ঢাকা ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪

সম্বোধন

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:২৮ পিএম
আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৩৩ পিএম
সম্বোধন

জনাব,
আজ শুক্রবার, আমি তো ছুটিতে,
লইব সময় খানিক ঘুম থেকে উঠিতে!
আপনি কি জেগেছেন নাকি শয্যায়?
কীভাবে যে বলিব কিঞ্চিৎ লজ্জায়!
প্রাতঃকাজ সারিয়া একটু বেলায়
যখন বেরোবেন টানিতে বিড়িখানা,
মুঠোফোনে লইবেন খবর, ঘটিয়াছে কিছু কি-না!
না না তেমন তাড়া নেই, ধীরে লইলেই হইবে
যখন বিষয়টা সবাই সবিস্তারে কইবে!
চঞ্চল করিবেন না মন, কহিলাম বলে কথাটা
বুঝিবেন যেন, এটাই হলো সততা!
জ্ঞানীগুণীরা সবাই চলিয়াছে ধীরে
আমরা কেন হারাইয়া যাইব, বর্তমানের ভিড়ে?
যে বোঝে সে অপেক্ষা করিবে আমার মুখপানে
আমি যে অনন্য, গুণীমান্যিরা তা জানে!
আবারও বলি, ভাইসাব
সময় করিয়া যদি লইতেন খবর
সর্বজনের উপকার হইত জবর!

শরতের এক বিকেলে

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:১৭ পিএম
আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ১০:২৯ পিএম
শরতের এক বিকেলে
অলংকরণ : মেহেদী হাসান

ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে মধুমালতী গাছটা।পশ্চিমের বারান্দায় বিকেলের রোদটা ঠিকরে পড়ছে সেই ফুলের উপর। রং বেরঙের ফুটন্ত ফুলের উপর রোদের খেলাটা চোখে এসে বিধছে অসহনীয়ভাবে আজ। তার উপর দিয়েই অপলক তাকিয়ে আছেন কবির স্যার।কত বছর এমন দৃশ্য দেখেননি তিনি তার হিসাব নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তার সময় কাটে ছাত্র ছাত্রী আর পড়ানোর ব্যস্ততায়।আকাশের এমন রূপ দেখার সময়ও হয় না তেমন।এতকাল শরতের আকাশ নিয়ে যত সাহিত্য রচিত হয়েছে, যত ছড়া কবিতা পড়েছেন তার সাথে আজকের আকাশের কোনো মিল নেই। নেই শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশ।নেই আকাশ জুড়ে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি। নেই শুভ্র কাশঁবনের দেখা।মনে হচ্ছে চির চেনা সেই শান্ত নীল আকাশটা এতকাল পুষে রাখা রাগটা উগরে দিচ্ছে রাক্ষসী বর্ণচ্ছটায়। 

এ কোন শরতের মুখোমুখি মানুষ আজ!এই শেষ বয়সে এমন এক সময়ের সাক্ষী হতে হবে তা  কল্পনাও করেননি।ভাবতে ভাবতেই চোখে জল এসে যায় কবির স্যারের।এই জনপদে তার জন্ম,বেড়ে ওঠা এবং আজ পৌঢ়ত্বে। সবুজের সমারোহে আন্দোলিত এই জন্মভূমি ছেড়ে কোথাও যাননি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও।নিজ পরিশ্রমে এই বাড়িটি করেছেন গ্রামের শেষ দিকে যার পাশ ছুঁয়ে গেছে দীঘল মাঠ।সকালে ঘুম থেকে উঠে যেনো মাঠের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন সেজন্য দোতলার বারান্দাটা গুছিয়ে করেছেন মাঠের দিকে।প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার অভিপ্রায়ে সব আয়োজন । 

নিজ হাতে কত ছেলেমেয়েদের জীবন গড়েছেন তিনি।এইতো কদিন আগেও সময় কেটেছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে। রাতের শেষ ব্যাচটা যখন শেষ করেন তখন প্রায় রাত ন'টা বাজে।নিজের সবটুকু জ্ঞান ও বোধ  ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছে থেকে এ বয়সে এসেও বাচ্চাদের পড়ান তিনি।যে যত টাকা পারে তাই দেয়।অবসর সময়টুকু বাচ্চাদের সাথে কাটানোর আনন্দে সব ভুলে যান তিনি।বয়সের ভার তাকে ক্লান্ত করতে পারে না। সেদিনও বাচ্চাদের বিদায় দিয়ে বাসায় ফেরেন প্রতিদিনের মত কিন্তু সকালটা আর প্রতিদিনের মত হয়নি।মধ্যরাতে গভীর ঘুমের মাঝেই বন্যার পানি ছুটে আসতে থাকে। ভারতের বাঁধভাঙা পানির প্রবল স্রোতে কাচা, আধাপাকা,টিনসেড বাড়িগুলো দুমড়ে মুচড়ে যায় মাটির সাথে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্লাবিত হয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম।গবাদি পশু হাস-মুরগি ভেসে যায় রাক্ষসী স্রোতে।কে কোথায় কিভাবে আছে তার কোনো খবর নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সারা দেশের মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।সাধ্যমত উদ্ধার করেছে।কে কোন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে তা জানা যায়নি। কবির স্যার কিছুতেই ভুলতে পারেন না রাতে বিদায় দেয়া সেই ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখগুলো। পানি কিছুটা নেমে যাওয়ার পর কিছু খবর পাওয়া গেছে। স্যারের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী ছিল গরীব অসহায় যাদের বাড়িঘর কাচা মাটির বা টিনসেড।আর এ ধরনের ঘরগুলো বন্যার পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে দূর কোনো সাগরে,সাথে নিয়ে গেছে ঐ ঘরের মানুষগুলো।চিরচেনা সেই জনপদ আজ বন্যার জলে ঢাকা পড়েছে। বারান্দা থেকে যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি।এতটুকু সবুজের চিহ্ন নেই।তীর্যক রোদটা স্যারের চোখের জলের উপর  পড়ে চিকচিক করছে বারান্দার ওপারের জলেঢাকা মাঠের মতই।  

শাহ আবদুল করিমের গানে দেহতত্ত্ব ও সমাজ ভাবনা

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:১৩ পিএম
আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ১০:২৯ পিএম
শাহ আবদুল করিমের গানে দেহতত্ত্ব ও সমাজ ভাবনা
অলংকরণ : মেহেদী হাসান

বাউল গানের অন্যতম কিংবদন্তি লোকায়ত ধারার সাধক বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন তার ঘটনাবহুল প্রায় শতবর্ষী জীবন। কিশোর বয়সে অভাবের সংসারে বেড়ে উঠেছেন বাউল আব্দুল করিম। নিত্য টানাটানির সংসারে হাল ধরতে গিয়ে গ্রামের গৃহস্থের বাড়িতে গরু রাখালের কাজ করেছেন বাউল সাধক শাহ আবদুল করিম। লোক সংস্কৃতির আধার হাওরকন্যা সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ধল আশ্রম গ্রামে ১৯১৬ খ্রি. এর ১৫ ফেব্রুয়ারি (বাংলা ১৩২২ সালের ফাল্গুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার) জন্মগ্রহণ করেন বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম । পিতার নাম ইব্রাহিম আলী এবং মাতার নাম নাইওরজান বিবি। পরবর্তী সময়ে ধল আশ্রম গ্রামের পার্শ্ববর্তী উজান ধল গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। নিজ গ্রামের নৈশ বিদ্যালয়ে মাত্র আট রাত্রি পড়াশোনা করেছেন তিনি। ছিলেন সংসারের বড় ছেলে। দিনে কাজ শেষে রাতে বাউল গান আর যাত্রা পালা শুনতে যেতেন গ্রামে গ্রামে। নসীব উল্লাহর কণ্ঠে বাউল গান শুনে কিশোর আব্দুল করিম বিমুগ্ধ হন এবং ধীরে ধীরে বাউল গানের ভুবনে জড়িয়ে পড়েন। সাধক করম উদ্দিন ও রশীদ উদ্দিনের সান্নিধ্যে বাউলতন্ত্রে মনোনিবেশ করেন। বিভিন্ন জায়গায় আমন্ত্রণ পেয়ে গান গাইতে যেতে থাকেন। আব্দুল করিম থেকে শাহ আব্দুল করিম হয়ে উঠেন মানুষের ভালোবাসায়।

বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম দেহতত্ত্ব নিয়ে সবসময় ভাবতেন। মানবজীবনের গূঢ় রহস্য নিয়ে তার ভাবনা ছিল প্রবল। মানবজীবন নিয়ে তিনি বরাবরই আগ্রহী ছিলেন। মানবজীবনের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে গিয়ে তিনি বলেন -
‘মানবতত্ত্বের কী মাহাত্ম্য
বোঝে কয়জনে 
মানবতত্ত্ব প্রকাশিল
অতি সন্ধানে।’ 
শাহ আবদুল করিম বাংলার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির প্রতি ছিলেন অত্যন্ত আস্থাশীল। তিনি তার এবং তাদের বাল্যের অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে স্মরণ করে বর্তমান কালের সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন দৃষ্টে ব্যথিত হয়েছেন। সে বেদনাকে তিনি প্রকাশ করেছেন তাই গানের বাণীতে, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।… গ্রামের নও-যোয়ান হিন্দু-মুসলমান/মিলিয়া বাউলা গান, ঘাটুগান গাইতাম/আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’
আমাদের সাধের মানবজীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। আমরা এখানে ক্ষণিকের অতিথি মাত্র। এ পৃথিবীর রূপ, রস ও সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। চলতে চলতে অনিবার্য সমাপ্তির মুখোমুখি হতে হয় আমাদের সবাইকে। শাহ আবদুল করিম তার গানে এর প্রতিফলন ঘটিয়েছেন এভাবে ---
‘আমি আছি আমার মাঝে
আমি করি আমার খবর
আমি থাকলে সোনার সংসার
আমি গেলে শূন্য বাসর।’
শাহ আবদুল করিম তার সংগীত জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, প্রথম থেকেই আমার গানের প্রতি টান। হিন্দু মুসলমানের দেশ গানের একটা পরিবেশ ছিল। দাদা সারিন্দা নিয়ে গান গেয়ে বেড়াত।
‘ভাবিয়া দেখ মনে
মাটির সারিন্দা বাজায় কেমনে…’
গানটা একেবারে ছোটবেলাতে শাহ আব্দুল করিমের মনে গভীর দাগ কাটে। তারপর দিনে দিনে তিনি একসময় কেবল গানের সুর-বাণীতেই নিজেকে সমর্পিত করেন। এ কথাটি তিনি তার গানেই প্রকাশ করেছেন সুর ও বাণীর যুগল সম্মিলনে,
‘আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া।’ তবে, এ কথাও ঠিক যে, শাহ আবদুল করিমের গান বিনোদনধর্মী কোনো গান নয়। তার গানে বিভিন্ন তত্ত্বকথা ও জীবন দর্শন যেন একাকার হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘দেহতত্ত্বের সঙ্গে দেহ শব্দটি আছে। আর এই দেহ তো শরীর। এর মধ্যে কী কী বস্তু আছে। দেহের মধ্যে চক্ষু আছে, কর্ণ আছে… এ সমস্ত আর কী। আমি এসব বুঝি বলে, মানুষে আমাকে পীর বলে মানে। আসলে, দেহ সম্পর্কে যারা ভালো জানেন তাদেরই পীর বলা হয়। এই ধারায় আমার মুর্শিদের নাম মওলা বক্স। মানুষের জীবনে পীরদের ভজতে হয়। আর পীর ভজলেই তত্ত্ব কথা পাওয়া যায়। দেহের মধ্যেই সব সত্য নিহিত থাকে। দেহ-আত্মা ইত্যাদির তত্ত্বই দেহতত্ত্ব। পঞ্চেন্দ্রিয়যুক্ত দেহই যে সকল শক্তির আধার এবং ইহাই যে আধ্যাত্মিক সাধনার একমাত্র পথ- এসব বর্ণনাই দেহতত্ত্ব গানের উদ্দেশ্য। শাহ আবদুল করিমের দেহতত্ত্বের একটি উল্লেখযোগ্য গান --
"আগে দেহের খবর জানগেরে মন,
তত্ত্ব না জেনে কি হয় সাধন । 
দেহে সপ্তস্বর্গ সপ্ত পাতাল 
চৌদ্দ ভুবন কর ভ্রমণ ।।
দেখনা খুঁজে কোথায় বিরাজে 
তার পরম গুরু আত্মারাম ।।"

শাহ আবদুল করিমের জন্মের মাত্র বছর দুই আগে দেহ রাখেন বাউল সাধক কুষ্টিয়ার ফকির লালন সাঁই। সুনামগঞ্জ অঞ্চলের অন্যান্য সাধকগণ হলেন হাসন রাজা, শীতালং শাহ, রাধারমণ, দূরবীণ শাহ প্রমুখ। তাঁদের সবার গান ও জীবন দর্শনে শাহ আবদুল করিম স্পষ্ট ধারণা রাখতেন। লালন ফকিরের গান সম্পর্কে তিনি বলতেন --আমি লালন ফকিরের গান শুনেছি, গেয়েছি, তাঁর গান মূলত তত্ত্বগান। রাধারমণের গানের সঙ্গে নিজের গানের মিল-অমিল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শাহ আবদুল করিম বলেছিলেন, রাধারমণের গানের সাথে আমার গানের বেশ মিল আছে। ছোট বেলা থেকে তার গান শুনে আসছি। তাঁর অনেক তত্ত্ব গান আছে, যা হিন্দু মুসলমান সবাই পছন্দ করে। তবে, খুব গভীর তত্ত্ব নাই। তাঁর গানের মধ্যে রাধা-কৃষ্ণের ভাবধারার গান বেশি। আর আমি দেহতত্ত্বকে বেশি ভালোবেসেছি। দেহের মাঝেই সবকিছু আছে। শাহ আবদুল করিম একই সঙ্গে ভক্তিবাদী এবং যুক্তবাদী। ভক্তিকে তিনি যুক্তির নিরিখে বিচার করে নিতেই পছন্দ করতেন। তাঁর সাহসী উচ্চারণ তাই গান হয়ে উঠেছিল--
'দেখাও দাও না কথা কও না
আর কত থাকি দূরে।
মুর্শিদ শোনো হে কেমনে চিনি তোমারে।'
ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর সরল ও দৃঢ় যুক্তিবাদী উচ্চারণ ছিল--
'শুনি উনি আছেন। দেখি নাই তো কোনোদিন…।'
যুক্তিবাদী বিবেচনার ভেতর দিয়ে তিনি প্রকৃতিবাদী এবং সর্বপ্রাণবাদীর মতো কথা বলতেন ।শাহ আবদুল করিম বাংলার অন্যান্য সাধকদের থেকে ছিলেন একেবারে ব্যতিক্রম। তিনি সাধনসঙ্গীতের পাশাপাশি রচনা করেছিলেন জনমানুষের অধিকার আদায়ের গান 'গণসঙ্গীত।' শাহ আবদুল করিমের গণচেতনা বাংলাদেশের শহুরে শিক্ষিত সঙ্গীত বিশেষজ্ঞদের কাছে সমাদৃত ছিল । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী বলেন , ''ভাষা আন্দোলন নিয়ে শাহ আবদুল করিমের গান আছে। এদেশের বাউল সাধকদের মধ্যে শাহ আবদুল করিম যে গণচেতনা প্রকাশ করেছেন তা সত্যি অন্যরকম একটা ঘটনা। এছাড়া, তাঁর প্রেমের গানগুলোও অকৃত্রিম যা শহুরের আধুনিক শিল্পীদের অবলম্বন বা ভরসার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে দেখে আনন্দই লাগে।'

ব্যক্তিজীবনে শাহ আবদুল করিম ছিলেন সহজ সরল । সহজ সরলতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন তাত্ত্বিক । তাইতো তার কন্ঠে ধ্বনিত হয় - মানবদেহের হাত ও পায়ের বিশ আঙ্গুলের কথা । তিনি বলেছেন এভাবে --"আজব রঙের ফুল ফুটেছে 
মানবগাছে 
চার ডালে তার বিশটি পাতা
কী সুন্দর আছে ।।"
দেহ তত্ত্ব নিয়ে বাউল সম্রাটের ভাবনা ছিল অতি সুক্ষ্ম । তিনি বলেন ---
" গাড়ি চলে না , চলে না 
 চলে না রে
 গাড়ি চলে না ।।" 

আমাদের এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক কিংবা মৌলবাদী ধ্যান ধারণার গভীরে অনুসন্ধান চালালে পাশ্চাত্যের দিকেই অভিযোগের তীর ধাবিত হবে । তবে সেক্ষেত্রে নিজেদের দায় দায়িত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করার উপায় নেই । ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পাশাপাশি সে সময়ের উচ্চবিত্তরা দায়ী ছিল বহুলাংশে । সেদিনের হিন্দু উচ্চবিত্তদের লাগানো আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিলেন মুসলিম উচ্চ বিত্তরা নিজেদের স্বার্থ আর আধিপত্য কায়েমের জন্য । বাউল বা লোকায়ত ধারায় প্রেম ভালোবাসার মাধ্যমে পরকে আপন করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় । বাউল সাধক ও বাউল গীতিকবিদের সাথে সমাজের নিম্নবর্গের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের একধরনের সহমর্মিতা সব সময়ই লক্ষ্য করা যায় । তারা অতি সহজেই সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের অংশীদার হয়ে উঠেন । তারা অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারনা নিয়ে চলতে পছন্দ করেন । বাংলার মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে যেমন বিভিন্ন ধর্মমত গ্রহন করেছেন আবার , আবার সময়ের খাতিরে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন । ধর্মের কঠোরতাকে গ্রহন না করে গ্রহন করেছেন উদারতাকে । এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের এ অঞ্চলে বিকাশ লাভ করেছে বাউল সাধনা । মাটি ও মানুষের জীবন একাত্ম হয়ে গেছে বাউলের ডেরায় । বাউল একটি জীবন দর্শন । এখানে সাধনা হয় । এখানে চর্চা হয় মানবতার গান , মানুষের গান , অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান ।

 অন্যান্য বাউলদের থেকে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমও ব্যাতিক্রম নন। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম মানুষের জীবনের সুখ দুঃখ প্রেম ভালোবাসার পাশাপাশি গেয়েছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান। দুঃখী মানুষের মনের কথা বলেছেন অন্তর দিয়ে । তার লেখা ও গাওয়া গানে এবং কর্মে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বারবার । আজীবন তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন । দেড় হাজারেরও বেশী গানের গীতিকার বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম তার গানে তুলে ধরেছেন শোষন বঞ্চনার কথা , অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারনা । আজ থেকে একশো বছর আগেও হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিল । বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল গুলো ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য আবাস । এধরনের মনন ও চিন্তার নিদর্শন পাওয়া যায় বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের লেখা ও গাওয়া গানে -----
"আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
 গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান 
 মিলিয়া বাউলা গান ঘাটুগান গাইতাম 
.............. ।"
বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের কাছে সব মানুষ ছিল সমান , এক মায়ের সন্তান । তাইতো তিনি অবলীলায় বলতে পেরেছেন ....
" এইসব নিয়ে দ্বন্দ্ব কেন 
 কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান
 তুমিও মানুষ আমিও মানুষ
 সবাই এক মায়ের সন্তান ।" 
বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছিলেন সব সময়ই সোচ্চার । সেটা তিনি প্রকাশ করেছেন তার লেখা গানে । তাইতো তিনি বলতে পেরেছিলেন ---
“বাউল আব্দুল করিম বলে সূক্ষ্ম রাস্তা ধরো,
শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে বাঁচার উপায় করো”।
( বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম । 

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সংগঠিত করার জন্য সকল ধর্মের মানুষকে আহবান জানিয়েছেন বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম ।
“কৃষক মজুর ভাই, হিন্দু-মুসলিম প্রভেদ নাই
বাঁচার মতো বাঁচতে চাই সবাই বলরে” । সিলেট অঞ্চলে একটি আন্দোলন হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। সিলেটের হরিপুরে আবিষ্কৃত হয়েছিল তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র। সেই তেল গ্যাস ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণ করার স্বার্থে দেশীয় দালাল গোষ্ঠীর সাথে আঁতাত করে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা শুরু হয়েছিল । তখন দেশের প্রগতিশীল নাগরিক এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন । সেই সময় সিলেটের সুনামগঞ্জের বাউল শাহ আব্দুল করিম “তেল চোরা” দের নিয়ে একটি গান লিখেন এবং বিভিন্ন জায়গায় গানটি ছিল এরকম --
“ হরিপুরে হরিলুট কেন, দেশবাসী কি খবর জানো;
তেলচোরা তেল নিল শোন, এদেশকে করতে চায় শ্বশান ।"

শাহ আব্দুল করিম জীবদ্দশায় পেয়েছেন একুশে পদক ২০০১ ,রাগিব রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার ২০০০, লেবাক এওয়ার্ড ২০০৩ , মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০০৪, সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড আজীবন সম্মাননা ২০০৫ সহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা । গ্রাম বাংলার সহজ সরল নির্মল পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন শাহ আব্দুল করিম । একদিকে বিশাল হাওরের থৈ থৈ জলরাশি , অন্যদিকে হাওরের দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ তার মনের জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে দারুনভাবে । নন্দিত এই বাউল সম্রাট ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ৯৩ বছর বয়সে সিলেটের নূরজাহান পলি ক্লিনিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । তিনি চলে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন তার লেখা ও গাওয়া অনেক জনপ্রিয় গান যা মানুষের মনকে নাড়া দেয় তুমুলভাবে । 

 

মায়াদ্বীপ

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:০৬ পিএম
আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৩১ পিএম
মায়াদ্বীপ
অলংকরণ : মেহেদী হাসান
ফাবিহা ডিসকভারিতে ওয়াইল্ডলাইফ-বিষয়ক একটি প্রোগ্রাম দেখছিল, চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বিরতি আসতে টিভিটা মিউট করে সে হেঁশেলে এলো। উদ্দেশ্য, কাজের মেয়েটার রান্নার খোঁজ করা। ডালিয়া নিবিষ্টমনে আনাজ কুটছে। এখন নিদাঘকাল যেহেতু, উনুনের আঁচে মেয়েটার থুতনি, নাক আর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমেছে। গরম থেকে কতকটা স্বস্তি পেতে ডালিয়া শাড়ির আঁচলটা নামিয়ে রেখেছে কোলের উপর।
 
গৃহকর্ত্রীর উপস্থিতি টের পেতে ডালিয়া একবার মুখ তুলে তাকাল; মুখে মোনালিসার হাসি ফোটাল; তারপর বলল, খালা, কালকের ঝিঙের সালুনটা কী করব? ফাবিহা জবাবে বলল, ওগুলো তুই নিয়ে যাস। ডালিয়া আবার বলল, রুইমাছ রইয়া গেছে দুই-পিচ, ওইদুটা? ফাবিহা বলল, ও-দুটোও তুই নিয়ে যাস। ডালিয়াকে দেখে মনে হলো, ফাবিহার এমন জবাব তার অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবু তার মুখে কৃতার্থভাব ফুটল। পরে পুনরায় তরকারি কুটায় মন দিল সে।
 
ফাবিহা ফিরে আসতে গিয়ে দৈবাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। অনিচ্ছাতেও তার আঁখিযুগল একবার ডালিয়ার কম্পমান সুগোল বুকজোড়া টেনে নিল। পাকা তালের মতো রসে টইটুম্বুর বুক এ মেয়ের! শাড়ির পর্দা সরে যেতে ডালিয়ার পীনোদ্ধত স্তনদুটো যেন ছিনাল নারীর মতো ঢলোঢলো মেজাজে হাসছে। ফাবিহা নিশ্চিত, এমন নিটোল বুক সে তার জন্মে খুব বেশি দেখেনি! তদুপরি ডালিয়ার স্বাস্থ্যখানাও মোহনীয়। ফাবিহার সহসা মনে হলো, ডালিয়ার শরীরকে যদি সুরাপাত্র ভাবা যায়, ডালিয়ার বুকজোড়া নির্ঘাত তার বরফকুচি।
 
ফাবিহা পলকের জন্য ভাবল, ডালিয়াকে বুকের উপর আঁচল টেনে নিতে বলে। পরে মনে পড়ল, বাসায় এখন তারা দুজন বই আর কেউ নেই। অবশ্য এও সত্যি যে, পুরুষগুলো জাহান্নামে যাক, ফাবিহার নিজেরই এখন প্রবল ইচ্ছে হচ্ছে, ডালিয়ার ওই দুরন্ত বুকদুটোয় একবার হাত রাখে। ফাবিহা মনে মনে বলল, কোনো মেয়ের এতটা সুন্দর বুক হওয়া ভালো নয়; ডালিয়ার মতো মেয়েদের তো নয়ইÑসে তো আর সিনেমার নায়িকা হতে যাচ্ছে না।
ফাবিহা আজ আবারও ভাবল, সজীবের যদি আরেকটু বেশি সময় বাসায় কাটানোর জো থাকত, সে বোধহয় ডালিয়াকে এভাবে বাসার কাজে রাখতে ভরসা করত না। এমনটা মনে আসতে মনখারাপও হলো; কিন্তু সে নিরুপায়-নিরালম্ব। কারণ সে দেখেছে, পুরুষমাত্রই নারীদেহ তাকে টানে, আর সে নারী যদি পর-নারী হয় তো কথাই নেই। পেঁচারা নাকি একগামী হয়, এবং জোড়ার প্রতি আমৃত্যু বিশ্বস্ত থাকে। ইস, পুরুষ জাতটারও যদি এ মতি হতো! আচ্ছা, ঘরের নারীরা যে তাদের নিয়ে অনুক্ষণ সংশয়ে ভোগে, পুরুষেরা এ নিয়ে কী ভাবে? না, সজীবকে এ নিয়ে কখনো প্রশ্ন করা হয়নি ফাবিহার।
 
ফাবিহা তার একাদশ-পড়–য়া ছেলে পলক বাসায় থাকলেও ডালিয়াকে নিয়ে তটস্থ থাকেÑডালিয়াকে বি¯্রস্তবসন হতে দেখলেই কৌশলে সতর্ক করে। এমন অবস্থায় ডালিয়া এক-একবার বলে ওঠে, খালা, গরম লাইগতাছে কিন্তু। বাসায় পুরুষ তো কেউ নাই। ডালিয়া কেন জানি সতেরোর পলককে এখনো পুরুষজ্ঞান করে না। ফাবিহার এক-একদিন ইচ্ছে হয়, ডালিয়ার এ ভুল ভাঙিয়ে দেয়। আবার পরক্ষণে ভয়ও হয়, প্রত্যুত্তরে মেয়েটা কী-না-কী জবাব করে! 
ফাবিহার এ বাসায় আজ ঠিক একবছর পূর্ণ হয়েছে। সে হিসেবে ডালিয়ারও এ বাসায় একবছর পূর্ণ হলো আজ। ফাবিহা ভেবেছিল, ডালিয়াকে সে আজকের জন্য কাজ থেকে রেহাই দেবে, আর পুরো সময়টায় সে ডালিয়ার সঙ্গে বসে গল্প করবে। এ কমাসে এটুকু ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার মেয়েটার হয়েছে বইকি। একটা মেয়ে যে কি-না একটা বছর ধরে তার বাসায় কাজ করছে, ফাবিহা তার সম্পর্কে সে-রকম কিছুই জানে না, কে বিশ্বাস করবে!
 
এমনটা ভেবে ডালিয়া আজ কাজে আসতে ফাবিহা ডালিয়াকে বলেছিল, শোন, তোর আজ কোনো কাজ করতে হবে না। আয়, এখানটায় বস! আজ কেবল তোর গল্প শুনব। ডালিয়া তখনি চোখ কপালে তুলে বলেছিল, খালা, আমার কি কুনু দোষ হইছে? নয়, কাম করতে মানা করেন ক্যান! ফাবিহা কোনোভাবেই তার ব্যাপারটা ডালিয়াকে বুঝাতে পারল না। ডালিয়ার ওই এককথা, তার মতো গরিব মানুষের কোনো গল্প থাকে না।
ফাবিহার মনে আছে, এ বাসার কেয়ারটেকারই তাকে ডালিয়ার খোঁজ দিয়েছিল; বলেছিল, আপা, আপনে যেমন মাইয়া চাইতাছেন, এই মাইয়াটা তেমনই। সাফসুফ মাইয়া। কামেও তাড়াহুড়া করে না। একটাই দোষ, কথা একটু বেশি কয়।
 
কেয়ারটেকার পুরোপুরি না হলেও অনেকখানি সত্য বলেছে। ডালিয়া যথার্থই গোছালো-পরিচ্ছন্ন মেয়ে। অন্যের ঘরের কাজকেও সে নিজের ঘরের কাজের মতো করেই মনপ্রাণ ঢেলে সামলায়। এখনকার কাজের মেয়েদের বেলায় যা প্রায় বিরল গুণ। ডালিয়ার বাচাল-স্বভাব সেভাবে চোখে পড়েনি ফাবিহার। বরং ডালিয়ার অন্য একটা স্বভাব ফাবিহাকে খানিকটা অস্বস্তি দেয়, মেয়েটা শরীর-সচেতন নয়। অথচ মেয়েদের শরীর-সচেতন না হলে চলে না। সে তো আর এমন নারী নয় যে, যার শরীর জরাগ্রস্ত, আর বুক হয়ে পড়েছে কিশমিশের মতো চিমসে। কে জানে, ডালিয়া হয়তো এমন ভাবে, মাইনষের ত আর খায়া-দায়া কাম নাই যে আমার মতন একটা গরিব মাইয়ার শইল দেখতে পেছন লইব। বিশ্বাস নেই ডালিয়াকে; এমনটা ভাবলেও ভাবতে পারে। ডালিয়ার বোধহয় জানা নেই, যে মানুষের শরীর দরকার, তার শরীরই দরকার; সে শরীর ধনীর না নির্ধনের, সে শরীর কৃষ্ণ না ধবল, সে শরীর ঘরের না পরেরÑএসবের ভাবনা তাকে ভাবায় না।
আচ্ছা, ডালিয়ার কত বয়স হবে? খুবজোর বাইশ-তেইশ। বিশ-একুশও হতে পারে। ফাবিহা একবার জিজ্ঞেস করেছিল। ডালিয়া অনুমতিভাবেই বলেছে, সত্যই মনে নাই খালা।
 
এমন অল্প বয়সেই ডালিয়া কিন্তু বিবাহিত একজন; বছর-দুয়েক বয়সের তার একটা বাচ্চাও রয়েছে। অবশ্য কাজে বেরোতে ডালিয়া কখনো বাচ্চাকে সঙ্গে নেয় না বলে আজতক ডালিয়ার বাচ্চাকে একনজর দেখা হয়নি ফাবিহার। ডালিয়ার স্পষ্ট কথা, ছোড বাচ্চা নিয়া কাম করণ যায় না।
এটা মিথ্যে নয় যে, ডালিয়ার শরীর এক-একবার ফাবিহার মনেও ঈর্ষা জাগায়। ফাবিহা জানে, তাদের দুজনকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিলে কেউ ডালিয়াকে ফেলে তার দিকে ফিরে তাকাবে না। কী করে ডালিয়া এমন সুন্দর শরীর সুন্দর বুক তৈরি করল, কে জানে! অথচ মেয়েটা শরীর নিয়ে কতই-না অসচেতন। তুলনায় ফাবিহা তার শরীরকে আজন্ম ভালোবাসা দিয়ে এসেছে; যতেœ রেখেছে, আরামে-আদরে রেখেছেÑসে তুলনায় তার শরীর সাড়া দিয়েছে সামান্য। কিছু কিছু ব্যাপারে প্রকৃতির ভাব বুঝা মুশকিল। নয় ডালিয়ার এই অযতেœর শরীর কেন এমন মায়াকাড়া আর নয়নভোলানো হবে!
ফাবিহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডালিয়া আরেকবার মুখে তুলে বলল, খালা, কিছু কি কইবেন?
ফাবিহা চট করে কথা খুঁজে না পেয়ে বলে উঠল, ভাবছি যে তোর কাছ থেকে রান্নাটা একটু-আধটু শিখে নেবো। শেখাবি নাকি?
ডালিয়া গালভর্তি হেসে বলল, খালায় যে কী কন না-কন!
এখন খোশগল্প আরম্ভ করলে ডালিয়ার কাজে ব্যাঘাত হবে ভেবে ফাবিহা টিভিরুমে ফিরে এলো।
 
দুই.
ডালিয়া কাজ শেষে যখন বেরিয়ে যাবে ফাবিহা ডেকে বলল, ডালিয়া, তোর কি তাড়া আছে?
কন যে কী করতে হইব।
কোনো কাজ নয়। আজ তোর সাথে একটু গল্প করতে ইচ্ছে করছে।
ধক করে উঠল ফাবিহার ভেতরটায়। বুকের অন্দরে সাইরেন বাজছে শুনতে পেল। ইতস্তত মুখ করে ডালিয়া কোনোরকমে বলল, বসতে কন যদি বসবার পারি। তয় কইলাম, আমার কিন্তু কোনো গল্প নাই।
ফাবিহা আলটপকা হেসে উঠে বলল, তোর কোনো গল্প নেই, এ কী রকম কথা! যে মানুষ বলে তার কোনো গল্প নেই, ওই মানুষটারই আসলে বলবার গল্প থাকে বেশি। অল্পের জন্য থেমে পুনশ্চ বলল, মনে হচ্ছে কিছুর তাড়া আছে তোর। ঠিক আছে, এখন যা তবে তুই। অন্যদিন করব তোর সাথে গল্প।
 
তিন.
ডালিয়া রাস্তায় নেমে এসে একবার পেছন ফিরে তাকাল। না, ফাবিহার টিকিটি নেই জানালা কিংবা ব্যালকনিতে। এতক্ষণে যেন দম ফেলল ডালিয়া। ফাবিহার আচরণ তাকে আজ ভালোরকম ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। মানুষটা কেন আজ বারবার করে তার গল্প শুনতে চাইছিল, কে জানে! মানুষটা কি তার সম্পর্কে কোথাও থেকে কিছু জানতে পেরেছে? অজানা আশঙ্কায় ডালিয়ার হাত-পা জমে আসতে চাইছে।
হ্যাঁ, ডালিয়ার ভেতর ঢের গল্প জমা আছে। কিন্তু কেবল ডালিয়া জানে, এ এমন গল্প, যা কাউকে শোনাবার মতো নয়।
 
ফাবিহার কাছে মিথ্যে বলে ডালিয়ার এখন কষ্ট হচ্ছে। মানুষটা তার প্রতি সমব্যথী-দরদি। তার শুভাকাক্সক্ষী একজনের সঙ্গে এভাবে কপটতা করা কি তার উচিত হলো? কিন্তু এখানটায় মিথ্যে না বলে ডালিয়ার উপায়ই-বা কী ছিল! ডালিয়া যদি তার গল্পগুলো শুনাতে যেতো, এসব গল্প সে যতই রেখেঢেকে করুক, ঝাড়পোঁছ করে যা বলা হবে তাতেও তার সর্বনাশের একশেষ হতো। চট করে তার এ বাসায় কাজটা হাতছাড়া গেলে সে নিদারুণ অসুবিধেয় পড়ে যাবে। বাঁচবার জন্য মানুষ কত কী অন্যায় কাজ করে; ডালিয়া নয় খানিকটা মিথ্যের আশ্রয় নিল। কেবল মিথ্যে করে বলল যে তার জীবনে কোনো গল্প নেই।
একদিক থেকে অবশ্য বলতে গেলে ডালিয়ার জীবনে কোনো গল্প নেইও। যেনতেন আজেবাজে কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনাকে কি গল্প বলা যায়? ডালিয়া ভেবে দেখল, গল্পের সংজ্ঞাটা তার কাছে আদতেই পরিষ্কার নয়।
 
চার.
ডালিয়া তার জন্ম থেকে দেখে এসেছে, তাদের পরিবারটা দীনহীন, অসচ্ছল। তার বাবা সংসারের ঘানি টানতে টানতে জেরবার, পরিশ্রান্ত। সংসার নামক তরীটাকে নিয়ে কোনোভাবেই যেন কূল খুঁজে পাচ্ছিল না বাবা!
সংসারটাকে এমন মাঝ দরিয়ায় রেখে বছর-আড়াই পূর্বে বাবা হুট করে একদিন দেহ রাখল। মৃত্যুতে মানুষটা বেঁচে গেলেও ডালিয়ারা পড়ে গেল আরও গভীর পাঁকে। বাস্তবতার করাল থাবার কাছে মানুষের নিরেট শোকভাবনাও মার খেয়ে যায়। স্বামীর মৃত্যুর মাস-দুই না হতে দ্বিতীয় একটা হাতে পুনরায় নিজের কাহিল হাতটা সঁপে দিল ডালিয়ার মা। খুবসম্ভব, মানুষমাত্রই প্রাণটা আকুলিবিকুলি করে আরেকটু বেশিদিন বাঁচতে।
এর মাঝে ডালিয়া সবিস্ময়ে লক্ষ করল, মায়ের এই দ্বিতীয় মানুষটা দেখতে শক্তপোক্ত, সুঠামদেহী; বয়সেও মায়ের চেয়ে আট-দশ বছরের ছোট হবে। লোকটা কী ভেবে মায়ের মতো বেহাল দশার জীর্ণ শরীরের একজনকে বিয়েতে রাজি হলো, ভেবে থই পাচ্ছিল না ডালিয়া।
 
না, ডালিয়াকে এ প্রশ্নের উত্তর পেতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না। ডালিয়ার হয়তো এখানে করার ছিল অনেক কিছুই, কিংবা কিছুই করার হয়তো ছিল না। মা একদিন কী করে যেন সেসব টের পেয়ে গেল। সেদিন শেষরাতের দিকে ডালিয়াকে ঘুম থেকে জাগিয়ে মা যুগপৎ অনুচ্চ ও দড়গলায় বলল, রাইত পোয়াবার আগেই যেইদিকে দুইচখ যায় বাইর হইয়া যাবি, নয় তর গলায় আমি ছুরি চালামু।
যার কিছু থাকে না, কেউ থাকে না, তারও ঠাঁই হয় কোথাও না কোথাও। ডালিয়ার ঠাঁই হলো শহরের এক বস্তিতে। কদিনেই পড়শি এক মহিলার সঙ্গে খালার সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলল। বাচ্চাদের কাছে অশরীরী কিছুর গল্প ফাঁদার মতো পাতানো খালার কাছে পেটের বাচ্চাটার ব্যাপারে আজগুবি সব গল্প করল ডালিয়া। খালা গল্পগুলো কৌতূহল নিয়ে শুনল; কোনো প্রশ্ন করল না। যথাসময়ে ডালিয়ার পেটের বাচ্চাটা জন্ম নিল। বাচ্চাকে একনজর দেখেই চমকে উঠেছিল ডালিয়া, হা খোদা, বাচ্চাটা যার আদল পেল, সে কী করে এ বাচ্চাকে লোকসম্মুখে বের করবে!
বাচ্চার মুখ দেখে ডালিয়াকে বিবশ হয়ে পড়তে দেখে পাতানো খালা উপদেশের ঢঙে বলেছিল, হতচ্ছাড়ি শোন, তোর সেই গোপন কুঠুরিগুলোয় এবার জন্মের তরে তালা ঝুলিয়ে দেয়। দেখবি অনেক হালকা হয়ে গেছিস। মনে রাখিস, এ দুনিয়াতে যত মানুষ দেখছিস, সবাই এভাবেই বেঁচে আছে।
এ মহিলা মাঝেমাঝেই এমন গুরুপাকের কথা বলে, যার অধিকাংশই ডালিয়া ধরতে পারে না। এটাও পারেনি। তাই নিরুত্তর ছিল।
যা হোক, ডালিয়া নিশ্চিত নয়, এভাবে মিথ্যের উপর নির্মিত সৌধ কতদিন টেকসই হয়। কিন্তু এখানে কী-ইবা সে করতে পারে, প্রতীক্ষার প্রহর গোনা ছাড়া।
 
 

সেই আদিম শকুন

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩৪ পিএম
আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩৪ পিএম
সেই আদিম শকুন

পৃথিবীর উত্তরে দক্ষিণে 
পূবে পশ্চিমে আজ শুধু শকুনের উল্লাস 
রাত্রির বুকে কলঙ্ক- অস্থির প্রবাহ,
অন্ধ-বধির সময়
সভ্যতা খেয়েছে দূষিত জীবাণু!

কোথাও আজ- কেউ কি ভালো আছো?

নক্ষত্রের বুক সেই আদিম শকুন! 
খামছে ধরেছে মধ্যবিত্তের হাত পা 
শান্তির ঘুম অবুঝ স্বপ্ন 
ঝাঁঝরা ধূলিতে পড়ে আছে ঝলসানো চাঁদ 
পোড়া হাড়গোড় 
ক্ষতবিক্ষত কত নিষ্পাপ মুখ!

প্রয়োজনে প্রিয়জন

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩৩ পিএম
আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩৩ পিএম
প্রয়োজনে প্রিয়জন

পূজো শেষে ফুলগুলো অপাঙক্তেয় হয়
প্রয়োজন ফুরালে কিছু প্রিয়জনের মতো।
রান্নার সুগন্ধে স্বাদে পরিপূর্ণ তৃপ্তির পরে;
মুল্যবান উপকরণকেও উচ্ছিষ্ট মনে হয়।

কৃতকার্য হয়ে কলম ছুঁড়ে ফেলে নির্দ্বিধায় 
বর্ষার সঙ্গী ছাতাটা অবহেলায় পড়ে থাকে। 
দুর্গন্ধ থেকে পরিত্রাণে সুগন্ধি পারফিউম;
ব্যবহার শেষে ছিটকে পড়ে ময়লার ঝুড়িতে।

প্রয়োজনে প্রিয়জন কখনো হয় না আপন
দেখেশুনে সর্বদা করো তাই জীবনযাপন।