জীবনে একবার হলেও দেখা হোক। জোবায়ের শুনেছে, সে নাকি জুলেখাকে জুলেখা বলে ডাকতে পারতো না, জোহা বলে ডাকতো। সে ভেবে রেখেছে, কখনো দেখা হলে তাকে ছোটবেলার মতো জোহা বলেই ডাকবে, তারপর জড়িয়ে ধরবে বুকের ভেতর।
১৯৯৫ সাল। নওগাঁতে এক রাতে বিনা নোটিশে বন্যার প্লাবনে ভেসে গেলো সব। ছোট যমুনার উপচে পড়া পানি ছড়িয়ে পড়লো শহর, গ্রাম সব জায়গায়। জেবা আপারা যেই বাসায় থাকতো, সেটা ছিলো দোতলা বাসা। এক রাতের ভেতর তাদের বাসার নিচতলা পানিতে ভরে গেলো। ভাগ্যিস তারা দোতলায় থাকার দরুণ ঘরের ভেতর পানি প্রবেশ করতে পারেনি। জোবায়েরের তখন তিন বছর বয়স। রাশেদ ভাইয়ের সরকারি চাকরি, অফিস ছুটি দেয়নি, বন্যার পানি ভেঙে রোজ অফিস করতে যেতে হয়। আপাদের বাসার পেছনে ছিলো একটা জামরুল গাছ। সেই গাছের সাথে একটা দশ বারো বছর বয়সী ছেলে রোজ নৌকা বাঁধতো। সেই নৌকাতেই রাশেদ ভাই অফিসে যাতায়াত করতো। একদিন আপা তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘রোজ নৌকায় মানুষ পারাপার করে সারাদিনে কত টাকা পাও’? ছেলেটা বললো, ‘একশ টাকার মতো’। তারপর আপা তাকে বললো, ‘তোমাকে রোজ আমি একশ টাকা দিবো, তুমি রাশেদকে আনা নেওয়া করা ছাড়া বাকিটা সময় এখানেই নৌকা নিয়ে বসে থাকবে। বাকি যাদের দরকার তারা অন্য নৌকায় পার হবে, সমস্যা নেই’। ছেলেটা রাজি হয়ে গেলো। আসলে ঐ ভয়াবহ বন্যার সময় কখন কী প্রয়োজন হয় কিংবা কখন কী বিপদ আপদ হয়, তা তো বলা যায় না। সেই আশঙ্কা থেকেই ছেলেটাকে কাছে কাছে থাকতে বলা, যাতে প্রয়োজনে ডাকলেই সহযোগিতা পাওয়া যায়।
বন্যার ভেতর একদিন রাতে শুরু হলো ঝুমবৃষ্টি। বিরামহীন বৃষ্টি নেমেই যাচ্ছে, থামার কোনো লক্ষণ নেই। বৃষ্টির জন্য সেই রাতে রাশেদ ভাই বাসায় ফিরতে পারলেন না, থেকে গেলেন তার কলিগদের কোয়ার্টারে। তখন তো এমন মোবাইল ফোন ছিলো না, টেলিফোন আর চিঠির যুগ ছিলো, টেলিফোনও সব জায়গায় সহজলভ্য ছিলো না। রাশেদ ভাইয়ের কোনো খোঁজ না পেয়ে জেবা আপা চিন্তায় অস্থির হয়ে গেলেন। এদিকে বন্যার জন্য বিগত কয়েকদিন ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে সর্বত্র। হারিকেন জ্বলছে ঘরের এক কোণে। অন্ধকার রাতে বৃষ্টির বিরামহীন শব্দে জোবায়ের ভয় পেয়ে ক্রমাগত কেঁদেই যাচ্ছিলো। জুলেখা কিছুতেই তাকে শান্ত করতে পারছিলো না। নৌকার মাঝি যেই ছেলেটা, বল্টু তার নাম, তাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো বৃষ্টির জন্য সে তার নিজের বাড়িতে চলে গেছে। জেবা আপা ঘরময় পায়চারি করছিলো, জানালা খুলে বারবার দেখার চেষ্টা করছিলো রাশেদ ভাই আসে কিনা। বাইরে বিদ্যুৎ চমকানোর আলো জ্বলতে থাকলেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলো না জেবা আপা। রাশেদ ভাইয়ের কোনো বিপদ হলো কিনা, সেই ভেবে তার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছিলো।
তখন প্রায় মধ্যরাত। জোবায়েরের কান্না কিছুটা কমেছে, তবে সে ঘুমাতে পারছে না ভয়ে। কোনো খাবারই সে খেতে চাচ্ছিলো না। জোবায়েরের খিচুড়ি পছন্দ বলে সেই মধ্যরাতেই জুলেখা ওর জন্য পাতলা খিচুড়ি রান্না করে। একদম গরম খিচুড়ি চুলা থেকে নামিয়ে বাটিতে করে জোবায়েরের সামনে নিয়ে আসে। খিচুড়ি একটু ঠান্ডা হলেই সে খাওয়াতো। কিন্তু খিচুড়ি দেখে যাতে জোবায়ের খুশি হয়, কান্না থামায়, তাই দেরি না করে গরম খিচুড়িই নিয়ে আসে। দেখা মাত্রই চোখের পলকে জোবায়ের সেই গরম খিচুড়ির ভেতর হাত ডুবিয়ে দেয়। আর তারপরই তার ভয়ানক চিৎকার শুরু হয়। জেবা আপা আর জুলেখা দুজনই ঘটনার আকস্মিকতায় খাবড়ে যায়। গরমে জোবায়েরের হাত পুড়ে যায়। বাসায় কোনো ঔষধ না থাকায় কিছুতেই তার যন্ত্রণা কমানো যায় না। বন্যার ভেতর ঐ বৃষ্টির রাতে কাউকে দিয়ে যে ঔষধ আনিয়ে নেবে, সেই উপায়ও নেই। রাগে, দুঃখে সেই রাতে জেবা আপা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। প্রথমে জোরে একটা চড় বসিয়ে দেয় জুলেখার গালে। তারপর বাটির সেই গরম খিচুড়ি জুলেখার মাথায় ঢেলে দেয়। শুধু তাই নয়, রান্নাঘর থেকে পাতিল এনেও পুরো খিচুড়িটা তার গায়ে ঢেলে দেয়, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে জুলেখাকে। শারিরীক আর মানসিক যন্ত্রণায় জুলেখা কুঁকড়ে যেতে থাকে। সেদিন শারিরীক কষ্টের চেয়ে সে বোধয় মানসিক কষ্টই পেয়েছিলো বেশি। তাই শরীরের দহনজ্বালা নিয়েও সে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে সব অপমান, অবজ্ঞা সহ্য করেছে। তার দুচোখ বেয়ে ঝরেছে ব্যথাদের অশ্রু, কিন্তু সে একটা টুঁ শব্দও করেনি।
ভোররাতের দিকে জোবায়েরকে কোনরকমে ঘুম পাড়ানো গেলে ক্লান্তিতে জেবা আপারও চোখ বুজে আসে। সকালে যখন ঘুম ভাঙে, তখন বৃষ্টি শেষে ধবধবে পরিবেশ চারপাশে, পেছনের দরজা খোলা, জুলেখা নেই কোথাও। জুলেখার থাকার ঘরে সবকিছু যেমন ছিলো, তেমনই পড়ে আছে। জেবা আপার বুঝতে আর কিছু বাকি রইলো না। ঐ বৃষ্টির রাতে বন্যার থইথই পানি ভেঙে জুলেখা চলে গেছে। অনেক অভিমানে বুকভরা কষ্ট নিয়ে শত শত বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় নিয়ে সে চলে গেছে। সে আর ফিরবে না কোনদিনও!
ঐদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে রাশেদ ভাই সব জানতে পেরে ব্যথিত হয়। জেবা আপাকে বলেন, ‘তুমি কাজটা একদম ঠিক করোনি। জানি তোমার মাথা ঠিক ছিলো না, তাই বলে যেই ছোট্ট মেয়েটা এই কয়েকটা বছর আমাদের এত উপকার করলো, জোবায়েরকে এত স্নেহ দিয়ে লালনপালন করলো, তার সঙ্গে এমন অমানবিক আচরণ করা ঠিক হয়নি। এটা ওর প্রাপ্য নয়। তোমার ক্ষমা চাওয়া উচিত ওর কাছে’। মাথা ঠান্ডা হওয়ার পর জেবা আপা বলেছিলো, ‘বন্যা শেষ হোক, তারপর ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। মান্দাতে যাবো ওর কাছে ক্ষমা চাইতে’।
কিন্তু জেবা আপার আর মান্দা যাওয়া হয়নি। কারণ, বন্যার পরই রাশেদ ভাইকে নওগাঁ থেকে ট্রান্সফার করে দেয়া হয় রংপুরে। বদলি হয়ে চলে যাওয়ার ব্যস্ততায় আর সময় সুযোগ হয়ে ওঠেনি জুলেখার কাছে যাওয়ার। এ জগৎ সংসারে জুলেখারা তো ততোটাও গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, তাদের কাছে ছুটে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার একটা আভ্যন্তরীণ তাড়া থাকবে!
দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর কেটে যায়। জোবায়ের এখন তার বাবার মতো প্রকৌশলী হয়ে বেরিয়েছে সদ্য। রাশেদ ভাইয়ের চুল পেকে গেছে অনেকটা। জেবা আপা বাইরে থেকে আগের মতোই ফিটফাট দেখতে, তবে তার ভেতরে বয়স বাড়ার মাশুলস্বরূপ কিছু অসুখ বাসা বেঁধেছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই আপা ভাবছিলো জুলেখাকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করে ক্ষমা চাইবে। রাশেদ ভাই কয়েক জেলা ঘুরে এখন কিছু বছর যাবৎ রাজশাহীতে আছেন, এখানেই বাড়ি গাড়ি করে থিতু হয়েছেন, সামনেই তার অবসরে যাওয়ার সময়। বউয়ের কথা রাখতে সে অনেক কষ্টে খুঁজে বের করেছে নওগাঁ অফিসের সেই বাগানের মালীকে। তিনিই তাকে জানিয়েছেন, জুলেখা এখনো মান্দাতেই আছেন। তবে মা-বাবার বাড়িতে নেই, বৈবাহিক কারণে স্বামীর বাড়িতে থাকে, বেনীমাধবপুরের পাশের গ্রাম শালবনীতে।
আমরা প্রথমে বেনীমাধবপুরে গেলাম। সেখান থেকে ঐ মালী চাচাকে নিয়ে চললাম শালবনীর দিকে। তিনি আমাদের একটা দারিদ্র্যের ছাপ লেগে থাকা মলিন বাড়ি দেখিয়ে গাড়ি থামাতে বললেন। মালী চাচার মতো আমরেও সবাই কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম, বাড়ি ভর্তি এত মানুষ কেন? জেবা আপার মনে কু ডাক ডাকতে শুরু করেছে। তার পা যেন আর চলছে না। তবু কষ্ট করে নিজের শরীরটাকে বয়ে নিয়ে শালবনীর সেই ঝরা পাতার উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সেখানে ধবধবে সাদা কাফনে জড়ানো একটা মৃতদেহ ঘিরে বসে আছে কিছু মানুষ। জানতে দেরি হলো না, এত বছর ধরে যার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থেকেছেন, যার জন্য ছুটে এসেছেন এতটা পথ, সে স্বর্গের পাখি হয়ে উড়ে গেছে আজ দুপুরের নির্জনতায়। জেবা আপা কান্নায় ভেঙে পড়লেন, আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। রাশেদ ভাই নিঃশব্দে চোখ মুছছে আর মালী চাচাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘এটা কী হলো চাচা? এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না’। জোবায়েরের গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে আছে। জোহা বলে ডেকে আর জড়িয়ে ধরা হলো না মানুষটাকে। জুলেখা দেখতে পেলো না তার ছোট্ট জোবায়ের আজ কত বড় হয়ে গেছে। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছি জেবা আপাকে ধরে। যেই জুলেখাকে কোনদিন দেখিনি, তার জন্য আমার ভেতরের পৃথিবীটা যেন ওলটপালট হয়ে গেলো। কী অসীম শক্তি এই অব্যখ্যায়িত ভালোবাসার!
জেবা আপাকে নিয়ে গেলাম জুলেখার কাছে। সে কাফনের কাপড় সরিয়ে জুলেখার মুখটা দেখলো, হাত বুলালো সারা মুখে। বারো-তেরো বছর বয়সী সেই হতদরিদ্র অভাগী জুলেখার জন্য তার অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগলো বুকের ভেতর। কিছুতেই তার কান্না থামছে না। জুলেখার কাছে ক্ষমা চাইতে না পারার আক্ষেপ তাকে অনেক বেশি ভেঙে দিয়ে গেলো এক মুহূর্তে। জুলেখা সারাজীবন একটা ক্ষত বয়ে বেড়ালো, ভুল বুঝলো তাকে, সেই ভুল ভাঙানোর আর সুযোগ হলো না। জুলেখা জানতেও পারলো না কত অজস্র রাতদিন জেবা আপা অনুশোচনায় ভুগেছে, কত আশা নিয়ে সে তার কাছে ছুটে এসেছিলো একটু ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়ার জন্য। আরেকটু সময় বেঁচে থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো? এই প্রশ্নের উত্তর জেবা আপার মতো আমিও জানি না। শুধু জানি, জুলেখা একটা আশ্চর্য প্রদীপ হয়ে আমাদের মনে জেগে থাকবে চিরকাল!
শালবনীতে সন্ধ্যা নামছে। কুপিবাতি জ্বালানো হয়েছে জুলেখার ঘরে। কিন্তু আজ সে গৃহে প্রবেশ করবে না, তার ঠিকানা বদলে গেছে। বাড়ির পেছনে একটা বাঁশের ঝাড়, তার সাথে কলতলা, ফসলের মাঠ। সেখানেই জুলেখার জন্য একটু জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছে। ঐ বৃষ্টির রাতে তুমুল অভিমান আর যন্ত্রণায় যেই ছোট্ট জুলেখা জেবা আপার ঘর ছেড়েছিলো, তাকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে কবরে শায়িত হতে দেখছেন তিনি। সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে। আমি বললাম, ‘ফিরে চলো আপা। এখানে আর তোমার কোনো পিছুটান রইলো না’। রাশেদ ভাই চিরকালই জেবা আপার অনুভূতিকে যত্নে লালন করেন। তিনি বললেন, ‘তুমি কী আজকের রাতটা জুলেখার এই বাড়িতে থেকে যেতে চাও? তাতে কী তুমি একটু প্রশান্তি পাবে? তাহলে আমরা থেকে যাবো’। জেবা আপা উঠে দাঁড়ালো। জুলেখার কবর থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে নিজের আঁচলে বাঁধলো। তারপর জোবায়েরকে বললো, ‘গাড়িতে উঠে বসো। আমরা এক্ষুনি চলে যাবো’। আমরা সবাই গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করলো। গোটা রাস্তায় জেবা আপা একটা কথাও বললেন না। বাকিরাও প্রয়োজন ছাড়া কথা বললো না। সবাই এক একটা ব্যথার পাহাড় বুকের ভেতর নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলো রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। পেছনে পড়ে রইলো শালবনী, বেনীমাধবপুর আর আমাদের জুলেখা!
যদি কোনদিন পাখি জীবন ক্লান্ত লাগে তোমার,
ডানায় একাকীত্বের অসুখ বাসা বাঁধে,
আমার অভাববোধ তোমাকে পীড়া দেয়,
ডাকতে দ্বিধা করো না,
আমি ফিরবো।
যদি কখনো পূর্বজদের ফসিল খুঁজে পাও,
মনে হয়- আগের জন্মে তুমি আমার ছিলে,
ফিরতি পথে পা না বাড়াতে পারো,
অন্তত আমাকে অনুভব করো,
আমি ফিরবোই।
কখনো তোমার তুমুল উল্লাসে ভেসে যাওয়া জীবনের কাছে ফিরবো না।
সেখানে আমার প্রয়োজন নেই, আমি বুঝি।
আমি ফিরবো তোমার দুঃখমেদুর দিনে,
হরিণদৌঁড়ের সমাপ্তিতে।
তুমি ডাকলে আমাকে ফিরতেই হবে!
ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে মধুমালতী গাছটা।পশ্চিমের বারান্দায় বিকেলের রোদটা ঠিকরে পড়ছে সেই ফুলের উপর। রং বেরঙের ফুটন্ত ফুলের উপর রোদের খেলাটা চোখে এসে বিধছে অসহনীয়ভাবে আজ। তার উপর দিয়েই অপলক তাকিয়ে আছেন কবির স্যার।কত বছর এমন দৃশ্য দেখেননি তিনি তার হিসাব নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তার সময় কাটে ছাত্র ছাত্রী আর পড়ানোর ব্যস্ততায়।আকাশের এমন রূপ দেখার সময়ও হয় না তেমন।এতকাল শরতের আকাশ নিয়ে যত সাহিত্য রচিত হয়েছে, যত ছড়া কবিতা পড়েছেন তার সাথে আজকের আকাশের কোনো মিল নেই। নেই শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশ।নেই আকাশ জুড়ে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি। নেই শুভ্র কাশঁবনের দেখা।মনে হচ্ছে চির চেনা সেই শান্ত নীল আকাশটা এতকাল পুষে রাখা রাগটা উগরে দিচ্ছে রাক্ষসী বর্ণচ্ছটায়।
এ কোন শরতের মুখোমুখি মানুষ আজ!এই শেষ বয়সে এমন এক সময়ের সাক্ষী হতে হবে তা কল্পনাও করেননি।ভাবতে ভাবতেই চোখে জল এসে যায় কবির স্যারের।এই জনপদে তার জন্ম,বেড়ে ওঠা এবং আজ পৌঢ়ত্বে। সবুজের সমারোহে আন্দোলিত এই জন্মভূমি ছেড়ে কোথাও যাননি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও।নিজ পরিশ্রমে এই বাড়িটি করেছেন গ্রামের শেষ দিকে যার পাশ ছুঁয়ে গেছে দীঘল মাঠ।সকালে ঘুম থেকে উঠে যেনো মাঠের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন সেজন্য দোতলার বারান্দাটা গুছিয়ে করেছেন মাঠের দিকে।প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার অভিপ্রায়ে সব আয়োজন ।
নিজ হাতে কত ছেলেমেয়েদের জীবন গড়েছেন তিনি।এইতো কদিন আগেও সময় কেটেছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে। রাতের শেষ ব্যাচটা যখন শেষ করেন তখন প্রায় রাত ন'টা বাজে।নিজের সবটুকু জ্ঞান ও বোধ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছে থেকে এ বয়সে এসেও বাচ্চাদের পড়ান তিনি।যে যত টাকা পারে তাই দেয়।অবসর সময়টুকু বাচ্চাদের সাথে কাটানোর আনন্দে সব ভুলে যান তিনি।বয়সের ভার তাকে ক্লান্ত করতে পারে না। সেদিনও বাচ্চাদের বিদায় দিয়ে বাসায় ফেরেন প্রতিদিনের মত কিন্তু সকালটা আর প্রতিদিনের মত হয়নি।মধ্যরাতে গভীর ঘুমের মাঝেই বন্যার পানি ছুটে আসতে থাকে। ভারতের বাঁধভাঙা পানির প্রবল স্রোতে কাচা, আধাপাকা,টিনসেড বাড়িগুলো দুমড়ে মুচড়ে যায় মাটির সাথে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্লাবিত হয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম।গবাদি পশু হাস-মুরগি ভেসে যায় রাক্ষসী স্রোতে।কে কোথায় কিভাবে আছে তার কোনো খবর নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সারা দেশের মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।সাধ্যমত উদ্ধার করেছে।কে কোন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে তা জানা যায়নি। কবির স্যার কিছুতেই ভুলতে পারেন না রাতে বিদায় দেয়া সেই ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখগুলো। পানি কিছুটা নেমে যাওয়ার পর কিছু খবর পাওয়া গেছে। স্যারের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী ছিল গরীব অসহায় যাদের বাড়িঘর কাচা মাটির বা টিনসেড।আর এ ধরনের ঘরগুলো বন্যার পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে দূর কোনো সাগরে,সাথে নিয়ে গেছে ঐ ঘরের মানুষগুলো।চিরচেনা সেই জনপদ আজ বন্যার জলে ঢাকা পড়েছে। বারান্দা থেকে যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি।এতটুকু সবুজের চিহ্ন নেই।তীর্যক রোদটা স্যারের চোখের জলের উপর পড়ে চিকচিক করছে বারান্দার ওপারের জলেঢাকা মাঠের মতই।