চলছে আষাঢ় মাস, নামছে বাদল ধারা। সিলেটের খাদিমনগর উপশহরে টিলার ওপরে শুকতারার একটি ঘরে বসে পয়লা আষাঢ়ের রাতটা কাটল অঝোর ধারার বৃষ্টির সঙ্গে। ভোর সাড়ে চারটে, বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই। রাতে ভেবে রেখেছিলাম, সকালে হাঁটতে হাঁটতে যাব খামিদনগর ইকোপার্কে, কিছু গাছপালার সঙ্গে মিতালি করতে। কিন্তু বৃষ্টি সে ইচ্ছেয় বাদ সাধল।
ভোরের আলো ফুটতেই জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি টিলার নিচে নিচু জায়গাগুলো জলে ভরে আছে, তবে বৃষ্টিটা থেমেছে। তাই হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম। উপশহরের রাস্তা আর টিলার প্রান্তে কিছু ঝোপের ভেতর যেন টুকরো টুকরো গোলাপি-সাদা চুনি-পান্না জ্বলছে। সাদা ফুলগুলো বুনো টগর, কিন্তু গোলাপি ফুলগুলো কী?
টিলার প্রান্তে নর্দমার ধারে জলসিক্ত গাছগুলোতে ফুটে আছে অজস্র ফুল। ফুল দেখে প্রথম দোপাটি মনে করে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে যখন একটা ঝোপের কাছে এসে পড়লাম, তখন সে ভুল ভাঙল- ওগুলো দোপাটি ফুল, তবে আমরা বাগানে যে দোপাটি ফুলের গাছ লাগাই, সে দোপাটি না। বাগানের দোপাটি গাছের কাণ্ড গিঁটযুক্ত, পাতা ছোট ও সরু, কিনারা করাতের মতো খাঁজকাটা এবং ফুল লাল, গোলাপি, সাদা। কিন্তু এই দোপাটি গাছের পাতা বেশ বড়, চওড়া ও আয়ত-ডিম্বাকার, অগ্রভাগ সুচালো, কিনারা সূক্ষ্মভাবে খাঁজকাটা।
গাছের মাথার দিকে পাতার কোল থেকে সরু লম্বা বোঁটায় কয়েকটা করে ফুল ফুটেছে। পাপড়িগুলো বোয়াল মাছের মতো হাঁ করে আছে। ওপরের পাপড়িটি প্রায় সাদা, নিচের পাপড়ি দুটো গোলাপি। হাঁ করা ফানেলের মতো পাপড়ির গহ্বরের ভেতরে শোভা পাচ্ছে ফুলের হলদে জননাঙ্গগুলো। ফুলের পরাগায়ন ঘটে পোকাদের মাধ্যমে। ফুল ফোটে সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। দেখলাম, ডালের নিচের দিকের ফুলগুলো ঝরে গেছে, সেখানে সরষে ফলের মতো সবুজ ফল গঠিত হয়েছে। সচরাচর দোপাটি ফুলের ফলগুলো হয় ডাম্বেল বা মাকুর মতো উপবৃত্তাকার, আর ফল সরু কাঠির মতো। এ রকম বনে ও পাহাড়ের কোলে রাস্তার ধারে কারও এসব গাছ লাগানোর কথা না। আশপাশে তাকাতেই আরও গাছ চোখে পড়ল। একেবারে আগাছার মতো ছড়িয়ে পড়েছে এই টিলার বন-পাহাড়ে।
ঢাকায় এসে বইপত্র ঘেঁটে এ গাছের পরিচয় পেলাম কাশ্মীর দোপাটি, ইংরেজিতে বলে হিমালয়ান বালসাম। ফুল দেখতে কিছুটা অর্কিডের মতো, তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো কেউ কেউ একে বলেন গরিবের অর্কিড। কাশ্মীর দোপাটি কখনো কারও বাগানে ঠাঁই পায়নি, সে রয়ে গেছে জঙ্গলের আগাছা হয়েই। এ গাছ হিমালয় অঞ্চলের, কাশ্মীরে বেশি দেখা যায় বলে এর নাম কাশ্মীর দোপাটি। হয়তো হিমালয় থেকে আসাম ঘুরে এই বনফুলের গাছ এসেছে সিলেটের পাহাড়ে-টিলায়। কখন কীভাবে এসেছে জানি না, তবে আগাছা হিসেবে যেভাবে বাড়ছে, তাতে আর সে পাহাড়ের চৌহদ্দিতে আর থাকবে না- একপর্যায়ে দেশের অন্যত্রও দেখা যাবে আশা করি।
কাশ্মীর দোপাটির উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Impatiens balfourii ও গোত্র বালসামিনেসী। এ গাছের পাকা ফল কারও হাতের সামান্য ছোঁয়াও সহ্য করতে পারে না, ছুঁলেই ফেটে যায়। বেশি পেকে শুকানো শুরু করলে স্পর্শ না করলেও ফল ফেটে বীজ প্রায় ৬ মিটার দূর পর্যন্ত মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে, সেখানেই চারা গজিয়ে ওঠে। এ জন্যই এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক লাতিন নামের প্রথম অংশ ইমপ্যাটিয়েন্স রাখা হয়েছে, যার অর্থ বিদারী, দ্বিতীয় অংশ বালফোরি রাখা হয়েছে স্কটিশ উদ্ভিদবিদ আইজ্যাক ব্যালে বালফোরের নামানুসারে। কাশ্মীর দোপাটির গাছ বর্ষজীবী বিরুৎ প্রকৃতির, গাছ ১৫ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়, কাণ্ড লালচে ও শাখায়িত। ওপর থেকে দেখলে ছোট-বড় পাতার আলপনার মতো বিন্যাসটা বেশ সুন্দর দেখায়। সাধারণত পাহাড়ের কোলে, রাস্তার ধারে, নর্দমার পাশে, পতিত জমিতে আগাছা হিসেবে এ গাছ জন্মে। কাশ্মীর দোপাটির আদি বাসভূমি হিমালয় অঞ্চল হলেও উনিশ শতকে তা ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে।