ঢাকা ১৬ বৈশাখ ১৪৩২, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

শাহ আবদুল করিমের গানে দেহতত্ত্ব ও সমাজ ভাবনা

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:১৩ পিএম
আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ১০:২৯ পিএম
শাহ আবদুল করিমের গানে দেহতত্ত্ব ও সমাজ ভাবনা
অলংকরণ : মেহেদী হাসান

বাউল গানের অন্যতম কিংবদন্তি লোকায়ত ধারার সাধক বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন তার ঘটনাবহুল প্রায় শতবর্ষী জীবন। কিশোর বয়সে অভাবের সংসারে বেড়ে উঠেছেন বাউল আব্দুল করিম। নিত্য টানাটানির সংসারে হাল ধরতে গিয়ে গ্রামের গৃহস্থের বাড়িতে গরু রাখালের কাজ করেছেন বাউল সাধক শাহ আবদুল করিম। লোক সংস্কৃতির আধার হাওরকন্যা সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ধল আশ্রম গ্রামে ১৯১৬ খ্রি. এর ১৫ ফেব্রুয়ারি (বাংলা ১৩২২ সালের ফাল্গুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার) জন্মগ্রহণ করেন বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম । পিতার নাম ইব্রাহিম আলী এবং মাতার নাম নাইওরজান বিবি। পরবর্তী সময়ে ধল আশ্রম গ্রামের পার্শ্ববর্তী উজান ধল গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। নিজ গ্রামের নৈশ বিদ্যালয়ে মাত্র আট রাত্রি পড়াশোনা করেছেন তিনি। ছিলেন সংসারের বড় ছেলে। দিনে কাজ শেষে রাতে বাউল গান আর যাত্রা পালা শুনতে যেতেন গ্রামে গ্রামে। নসীব উল্লাহর কণ্ঠে বাউল গান শুনে কিশোর আব্দুল করিম বিমুগ্ধ হন এবং ধীরে ধীরে বাউল গানের ভুবনে জড়িয়ে পড়েন। সাধক করম উদ্দিন ও রশীদ উদ্দিনের সান্নিধ্যে বাউলতন্ত্রে মনোনিবেশ করেন। বিভিন্ন জায়গায় আমন্ত্রণ পেয়ে গান গাইতে যেতে থাকেন। আব্দুল করিম থেকে শাহ আব্দুল করিম হয়ে উঠেন মানুষের ভালোবাসায়।

বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম দেহতত্ত্ব নিয়ে সবসময় ভাবতেন। মানবজীবনের গূঢ় রহস্য নিয়ে তার ভাবনা ছিল প্রবল। মানবজীবন নিয়ে তিনি বরাবরই আগ্রহী ছিলেন। মানবজীবনের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে গিয়ে তিনি বলেন -
‘মানবতত্ত্বের কী মাহাত্ম্য
বোঝে কয়জনে 
মানবতত্ত্ব প্রকাশিল
অতি সন্ধানে।’ 
শাহ আবদুল করিম বাংলার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির প্রতি ছিলেন অত্যন্ত আস্থাশীল। তিনি তার এবং তাদের বাল্যের অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে স্মরণ করে বর্তমান কালের সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন দৃষ্টে ব্যথিত হয়েছেন। সে বেদনাকে তিনি প্রকাশ করেছেন তাই গানের বাণীতে, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।… গ্রামের নও-যোয়ান হিন্দু-মুসলমান/মিলিয়া বাউলা গান, ঘাটুগান গাইতাম/আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’
আমাদের সাধের মানবজীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। আমরা এখানে ক্ষণিকের অতিথি মাত্র। এ পৃথিবীর রূপ, রস ও সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। চলতে চলতে অনিবার্য সমাপ্তির মুখোমুখি হতে হয় আমাদের সবাইকে। শাহ আবদুল করিম তার গানে এর প্রতিফলন ঘটিয়েছেন এভাবে ---
‘আমি আছি আমার মাঝে
আমি করি আমার খবর
আমি থাকলে সোনার সংসার
আমি গেলে শূন্য বাসর।’
শাহ আবদুল করিম তার সংগীত জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, প্রথম থেকেই আমার গানের প্রতি টান। হিন্দু মুসলমানের দেশ গানের একটা পরিবেশ ছিল। দাদা সারিন্দা নিয়ে গান গেয়ে বেড়াত।
‘ভাবিয়া দেখ মনে
মাটির সারিন্দা বাজায় কেমনে…’
গানটা একেবারে ছোটবেলাতে শাহ আব্দুল করিমের মনে গভীর দাগ কাটে। তারপর দিনে দিনে তিনি একসময় কেবল গানের সুর-বাণীতেই নিজেকে সমর্পিত করেন। এ কথাটি তিনি তার গানেই প্রকাশ করেছেন সুর ও বাণীর যুগল সম্মিলনে,
‘আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া।’ তবে, এ কথাও ঠিক যে, শাহ আবদুল করিমের গান বিনোদনধর্মী কোনো গান নয়। তার গানে বিভিন্ন তত্ত্বকথা ও জীবন দর্শন যেন একাকার হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘দেহতত্ত্বের সঙ্গে দেহ শব্দটি আছে। আর এই দেহ তো শরীর। এর মধ্যে কী কী বস্তু আছে। দেহের মধ্যে চক্ষু আছে, কর্ণ আছে… এ সমস্ত আর কী। আমি এসব বুঝি বলে, মানুষে আমাকে পীর বলে মানে। আসলে, দেহ সম্পর্কে যারা ভালো জানেন তাদেরই পীর বলা হয়। এই ধারায় আমার মুর্শিদের নাম মওলা বক্স। মানুষের জীবনে পীরদের ভজতে হয়। আর পীর ভজলেই তত্ত্ব কথা পাওয়া যায়। দেহের মধ্যেই সব সত্য নিহিত থাকে। দেহ-আত্মা ইত্যাদির তত্ত্বই দেহতত্ত্ব। পঞ্চেন্দ্রিয়যুক্ত দেহই যে সকল শক্তির আধার এবং ইহাই যে আধ্যাত্মিক সাধনার একমাত্র পথ- এসব বর্ণনাই দেহতত্ত্ব গানের উদ্দেশ্য। শাহ আবদুল করিমের দেহতত্ত্বের একটি উল্লেখযোগ্য গান --
"আগে দেহের খবর জানগেরে মন,
তত্ত্ব না জেনে কি হয় সাধন । 
দেহে সপ্তস্বর্গ সপ্ত পাতাল 
চৌদ্দ ভুবন কর ভ্রমণ ।।
দেখনা খুঁজে কোথায় বিরাজে 
তার পরম গুরু আত্মারাম ।।"

শাহ আবদুল করিমের জন্মের মাত্র বছর দুই আগে দেহ রাখেন বাউল সাধক কুষ্টিয়ার ফকির লালন সাঁই। সুনামগঞ্জ অঞ্চলের অন্যান্য সাধকগণ হলেন হাসন রাজা, শীতালং শাহ, রাধারমণ, দূরবীণ শাহ প্রমুখ। তাঁদের সবার গান ও জীবন দর্শনে শাহ আবদুল করিম স্পষ্ট ধারণা রাখতেন। লালন ফকিরের গান সম্পর্কে তিনি বলতেন --আমি লালন ফকিরের গান শুনেছি, গেয়েছি, তাঁর গান মূলত তত্ত্বগান। রাধারমণের গানের সঙ্গে নিজের গানের মিল-অমিল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শাহ আবদুল করিম বলেছিলেন, রাধারমণের গানের সাথে আমার গানের বেশ মিল আছে। ছোট বেলা থেকে তার গান শুনে আসছি। তাঁর অনেক তত্ত্ব গান আছে, যা হিন্দু মুসলমান সবাই পছন্দ করে। তবে, খুব গভীর তত্ত্ব নাই। তাঁর গানের মধ্যে রাধা-কৃষ্ণের ভাবধারার গান বেশি। আর আমি দেহতত্ত্বকে বেশি ভালোবেসেছি। দেহের মাঝেই সবকিছু আছে। শাহ আবদুল করিম একই সঙ্গে ভক্তিবাদী এবং যুক্তবাদী। ভক্তিকে তিনি যুক্তির নিরিখে বিচার করে নিতেই পছন্দ করতেন। তাঁর সাহসী উচ্চারণ তাই গান হয়ে উঠেছিল--
'দেখাও দাও না কথা কও না
আর কত থাকি দূরে।
মুর্শিদ শোনো হে কেমনে চিনি তোমারে।'
ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর সরল ও দৃঢ় যুক্তিবাদী উচ্চারণ ছিল--
'শুনি উনি আছেন। দেখি নাই তো কোনোদিন…।'
যুক্তিবাদী বিবেচনার ভেতর দিয়ে তিনি প্রকৃতিবাদী এবং সর্বপ্রাণবাদীর মতো কথা বলতেন ।শাহ আবদুল করিম বাংলার অন্যান্য সাধকদের থেকে ছিলেন একেবারে ব্যতিক্রম। তিনি সাধনসঙ্গীতের পাশাপাশি রচনা করেছিলেন জনমানুষের অধিকার আদায়ের গান 'গণসঙ্গীত।' শাহ আবদুল করিমের গণচেতনা বাংলাদেশের শহুরে শিক্ষিত সঙ্গীত বিশেষজ্ঞদের কাছে সমাদৃত ছিল । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী বলেন , ''ভাষা আন্দোলন নিয়ে শাহ আবদুল করিমের গান আছে। এদেশের বাউল সাধকদের মধ্যে শাহ আবদুল করিম যে গণচেতনা প্রকাশ করেছেন তা সত্যি অন্যরকম একটা ঘটনা। এছাড়া, তাঁর প্রেমের গানগুলোও অকৃত্রিম যা শহুরের আধুনিক শিল্পীদের অবলম্বন বা ভরসার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে দেখে আনন্দই লাগে।'

ব্যক্তিজীবনে শাহ আবদুল করিম ছিলেন সহজ সরল । সহজ সরলতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন তাত্ত্বিক । তাইতো তার কন্ঠে ধ্বনিত হয় - মানবদেহের হাত ও পায়ের বিশ আঙ্গুলের কথা । তিনি বলেছেন এভাবে --"আজব রঙের ফুল ফুটেছে 
মানবগাছে 
চার ডালে তার বিশটি পাতা
কী সুন্দর আছে ।।"
দেহ তত্ত্ব নিয়ে বাউল সম্রাটের ভাবনা ছিল অতি সুক্ষ্ম । তিনি বলেন ---
" গাড়ি চলে না , চলে না 
 চলে না রে
 গাড়ি চলে না ।।" 

আমাদের এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক কিংবা মৌলবাদী ধ্যান ধারণার গভীরে অনুসন্ধান চালালে পাশ্চাত্যের দিকেই অভিযোগের তীর ধাবিত হবে । তবে সেক্ষেত্রে নিজেদের দায় দায়িত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করার উপায় নেই । ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পাশাপাশি সে সময়ের উচ্চবিত্তরা দায়ী ছিল বহুলাংশে । সেদিনের হিন্দু উচ্চবিত্তদের লাগানো আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিলেন মুসলিম উচ্চ বিত্তরা নিজেদের স্বার্থ আর আধিপত্য কায়েমের জন্য । বাউল বা লোকায়ত ধারায় প্রেম ভালোবাসার মাধ্যমে পরকে আপন করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় । বাউল সাধক ও বাউল গীতিকবিদের সাথে সমাজের নিম্নবর্গের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের একধরনের সহমর্মিতা সব সময়ই লক্ষ্য করা যায় । তারা অতি সহজেই সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের অংশীদার হয়ে উঠেন । তারা অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারনা নিয়ে চলতে পছন্দ করেন । বাংলার মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে যেমন বিভিন্ন ধর্মমত গ্রহন করেছেন আবার , আবার সময়ের খাতিরে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন । ধর্মের কঠোরতাকে গ্রহন না করে গ্রহন করেছেন উদারতাকে । এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের এ অঞ্চলে বিকাশ লাভ করেছে বাউল সাধনা । মাটি ও মানুষের জীবন একাত্ম হয়ে গেছে বাউলের ডেরায় । বাউল একটি জীবন দর্শন । এখানে সাধনা হয় । এখানে চর্চা হয় মানবতার গান , মানুষের গান , অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান ।

 অন্যান্য বাউলদের থেকে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমও ব্যাতিক্রম নন। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম মানুষের জীবনের সুখ দুঃখ প্রেম ভালোবাসার পাশাপাশি গেয়েছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান। দুঃখী মানুষের মনের কথা বলেছেন অন্তর দিয়ে । তার লেখা ও গাওয়া গানে এবং কর্মে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বারবার । আজীবন তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন । দেড় হাজারেরও বেশী গানের গীতিকার বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম তার গানে তুলে ধরেছেন শোষন বঞ্চনার কথা , অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারনা । আজ থেকে একশো বছর আগেও হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিল । বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল গুলো ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য আবাস । এধরনের মনন ও চিন্তার নিদর্শন পাওয়া যায় বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের লেখা ও গাওয়া গানে -----
"আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
 গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান 
 মিলিয়া বাউলা গান ঘাটুগান গাইতাম 
.............. ।"
বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের কাছে সব মানুষ ছিল সমান , এক মায়ের সন্তান । তাইতো তিনি অবলীলায় বলতে পেরেছেন ....
" এইসব নিয়ে দ্বন্দ্ব কেন 
 কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান
 তুমিও মানুষ আমিও মানুষ
 সবাই এক মায়ের সন্তান ।" 
বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছিলেন সব সময়ই সোচ্চার । সেটা তিনি প্রকাশ করেছেন তার লেখা গানে । তাইতো তিনি বলতে পেরেছিলেন ---
“বাউল আব্দুল করিম বলে সূক্ষ্ম রাস্তা ধরো,
শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে বাঁচার উপায় করো”।
( বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম । 

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সংগঠিত করার জন্য সকল ধর্মের মানুষকে আহবান জানিয়েছেন বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম ।
“কৃষক মজুর ভাই, হিন্দু-মুসলিম প্রভেদ নাই
বাঁচার মতো বাঁচতে চাই সবাই বলরে” । সিলেট অঞ্চলে একটি আন্দোলন হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। সিলেটের হরিপুরে আবিষ্কৃত হয়েছিল তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র। সেই তেল গ্যাস ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণ করার স্বার্থে দেশীয় দালাল গোষ্ঠীর সাথে আঁতাত করে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা শুরু হয়েছিল । তখন দেশের প্রগতিশীল নাগরিক এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন । সেই সময় সিলেটের সুনামগঞ্জের বাউল শাহ আব্দুল করিম “তেল চোরা” দের নিয়ে একটি গান লিখেন এবং বিভিন্ন জায়গায় গানটি ছিল এরকম --
“ হরিপুরে হরিলুট কেন, দেশবাসী কি খবর জানো;
তেলচোরা তেল নিল শোন, এদেশকে করতে চায় শ্বশান ।"

শাহ আব্দুল করিম জীবদ্দশায় পেয়েছেন একুশে পদক ২০০১ ,রাগিব রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার ২০০০, লেবাক এওয়ার্ড ২০০৩ , মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০০৪, সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড আজীবন সম্মাননা ২০০৫ সহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা । গ্রাম বাংলার সহজ সরল নির্মল পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন শাহ আব্দুল করিম । একদিকে বিশাল হাওরের থৈ থৈ জলরাশি , অন্যদিকে হাওরের দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ তার মনের জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে দারুনভাবে । নন্দিত এই বাউল সম্রাট ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ৯৩ বছর বয়সে সিলেটের নূরজাহান পলি ক্লিনিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । তিনি চলে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন তার লেখা ও গাওয়া অনেক জনপ্রিয় গান যা মানুষের মনকে নাড়া দেয় তুমুলভাবে । 

 

বিড়ালের থাবা

প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৩৩ পিএম
আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৩৭ পিএম
বিড়ালের থাবা
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

মিনিরা যে পাড়ায় বাস করতো তা ছিল সবুজে ঘেরা বিলের পাড় ঘেষা। চারদিকেের প্রকৃতি, জনজীবন ছিল খুবই সাদামাটা ঘরনার। বিলে মাছ ধরা, ধান, সবজি চাষ সাধারণ গ্রামীণ জনপদের আবহের ধারায় প্রবহমান। এখানে প্রায় সকল বাড়িতেই একটা দুটো দেশি মুরগী পালন করতো। দিনকাল ভালোই কাটছিল সকলের। কিন্তু হঠাৎ করেই আগমন ঘটলো দুষ্ট, ধুরন্দর, বড়সড় এক বিড়ালের। দেখতে সাদার মধ্যে কিছুটা কালো ছোপ ছোপ  কেমন ভয়ানক বাঘডাশের মতো দেখতে অনেকটা। তাকে দেখলেই সকলে আঁতকে উঠতো। তার খাবারের কোন অভাব ছিল এমনটাতো নয় ; বরং এলাকাবাসী সকলেই মাছের কাঁটা, এটা সেটা তাকে খেতে দিতোই । এসব খেয়ে সে দিনকে দিন ভালোই মোটাতাজা হচ্ছিল আর হয়ে উঠছিল আরও বেশি শক্তিশালী এবং ভয়ানক দেখতে। সে যে প্রথমে এমনটা ছিল তা কিন্তু নয়। সে কিছুটা নিরীহ প্রকৃতিরই ছিল বটে।আর এই নিরীহ ভাব নিয়েই সে কুকর্ম শুরু করে।  সহজলভ্য শিকার হাতের কাছে পেয়ে পেয়েই সে এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল।

সকলের বাড়িতে মুরগীর নতুন ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোর প্রতি বিড়ালটার লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। সে নিয়ম করে সকলের মুরগীর বাচ্চাগুলোকে খেতে শুরু করে। তার এই খাওয়া বেড়েই চলে দিনকে দিন। ছোট  থেকে শুরু করে বড় মুরগির বাচ্চা কোনটাই বিড়ালটির থাবা থেকে রেহাই পেত না।

বিড়ালটির লোভের অত্যাচারে অতিষ্ট এলাকাবাসী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিনিরা। তাদের অনেক ক্ষতি সে করেছে। কারণ ওদের ছোট বড় সবগুলো বাচ্চাই সে দরজা, জানালা এদিক সেদিন দিয়ে ডুকে ডুকে খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে। এমন করে প্রায় সে প্রতিটি বাড়িতেই থাবা বসিয়ে সবাইকে নিঃস্ব করে ফেলেছে। 

মিনির মার আরও বেশিই কষ্ট হয়। কারণ বিড়ালটি তার মুরগির আদুরে পালিত বাচ্চাগুলোকে তৃপ্তি করে খেয়ে নাদুস নুদুস হচ্ছে ; আবার শীতের মধ্যে তারই মাটির চুলোর পাড়ে শুয়ে দিব্যি আরাম করে ঘুমায়ও।

মিনির মা অবশ্য বহুবার একে তাড়ানোর চেষ্টা করেছে। কখনো বা ভয় দেখিয়ে কখনও বা আবার ঝাঁটার বাড়ি দিয়ে ; নয়তো মনের দুঃখে গালমন্দ করে। এতে করে কিছুটা সময় স্বস্তি কিংবা মনের জ্বালা হয়তো মিটতো;  কিন্তু তাতে দীর্ঘ জ্বালা মিটতো না অবশ্য। এতে তার কষ্ট বেড়ে আরও তিন গুণ হয়ে যায়। সে একসময় প্রচণ্ড কষ্ট থেকে চিন্তাই করে এই অতিষ্ঠকারীটাকে মেরেই ফেলবে। যদিও সত্যি সত্যি তা করার দুঃসাহসও দেখায় নি। যতই হোক, একটা জীবন্ত প্রাণী তো। ছোট্ট মিনিও বারবার না করে। দরকার কি একটা প্রাণী মেরে অযথা পাপের ভাগীদার হওয়ার? তার শাস্তি সে নিজেই পাবে হয়তো। মিনির এই কথাটিই সত্যিও হলো অবশ্য পরে একদিন।

হঠাৎ একদিন রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক প্রতিবেশী বলে উঠলেন , " আপনাদের রান্নাঘরে এত দু্র্গন্ধ কীসের? " এ কথা শুনে মিনি আর ওর মা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাহলে কি তারা যা ভাবছে তাই ঘটেছে? আরে ঐ বিড়ালটা তো এখানে আয়েশ করে ঘুমায় ; তার মানে!  শেষ এক সপ্তাহ আগে রান্না শেষে দরজায় তালা। এরপর কেউ আর ঐদিকে যায়ও নি। মিনির মা দ্রুত রান্নাঘরের দরজার তালা খুললেন। তারা দুজন তো অবাক হয়ে গেলেন! আরেহ এ তো সেই বিড়ালটি! তারমানে ঐদিন রান্নার পরই বিড়ালটি মুরগির বাচ্চা খেয়ে প্রচুর শীতের মধ্যে আয়েশ বেশি করতে গিয়ে একেবারে গরম চুলোর মধ্যেই ডুকে পড়েছিল! তাই এই অবস্থা! একেবারে পোকা কিলবিল করছে পুরো শরীর জুড়ে। তারা দুজন আঁতকে উঠলো যাই হোক না কেন একটা প্রাণীর এ অবস্থা তো তারা কোনভাবেই চায় নি, মুখে যাই বলুক না কেন। 

ঘটনাটি শুনে এলাকাবাসী একেকজন একেকরকম প্রতিক্রিয়া দেখালো। কেউ কেউ ত খুবই মর্মাহত হয়ে বললেন, " আহারে বিড়ালটা মরে গেল, যতই হোক একটা জীব তো! "  আবার আরেকজন পাশ থেকে বলে উঠলেন," মরছে ঠিকই আছে এর অত্যাচারে আমরা অতিষ্ট, এর পাপের শাস্তিই এ পাইছে।" সবার মুরগী এই একটা বিড়ালের কারণে বাচ্চাহীন। সে এত বেশি লোভী আর লাগামছাড়া ছিল যে সবাই তার উপর অতিষ্ট ছিল। কিন্তু কারও কিছুই করার সাধ্যও ছিল না।

ছোট্ট মিনির বিড়ালটির এই ভয়াবহ পরিণতি দেখে করুণা হচ্ছিল। সে বলে, " আচ্ছা বিড়ালটি যদি এত লোভী আর নির্দয় না হতো তাহলে হয়তো এমনটা নাও ঘটতে পারতো! " মাথায় তখন কেবল একটাই কথা   ঘুরপাক খাচ্ছিল - " সমাজের লোভী, নির্দয়,স্বার্থপর মানুষগুলোরও কি শেষে কর্মফলের কারণে এমন পরিণতিই হয় ? " তাদের অতিমাত্রায় - " আরও লাগবে আরও লাগবে , আরও চাই আরও চাই " এই মানসিক ব্যাধির কারণেই তারা নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে আনে কি! 

 

 

সেলিম সোলায়মানের ‘তিয়েন আন মেনে পথ হারিয়ে’

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৩৫ এএম
আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৩৭ এএম
সেলিম সোলায়মানের  ‘তিয়েন আন মেনে পথ হারিয়ে’

তিয়েন আন মেনে পথ হারিয়ে
সেলিম সোলায়মান
শ্রেণি: ভ্রমণবিষয়ক
প্রকাশনী: উৎস প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ, ২০২৫ 
পৃষ্ঠা: ১৭৬; মূল্য: ৪৫০ টাকা

দিককানা মানুষ তিয়েন আন মেন চত্বরের মতো খোলামেলা বিশাল চত্বরে, চারদিকে আছে যার নানান গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, এরকম জায়গাতেও যে দিকভ্রান্ত হতে পারে, এ হলো সেই গল্প। শীতের বেইজিংয়ের তুমুল হিমে, শিল্পোন্নত চীনের ধোঁয়াশামোড়া তিয়েন আন মেন চত্বরে সপরিবারে দিকভ্রান্ত হয়ে পথ হারিয়ে নাকাল হওয়া, উদ্ধার পাওয়া এবং তৎপরবর্তী নানান মজার ঘটনা মিলে যেসব গল্প জমে উঠেছে, সেসবের সরস বর্ণনা ধারণ করেছে এই বই। গল্পে গল্পে ঘুরে আসা যাক তিয়েন আন মেন চত্বর, বেইজিং ও চীনেরও কিছুটা!

গত ২৪ জানুয়ারি শুক্রবার ধানমন্ডি লেকপাড়ের মোগল সাম্পান রেস্তোরাঁর খোলা চত্বরে বইপ্রেমী সুধীদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল লেখক সেলিম সোলায়মানের চীন-বিষয়ক অষ্টম ভ্রমণালেখ্য ‘তিয়েন আন মেনে পথ হারিয়ে’র পাঠ উন্মোচন।

বইমেলা ২৫ উপলক্ষে ‘তিয়েন আন মেনে পথ হারিয়ে’ প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন!

গীতিকার, নাট্যকার, লেখক ও শিল্পকলা একাডেমির সাবেক পরিচালক আ বা এম ছালাহউদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটির শুভ সূচনা হয় খ্যাতিমান শিল্পী সৌমিত রায়ের এসরাজ বাদনে। এরপর ‘তিয়েন আন মেনে পথ হারিয়ে’ থেকে অংশবিশেষ পাঠ করে শোনায় শিশু শিল্পী রূপকথা রহমান, উচ্ছল নাদিফ ও বাচিক শিল্পী রোটারিয়ান ফরিদা রুমা। এর পর সংগীত পরিবেশন করেন স্বনামখ্যাত স্থপতি শিল্পী রেজাউর রহমান ও তার মেয়ে রূপকথা রহমান।

সাহিত্যসভার ছোটগল্প

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:১৯ পিএম
আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:১৯ পিএম
সাহিত্যসভার ছোটগল্প
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

 

ভালোবাসার লাল করবী
মো. রায়হান পারভেজ

‘তয় আমার জন্য লাল টকটকা একটা গোলাপ ফুল নিয়া আইসো, আমি মনে করমু তুমি আমার জন্য গোলাপ ফুল না, পুরা ভালোবাসাটাই নিয়ে আসছো…’ খুব অনুরক্ত কণ্ঠে শেফালী তার কামনাটি ব্যক্ত করে সুরুজের কাছে। সুরুজের মনে হয় শেফালীর থেকে শোনা এই কামনাটি এক আকাশ স্বপ্নের বাস্তবতার সৌন্দর্য নিয়ে তার সম্মুখে দৃশ্যমান হয়েছে। বাংলাদেশেরই দক্ষিণাঞ্চলের একটি মফস্বল শহর। ছবির মতো এই সুন্দর শহরেরই দুটি পান্থপথিক যেন সুরুজ এবং শেফালী। শৈশবেই বাবা-মা হারানো সুরুজ দারিদ্র্য নামক পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করে বেড়ে উঠেছে। চিরায়ত দারিদ্র্যের অনুপম সঙ্গী হিসেবেই যেন নিয়তির লিখনে তার জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় রিকশানামক ত্রিচক্রযানে যাত্রী আনয়ন। এই শহরেই অপর এক প্রান্তে রয়েছে শেফালীর আবাস। মা-মরা হতদরিদ্র পিতার একমাত্র অবলম্বন শেফালীকে জীবনের রুঢ় বাস্তবতায় বেছে নিতে হয় পোশাক কারখানার কর্মীনামক কঠোর পরিশ্রমের পেশা। শেফালী আর সুরুজের দেখাটি যেন ঠিক দৈবচক্রের মতোই। কর্মস্থলে যাওয়ার তাগিদে পথে দ্রুত হাঁটা শেফালীর সামনে যেন ঠিক ধ্রুবতারার মতোই আবির্ভূত হয় রিকশাচালকের আসনে থাকা সুরুজ। ‘Love at first sight’ তত্ত্বকে সত্যি করে ওই দিন থেকেই সুরুজের মনের পর্দায় একটিই মুখ ভেসে বেড়ায়- শেফালী। হৃদয়ে দোলনচাঁপার গন্ধটি বুকে ধারণ করে উপলব্ধি করলে বোঝা যায় শেফালীর মনেও দোলা দেয় সুরুজ নামের ঝাঁকড়া চুলের সুঠাম দেহের এক তরুণের আবহ। প্রতিদিন চৌরাস্তার মোড়ে পলকে পলকে দেখায় পুঞ্জীভূত ভালোবাসা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে রূপ নেয় পরিণত বৃক্ষে। একদিন আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ- বুকের ভেতর জমা সব সাহসকে একীভূত করে সুরুজ বলেই ফেলে শেফালীকে, ‘আমি তোমার লগে আইজ বিকেলে নদীর কিনারায় গিয়ে কয়ডা কথা কইবার চাই, তুমি কি আইজ কাম হইতে একটু তাড়াতাড়ি আইতে পারবা?’ সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে শেফালী সুধালো, ‘আইতে পারি, কিন্তু তোমারে কথা দিতে হইব, আমি যা চাই সেইটা তোমারে আমার জন্য নিয়া আইতে হইবো।’ সুরুজ প্রত্যুত্তর দেয়, ‘তোমার জন্য যেহানে আমার পরাণ-মন বরবাদ, সেহানে তোমার চাওয়া যেকোনো কিছুই আমি আইনা দিমু, তাতে যদি শরীরের রক্ত বেচা লাগে তয় লাগবে।’ শেফালী হেসে বলে, ‘আরে না না, তোমার রক্ত বেচা লাগবে না, তুমি আমার জন্য লাল টকটকা একটা গোলাপ ফুল নিয়া আইসো…’। অন্য আর হাজারটি দিনের চেয়ে আজকের দিনটি জনৈক সুরুজের জীবনে বিশেষ থেকে বিশেষতর। সে ঠিক করল খুব বেশি সময় আর আজকে রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়াবে না। ঠিক তাই হলো, দুপুরের মধ্যেই রিকশাটি গ্যারেজে রেখে সুরুজ ফিরল তার ছোট্ট সুখের কুঁড়েঘরে। নিজের যত্নের সঞ্চয়ে কেনা নীলাভ রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামাটি পরিধান করে সুরুজ বেরিয়ে পড়ে তার কাঙ্ক্ষিত পথের পানে। শহরের মধ্যখানেই গোলাপ ফুলের তিন-চারখানা সারিবদ্ধ বিপণি। কিন্তু সুরুজের স্বপ্নের জোয়ারে অনেকটাই ভাটা পড়ে, যখন সে দেখে প্রতিটি দোকানই তালাবদ্ধ। হতাশায় মুষড়ে পড়া সুরুজ ঠিক পাশেই দণ্ডায়মান স্টলের একজন কর্মীকে প্রশ্ন করে জানতে পারে গত দুই দিন ধরে গোলাপ চাষিদের ধর্মঘট চলছে, যার ফলে এই শহরের কোনো ফুলের দোকানেই গোলাপ ফুলের আমদানি হয়নি। সুরুজের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে, সে হন্তদন্ত হয়ে লাল গোলাপের হন্য করতে থাকে। কিন্তু ওই ছোট শহরে শখের গোলাপবাগান আছে এমন কারও সন্ধান তার নজরে আসে না। যখনই তার মনে হয় প্রিয়তমার প্রথম কথা রাখার স্নিগ্ধ অনুভূতি থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে, তখনই তার মনে ভেসে ওঠে বর্ষীয়ান ভিক্ষুক তার প্রতিবেশী বশির চাচার কথা, ভিক্ষার তাড়নায় যার পদার্পণ হয়েছে এই শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙিনায়। বশির চাচার মাধ্যমে সুরুজ জানতে পারে শহরতলির ঠিক কাছেই একটি খামারবাড়িতে ফুটে উঠেছে সাদা করবী ফুল। ঠিক গোলাপের মতোই আকৃতির এই সফেদ করবী ফুলই হতে পারে সুরুজের সেই আরাধ্য বস্তু। বশির চাচার থেকে শুনে সুরুজ ছোটে করবী ফুলের সন্ধানে। খামারবাড়ির মালিককে বলে-কয়ে সুরুজ তার বাগান থেকে তুলে নেয় শুভ্র, পবিত্র ও শ্বেত একটি উজ্জ্বল করবী ফুল। করবীর দিকে মুখ তুলে সুরুজের হৃদয়টি যেমন প্রশান্ত হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি হৃদয়ের এক কোণে আশঙ্কা ও দুঃশ্চিন্তার কালো মেঘ তার মনকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। যে রক্তিম লাল বর্ণের গোলাপের বাকরুদ্ধ প্রতীক্ষায় তার প্রিয়তমা শেফালী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, সেই অপেক্ষার অবসান হবে এক ইচ্ছাভঙ্গের অবতারণায়, তা ভেবে সুরুজের মুহূর্তগুলো বিষাক্ত হয়ে ওঠে। এক রাজ্য প্রজাপতিমিশ্রিত ভালোবাসা উপহার দেওয়ার বদলে এক আকাশ কষ্ট শেফালীকে উপহার দেবে, এই চেতনা সুরুজকে মনের সঙ্গে এক নতুন যুদ্ধে অবতীর্ণ করে। প্রগাঢ় ভালোবাসার স্বর্গীয় প্রেষণা নিয়ে সুরুজ মনের সঙ্গে লড়াইয়েও জয়ী হয়, ঠিক নিকটবর্তী একটি ফলের দোকান থেকে সংগ্রহ করে ধারালো এক ছুরি। কালবিলম্ব না করে ছুরির এক তীক্ষ্ম আঘাতে কেটে ফেলে তার নিজ হাতের শিরা। রক্তাক্ত শিরা থেকে প্রবাহিত রক্তের স্পর্শে সাদা করবী ফুল ধারণ করে রক্তিম লাল বর্ণ। তীব্র ব্যথাকে ছাপিয়ে যায় সুরুজের প্রশান্ত মন থেকে উৎসারিত অট্টহাসি। এক নিঃশ্বাসে লাল গোলাপসদৃশ রক্তমাখা করবী নিয়ে সুরুজ ছোটে নদীর তীরে অপেক্ষমাণ প্রেয়সী শেফালীর পানে। ক্রমাগত রক্ত নির্গতের ফলে জীবনীশক্তি নিঃশেষিত হওয়ার পথেও রক্তভেজা করবী হাতে শেফালীর মুক্তাঝরা হাসি তার কাছে এক পৃথিবীর ভালোবাসার সংজ্ঞা নতুন করে জানায়। স্বার্থভরা কণ্টকময় পৃথিবীতে অনন্ত বেঁচে থাকার ক্ষণের থেকেও প্রেয়সীর স্নিগ্ধ মুখের মায়াভরা চাহনির এক চিলতে হাসি সুরুজের নিকট শ্রেয় থেকে শ্রেয়তর হয়ে ধরা দেয়…। 

সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৫৩ পিএম
আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৫৪ পিএম
সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

 

ফুলের গালে টোল
মোরশেদুল ইসলাম

এক শীতের মাসের গল্প
হৃদয়ের উঠোনজুড়ে
জেঁকে বসে বরফ সময়
দ্রাক্ষালতার মতো হৃদয়
স্রেফ আশাকে পেঁচিয়ে
চেয়ে ছিল ওপরের দিকে
কত ফুল দিয়ে গেছে
হেমন্ত মোহিনী
মাটি হিম হওয়ার খানিক আগে
তবু মন কার যেন প্রতীক্ষায়
তীব্র, তীব্রতর শীত শেষ
বসন্তের শুরু হয় হয় ভাব
ফুল আসলো অবশেষে
উজ্জ্বল হলুদ রঙে হেসে
নাগরেরা ভালোবেসে নাম দেয়
জুঁই
রৌদ্রোজ্জ্বল হৃদয়জুড়ে
ধূসর এক সময়
আলিয়া ভাটের মতো টোল পড়ে
জুঁইয়ের দুর্দান্ত গালে!

সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:০৫ এএম
সাহিত্যসভার মুক্ত কবিতা
অলংকরণ: মেহেদী হাসান

 

অন্ধ মনের চোখ
মো.আশতাব হোসেন 

ক্ষতের উপর ক্ষত করলে ক্ষত হয় বিক্ষত
তার পরে করলে আঘাত নীলকণা হয় বিস্ফোরিত। 
একই কথা বারবার বললে লাগতে পারে তিতা
যে পাত্রে ধারণ হয়না সে পাত্র নয় কি ফুটা? 

বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে না পাইলে তার জবাব
তার ভিতরে কি আছে বিবেক জীবন্ত সজাগ? 
বিবেক বিহীনা বালির পুতুল ধরতেই ভেঙ্গে যায়
 করতে অপারগ নিজের সুবিচার। 

নিজের ভুল ধরতে পারেনা অন্ধ মনের চোখ
ভুলগুলি ভুল হিসাবে থাকে ভুলের গুদাম,
অন্যের ভুল ধরতে যাওয়া  সাধ্য নেই তার 
শুদ্ধি বুদ্ধি গজায় না প্রাণে ভুলেরই হয় পাহাড়। 

তারাই পারে ক্ষতের উপর আরো ক্ষত করতে
তাদের থেকে দূরসীমানায় বসত উত্তম স্থান, 
শুনতে মানা তাদের মুখের মিষ্টি সুরের গান 
তাদের মতো  মমতাহীনার মোম পরশে
বিবেকবিহীন পুতুলের হয় উত্থান।