ঢাকা ২৫ আষাঢ় ১৪৩২, বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫
English

কাস্তেচরার চীন অভিযান

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ১১:১২ এএম
আপডেট: ১৮ মে ২০২৪, ১১:১৩ এএম
কাস্তেচরার চীন অভিযান
ছবি: লেখক

পাখিপ্রেমীদের জন্য সুখবর। বাংলাদেশে খয়রা-কাস্তেচরার সংখ্যা বাড়ছে। দুই দশক আগে এর সংখ্যাটা শূন্য ছিল, এখন কয়েক হাজার হয়েছে। আরও তাজা খবর হলো, সুদর্শন এই পাখি এবার হাজির হয়েছে হাইনান দ্বীপে। গত দুই সপ্তাহ ধরে চীনের স্বশাসিত এই দ্বীপে প্রথমবারের মতো খয়রা-কাস্তেচরার দেখা মিলেছে। 

গত ১১ মে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবসে হাইনানবাসীরা পেয়েছেন কাস্তেচরার চমকপ্রদ এ উপহার। তবে চীনে পাখি-দর্শকের চেয়ে পাখি-ভক্ষকের সংখ্যা বেশি। তাই হাইনান-প্রশাসক নবাগত এই পাখির জন্য ‘প্রথম-স্তরের নিরাপত্তা’ ঘোষণা করেছেন। বিশ্বে আর কোথাও খয়রা-কাস্তেচরার জন্য কখনো এই ঘোষণা দেওয়া হয়নি। 

বিশ্বে খয়রা-কাস্তেচরার প্রসার ঘটছে গত তিন শতাব্দী ধরে। তার আগে সম্ভবত এর নিবাস ছিল একমাত্র আফ্রিকা মহাদেশে। এ পাখি ইউরোপ মহাদেশের পর্তুগাল, স্পেন ও ফ্রান্সে বাস করছে গত ২০০ বছর ধরে এবং ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও ইউরোপের শীতল উত্তরাঞ্চলে এর বিস্তৃতি ঘটেছে মাত্র ১৫ বছর আগে। 

আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে খয়রা-কাস্তেচরা আমেরিকা গেছে মাত্র ১০০ বছর আগে। এই এক শ বছরে আমেরিকা মহাদেশদ্বয়ের পূর্ব উপকূল বরাবর এর বসতি দ্রুত বিস্তৃত হয়েছে এবং ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ পাখির বাড়বাড়ন্ত ঘটেছে সবচেয়ে বেশি।

অস্ট্রেলিয়ায় এ পাখি বাসা বাঁধছে ১৯৩০ থেকে। সম্ভবত তার আগেই এরা পশ্চিম ভারতে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিল। শীতে বাংলাদেশেও এর আগমন ঘটত। কিন্তু বিশ শতকের শেষ দিকে এ দেশে এ পাখি আর দেখা যায়নি। গত দুই দশক ধরে আবার এদের দেখা মিলছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধিও হচ্ছে। এই দুর্দিনে খুব কম পাখিই এভাবে সংখ্যাবৃদ্ধি করতে ও ছয়টি মহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে। 

খয়রা-কাস্তেচরার এই সাফল্যের কারণ কী! প্রথম কারণ, এর আহারে বাছবিচার কম। পোকামাকড়, শামুক-ঝিনুক, কাঁকড়া-বিছা, সাপ-ব্যাঙ, কেঁচো-জোঁক সবই আছে তার খাবারের তালিকায়। আবার কাদায় আটকে থাকা বীজ-দানা খেতেও আপত্তি নেই। দ্বিতীয় কারণ, চরম যাযাবর এই পাখির ছানারা বাসা ছেড়ে যাওয়ার পরই দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। কৃষ্ণসাগর এলাকায় রিং লাগিয়ে দেওয়া একটি ছানাকে সাহারা মরুভূমি পার হয়ে পূর্ব-আফ্রিকায় চলে যেতে দেখা গেছে। 

অনেকে অনুমান করেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে পোকামাকড়, কাঁকড়া-বিছা ইত্যাদির বাড়বাড়ন্ত হওয়ায় খয়রা-কাস্তেচরার মতো পাখিদের প্রসার ঘটছে। আমরা অনুমান করি যে সুদর্শন, সৌম্য ও প্রসন্ন এ পাখিটির জন্য মানুষের ভালোবাসাও এর সাফল্যের পিছনে রয়েছে। অভিজাত এই পাখির পশমি-খয়েরি মাথা ও গলা, উজ্জ্বল তামাটে ও ধাতব সবুজ ডানা এবং সজল কালো চোখ সহজেই লোকের দৃষ্টি কাড়ে।

মানুষের আহার্য হিসেবে এ পাখি যে বেশি আকর্ষণীয় নয়, সে কথাটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আকারে বিশাল হলেও এর গায়ে মাংস খুবই কম। লম্বা পায়ের আঙুল থেকে দীর্ঘ চঞ্চুর প্রান্ত পর্যন্ত মাপলে পাখিটি দুই ফুট লম্বা; কিন্তু ওজন মাত্র আধা কেজি। পলকা দেহের এই পাখি তাই তিন ফুট পরিসরের দুটি ডানায় ভর করে সহজেই উড়ে পালায়, পার হয় মহাদেশ ও মহাসাগর। 

এখন আমরা শীতে বাইক্কা বিল, টাঙ্গুয়ার হাওড় ও ভোলার চরাঞ্চলে শত শত খয়রা-কাস্তেচরা দেখতে পাই। ভবিষ্যতে এ পাখি ভোলার চরাঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেও আমরা অবাক হব না। মাত্র ১৫ বছর আগে ইংল্যান্ডে পরিযায়ন করে এখন সেখানে এরা থিতু হয়েছে এবং লিঙ্কনশায়ারে বাসা করছে বলে সংবাদ এসেছে। 

পৃথিবীর ২৯ প্রজাতির কাস্তেচরার মাত্র তিনটিকে আমরা বাংলাদেশে দেখতে পাই। সবচেয়ে বেশি দেখি কালামাথা-কাস্তেচরা এবং সবচেয়ে কম কালা-কাস্তেচরা। তিন প্রজাতির কাস্তেচরাই এ দেশে থাকে শীতকালে। এখানে এরা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে এবং বাসা বাঁধলে মন্দ কী! জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত যেসব উপকূলীয় চরে মানুষের ঠাঁই নেই, সেখানেই তো সব কাস্তেচরাদের আনাগোনা। উষ্ণায়নের জোয়ারে তা তলিয়ে যাওয়ার আগে ওরাই থাকুক না ওখানে ছানাপোনা নিয়ে। 

দেখা পেলাম পাতা বিটল পোকার

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১০:১২ এএম
দেখা পেলাম পাতা বিটল পোকার
ঢাকার শেরেবাংলা নগরে দুই ফোঁটাযুক্ত পাতা বিটল পোকা। ছবি: লেখক

গত ৪ জুলাই ছুটির দিন। বর্ষাকাল বলে মাঝে মাঝেই আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরছে। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সকালে গেলাম শেরেবাংলা নগরে বৃক্ষমেলায়। সকাল ১০টা বেজে ১০ মিনিট। মেলায় ঢোকার আগেই বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র পেরিয়ে রাস্তার ধারে জন্মানো একটা বুনো ঝোপের দিকে হঠাৎ চোখ পড়ল। অর্জুন গাছ, তার পাশে একটি তালের চারাগাছ। তালপাতায় জড়াজড়ি করছে অমললতা বা অনললতা, কিছু ঘাসও জন্মেছে গোড়ার মাটিতে। এসব ঝোপের ভেতর কমলা রঙের কিছু পোকা উড়াউড়ি করছে, অমললতায় হেঁটে বেড়াচ্ছে। ছবি তুলতে গেলেই মনে হয় আমার উপস্থিতি টের পেল পোকাগুলো। ঝুপ করে পড়ে গেল সেখান থেকে মাটিতে, লুকিয়ে পড়ল ঘাসপাতার ভেতরে। অসুবিধে নেই। আরও কয়েকটা তো রয়েছে দেখছি। একটা তালপাতার ওপর তিনটে পোকা বসে মনে হলো ঝিমুচ্ছে, প্রায় নিশ্চল হয়ে বসে রয়েছে। ওগুলোর গায়ে গাছের ছায়া পড়ায় সে জায়গা কিছুটা অন্ধকার হয়ে রয়েছে। লতা ও পাতা সরাতে সাহস হলো না, যদি আবার টুপ করে পড়ে যায়! ওই অবস্থাতেই পোকাটার ছবি তুললাম। এ পোকা এর আগে কখনো আমার চোখেও পড়েনি। 

বাংলাদেশের পোকামাকড়ের তালিকায় এটি নথিভুক্ত কি না, তাও নিশ্চিত হতে পারলাম না। একটা খটকা লাগল মনের ভেতর। বৃক্ষমেলায় তো অনেক গাছপালা আনা হয় থাইল্যান্ড থেকে। সেসব গাছের কোনো একটির সঙ্গে এ পোকাও এ দেশে চলে আসেনি তো? একটি অপোষক উদ্ভিদ অমললতার (Cayratia trifolia) ওপর ২০১৮ সালে থাইল্যান্ডে প্রথম এ পোকা দেখার পর তা নতুন পোকা হিসেবে রেকর্ড করা হয়। 

বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞান কোষ বইয়ের ২২তম খণ্ডে বিটল পোকার বর্ণনা রয়েছে। সেখানে এ প্রজাতির পোকার কোনো উল্লেখ নেই। তবে ইনসেক্টস অব বাংলাদেশ ফেসবুক গ্রুপের ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখের একটি পোস্ট থেকে জানা গেল যে, কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীর ধারে সে বছর জুনের ২০ তারিখে দহকুলায় তারা এ পোকাটির দেখা পেয়েছিলেন। এ কথা সত্যি হলে এ পোকা নিশ্চয়ই এ দেশে আছে। সেখানে বনকার্পাস বা ঝাপি টেপারি (Hibiscus vitifolius ) গাছকে এ পোকার পোষক বা আশ্রয়দাতা উদ্ভিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

অন্তর্জাল ঘেঁটে রিসার্চগেটে প্রকাশিত ট্রেভর ও আরও দুজন গবেষকের করা একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা গেল থাইল্যান্ডের উবন রাতচাথানি প্রদেশে ২০১৮ সালে এ প্রজাতির পোকাটির প্রথম দেখা ও নথিভুক্ত করার কথা। সে গবেষণাপত্রের ভূমিকাতে এ পোকাটি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চকচকে কমলা রং ও দুটি কালো ফোঁটা দেখে সহজেই এ পোকাটিকে চেনা যায়। এ জন্য এ পোকার ইংরেজি নাম রাখা হয়েছে টু স্পটেড লিফ বিটল। ইংরেজি নামের সঙ্গে মিলিয়ে আমরা এর বাংলা নামকরণ করতে পারি দুই ফোঁটাযুক্ত পাতা বিটল। এ পোকার বিশদ বর্ণনা খুব কমই পাওয়া যায়। তবে এটি যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পোকা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

এ পোকাটি এ দেশে দেখা অন্যান্য পাতার বিটলদের চেয়ে আকারে বড়, দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ থেকে ১৩ মিলিমিটার, ডানার রং চকচকে কমলা, ডানার পিছনের দিকে বড় দুটো ডিম্বাকার কালো ফোঁটা রয়েছে। দেহটা উপবৃত্তাকার, পিছনের প্রান্ত কিছুটা সুচালো। এরা সাধারণত পাতার ওপরে থাকে। তবে প্রতিকূল অবস্থা বুঝলে কখনো কখনো তারা পাতার নিচের পিঠে চলে যায়, এমনকি পাতা থেকে ঝাঁপ দিয়ে নিচে পড়ে শুকনো পাতার মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। এরা পর্ণভোজী। প্রাপ্তবয়স্ক পোকা ও তার বাচ্চারা অমললতা গাছের কচি পাতা ফুটো করে খেতে পছন্দ করে। অমললতা এ দেশে একটি লতানো বিরুৎ শ্রেণির আগাছা। বাচ্চাদের দেহের রং হলদে ও লম্বাটে। মে থেকে জুলাই মাসে এদের বেশি দেখা যায়। প্রবল বৃষ্টিতেও এদের কোনো অসুবিধা হয় না। তখন তারা ঘন পাতার আড়ালে আশ্রয় নেয়। বাচ্চারা পরিপূর্ণভাবে বড় হলে মূককীট বা পুত্তলি দশায় যাওয়ার জন্য গাছ থেকে মাটিতে নেমে পড়ে ও হামাগুড়ি দিয়ে সুবিধাজনক কোনো জায়গা খুঁজতে থাকে। সে ধরনের জায়গা পেলে মাটিতে পুত্তলি দশায় যায় ও সেখানে কিছুদিন কাটানোর পর পূর্ণাঙ্গ পোকা হয়ে বেরিয়ে আসে এবং গাছে উঠে খাদ্যের সন্ধানে ঘুরতে থাকে। 

পাতা বিটল পোকা কলিওপ্টেরা বর্গের ক্রাইসোমেলিডি গোত্রের Oides palleata প্রজাতির একটি পোকা। ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, চীন ও তাইওয়ানে এ পোকা আছে। বাংলাদেশে এ পোকাটি নিয়ে বিশদ গবেষণা করা যেতে পারে। কোনো ফসলের ক্ষতি করে কি না, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। কেননা, এ গণের পোকারা ফ্যাবেসি, পোয়েসি, রুবিয়েসি, কিউকারবিটেসি, মালভেসি, রোজেসি, রুটেসি ইত্যাদি গোত্রের উদ্ভিদের খাদক বলে জানা গেছে। পোকাটি এ দেশের পোকামাকড়ের তালিকায় নথিভুক্ত না হয়ে থাকলে সে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

লেখক: কৃষিবিদ ও পরিবেশবিদ

দোষ ও গুণের শিয়ালকাঁটা

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫, ১০:২৩ এএম
দোষ ও গুণের শিয়ালকাঁটা
ময়মনসিংহের কাচারিঘাটে জন্ম নেওয়া এক শিয়ালকাঁটা। ছবি: লেখক

বন ও নদীর ধারে জন্মানো সুন্দর হলুদ ফুলের শিয়ালকাঁটা অনেকেরই পরিচিত। এই উদ্ভিদ একই সঙ্গে বিষাক্ত এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন। এ উদ্ভিদের কাণ্ড ভাঙলে একধরনের হলুদ ল্যাটেক্স বের হয়। এই ল্যাটেক্স বিষাক্ত। এর কাণ্ড, পাতা ও ফুলে কাঁটা থাকে। ফুল দেখতে পপি ফুলের মতো। কারণ শিয়ালকাঁটা আর পপি একই গণ আর গোত্রের উদ্ভিদ। গত ২৩ মার্চ ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরের কাচারিঘাটে সকালে হাঁটতে গিয়ে একটি শিয়ালকাঁটাগাছের দেখা পাই। ঝটপট ছবি তুলে নিই। 

শিয়ালকাঁটা জন্মায় কোনো যত্ন ছাড়াই। এটি অল্প শাখাবিশিষ্ট গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। ফল অনেকটা ডিম্বাকার ও লম্বায় ১ থেকে ১২ ইঞ্চি হয়ে থাকে। এর মধ্যে সরিষার মতো কালো রঙের বীজ থাকে। শিয়ালকাঁটা গ্রীষ্মকালে মারা যায়, শরৎকালে মাটিতে পড়ে থাকা কালো রঙের বীজ থেকে নতুন গাছ জন্মায়। এর সংস্কৃত নাম শৃগাল কণ্টক। গাছটির আরও নাম স্বর্ণক্ষীরা, স্বর্ণমুদ্রা, রুক্সিণী, সুবর্ণা, হেমদুগ্ধী, কাঞ্চনী ইত্যাদি। ইংরেজিতে শিয়ালকাঁটা মেক্সিকান পপি, মেক্সিকান প্রিকলি পপি, কারডো ইত্যাদি নামে পরিচিত।

এই গাছের কাণ্ড দেখতে কিছুটা শিয়ালের লেজের মতো এবং এর গা-ভর্তি কাঁটা। এ জন্যই এর নাম শিয়ালকাঁটা। বেলেমাটিতে ভালো জন্মায়। এর ডাঁটা রান্না করে খাওয়া যায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Argemone Mexicana, এটি Papaveraceae গোত্রের উদ্ভিদ। এর ফুলে পাপড়ি থাকে ছয়টি। এর বীজ ও মূলের নির্যাস থেকে তেল আহরণ করা যায়। এই তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালানো যায়। এর নির্যাসকে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। 

এই গাছ মেক্সিকো থেকে সারা বিশ্বে আগাছা হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ‘আর্জিমা’ মানে চোখের ছানি। এই গাছের রস চক্ষুরোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হতো বলে এর গণের নাম Argemone এবং মেক্সিকোয় পাওয়া যায় বলে প্রজাতিক পদ Mexicana। এর কাণ্ড গাঢ় সবুজ ও পাতায় সাদাটে ছিট থাকে। এর পাতা ঢেউ-খেলানো ও খণ্ডিত। প্রতিটি খণ্ডের মাথায় কাঁটা থাকে। এই গাছ দেখতে অনেকটা পপিগাছের মতো। তাই একে মেক্সিকান পপিও বলা হয়।
মেক্সিকো থেকে হন্ডুরাস পর্যন্ত বিস্তৃত জায়গার স্থানীয় এই বুনোফুল প্রায় ৫০০ বছর আগে আমাদের দেশের প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে। ষোড়শ শতকের দিকে স্প্যানিশ বাণিজ্যিক জাহাজে আলুর বস্তা ও মাটির সঙ্গে এই গাছের সরিষার মতো ছোট ছোট বীজ চলে এসেছিল এ দেশে। এভাবেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে গাছটি।

১৯৯৮ সালে ভারতের দিল্লির আশপাশে এর বিষক্রিয়ার প্রাদুর্ভাবে প্রায় ৬৫ জন মানুষ মারা যায়। এই বিষক্রিয়ার লক্ষণ শরীরে পানি জমে যাওয়া। এ গাছের রসে আছে কয়েক ধরনের অ্যালকালয়েডস।

শিয়ালকাঁটা ভেষজ গুণে পরিপূর্ণ। এই গাছ কৃমি, পিত্ত ও কফনাশক। জ্বর ও মূত্রকৃচ্ছ্র রোগে কার্যকর। মূলের রস কুষ্ঠরোগ নিরাময়ে কাজে লাগে। গাছের পীত বর্ণের নির্যাস গনোরিয়া ও উপদংশ রোগে বেশ উপকারী। রক্তের ক্ষমতা তৈরিতে, নতুন রক্ত তৈরিতে, দেহের ক্ষয় পূরণে, পেটের যাবতীয় রোগ নিরাময়ে শিয়ালকাঁটা ব্যবহৃত হয়। 

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ

হাজারীখিলে অবমুক্ত করা হলো ৩৩টি অজগর ছানা

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ১০:৫৭ এএম
হাজারীখিলে অবমুক্ত করা হলো ৩৩টি অজগর ছানা
অবমুক্ত করা হলো ৩৩টি অজগর ছানা।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় জন্ম নেওয়া ৩৩টি অজগরের বাচ্চা ফটিকছড়ি উপজেলার হাজারীখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। 

শুক্রবার (৪ জুলাই) বিকেল ৪টায় বাচ্চাগুলো গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নজরুল ইসলাম, হাজারীখিল রেঞ্জ কর্মকর্তা শিকদার আতিকুর রহমান ও চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. মো. শাহাদাত হোসেন শুভ।

চিড়িয়াখানার কিউরেটর শাহাদাত হোসেন শুভ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় ষষ্ঠবারের মতো কৃত্রিম উপায়ে অজগরের ৩৩টি বাচ্চা ফোটানো হয়। এসব অজগর ছানা ফটিকছড়ি উপজেলার হাজারীখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করা হয়েছে। হাজারীখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে অফিস কার্যালয় থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার ভেতরে ছাড়া হয় বাচ্চাগুলো।’

জানা গেছে, গত ৪ ও ১৪ এপ্রিল দুটি অজগর থেকে পাওয়া ৪৫টি ডিম সংগ্রহ করে হাতে তৈরি ইনকিউবেটরে বসানো হয়। দুই ধাপে গত ১১-১৩ জুনের মধ্যে ১৭টি ও ২১-২৪ জুনের মধ্যে ১৬টিসহ ৩৩টি অজগরের বাচ্চা জন্ম নেয়। ওই বাচ্চাগুলো পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা পাওয়ার পর অবমুক্ত করা হয়।  

 

নিরিবিলিপ্রিয় খুদে বক

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৯:৩০ এএম
নিরিবিলিপ্রিয় খুদে বক
তালগাছের কাণ্ডে বসে আছে খুদে বক, টাঙ্গাইল থেকে তোলা। ছবি: লেখক

গ্রীষ্মের এক সকাল। টাঙ্গাইল শহরের আশপাশের ঝোপঝাড় ও জলাশয়ের কাছে পাখি দেখতে বের হয়েছি। পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের পেছনে একটি পুকুরের পাড়ে গিয়ে দেখলাম তিনটি ছোট পানকৌড়ি গাছের ডালে বসে আছে মাছ ধরার জন্য। পুকুরপাড়ের একটি আমগাছে বসে থাকা কোকিলের ছানাকে খাবার খাওয়াচ্ছে হলদে পাখি। কোকিল অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে এবং ছানাদের সেই পাখিরাই বড় করে তোলে আহার দিয়ে। কয়েকটি সিপাহি বুলবুলি, সাদাবুক মাছরাঙাও দেখা গেল। পুকুরে একটি ভাসমান তালগাছের কাণ্ডের ওপর একটি খুদে বক দেখে অবাক হলাম। কারণ এ বক কিছুটা নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ করে। পুকুরের চারপাশ বেশ নিরিবিলি। যে কারণে অনেক পাখির আনাগোনা।

খুদে বকটি চুপিসারে তাকিয়ে আছে জলের দিকে। শিকার দেখতে পেলেই ধরবে ঠোঁট দিয়ে। বান্দরবানের কেওক্রাডং পর্বতচূড়ায় যাওয়ার পথে বগা লেকে, মহেশখালীর প্যারাবনে এবং শেরপুর জেলার হাতিবান্ধা গ্রামেও খুদে বক দেখেছিলাম।

খুদে বক হালকা সবুজ ও হলদে চোখের জলচর পাখি। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা অভিন্ন। প্রধানত এই বক ঊষা, গোধূলী বেলায় এবং মেঘলা দিনে কর্মতৎপর থাকে। ছায়াময় জলার ধারে খুব সকালে একাকী বসে থাকে শিকারের জন্য। রোদ বাড়লেই ঝোপের আড়ালে চলে যায়। খুবই লাজুক পাখি। নিজকে আড়াল রাখতে সব সময় সতর্ক থাকে। মানুষর অস্তিত্ব কোনোভাবে টের পেলে উড়ে গিয়ে ঝোপে লুকিয়ে পড়ে। পানির কাছের মাটি ও ঝোপের সঙ্গে পালকের রং মিলে ক্যামোফ্লেজ সৃষ্টি হওয়ার কারণে খুব সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। বুনো পরিবেশে পাখিটি পর্যবেক্ষণ করে এ স্বভাবগুলো পাওয়া গেল। 

খুদে বক বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি। এই সবুজ বকের বৈজ্ঞানিক নাম Butorides striatus. ইংরেজি নাম Little Green Her। পাখিটি দেশের কোথাও কোথাও সবুজ বক ও কুড়া বক নামেও পরিচিত। খুদে বকের গায়ের পালকের রং ধূসর মিশ্রিত কালো ও সবুজ। মাথা ও শিখার লম্বা পালক সবুজে কালচে, চিবুক, গাল, গলা সাদা। ঘাড়, বুক, পেট ধূসর। পিঠ, ডানা ও লেজের ওপরের দিক কালচে সবুজ। বর্ষকাল এ বকের প্রজননের সময়। জলের কাছের ঝোপে, নল বনে অগোছালোভাবে বাসা বানিয়ে সবুজ রঙের তিন থেকে পাঁচটি ডিম পাড়ে। খাদ্যতালিকায় আছে ছোট মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, ব্যাঙ ও জলজ পোকা। বাংলাদেশের প্যারাবন, নদীর মোহনা, প্রবালপ্রাচীর, পাথুরে উপকূল, নদী, খাল, গ্রামের ছোট জলাশয় বা ডোবার ধারে প্রধানত বিচরণ করে। সচরাচর একাই থাকে। অগভীর জলাশয়ের কাছেই এ বক শিকার ধরতে পছন্দ করে। দেশের সব বিভাগেই খুদে বক দেখা যায়। 

লেখক: নিসর্গী ও পরিবেশবিদ, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার

বাদল দিনের কদম কথা

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ০৯:৫২ এএম
বাদল দিনের কদম কথা
ধামরাইয়ের সীতি গ্রামে গাছে ফোটা কদম ফুল । ছবি: লেখক

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালে। সেই গ্রন্থে বাদল বরিষণে নামে একটি গল্প রয়েছে। গল্পের শুরুতেই রয়েছে বেদনা, বৃষ্টি ও কদম ফুলের কথা- ‘বৃষ্টির ঝম-ঝমানি শুনতে শুনতে সহসা আমার মনে হলো, আমার বেদনা এই বর্ষার সুরে বাঁধা! সামনে আমার গভীর বন। সেই বনে ময়ূর পেখম ধরেছে, মাথার ওপর বলাকা উড়ে যাচ্ছে, ফোটা কদম ফুলে কার শিহরণে কাঁটা দিয়ে উঠছে, আর কিসের ঘন-মাতাল-করা সুরভিত নেশা হয়ে সারা বনের গা টলছে।’ এটি তার শ্রাবণের শুক্ল পঞ্চমীর এক বৃষ্টিমুখর রাতে প্রিয় মানুষ চঞ্চলা কিশোরী কাজরির জন্য ইউসুফের বেদনার স্মৃতি রোমন্থনের একটি বেদনাতুর গল্প। নজরুলের গান, লেটো গান, গল্প ও কবিতার অন্তত দশটি স্থানে কদমের উল্লেখ রয়েছে। কদম হলো বর্ষার দূত, আনন্দের ও প্রেমের। নজরুলের এই গল্প প্রেমের বিসর্জন ঘটিয়ে কদমকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বেদনার প্রতীকে। রাতের বেলায় কদম ফুলের ঘ্রাণ যে না পেয়েছে, সে বুঝবে না তা মানুষকে কীভাবে স্মৃতিকাতর করে তুলতে পারে। 

আষাঢ়ের এক সকালে ধামরাইয়ের সীতি গ্রামে গিয়ে দেখা পেলাম কয়েকটা কদমগাছের। ডালপালা ভরে শত শত কদম ফুল ফুটে রয়েছে। লাড্ডুর মতো গোল গোল ফুল। হলদে বলের ওপর খাড়া খাড়া সরু সাদা ফুল। এই রূপ থেকেই এ দেশে তৈরি হয়েছে রসকদম মিষ্টির। এ বছর কদমের স্ফুরণ প্রাচুর্য লক্ষ করা যাচ্ছে। রমনা, ধানমন্ডি লেকের পাড়ে, বলধায়, যেখানেই কদমগাছ দেখেছি, সব গাছেই প্রচুর ফুল ফুটেছে। পথের শিশুরা কদম পেড়ে পথে পথে বিক্রিও করছে। কোনো কোনো প্রেমিক-প্রেমিকার হাতে উঠছে সেসব ফুল। কোনো কোনো নারীর রূপসজ্জায় ঠাঁই পাচ্ছে কদম ফুল।

নারীর সৌন্দর্য ও কদম ফুল যেন সমার্থক হয়ে উঠেছে। কবি নজরুলের গানেও দেখি কদমের সেই উচ্ছ্বাস– ‘রিমি ঝিমি রিমি ঝিমি ওই নামিল দেয়া/ শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া।’ কদম আর কেয়া ফুল যেন বর্ষা প্রকৃতির সৌন্দর্য ও প্রকৃতির এক মুগ্ধকর প্রতীক হয়ে ধরা দিয়েছে এ গানে। কদমের আর এক নাম নীপ। নজরুলের গানে সে নীপবৃক্ষেরও উল্লেখ রয়েছে- ‘বিরহী কুহু-কেকা গাহিবে নীপ-শাখে/ যমুনা-নদীপারে শুনিবে কে যেন ডাকে।’

কদম আমাদের দেশের এক অনন্য রূপসী তরু। কদমের আদি নিবাস বাংলাদেশ, ভারত ও চীন। গাছ ৪৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। কদমের ইংরেজি নাম Burflower-tree, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Neolamarckia cadamba ও গোত্র রুবিয়েসী।

কদমগাছ বড় বৃক্ষ, শীতে গাছের পাতা ঝরে যায় ও বসন্তে নতুন পাতা গজায়, গ্রীষ্মে গাছের ডালপালা প্রচুর পাতা ভরে ঘন ছায়া দেয়। এ জন্য এ গাছকে বিভিন্ন উদ্যান, বাগান ও পথের ধারে লাগানো হয়। এ গাছের কাণ্ড সোজা ও খাড়া, বাকল ফাটা ফাটা দাগবিশিষ্ট ও অমসৃণ। অসংখ্য ডালপালা কাণ্ডের চারদিক থেকে বের হয়। ডালের আগায় মার্বেলের মতো কুঁড়ি আসে ও ফুল ফোটে। আমরা যাকে কদম ফুল বলি, সেটি আসলে অনেকগুলো ফুলের সমষ্টি। বলের মতো গড়নটিকে বলা হয় পুষ্পমঞ্জরি, হলদে বলের ওপর গেঁথে থাকে সাদা রঙের ফুল। ফুলগুলো একটি হলদে-কমলা সুগোল বলের ওপর সুন্দরভাবে খাড়া হয়ে ফোটে, ফুল সাদা। ফুল সুমিষ্ট ঘ্রাণযুক্ত। প্রধানত বর্ষাকালে ফুল ফোটে, হেমন্তেও এখন কদম ফোটে। একটি পুষ্পমঞ্জরিতে কয়েক শ ফুল থাকে। ফুলের গোড়া যে বলের মধ্যে খাড়াভাবে গেঁথে থাকে, সে বলটিই ফুল ঝরার পর হয়ে ওঠে বীজের আধার বা ফল। কদম ফল স্বাদে টক বলে কেউ কেউ তা নুন লংকা দিয়ে চটকে খান। রাতে বাদুড়রা এসে ফল খায়, দিনে খায় কাঠবিড়ালিরা। ওরা না খেলে হয়তো দেশটাই কদমের চারা বা গাছে ভরে যেত। কেননা, একটা ফলে ৮ হাজার পর্যন্ত বীজ থাকতে পারে বলে জানা গেছে। বীজ থেকে চারা হয়। গাছ দ্রুত বাড়ে। লাগানোর পর প্রায় ৪ বছর বয়স থেকেই ফুল ফুটতে শুরু করে। ফুল ফোটা গাছের ডাল থেকে কলম করে টবে লাগালে পরের বছর থেকেই সেসব গাছে ফুল ফোটে। কদমগাছকে পথতরু ও ছায়াতরু, উদ্যানে ও পথের ধারে লাগানো যায়। বনজ গাছ হলেও শোভাময়ী। কদম কাঠ থেকে কাগজের মণ্ড ও বাক্স-পেঁটরা তৈরি হয়। এ গাছের কিছু ঔষধি গুণ আছে। পাতার রস কৃমি নাশ করে ও বাকল জ্বর সারায়।

লেখক: কৃষিবিদ ও পরিবেশবিদ