এক সপ্তাহ ধরে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ হালদা নদীতে প্রায় প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে মরা মা- মাছ ও ডলফিন। এক সপ্তাহে হালদা নদীতে একটি রুই এবং চারটি কাতলা (এগুলো মা-মাছ, যাকে ব্রুড বলা হয়) এবং একটি ডলফিন মরে ভেসে উঠেছে। এটিকে হালদার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য অশনিসংকেত বলে মন্তব্য করেছেন হালদার গবেষকরা।
হালদার দূষণ কী কারণে হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার জন্য ৫ সদস্যবিশিষ্ট দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি কমিটি মৎস্য বিভাগ করেছে, অপরটি পরিবেশ অধিদপ্তরের।
গত রবিবার (৩০ জুন) দুপুর ১টার দিকে হাটহাজারীর আজিমের ঘাট এলাকা থেকে প্রায় ১৯ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের (দৈর্ঘ্য প্রায় ১১৮ সেন্টিমিটার) আরও একটি মৃত কাতলা ব্রুড মাছ উদ্ধার করা হয়।
এর আগে গত ২৫ জুন মঙ্গলবার দুপুরে হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা এলাকায় ৯০ কেজি ওজনের ৭ ফুট লম্বা একটি মৃত ডলফিন ভেসে ওঠে। স্থানীয় লোকজন সেটি উদ্ধার করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও বেসরকারি সংস্থা আইডিএফের সহযোগিতায় নদীর পাড়ে হ্যাচারি এলাকায় মাটিচাপা দেয়।
২৮ জুন হাটহাজারী উপজেলার উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের কুমারখালী এলাকা থেকে দুটি কাতলা ব্রুড মাছ উদ্ধার করা হয়। একটির ওজন ছিল ১০ কেজি এবং দৈর্ঘ্য ৫৮ সেন্টিমিটার, অপরটির ওজন ১২ কেজি ৫০০ গ্রাম দৈর্ঘ্য ৯৮ সেন্টিমিটার।
গত ২৬ জুন রাউজান উরকিরচর বাকর আলী চৌধুরী ঘাট এলাকায় ১০ কেজি ওজনের একটি রুই মা-মাছ মরে ভেসে ওঠে। তার কয়েক দিন আগেও ১২ কেজি ওজনের একটি কাতলা মা-মাছ মরে ভেসে উঠেছিল।
হালদা নদীতে গত দুই বছর পরে কয়েকদিনের মধ্যে পাঁচটি ব্রুড মাছ এবং একটি ডলফিনের মৃত্যু হালদার পরিবেশের জন্য একটি অস্বাভাবিক ঘটনা বলে জানিয়েছেন হালদার গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান ড. মনজুরুল কিবরিয়া।
তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘বেশ কয়েক মাস ধরে শাখা খালসমূহে দূষণের খবর বেশ কিছু সংবাদপত্র গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে আসছে। এই ব্রুড মাছের মৃত্যুর জন্য প্রাথমিকভাবে শাখা খালসমূহের দূষণ এবং বিষ প্রয়োগে মাছ মারার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া অন্যতম কারণ বলে মনে করি। হালদা নদী তথা বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ রক্ষার জন্য বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি কারণ উদঘাটন করে রিপোর্ট দেওয়ার পর হালদা দূষণ এবং মা-মাছের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’
তিনি আরও বলেন, একটি হতাশাজনক বিষয় হলো ২০১৬ সালের পর হালদা নদীতে এ বছর সবচেয়ে কম পরিমাণ ডিম দিয়েছে। যা পরিমাণে নমুনা ডিমের চেয়ে একটু বেশি। ইতোমধ্যে প্রজনন মৌসুমের ৬টি জো শেষ হওয়ার মাধ্যমে ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে গেছে। জুলাই মাসে মাছ ডিম ছাড়ার কোনো রেকর্ড নাই। হালদার ডিম সংগ্রহকারীদের এত হতাশার মধ্যে পাঁচটি ব্রুড মাছ এবং একটি ডলফিনের মৃত্যু হালদা নদীর পরিবেশগত বিপর্যয়ের ইঙ্গিত বহন করে।
সূত্র মতে, পাঁচ বছরে হালদায় ৪৩টি ডলফিন ও ৩০টি রুই ও কাতলা মা-মাছের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কিন্তু সপ্তাহের ব্যবধানে ছয়টি মাছের মৃত্যু এবারই প্রথম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ খবরের কাগজকে বলেন, ‘মা-মাছের মৃত্যুর ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেবে।
তিনি জানান, মরা মা-মাছের নমুনা সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরি ল্যাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ ছাড়া মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে আরও অধিকতর পরীক্ষার জন্য মরা মা-মাছের নমুনার ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য সিআইডির ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।
যেসব খালের কারণে দূষিত হচ্ছে হালদা:
চট্টগ্রাম নগরের খন্দকিয়া খাল, কাটাখালি খাল ও কৃষ্ণখালি খাল দিয়ে শহরের দূষিত ও ময়লা পানি এবং বর্জ্য এসে পড়ছে হালদায়। মদুনা ঘাটের নিচের দিকে কাটাখালি ও কৃষ্ণখালি খাল হালদায় পড়েছে। এই দুটি খাল দিয়ে কালুরঘাট শিল্প এলাকার বাইরের সিগন্যাল এলাকা দিয়ে শিল্প কারখানার দূষিত পানি সরাসরি হালদায় গিয়ে পড়ছে। অপরদিকে খন্দকিয়া খাল দিয়ে শহরের বর্জ্য এসে পড়ছে হালদায়। মূলত এ তিন খাল দিয়ে আসা দূষিত পানির কারণে হালদার মা-মাছ মরছে।
ভূজপুর রাবার ড্যামের প্রভাব:
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভূজপুর থানা এলাকায় হালদা নদীতে রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে। শুকনো মৌসুমে চাষাবাদ ও চা বাগানের পানি ব্যবস্থার জন্য হালদার রাবার ড্যামটি ফুলিয়ে পানি বন্ধ রাখা হয়। এতে হালদায় মিঠা পানির সংকট সৃষ্টি হয়। পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। আবার মা-মাছ ডিম ছাড়ার সময় রাবার ড্যামটি ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে দীর্ঘ দিন ধরে জমে থাকা বর্জ্য, চাষাবাদের দূষিত পানি, চা বাগানের বর্জ্য এসে মা-মাছের অভয়ারণ্য এলাকায় মিশে যায়। এসব কারণে মা-মাছ দুর্বল হয়ে পড়ে।
চট্টগ্রাম জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের রিসার্চ অফিসার মোহাম্মদ আশরাফউদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে হালদা ও কর্ণফুলীর দূষণের উৎস খোঁজার জন্য। আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের একটি টিম সোমবারও হালদায় গিয়েছে পানির প্যারামিটার পরীক্ষা করার জন্য। তবে সব দিক থেকে চেষ্টা করা গেলে হালদার প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করা যাবে।