অচীনপুরে কেমন আছো জানি না। তবে তোমার প্রতি আমার যে ভালোবাসার তীব্রতা, সেই ভালোবাসাগুলো জানান দিয়ে যায়, সুনীল বাবুরা কখনো খারাপ থাকতে পারে না। অমরত্বের যে হেমলক তুমি পান করেছো, তা তোমাকে অনন্তকাল স্বর্গের সিংহাসনে বসিয়ে রাখবে, এ আমার অগাধ বিশ্বাস! তোমাকে চর্মচক্ষুতে একটাবার দেখার সুযোগ হলো না, আমৃত্যু এ আক্ষেপ আমাকে পোড়াবে।
খুব ইচ্ছে করে কলকাতার ম্যান্ডেভিল গার্ডেনসের পারিজাত ফ্ল্যাটে ছুটে যাই, সেখানে আজও তুমি জীবন্ত হয়ে আছো। ইচ্ছে করে তোমার অস্তিত্বকে ছুঁয়ে দিয়ে আসি সেখানে গিয়ে। তোমার সহধর্মিণী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তোমাকে নিয়ে অনেক অনেক গল্প করার ইচ্ছে জাগে জানো। কিন্তু চাইলেই যে অনেককিছু সম্ভব হয় না। ছোট হয়ে জন্মানোর এ এক অভিশাপ!
আচ্ছা সুনীলবাবু, তোমার প্রিয় পদ্মা নদীটা আজো যে একেক সন্ধ্যেয় তোমার জন্য কাঁদে, তুমি কী ভিনগ্রহ থেকে শুনতে পাও সেই কান্নার আওয়াজ? দেশভাগের কষ্ট তোমাকে কী প্রবলভাবে ছুঁয়ে গেছে, তোমার অনেক লেখা পড়ে জেনেছি। ভীষণ ইচ্ছে, মৃত্যুর আগে যদি দেখে যেতে পারতাম দুটো দেশ আবার এক হয়ে গেছে, কাঁটাতারের বেড়াটাকে উপড়ে ফেলা হয়েছে, আবার হিন্দু মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শুধুমাত্র মানুষের পরিচয়ে বেঁচে থাকছে! এমনটা হওয়ার নয় জানি, তবু ভীষণভাবে স্বপ্ন দেখি। মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা পাশাপাশি থাকলে যতোটা সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা হয়, তামাম দুনিয়ার সৌন্দর্য জড়ো করলেও এরচেয়ে বেশি সুন্দর হবে না!
একটামাত্র ছোট্ট পৃথিবী, তার মধ্যে কেন এত দেশভাগ, কাঁটাতারের বেড়া, এ হিসেব আমি বুঝি না। অস্থায়ী মানবজনমে কেন সবাই ভালোবেসে একসঙ্গে পথ চলতে পারে না, বলতে পারো? তুমি নিজে দেশভাগ হতে দেখেছো, আমার চেয়ে তোমার যন্ত্রণা অনেক বেশি। তুমি নিজেও এ বাস্তবতার শিকার। কিন্তু আমি না দেখেও দেশভাগের যন্ত্রণা যতোটা অনুভব করি, আমার এত বছরের জীবনে এর চেয়ে বেশি যন্ত্রণাবোধ অন্য কোনো কারণে হয়নি কখনো!
দেশভাগের পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তুমি এপার বাংলায় বহুবার এসেছো, এমনকি ওপার বাংলাকে ভালোবাসলেও কোনোদিন তাকে জন্মভূমির স্বীকৃতি দিতে কিংবা নিজের দেশ ভাবতে পারোনি, আমি জানি। দেশভাগের পর একবার যখন তুমি তোমার মাদারীপুরের সেই মাঈজপাড়া গ্রামে গিয়েছিলে, কেউ তোমাকে চিনতে পারেনি। সেই বাঁশ বাগান, বেগুন লঙ্কার ক্ষেত, ঘাসফুল, সন্ন্যাসীর মতো নদী, মায়াবতী সন্ধ্যে, কিছুই ছিলো না সেখানে। তোমার উঠোনের সেই লম্বা গাছের ডালে আর পেঁচা ডাকে না, জানো। তোমার মায়ের রান্নাঘর, কুপির আলোয় ছোট্ট সংসারের ছায়া, সন্ন্যাসী নদীর কিনারের সেই বাড়ি সবটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে আজ। সবটা জুড়ে অদ্ভূত এক পবিত্র শূন্যতা!
আমি জানি, তুমি ভিনগ্রহে বসেও পদ্মানদীর সেই স্টিমারের ভেঁপু, বর্ষার জলে ভেজা কচুরিপানা উঠোন, আড়িয়াল খাঁর তীর ধরে ছুটে বেড়ানো দুরন্ত কৈশোর, বাড়ির গাছপালা, পাখির বাসা, নির্জন পুকুর ঘাট, তুলসি তলা, সুপুরি গাছের সারি, মাটির দেয়ালে গাঁথা তোমার সেই বাড়ি, বাঁশের সাঁকো, পড়শি নদী, তোমার সেই জ্যোৎস্না মাখানো গ্রাম, সবকিছু খুব মিস করো। আজ আর পদ্মানদীতে মাঝরাত্রিরে কোনো নৌকা থেকে ভিনদেশি মাঝির গান ভেসে আসে না। শিশির পতনের নীরবতাগুলো কবেই হারিয়ে গেছে। তোমার দেখা সেই বাঁশের সাঁকোটাও ভেঙে গেছে কবে। উঠোনের জামরুল গাছটাও নেই, তোমার স্বপ্নে দেখা সেই ফৈজুদ্দিন নামের নৌকার মাঝিটাও মারা গেছে, তোমার মায়ের শেষ সম্বল দু'গাছা সোনার চুড়ি বন্ধক নিয়েছিলো যে চেতন স্যাকড়া, সেও জীবনের লেনাদেনা শেষ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। পাটক্ষেতে ফিসফিসানি, দিঘীতে ডুবন্ত চাঁদ দেখে মুগ্ধ হওয়া, ঝুরো বৃষ্টিতে দাপিয়ে বেড়ানো, উদ্দাম কৈশোর, প্রযুক্তির আবির্ভাবে এ সবকিছু হারিয়ে গেছে মাঈজপাড়া থেকে। গোয়ালঘরের পাশে মাঝরাতে যে বোবা কালা ভূতপ্রেত ডাকতো বলে তুমি ভয় পেতে, আধুনিক মানুষ আজ তাকে কুসংস্কার ভাবে।
তোমার কোমর ভাঙা প্রভা পিসীমা মারা গেছে সেই কবে। তোমার বাতাবি নেবুর গাছটাও মরে গেছে তোমার শোকে। ভরা বর্ষায় রান্নাঘর ডুবে গেলো বলে চিৎকার করা তোমার ঠাকুমা গত হয়েছে তোমারও আগে। তার ফ্রেমে বন্দী ছবি দেখে কত মন খারাপ হতো তোমার, কত নস্টালজিয়ায় ভুগতে তুমি, আমি জানি। তোমার ঠাকুর্দা মারা গিয়েছিলো তোমারও জন্মেরও আগে। তবু তুমি তোমার ঠাকুর্দাকে কল্পনায় নিজের মতো করে একটা অবয়ব দিতে। ভাবতে, তোমার ঠাকুর্দা হুঁকো হাতে দাওয়ায় বসে আছে, কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেলেই সে ভাবতো হয়তো তোমার বাবা ঘরে ফিরেছে। শহরে মাস্টারি করে সংসার চালানো তোমার বাবাকে আমি সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই, তিনি একজন সত্যিকারের সংগ্রামী বাবা। আর তোমার আত্মত্যাগী মা, যে কিনা সংসারের স্বচ্ছলতার প্রয়োজনে নিজের শেষ সম্বলটুকু বন্ধক রেখেছিলো, সে দেবী হয়ে আমার হৃদয়ের মন্দিরে চির জাগ্রত!
রাজা-ভাত-খাওয়া ইস্টিশনে তুমি জীবনে একবারই তক্ষকের ডাক শুনেছিলে, মনে আছে সুনীল? সেই ডাকটা তোমার মনে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিলো যে, পরবর্তী জীবনে তুমি স্বপ্ন দেখতে বারবার খালের ধারে বটবৃক্ষে এক তক্ষকের বাসা, যে রোজ ঠিক সাত বার ডাকতো, একবারো ভুল হতো না কোনোদিন। আরো কত কী স্বপ্নে দেখতে তুমি, কিন্তু শেষ অব্দি ঘুমভেঙে নিজেকে আবিষ্কার করতে ম্যান্ডেভিল গার্ডেনসের সেই পারিজাত ফ্ল্যাটে। আজ আর দেশে বন্যা হলে কেউ জলপাইগুঁড়ি, মালদার দিকে আশ্রয়ের জন্য ছুটে যায় না, একটা কাঁটাতারের বেড়া শুষে নিয়েছে সমস্ত অধিকার। আর তোমার জীবদ্দশাতেই তুমি দেখে গেছো, তোমার সেই মাঈজপাড়া গ্রাম শুধু বদলেই যায়নি, বদলে গেলেও মেনে নিতে পারতে, কিন্তু তোমার সেই গ্রামটা একেবারে শূন্যে বিলীন হয়ে গেছে। আর কোনো চেনা মানুষ নেই সেখানে, কে কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। এখন আর শেষ বিকেলে তোমার সেই চিরচেনা পুকুরঘাটে কোনো গ্রাম্য নারী জল সইতে যায় না। তোমার হাসাহাসির খোরাক যোগানো সেই শান্তি আর বিন্তী যমজ পিসী দেশভাগের পর কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না!
তোমার যে বন্ধু আজানের শব্দ শুনে জেগে উঠতো, যার সাথে তুমি অনেক ঝগড়া করতে, যে গাব গাছে উঠে তোমাকে ডাব পেড়ে খাওয়াতো, সেই বন্ধু 'আনোয়ার' যার নাম, তাকে তুমি হারিয়ে ফেলেছিলে ঐ খেলার বয়সেই, নদীতে তোমাদের গ্রামের অনেকটা অংশ ভেঙে গিয়েছিলো বলে। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তুমি তোমার ঐ বন্ধুকে কতটা যত্ন করে মনে রেখেছিলে, সে খবর আমি জানি!
তোমাদের গ্রামে এসে যখন তুমি কোনো চেনাজনকে খুঁজে পাওনি, কান্নায় দমবন্ধ হয়ে এসেছিলো তোমার, অনেক চেনা নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছে করেছিলো কিন্তু তুমি পারোনি। এ যে কী ভীষণ যন্ত্রনার! রাজ্জাক হাওলাদার নামের লোকটা, যার জন্মের আগেই তুমি মাঈজপাড়া ত্যাগ করেছিলে, যার সাথে তোমার কোনো সম্পর্কই ছিলো না, তবু তাকে দেখে তোমার খুব আপন মনে হয়েছিলো, শুধু সে মাঈজপাড়ার সন্তান বলে। শেঁকড়ের টান তো এমনই হয় সুনীলবাবু!
একবার তোমার এক সঙ্গীকে নিয়ে যখন তুমি মাঈজপাড়া যাচ্ছিলে সে তোমায় বলেছিলো, 'যে নার্সিংহোমে জন্মায়, সে কী বারবার সেখানে ফিরে আসে?' তুমি সেদিন তার কথার কোনো উত্তর দাওনি। আসলে শেঁকড়ের টান টা উপলব্ধি করার বিষয়, এটা কাউকে ব্যাখ্যা করে বোঝানো যায় না!
তোমার সেই গ্রামের কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই, এ নিয়ে ভীষণ কষ্ট তোমার। শুনেছি, ছেলেকে পড়াতে বসালেই তুমি তার চোখে গল্পে গল্পে সেই গ্রামের ছবি এঁকে দেওয়ার চেষ্টা করতে। তুমি চাইতে, সে তোমার জন্মস্থানকে মনে রাখুক। তোমার ছেলে কতটুকু মনে রেখেছে জানি না, তবে তোমার সেই গ্রামটাকে আমি ছবির মতো মনের খু্ব গভীরে এঁকে রেখেছি। খুব ইচ্ছে হয় জানো, তোমার সেই জন্মস্থান তোমার পূণ্যভূমি মাঈজপাড়া ছুটে যেতে। যদি একবার সেই মাঈজপাড়ার মাটি মাথায় ছোঁয়াতে পারতাম, জীবন ধন্য হয়ে যেতো। কিন্তু তুমিই তো বলেছো, মাঈজপাড়ার কোনো চিহ্নই এখন আর অবশিষ্ট নেই। তাই আমারও আর যাওয়া হয়নি কোনোদিন। প্রসঙ্গক্রমে তোমার একটা কবিতা মনে পড়ে গেলো-
"বগুড়া রোড, বাঁকের মুখে বাড়ি
টালির চাল, কাঁঠাল গাছের ছায়া
কালকাসুন্দি, হেলেঞ্চার বেড়া
শীতের রোদে ছড়িয়ে আছে মায়া।
সদর দ্বার অনেকখানি খোলা,
কেউ কি আছে? বাগান বেঁচে আছে,
নরম মাটি, মৃদু পায়ের ছাপ,
ইস্টিকুটুম পাখিটি নিম গাছে।
কবির বাড়ি, কবি এখন নেই,
শতাব্দীও ফুরিয়ে এলো ক্রমে,
বাতাসে ওড়ে ছিন্ন ইতিহাস,
জীবন ভাঙে ইতিহাসের ভ্রমে।
কবির বাড়ি, কবি এখন নেই,
তাহলে আর ভেতরে কেন যাওয়া,
একটা ভ্রমর গুণগুণোচ্ছে একা,
শব্দটুকুই পাওয়ার মতোন পাওয়া"
ভালো থেকো সুনীলবাবু। তোমাকে আরো অনেক কথা বলা বাকি। অন্য চিঠিতে বলবো নাহয়! আজ তবে আসি।
ইতি
মোহনা জাহ্নবী