করোনারি আর্টারি
দ্বীপ সরকার
হৃৎপিণ্ডের চারপাশে ছড়িয়েছে প্রশাখার নদী-
পরাগের কুসুমে হরদম বেলুনের মতো
বিচলিত ফড়িং সশব্দে নাড়ছে ডানা
ধুকপুকিয়ে ওঠা নদীর ঢেউ মাড়িয়ে
কোথায় যায় রক্তের কুসুমনালির মহাসড়কে-
ক্রীয়াশীল বেলুনে
উঠছে নামছে ইসিজির চিকন চিকন দাগ
তাবৎ রক্ত- জটিল ধাঁধার স্রোতে
কখন আটকে যাবে নীল পদ্ম
তখন আমাকেও থেমে যাতে হবে।
একি তুমি
চিরঞ্জীব চ্যাটার্জী
বিকেলের নির্জন সাগর কিনারে হে বিভ্রম হাঙ্গর,
তোমার উচ্চকিত গ্রীবায় আমি বিনোদন খুঁজি...
কিন্তু আমার উদ্ভাসিত চৈতন্যে তখনই ছেদ পড়ে-
যখন পশ্চাতে শুনি, ‘একি তুমি নারী,
একাকী কেন এই নির্জন সমুদ্রসৈকতে।’
রান্নাবান্না
সায়্যিদ লুমরান
তোমারও নিজস্ব একটা পৃথিবী আছে। তবে এর কোনো ভৌগোলিক
সীমা এবং দ্রাঘিমা নেই।
সেই গ্রহে-
ইচ্ছে হলেই মধ্য দুপুরে সূর্য ডুবিয়ে দিতে পার দীর্ঘ এক ঘুম,
অথবা হতে পার কোনো মৃত বা জীবিতের মুখোমুখি।
ডেকেও আনতে পার শ্রাবণের মাঝামাঝি পৌষকে,
যদি তোমার হঠাৎ শীতের রোদ্দুরকে খুব বেশি মনে পড়ে যায়।
এবং নীলনকশাও আঁকতে পার ঈশ্বরকে হত্যার, আর রূপান্তরের
পর হয়ে উঠতে পার- প্রতিনিধি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী।
রক্তক্ষরণ
নকুল শর্ম্মা
গল্প জমে না চায়ের চুমুকে-
রাহুগ্রাসে হারিয়ে গেছে গল্প বলার উপন্যাস,
ভালোবাসার চোরাগলি বেয়ে হয় না তোমার উপস্থিতি।
চাঁদের মুখে মেঘের ভিটেবাড়ি-
জোছনার আলো ঢাকা পড়েছে বৃষ্টির ঘন বর্ষায়,
আমার বুকে রৌদ্রতপ্ত চৈত্রের বসবাস।
অপেক্ষার দুয়ারে বৈষম্যের খিলকাটি-
অবেলায় ঝরে পড়ে শরতের স্নিগ্ধ শিউলি,
ব্যথার পাহাড়ে উল্টো কাঁটার নির্লজ্জ তিরস্কার।
গান থেমে যায় কণ্ঠের ক্ষত আঘাতে-
হৃদয়ের থরে থরে ভালোবাসার রক্তক্ষরণ,
নির্বাক চেয়ে থাকা সীমাহীন জিজ্ঞাসায় সমুদ্র পানে।
হলুদিয়া পাখি
ইফতেখার হোসেন সিদ্দিকী
সেই কবে কোন ঠিকানায়
বসেছিল এক হলুদিয়া পাখি
গেয়েছিল শুধু বিরহের গান,
কোন পথ ধরে চলে যায়
নক্ষত্র বীথিকা দূর থেকে দূরে
অঘ্রাণে কেউ তো দিয়েছিল শিস
তবুও দূরে যায়, যায় উড়ে।
একচুল
এস ডি সুব্রত
মরতে মরতেও বেঁচে থাকি
আশ্চর্য তুমুল,
আচমকা প্রবল প্রতাপে কীভাবে জানি
নিমেষেই উড়িয়ে দিই
জীবনের যত দুঃখ যন্ত্রণা ভুল,
কেবল অশরীরী ভালো লাগা পেলে একচুল।
বিভাজনের প্রাচীর
আলমগীর কবির
এত কেন বিভেদ চারপাশে।
বিভেদের স্ফুলিঙ্গ পোড়ায় ভালোবাসার দেয়াল।
এত ঘৃণা কেন চারপাশে?
ঘৃণার কাঁটায় রক্তাক্ত হয় মন।
চলতে চলতে থমকে দাঁড়াই!
সামনে দেখি বিভাজনের প্রাচীর!
এত আঁধার কেন চারদিকে
একনিমিষে ঢেকে ফেলে চাঁদের হাসি মুখ!
অথবা অন্য আরও কিছুর জন্য
আল জাবিরী
তোমার কাটাছেঁড়া কথাগুলো
আমি জোড়া লাগিয়ে
তৈরি করি কবিতা।
আমার কবিতা সরলভাবে চলে
ঠিক তোমার মতো।
আবার কখনো সখনো
কবিতার বুক ছিঁড়ে
গজিয়ে ওঠে সবুজ পাহাড়
খেয়াল করলেই দেখবে গহিন অরণ্য
মাঝখানে কলকল করে
ছুটে চলে
সুন্দরী ঝরনাধারা।
কবিতা লিখতে গেলে
বারবার
তোমার কাছে ফিরে আসতে হয়
আমাকে।
হয়তো কোনো জুতসই উপমার জন্য
কিংবা ছন্দের দ্যোতনার জন্য
অথবা
অন্য আরও কিছুর জন্য।
অসহ্য স্বাধীনতা
সাজু কবীর
নাকদড়ি ছেঁড়া ষাঁড় তেড়ে আসে লম্ফঝম্প দিয়ে
তাগড়া ত্রাসে সন্ত্রস্ত পায়রারা উড়াল দেয় নিরুদ্দেশে
ঘুঘুদল নৃত্য ছেড়ে প্রাণভয়ে দ্রুত লুকোয় সরষে খেতে
তীক্ষ্ণ দাঁতে পয়মাল মাঠের সবুজ ভালোবাসা
এ কেমন ইচ্ছেসুখ! বলো, এ কেমন স্বাধীনতা!
অরক্ষিত রক্তবিল যেন জলৌকার সুরক্ষিত গোলাবাড়ি
লালপদ্ম নীল হয়, কাণ্ডে তার শুষ্ক মরুভূমি
খলসে নেই, পুঁটি নেই; বক নেই, নির্বাক ডাহুক ডাহুকি
শ্যাওলার দামে দমবন্ধ বিলের জীবনে পরাজয়ের গ্লানি।
অনুক্ষণ হানা দেয় সংসারের মৌচাকে দুর্বৃত্ত
কাফনমোড়া ইজ্জত মড়িঘরে শুয়ে থাকে নিত্য
বেজন্মা পেশিওয়ালা পাগলা কুকুর হয়ে ছোটে
‘ঘা খাওয়া অধিকার’ প্রতিনিয়ত মাথা কুটে মরে।
লুটেরা জাগ্রত সদা
তল্লাটে তল্লাটে লুট হয় স্বাধীনতা,
লুট হয় নাগরিক, জ্বালার জলে নগর ভাসে
দস্যুদের হুইসিলে ‘মানবিক বন্দর’ থরথর কাঁপে।
সভ্য বলে দাবি করি অথচ নিরুদ্দেশ সভ্যতা
কেউ মারে, কেউ মরে; কেউবা নির্বিঘ্ন, কেউবা শৃঙ্খলে বাঁধা
এ কেমন স্বাধীনতা! এ যেন অসহ্য স্বাধীনতা!
পুড়েছে তো বাংলাদেশের হৃদয়
ইদরিস আলী মধু
মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায় না মাথার ওপর ধোঁয়ার উত্তাপ
সম্মুখে যাওয়া যায় না কাঁটার দেয়াল
টাঙানো
পেছনে ফেরা যায় না দাউদাউ আগুনসন্ত্রাস ঘিরে নেমেছে।
কারা আগুন দিল
কারা মেতে উঠল এমন ঘৃণ্য ধ্বংসলীলায়।
কোনো অগ্নিদাতা জানে কি বত্রিশ নম্বর, জানে কি মুজিব
জানে কি মুক্তিযুদ্ধ
জানে কি বাংলাদেশের ইতিহাস?
বাঙালির প্রাণ, স্বাধীনতার রোপিত স্বপ্ন- বীজ, সৌর্য- বীর্য আর কতক্ষণ জীবিত থাকতে পারে।
দেখতে দেখতে পিতার খাট, আলনা, আলমেরা, চশমা, পাঞ্জাবি, প্রিয় পাইপ, জুতা, সিঁড়িতে রক্তের দাগ পুড়ে ছাই।
কে বলেছে বত্রিশ নম্বর পুড়েছে
পুড়েছে তো বাংলাদেশের হৃদয়।