পুরান ঢাকায় বিদ্যুৎ-পাইলনের গরম ইস্পাতে স্থির বসে রয়েছে একটি শিকারি পাখি। নিচের দিকেই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও গভীর মনোযোগ। দেখে মনে হলো, পাইলনের নিচে উড়ে চলা চড়ুই পাখি শিকার করার জন্যই সে তাক করে আছে। ঢাকা নগরীর বিরল বাসিন্দা এ পাখির নাম লালমাথা-শাহিন। পাখিটি ‘ফালকন’ পরিবারের সদস্য এবং ঈগল, বাজ ও শিকড়ে পাখির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নজাতের শিকারি।
বিশ্বে ৫৫ প্রজাতির ফালকন আছে এবং ‘শাহিন’, ‘হবি’, ‘কেস্ত্রেল’, ‘কারাকারা’ ইত্যাদি নামে এরা পরিচিতি পেয়েছে। শেরপুরের শালবনে সম্প্রতি ‘কুটিশাহিন’ পাখির সাক্ষাৎ পাওয়ার পর বাংলাদেশে ফালকন পরিবারে প্রজাতি-সংখ্যা ১০-এ উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে একমাত্র লালমাথা-শাহিনকেই আমরা সারা বছর ঢাকা নগরীতে দেখতে পাই। তবে সহজে নয়, বিশ্বের তাবৎ পাখি-শিকারিদের মতোই সে লুকিয়ে চলতে অত্যন্ত দক্ষ।
অধিকাংশ ফালকনই দ্রুতবেগে উড়ে চলা পাখিদের পাকড়াও করতে পটু। ঢাকাবাসী এই শাহিন পাখিও উড়ন্ত চড়ুই, বাবুই, বুলবুল ও মুনিয়া শিকার করে জীবনধারণ করে। সারা দেশে ছোট পাখির সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেলেও শহরের পথপাশে চড়ুই তো ভালোই আছে। তাই চড়ুই পাখিই হয়েছে লালমাথা-শাহিনের মেইন ডিশ বা খাবার। তবে মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় এরা চামচিকা শিকারে নামে; সম্ভবত রুচি বদলাবার জন্য।
এই পাখি শুধু ভারতবর্ষ ও আফ্রিকার দক্ষিণে কয়েকটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এর ইংরেজি নাম ‘রেড-নেকড ফালকন’ এবং প্রমিত বাংলা নাম ‘লালঘাড়-শাহিন’ ছিল। সম্প্রতি দুই এলাকার পাখিকে দুটি পৃথক প্রজাতি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রজাতি ভিন্ন হলে তো নামও ভিন্ন হতে হয়। তাই এখন আফ্রিকার পাখির ইংরেজি নাম ‘রেড-নেকড ফালকন’ আর ভারতবর্ষের ‘রেড-হেডেড ফালকন’ হয়েছে।
চেহারা দেখে এ দুই প্রজাতির পাখির পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন। দুটিরই ঘাড় ও মাথা লালচে খয়েরি এবং চঞ্চু, পা-ও চশমা হলদে। ভারতবর্ষের পাখিটির বাংলা নাম ‘লালঘাড়-শাহিন’ বহাল রাখলে আফ্রিকার পাখিটিকে আমরা কী বলব, যদি ভবিষ্যতে কোনো দিন আফ্রিকার পাখির বাংলা নাম দিতে চাই! তাই আমাদের দেশের পাখিটির নাম বদলে ইতোমধ্যে আমরা ‘লালমাথা-শাহিন’ বলতে শুরু করেছি।
গত শতাব্দীতে বাংলায় লেখা পাখির বইতে কোনো কোনো লেখক এ পাখিকে ‘তুরমতি বাজ’ নাম দিয়েছিলেন। ওই নামের দুটি বড় সমস্যা ছিল। প্রথমত, পাখিটি ‘বাজ’ নয় এবং অন্য একটি পরিবারে অনেক ‘বাজ’ ও ‘তিশাবাজ’ আছে এ দেশে। দ্বিতীয়ত হিন্দি, মারাঠি ও গুজরাটি ভাষায় একে ‘তুরমতি’ অর্থাৎ দ্রুতগামী বলা হয়, বাংলায় নয়। অন্য ভাষা থেকে যদি নিতেই হয়, তো এর সংকেত নাম ‘ভেগি’ই তো ভালো। ভেগি মানেও দ্রুতগামী।
দেখলাম, পাইলনের প্রায় শীর্ষে লালমাথা-শাহিনের দুটি বাড়ন্ত ছানা বসে রয়েছে। অদূরে বসে আছে আকারে অনেকটা বড় আরেকটি শাহিন। নিশ্চিত বলা যায়, এই বড় পাখিটিই ছানাদের মা। অধিকাংশ শিকারি পাখির মতো এই পাখির মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেকটা বড় হয়। লালমাথা-শাহিনের সংসারে বাবার কাজ হলো পাখি শিকার করে এনে মাকে দেওয়া। আর মায়ের কাজ হলো মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছানাদের খাওয়ানো। ছানারা বাসা ছেড়ে যাওয়ার পরও দু-সপ্তাহ ধরে বাবা-মা এটা করতে থাকে।
পুরুষ পাখিটি পাইলনের ওপর থেকে এখনো চড়ুই পাখির ওড়াউড়ি দেখছে। মাটির কাছে কিংবা কার্নিশের আড়ালে থাকলে চড়ুই পাখিরা মোটামুটি নিরাপদ। শিকার ধরার জন্য তিরবেগে ছুটে গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে মরতে চায় না কোনো শাহিন পাখি। কিন্তু চড়ুই পাখিদের জীবনেও নানা চাহিদা, ছোটাছুটি ও কলহবিবাদ আছে। সবাই সব সময় সাবধান থাকে না। পাইলনের ওপর তাই এই শিকারি সেই সুযোগের অপেক্ষায় আছে।
আমরা চাই, রোদ চড়া হওয়ার আগেই ধৈর্যশীল এই পাখি একটি চড়ুই শিকার করুক। আমাদের এ আকাঙ্ক্ষাটি শাহিন-ছানার জন্য শুভ হলেও চড়ুই পাখির জন্য নির্মম। যে চড়ুই পাখিটি নিহত হবে, তার বাসাতেও হয়তো অভুক্ত ছানা অপেক্ষারত। ওসব নৈতিক সংকট এড়ানোর জন্য তখনই আমরা এলাকাটি ছেড়ে চলে এলাম।