
একটানা বর্ষা না হলেও হচ্ছে থেমে থেমে। মাঝে মাঝেই হচ্ছে। আর এতেই যেন হয়েছে টিয়াঠুঁটি গাছের পোয়া বারো। লকলক করে বেড়ে উঠছে। ঝোপঝাড় করে ঝাঁপিয়ে দিচ্ছে বাগানগুলো। বর্ষাকালে টিয়াঠুঁটির আলো ঝরঝর ফুলে ফুলে ভরা গাছগুলোর রূপ যেন ‘অধরা দিয়েছে ধরা ধূলির ধরণীতে’। প্রগাঢ় সবুজের মাঝে লম্বা চিকন ডাঁটির মাথায় ফোটা ফুল আর ফুলের মঞ্জরিপত্র, পুরো পুষ্পমঞ্জরিটি যেন এক আলোকবর্তিকা।
শ্রাবণের এক দিনে মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের ভেতরে টিয়াঠুঁটির এই রূপ দেখা গেল, প্রশাসনিক ভবনের পিছনে একফালি বাগানে। ডাঁটির আগায় ফুটে আছে অসংখ্য ফুল। কিন্তু এ ফুলগুলোর চেহারা একটু অন্য রকম। মনে করার চেষ্টা করলাম, এরকম ফুল কি আর দেখেছি কোথাও? দেখেছি তো বটেই, কিন্তু সে টিয়াঠুঁটি ফুলের সঙ্গে এগুলো তো মিলছে না, পাতাও না। গত বছর গ্রীষ্মে দেখেছিলাম সাভারে ডিসি নার্সারিতে। এ বছর বর্ষায় দেখলাম ফার্মগেটে তুলা ভবনের সামনে।
সারি করে লাগানো সেসব টিয়াঠুঁটি গাছের ফুলের রং কমলা বা উজ্জ্বল কমলা, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার উদ্যানে ফোটা টিয়াঠুঁটির ফুলগুলো হলদে আর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ফোটা ফুলগুলো ঘিয়া থেকে হলুদাভ। সব টিয়াঠুঁটি গাছের পাতাই একহারা সবুজ। কিন্তু গাজীপুরের কালীগঞ্জের ফুলদি গ্রামে তাসমিয়া রিসোর্টে দেখা পেয়েছিলাম আবার অন্য আরেক রকম টিয়াঠুঁটি গাছের। সে গাছগুলোর পাতা সবুজ ও সাদাটে ছোপায় বিচিত্রিত। এ জন্য ওগুলোর নাম হয়েছে বিচিত্র টিয়াঠুঁটি বা ভেরিগেটেড প্যারাকিট ফ্লাওয়ার।
সেখানে শুধু গাছই দেখেছিলাম, ফুল দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এবারের বৃক্ষমেলায় সে সুযোগ হয়েছিল। বিচিত্র টিয়াঠুঁটির কিছু ফুলসহ গাছের দেখা পেয়েছিলাম এবার বৃক্ষমেলায় বৃক্ষায়ন গার্ডেনিং নার্সারিতে। ফুলগুলোর রঙ ছিল প্রায় সাদা। এসব দেখে মনে হলো, টিয়াঠুঁটির এত রূপের বাহার হয়েছে তার একাধিক জাত-বৈচিত্র্যের কারণে। ঠিক কতগুলো জাত আমাদের দেশে আছে তার কোনো তথ্য নেই। কোন জাতের কি নাম, তাও জানা নেই। টিয়াঠুঁটির ইংরেজি নাম প্যারাকিট ফ্লাওয়ার বা প্যারটস ফ্লাওয়ার।
টিয়াঠুঁটি গাছ হেলিকোনিয়েসি গোত্রের হেলিকোনিয়া গণের একটি গাছ। বার্ড অব প্যারাডাইস বা স্বর্গের বুলবুলিও এ গণের একটি গাছ, যা সচরাচর দেখা যায় না। এ দেশে হেলিকোনিয়া গণের সাতটি প্রজাতির গাছ আছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় Heliconia psittacornum I Heliconia rostrata প্রজাতির গাছ। টিয়াঠুঁটি প্রথমোক্ত গণের গাছ। দ্বিতীয় প্রজাতির গাছকে বাংলায় বলে চিংড়িনমি ফুল, ইংরেজি নাম হ্যাঙ্গিং লবস্টার ক্ল। ফুলের অদ্ভুত গড়নের জন্য এটিও বাহারি গাছ হিসেবে এখন বাগানে লাগানো হচ্ছে।
টিয়াঠুঁটি গাছ বর্ষজীবী বিরুৎ স্বভাবের, এক বছরের বেশি বাঁচে না। গাছের গোড়ায় মাটির নিচে কন্দ থাকে, সেখান থেকে গাছ জন্মে। গাছ প্রায় এক থেকে দেড় মিটার লম্বা হয়, জাতভেদে খাটো গাছও দেখা যায়। পাতা সরল ও দেখতে অনেকটা কলাপাতার মতো। তবে কলাপাতার চেয়ে শক্ত ও ছোট। কলাপাতার মতো এ পাতার বোঁটার সঙ্গে একটি পত্রখোল থাকে।
পাতা মসৃণ ও চকচকে। একটি গাছ থেকে একটি শক্ত নলের মতো পুষ্পদণ্ডের মাথায় বৃশ্চিকাকার বা বিছার মতো মঞ্জরিতে ফুল ফোটে। ফুলের বৃতি বা মঞ্জরিপত্র দেখতে অনেকটা নৌকার খোলের মতো, ঠিক কলার মোচায় যে রকম খোল থাকে, সে রকম। খোলের মধ্য থেকে ৬টি লম্বা কাঠির মতো ফুল বেরিয়ে আসে। খোল বা মঞ্জরিপত্র একটির পর আর একটি প্রায় ২ সেন্টিমিটার ব্যবধানে বিপরীতমুখীভাবে থাকে। প্রতিটি ফুলে থাকে ৫টি পুরুষ কেশর ও একটি স্ত্রী কেশর। ফুলে পরাগায়নের পর ফল হয়।
বসন্তকাল থেকে শুরু করে বর্ষাকাল পর্যন্ত ফুল ফুটতে থাকে। কিছু কিছু জাতের গাছে প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে। সিলেটের জঙ্গলে দেখেছি এ গণের গাছকে বন্যভাবে জন্মাতে। তবে অধিকাংশ সময়ে এসব গাছ টবে ও বাগানে লাগানো হয় শোভাবর্ধক হিসেবে। বর্ষার প্রকৃতিতে অন্যান্য ফুলের সঙ্গে টিয়াঠুঁটিও তার রূপের বাহার ছড়িয়ে দেয়। ছায়া ও স্যাঁতসেঁতে জায়গায় এ গাছ ভালো জন্মে।
আদি নিবাস ব্রাজিলের বাদল বন। বিশেষ করে আমাজনের উত্তরাংশ থেকে এ গাছ এখন পৃথিবীর অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থায়িত্বকাল বেশি হওয়ায় এখন ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখার ফুল হিসেবে টিয়াঠুঁটির কদর বাড়ছে। কাটা ফুল ২ থেকে ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত ফুলদানিতে সতেজ থাকে। গোড়ার মোথা কেটে ভাগ করে মাটিতে পুঁতে দিলে সহজেই তা থেকে এর গাছ জন্মে। গাছ বেশ কষ্ট সইতে পারে।