ঢাকা ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫
English
শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

টিয়াঠুঁটির রূপের বাহার

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:০৮ এএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:০৯ এএম
টিয়াঠুঁটির রূপের বাহার
মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ফুটেছে টিয়াঠুঁটি ফুল। ছবি: লেখক

একটানা বর্ষা না হলেও হচ্ছে থেমে থেমে। মাঝে মাঝেই হচ্ছে। আর এতেই যেন হয়েছে টিয়াঠুঁটি গাছের পোয়া বারো। লকলক করে বেড়ে উঠছে। ঝোপঝাড় করে ঝাঁপিয়ে দিচ্ছে বাগানগুলো। বর্ষাকালে টিয়াঠুঁটির আলো ঝরঝর ফুলে ফুলে ভরা গাছগুলোর রূপ যেন ‘অধরা দিয়েছে ধরা ধূলির ধরণীতে’। প্রগাঢ় সবুজের মাঝে লম্বা চিকন ডাঁটির মাথায় ফোটা ফুল আর ফুলের মঞ্জরিপত্র, পুরো পুষ্পমঞ্জরিটি যেন এক আলোকবর্তিকা। 

শ্রাবণের এক দিনে মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের ভেতরে টিয়াঠুঁটির এই রূপ দেখা গেল, প্রশাসনিক ভবনের পিছনে একফালি বাগানে। ডাঁটির আগায় ফুটে আছে অসংখ্য ফুল। কিন্তু এ ফুলগুলোর চেহারা একটু অন্য রকম। মনে করার চেষ্টা করলাম, এরকম ফুল কি আর দেখেছি কোথাও? দেখেছি তো বটেই, কিন্তু সে টিয়াঠুঁটি ফুলের সঙ্গে এগুলো তো মিলছে না, পাতাও না। গত বছর গ্রীষ্মে দেখেছিলাম সাভারে ডিসি নার্সারিতে। এ বছর বর্ষায় দেখলাম ফার্মগেটে তুলা ভবনের সামনে। 

সারি করে লাগানো সেসব টিয়াঠুঁটি গাছের ফুলের রং কমলা বা উজ্জ্বল কমলা, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার উদ্যানে ফোটা টিয়াঠুঁটির ফুলগুলো হলদে আর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ফোটা ফুলগুলো ঘিয়া থেকে হলুদাভ। সব টিয়াঠুঁটি গাছের পাতাই একহারা সবুজ। কিন্তু গাজীপুরের কালীগঞ্জের ফুলদি গ্রামে তাসমিয়া রিসোর্টে দেখা পেয়েছিলাম আবার অন্য আরেক রকম টিয়াঠুঁটি গাছের। সে গাছগুলোর পাতা সবুজ ও সাদাটে ছোপায় বিচিত্রিত। এ জন্য ওগুলোর নাম হয়েছে বিচিত্র টিয়াঠুঁটি বা ভেরিগেটেড প্যারাকিট ফ্লাওয়ার। 

সেখানে শুধু গাছই দেখেছিলাম, ফুল দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এবারের বৃক্ষমেলায় সে সুযোগ হয়েছিল। বিচিত্র টিয়াঠুঁটির কিছু ফুলসহ গাছের দেখা পেয়েছিলাম এবার বৃক্ষমেলায় বৃক্ষায়ন গার্ডেনিং নার্সারিতে। ফুলগুলোর রঙ ছিল প্রায় সাদা। এসব দেখে মনে হলো, টিয়াঠুঁটির এত রূপের বাহার হয়েছে তার একাধিক জাত-বৈচিত্র্যের কারণে। ঠিক কতগুলো জাত আমাদের দেশে আছে তার কোনো তথ্য নেই। কোন জাতের কি নাম, তাও জানা নেই। টিয়াঠুঁটির ইংরেজি নাম প্যারাকিট ফ্লাওয়ার বা প্যারটস ফ্লাওয়ার। 

টিয়াঠুঁটি গাছ হেলিকোনিয়েসি গোত্রের হেলিকোনিয়া গণের একটি গাছ। বার্ড অব প্যারাডাইস বা স্বর্গের বুলবুলিও এ গণের একটি গাছ, যা সচরাচর দেখা যায় না। এ দেশে হেলিকোনিয়া গণের সাতটি প্রজাতির গাছ আছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় Heliconia psittacornum I Heliconia rostrata প্রজাতির গাছ। টিয়াঠুঁটি প্রথমোক্ত গণের গাছ। দ্বিতীয় প্রজাতির গাছকে বাংলায় বলে চিংড়িনমি ফুল, ইংরেজি নাম হ্যাঙ্গিং লবস্টার ক্ল। ফুলের অদ্ভুত গড়নের জন্য এটিও বাহারি গাছ হিসেবে এখন বাগানে লাগানো হচ্ছে।

টিয়াঠুঁটি গাছ বর্ষজীবী বিরুৎ স্বভাবের, এক বছরের বেশি বাঁচে না। গাছের গোড়ায় মাটির নিচে কন্দ থাকে, সেখান থেকে গাছ জন্মে। গাছ প্রায় এক থেকে দেড় মিটার লম্বা হয়, জাতভেদে খাটো গাছও দেখা যায়। পাতা সরল ও দেখতে অনেকটা কলাপাতার মতো। তবে কলাপাতার চেয়ে শক্ত ও ছোট। কলাপাতার মতো এ পাতার বোঁটার সঙ্গে একটি পত্রখোল থাকে। 

পাতা মসৃণ ও চকচকে। একটি গাছ থেকে একটি শক্ত নলের মতো পুষ্পদণ্ডের মাথায় বৃশ্চিকাকার বা বিছার মতো মঞ্জরিতে ফুল ফোটে। ফুলের বৃতি বা মঞ্জরিপত্র দেখতে অনেকটা নৌকার খোলের মতো, ঠিক কলার মোচায় যে রকম খোল থাকে, সে রকম। খোলের মধ্য থেকে ৬টি লম্বা কাঠির মতো ফুল বেরিয়ে আসে। খোল বা মঞ্জরিপত্র একটির পর আর একটি প্রায় ২ সেন্টিমিটার ব্যবধানে বিপরীতমুখীভাবে থাকে। প্রতিটি ফুলে থাকে ৫টি পুরুষ কেশর ও একটি স্ত্রী কেশর। ফুলে পরাগায়নের পর ফল হয়। 

বসন্তকাল থেকে শুরু করে বর্ষাকাল পর্যন্ত ফুল ফুটতে থাকে। কিছু কিছু জাতের গাছে প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে। সিলেটের জঙ্গলে দেখেছি এ গণের গাছকে বন্যভাবে জন্মাতে। তবে অধিকাংশ সময়ে এসব গাছ টবে ও বাগানে লাগানো হয় শোভাবর্ধক হিসেবে। বর্ষার প্রকৃতিতে অন্যান্য ফুলের সঙ্গে টিয়াঠুঁটিও তার রূপের বাহার ছড়িয়ে দেয়। ছায়া ও স্যাঁতসেঁতে জায়গায় এ গাছ ভালো জন্মে। 

আদি নিবাস ব্রাজিলের বাদল বন। বিশেষ করে আমাজনের উত্তরাংশ থেকে এ গাছ এখন পৃথিবীর অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থায়িত্বকাল বেশি হওয়ায় এখন ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখার ফুল হিসেবে টিয়াঠুঁটির কদর বাড়ছে। কাটা ফুল ২ থেকে ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত ফুলদানিতে সতেজ থাকে। গোড়ার মোথা কেটে ভাগ করে মাটিতে পুঁতে দিলে সহজেই তা থেকে এর গাছ জন্মে। গাছ বেশ কষ্ট সইতে পারে।

জাতীয় পরিবেশ পদক পাচ্ছেন তেঁতুলিয়ার মাহমুদুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ০৯:৩২ পিএম
জাতীয় পরিবেশ পদক পাচ্ছেন তেঁতুলিয়ার মাহমুদুল ইসলাম

পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে অবদানের জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে ‘জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২৪’ পেলেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার আজিজনগর এলাকার বাসিন্দা মো. মাহমুদুল ইসলাম।

গত সোমবার (২ জুন) পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সাবরীনা রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে পদকের জন্য মনোনীতদের নাম প্রকাশ করা হয়।

দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চারাগাছ উপহার, প্লাস্টিক রিসাইকেল, বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা ও পথঘাট পরিচ্ছন্ন রাখার মতো পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছেন পরিবেশকর্মী মাহমুদুল ইসলাম।

মাহমুদুল ইসলামের ডাকনাম মামুন। তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। এই তরুণ কোনোদিনও পেট্রোলচালিত যান ব্যবহার করেননি। 

একটি বাইসাইকেলের সামনে বইয়ের ঝুড়ি, পেছনে চারাগাছ ও প্লাস্টিক সংগ্রহের ব্যাগ - এই নিয়েই ছুটে চলেন গ্রাম থেকে গ্রাম। ‘একজনের মাঝে দশ’ স্লোগানে শিশু-কিশোরদের মাঝে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি করছেন, পাশাপাশি উপহার দিচ্ছেন ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা। নিজের বাড়ির উঠানে গড়ে তুলেছেন ‘প্রকৃতির পাঠাগার’। এখানে নিয়মিত বই পড়া শিশুদের চারাগাছ ও সবজির বীজ উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। প্রতিদিন বিকেলে নিজ হাতে চারা তৈরি ও প্যাকেট প্রস্তুতের কাজ করেন। তিনি ইতোমধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ গাছের চারা বিতরণ করেছেন। 

মাহমুদুলের মতো একই অবদানের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ঢাকার ধামরাইয়ের ‘স্নোটেক্স আউটারওয়্যার লিমিটেড’কে এই পদকের জন্য মনোনীত করা হয়।

পরিবেশ সংরক্ষণ, শিক্ষা ও গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২৪’ জন্য যে ছয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করা হয় এর মধ্য পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা ও প্রচার ক্যাটাগরিতে ব্যক্তি পর্যায়ে মনোনয়ন পেয়েছেন চট্টগ্রামের সিডিএ আবাসিক এলাকার মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী।

একই ক্যাটাগরিতে প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে নির্বাচিত হয়েছে পরিবেশবান্ধব সংগঠন ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট’।

এ ছাড়া পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অবদানের জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে পদক পাচ্ছেন প্রফেসর ড. এম. ফিরোজ আহমেদ। 

একই ক্যাটাগরিতে প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে মনোনীত হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)।

প্রত্যেক বিজয়ীকে জাতীয় পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে।

অমিয়/

রবীন্দ্রনাথের মধুমঞ্জরী লতা

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১০:৫৩ এএম
রবীন্দ্রনাথের মধুমঞ্জরী লতা
ময়মনসিংহের শশী লজের আঙিনায় মধুমঞ্জরী লতা। ছবি: লেখক

এই উদ্ভিদের মধুমঞ্জরী নামটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া।
রবীন্দ্রনাথ মধুমঞ্জরীকে নিয়ে লিখেছেন- 
‘তব প্রাণে মোর ছিল যে প্রাণের প্রীতি
ওর কিশলয় রূপ নেবে সেই স্মৃতি,
মধুর গন্ধে আভাসিবে নিতি নিতি
সে মোর গোপন কথা।
অনেক কাহিনী যাবে যে সেদিন ভুলে,
স্মরণ চিত্ত যাবে উন্মুলে;
মোর দেওয়া নাম লেখা থাক ওর ফুলে
মধুমঞ্জরী লতা।’ 

ফুলটির পরিচয় দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘এ লতার কোনো একটা বিদেশী নাম নিশ্চয় আছে- জানিনে, জানার দরকারও নেই। আমাদের দেশের মন্দিরে এই লতার ফুলের ব্যবহার চলে না, কিন্তু মন্দিরের বাইরে যে দেবতা মুক্তস্বরূপে আছেন তার প্রচুর প্রসন্নতা এর মধ্যে বিকশিত। কাব্যসরস্বতী কোন মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন, তার ব্যবহারে এই ফুলকে লাগাব ঠিক করেছি, তাই নতুন করে নাম দিতে হলো। রূপে রসে এর মধ্যে বিদেশী কিছুই নেই, এ দেশের হাওয়ায় মাটিতে এর একটুও বিতৃষ্ণা দেখা যায় না, তাই দিশী নামে একে আপন করে নিলেম এই দিশী (দেশি) নামটিই মধুমঞ্জরী লতা।’ 

প্রায় সারা বছরই মধুমঞ্জরী লতা ফোটে, তবে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মধুমঞ্জরী ফুল ফোটার প্রধান মৌসুম। শুকনো প্রাণহীন লতায় প্রাণ জেগেছিল বৈশাখে। সৌন্দর্যের সবটুকু নিয়ে ফুটেছিল ফুল। বর্ষা আসছে। গত ২৭ মে গিয়েছিলাম সেখানে। আগে যে ভবনটি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের (মহিলা) অধ্যক্ষের বাসভবন ছিল তার বাম দিকে মধুমঞ্জরীর প্রস্ফুটন চোখে পড়ল। ডালের আগায় বড় বড় ঝুলন্ত থোকায় সুগন্ধি, সাদা ও লাল রঙের ফুল ফুটে আছে। এর পাতা কিছুটা পাতলা ও খসখসে প্রকৃতির, গঠনে আয়তাকার থেকে ডিম্বাকার, রং সবুজ। পাতাগুলো শাখায় জোড়ায় জোড়ায় সুবিন্যস্তভাবে সাজানো থাকে। তাজা ও বাসি ফুলে রঙের ভিন্নতাও এ ফুলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাজা ফুলের রং সাদা, বাসি হলে লাল হয়। ফুলে ক্ষুদ্রাকৃতির পাপড়ির সংখ্যা পাঁচটি, মাঝে পরাগ অবস্থিত, দলনল বেশ লম্বা। ফুলের গন্ধ বেশ মিষ্টি। এ সময়ে ফুলে ফুলে ভরে ওঠে গাছ। আমাদের দেশে বাসাবাড়ির বাগান, পার্ক, উদ্যান ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বাগানে মধুমঞ্জরী ফুলগাছ চোখে পড়ে। শীতে পাতা কমে যায়। বছরে কয়েক দফা ফুল ফোটে। ঘন সবুজ পাতার মাঝখানে ঝুলন্ত সাদা-লাল ফুল সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সন্ধ্যায় নতুন ফুল ফোটে আর হালকা সুবাস ছড়ায়।

মধুমঞ্জরী লতা কাষ্ঠল, পত্রমোচী, আরোহী উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Combretum indicum, এটি Combretaceae পরিবারে লতানো উদ্ভিদ। ইংরেজিতে Chinese honeysuckle, Rangoon creeper ইত্যাদি নামে পরিচিত। এ ছাড়া বাংলায় হরগৌরী, মধুমালতী, লাল চামেলী নামেও এটি পরিচিত। মধুমঞ্জরী প্রায় সারা দেশেই সহজলভ্য। অনেকে এই ফুলটিকে মাধবীলতা বলে ভুল করেন। ঢাকার শিশু একাডেমি , বলধা গার্ডেন ও রমনা পার্কে এই ফুলগাছ রয়েছে ।

গোড়ার শিকড় থেকে এর চারা গজায়। সাধারণত কলমে চাষ হয়। এই উদ্ভিদটির আদি নিবাস ফিলিপিন্স, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া। পরবর্তী সময়ে মায়ানমার, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে এই উদ্ভিদের চাষ করা হয়েছে এবং প্রকৃতিতে অভিযোজিত হয়েছে। 

অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ,
মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ

ধূসর শিখীপর্ণ প্রজাপতি

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৫, ১১:৪৪ এএম
ধূসর শিখীপর্ণ প্রজাপতি
ঢাকার বাউনিয়া বাঁধের ধারে দেখা ধূসর শিখীপর্ণ প্রজাপতি। ছবি: লেখক

সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরের কালশী মোড় থেকে বাউনিয়া বাঁধ রোড ধরে যাচ্ছিলাম দেওয়ানপাড়ার দিকে। রাস্তার দুই ধারে নতুন নতুন বড় বড় দালান উঠছে আর রাস্তার ধারের ঝোপঝাড় উজাড় হচ্ছে, ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বড় কোনো গাছপালা নেই, সবুজ যেন নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে, জলাশয়ও। শেষমেশ কী আছে ঢাকা শহরের ভাগ্যে কে জানে। রাস্তার ধারে ধুলোমাখা শরীর নিয়ে কিছু লতা, বিরুৎ, তৃণ যেন উদোম মাটির সেই লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করে চলেছে। কয়েকটা আসামলতার গাছ যেন সেই আব্রু ঢাকার প্রধান অবলম্বন, সঙ্গে সঙ্গ দিচ্ছে মলিন চাপড়া, উলু ও দূর্বা ঘাস, ত্রিধারা আগাছা। কোনো গাছেই কোনো ফুল নেই। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গাছগুলোর গা পরিষ্কার হয়েছে। ত্রিধারার ওই দু-চারটা ফুলেই হয়রান হয়ে ছোটাছুটি করছে একটা প্রজাপতি। কোথাও যেন ওর আহার জুটছে না। ক্ষুধার্ত প্রজাপতি সাদাটে ত্রিধারা ফুল থেকে মধু খেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অনবরত উড়তে উড়তে ক্ষণিকের জন্য সে ফুলে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। অলস-ক্লান্ত ভঙ্গিতে ডানা চারটে দুই পাশে মেলে ধরে সে যেন প্রকৃতিমাতার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে একরত্তি আহার আর আশ্রয়ের জন্য। ঢাকা শহরে গাছ নেই, ফুল নেই, ফল নেই, পাখি নেই, প্রজাপতি নেই- এ রকম একটা দৃশ্য কল্পনা করতেও ভয় হয়। যা দু-চারটা প্রজাপতির দেখা মেলে তার জন্য যেতে হয় নগর উদ্যানগুলোয়।

প্রজাপতিটা বিশ্রাম নিতেই ওকে চেনা গেল, ধূসর-বাদামি রঙের চমৎকার ডানা। বেশ বড়। দেহ ও ডানার ওপরের পিঠ ধূসর-সাদা, নিচের পিঠ কিছুটা হালকা রঙের। ডানাগুলোর প্রান্তের দিকে চারটি করে আড়াআড়ি গাঢ় বাদামি রঙের ঢেউ খেলানো দাগ বা রেখা রয়েছে। সামনের ডানার প্রান্তে ৬টি ও পেছনের ডানার শেষে ৫টি করে চক্রাকার বাদামি দাগ। দাগগুলো সরু গাঢ় বাদামি রেখা দ্বারা বেষ্টিত, ভেতরে কমলা রঙের মধ্যে এক প্রান্তে কালচে বাদামি ফোঁটা।  ডানার গোড়ার দিকটা দাগশূন্য ও একহারা ধূসর-বাদামি, দেহের রংও তাই। সব মিলিয়ে প্রজাপতিটা খুব বর্ণিল না হলেও দেখতে বেশ সুন্দর। 

এ প্রজাপতির বাংলা নাম ধূসর শিখীপর্ণ হলেও এর আরও কয়েকটি নাম আছে। কেউ কেউ বলেন ধূসরাক্ষী বা ধূসর-সোনালি চক্র প্রজাপতি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এর নাম চাঁদনরি। লেপিডোপ্টেরা বর্গের নিম্ফালিডি গোত্রের এ প্রজাপতির ইংরেজি নাম গ্রে প্যানজি, বৈজ্ঞানিক নাম জুনোনিয়া আটলিটিস। এ দেশে সহজে এদের সর্বত্র দেখা যায়। তবে প্রচুর বৃষ্টিপাতপ্রবণ খোলা জায়গায় এরা বিচরণ করতে বেশি পছন্দ করে। এরা উড়তে উড়তে খুব বেশি ওপরে ওঠে না, সাধারণত মাটির কাছাকাছি চলাচল করে। জলাধারের ঝোপজঙ্গলে এদের বেশি দেখা যায়। গাজীপুরে পুবাইলে জলজঙ্গলের কাব্য রিসোর্টে গত নভেম্বরেও জলাময় বিলের ধারে এদের অনেকগুলোকে উড়তে দেখেছিলাম। ধানখেতেও এরা বিচরণ করে। তালমাখনা, কেশুটি, হেলেঞ্চা, কেশরদাম, আসামলতা ইত্যাদি আগাছার ফুলে ফুলে এদের ঘুরতে দেখা যায়। 

পুরুষ প্রজাপতির চেয়ে মেয়ে প্রজাপতির দেহ একটু বড়। পুরুষ প্রজাপতির মিলনের ইচ্ছা হলে সে অনুচ্চ ঝোপের ওপর ওত পেতে বসে থাকে। একটা মেয়ে প্রজাপতি দেখলে তার পিছু পিছু উড়তে থাকে। মেয়েটাকে মিলনে রাজি করাতে সে নানাভাবে তার সঙ্গে সখ্য স্থাপনের চেষ্টা করে। এরপর একসময় দুজনে মিলনে যায়। মেয়ে প্রজাপতি গাছের পাতার ওপর ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সেখানে তিন দিন পর ফুটে বাচ্চা বের হয়, বাচ্চারা সেসব গাছের পাতা খেতে খেতে বড় হয়। বাচ্চার দেহের রং হলুদাভ-কমলা, নলাকার, মাথা কালো ও দেহজুড়ে ছোট ছোট কাঁটার মতো অঙ্গ থাকে। পূর্ণতা পেলে বাচ্চা বা কীড়ার দেহ কালচে হয়ে যায়। মাথাটা কমলা পট্টিযুক্ত কালো হয়। বাচ্চা অবস্থায় থাকে ১২ থেকে ২২ দিন। এরপর ৫ থেকে ৯ দিন শূককীট অবস্থায় থাকার পর সেখান থেকে প্রাপ্তবয়স্ক প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসে। শূককীট বা পিউপার রং ধূসর বাদামি। ওদের জীবনচক্র শেষ হতে ২০ থেকে ৩২ দিন সময় লাগে। বাচ্চারা পাতা খায় ও প্রাপ্তবয়স্ক প্রজাপতিরা খায় ফুলের মধু। এ দেশে এদের সারা বছরই বেশ দেখা যায়, আপাতত বিলুপ্তির কোনো ঝুঁকি বা শঙ্কা নেই। এ দেশ ছাড়াও এ প্রজাপতি আছে নেপাল, ভারত, ক্যাম্বোডিয়া, দক্ষিণ চীন, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায়। 

হুমকিতে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ০৯:৩২ এএম
হুমকিতে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য
সুন্দরবনের ভেতরে পর্যটকদের ফেলা ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের খাবারের পাত্র । খবরের কাগজ

সুন্দরবনের সীমানা ঘেঁষে থাকা সাতক্ষীরার শ্যামনগরে বাড়ছে ‘ওয়ান টাইম’ প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার। বাজার থেকে গ্রাম সবখানেই মিলছে একবার ব্যবহারযোগ্য গ্লাস, প্লেট, চামচ ও বক্স। ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া এসব বর্জ্য নদীতে গিয়ে পড়ে। জোয়ার-ভাটার কারণে তা ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনের নদী ও খালে। পরিবেশবিদরা বলছেন, অপচনশীল এসব প্লাস্টিক সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাছপালা ও প্রাণীকুল।

যেসব প্লাস্টিক পণ্য একবার ব্যবহারের পর আর কোনো কাজে লাগে না, সেগুলোই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক (ওয়ান টাইম প্লাস্টিক) হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় জলবায়ু কর্মীরা জানান, দেশের উপকূলীয় এলাকায় একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পণ্যের ওপর হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। 

সম্প্রতি সরেজমিনে সুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সীগঞ্জ, হরিনগর, নীলডুমুর, রমজাননগর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, পাশের নদীতে ভাসছে নানা রকম প্লাস্টিক পণ্য ও পলিথিন। দেখা মিলেছে খাবারের প্লেট, পানির বোতল, চানাচুর ও চিপসের প্যাকেটসহ আরও অনেক বর্জ্যের।

স্থানীয়রা জানান, এসব এলাকায় যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান, বনভোজন এবং দোকানে খাবার ও পানীয় পরিবেশন করতে প্লাস্টিক ব্যবহারের আশঙ্কাজনকভাবে প্রবণতা বেড়েছে। নদী ও সুন্দরবন থেকে ধরা মাছের পেটেও মিলছে প্লাস্টিক। অনেক মাছ, কচ্ছপ প্লাস্টিকে আটকে মারা যাচ্ছে। বনের ফাঁকা জায়গায় গাছপালা গজানোর হারও কমেছে।

গত ২০ বছর ধরে সুন্দরবনসংলগ্ন খোলপেটুয়া নদীতে নিয়মিত মাছের পোনা ধরেন জহুরা বিবি। তিনি বলেন, ‘জালে মাছের পরিবর্তে পলিথিন উঠে আসে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও এমন ছিল না। লোকালয়ে এখন পলিথিন ব্যবহার বেড়েছে। ব্যবহার শেষে তারা নির্দিষ্ট স্থানে না ফেলে যেখানে সেখানে ফেলে দেন। সেগুলোই পরে নদীতে এসে পড়ে।’ 

নীলডুমুর বাজারের ব্যবসায়ী আল-আমিন হোসেন জানান, এখন মানুষ প্রায় সব কাজে প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার করে। সুন্দরবন ভ্রমণে আসা পর্যটকরা এখন ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের গ্লাস, প্লেট, চামচ ও বক্স ব্যবহার করেন। ব্যবহার শেষে নদীতেই ফেলা হয় এসব প্লাস্টিক। এ ছাড়া প্রতিদিনের পরিত্যক্ত প্লাস্টিক-পলিথিন ঝাড়ু দিয়ে নদীতে ফেলা দেওয়া হয়।’

নীলডুমুর বাজারের সুন্দরবনের মাছ কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী শরিফ হোসেন। তিনি জানান, তিনি কাইন ও ভোলা মাছের পেটের মধ্যে পলিথিন পেয়েছেন। জেলেদের পলিথিনে জড়িয়ে মৃত কচ্ছপ নিয়ে ফিরতে দেখেছেন।

জলবায়ু কর্মী শাহিন আলম বলেন, স্থানীয় নদ-নদী দিয়ে প্লাস্টিক সুন্দরবনে ঢুকে যাচ্ছে। বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সীগঞ্জ, হরিনগর, রমজাননগর, আটুলিয়া, গাবুরা- এসব এলাকার প্লাস্টিক যাচ্ছে কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া, চুনকুড়ি নদী হয়ে সুন্দরবনে। এ হুমকি ঠেকাতে ‘ওয়ান টাইম’ পণ্যের বিকল্প দরকার।

বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী রেঞ্জার এবিএম হাবিবুল ইসলাম বলেন, পর্যটকদের সুন্দরবন ভ্রমণের অনুমতি দেওয়ার সময় নদীতে প্লাস্টিকের পণ্য না ফেলার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিটি ট্রলারে ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবুও অনেক পর্যটক নদীতে প্লাস্টিক ফেলেন। পাশের লোকালয় থেকেও সুন্দরবনে প্রচুর বর্জ্য চলে আসে। 

শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. তরিকুল ইসলাম বলেন, ওয়ান টাইম পণ্যে গরম খাবার পরিবেশন স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব পণ্যে রাখা গরম খাবার ও পানীয় খেরে হৃদরোগ, রক্তনালির অসুখ, নারীদের ব্রেস্ট ও ওভারিয়ান ক্যানসার এবং পুরুষের প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. রনী খাতুন জানান, সুন্দরবনের দুষণমুক্ত রাখার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চলছে। যত্রতত্র প্লাস্টিক-পলিথিন না ফেলতে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে।

নীলগলা বসন্ত

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫, ১০:০০ এএম
নীলগলা বসন্ত
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার একটি কাঁঠালগাছে বসা নীলগলা বসন্ত। ছবি: লেখক

বাংলাদেশের অনেক জনপদে পাখি দেখতে গিয়েছি। কিন্তু পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় নীলগলা বসন্ত পাখির সবচেয়ে বেশি দেখা পেয়েছি। তেঁতুলিয়ার  যে পথ দিয়েই হেঁটেছি, সব জায়গাতেই এ পাখির ডাকাডাকি শুনেছি। এ পাখি সাধারণত গাছের ফল খেতে বেশি ভালোবাসে। বিশেষ করে পাকা পেঁপে, পাকা তেলকুচা ফল ও পাকা পেয়ারা খেতে পছন্দ করে। তা ছাড়া এ পাখি নানা রকমের কচি ফলও খায়। 

নীলগলা বসন্ত (Blue-Throated Barbet) বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি। এরা বৃক্ষচারী পাখি। দেশের কোথাও কোথাও এ পাখি বসন্ত বাউরি নামে পরিচিত। বাংলাদেশে পাওয়া যায় পাঁচ প্রজাতির বসন্ত পাখি। এরা হলো নীলগলা বসন্ত, নীলকান বসন্ত, সেকরা বসন্ত, দাগি বসন্ত ও বড় বসন্ত।

নীলগলা বসন্ত ভারি সুন্দর সবুজ-নীল ও লাল মেশানো রঙের পাখি। দেহের সবুজ পালকের রং গাছের পাতার সঙ্গে মিশে যায় বলে পাখিটি অনেক মানুষেরই দৃষ্টিগোচর হয় না। এ কারণে পাখিটিকে অনেকেই বিরল প্রজাতি মনে করেন।

প্রাপ্তবয়স্ক পাখির সামান্য কিছু পালক ছাড়া দেহের পুরোটাই সবুজ ঘাস বর্ণের। তবে মুখ, গলা ও বুকের উপরিভাগ নীল পালক দিয়ে আবৃত থাকে। বুকের পাশে কালো পট্টি রয়েছে। কপাল লাল, কালো ও গাঢ় লাল হয়ে থাকে। ঠোঁট ফিকে ধূসর। কমলা-হলুদ সরু চোখের কিনারাসহ চোখ লালচে বাদামি। পা ও পায়ের পাতা সবুজাভ। ছেলেও মেয়েপাখি দেখতে একই রকম। 

নীলগলা বসন্ত সব বন, বাগানে বিচরণ করে। এরা সাধারণত একা বা জোড়ায় থাকে। এরা মাঝেমধ্যে অন্যান্য ফলাহারী পাখির মিশ্র দলে যোগ দেয়। সাধারণত এরা জোর গলায় দীর্ঘক্ষণ ধরে ডাকে কুটুরর... শব্দে। প্রজনন সময়ে প্রায় বিরতিহীনভাবে সারা দিন ডাকে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষপাখি বেশি ডাকাডাকি করে। মার্চ-জুলাই মাস এদের প্রজননের সময়। এ সময় ভূমি থেকে ২ থেকে ৮ মিটার ওপরে গাছে গর্ত খুঁড়ে এরা বাসা করে। বাসায় ৩-৪টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলোর রং সাদা।